মেসিডোনের নতুন রাজা

খুব বেশি দিন নানাবাড়িতে কাটাতে হয়নি আলেকজান্ডারকে। রাজা ফিলিপই একসময় ডেকে পাঠালেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, রাজা ফিলিপ আলেকজান্ডারকে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। নতুন রানীর কুটচালে রাজা যদিও ধরাশায়ী হয়েছেন, কিন্তু নতুন যেসব রাজ্য জয় করেছেন রাজা ফিলিপ, সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আলেকজান্ডার পেন্না ছেড়ে চলে গেছেন, এটা জানার পর এখানে সেখানে শুরু হয়েছে রাজার বিরুদ্ধাচারণ। সেনাবাহিনীর একটা অংশও আলেকজান্ডারের দেশত্যাগকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ আলেকজান্ডারের মতো এমন সাহসী বীর তারা আর দেখেনি। কেবল সাহসী নয়, বেশ কৌশলীও। তবে আলেকজান্ডারের পক্ষে অবস্থান নেয়া সৈন্যদের অংশ খুব একটা বড় নয়। একদিন যে এই অংশটা আরো বড় হবে না, এর নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? যেখানে আলেকজান্ডার নিজেই সৈন্যদের একটা অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিল। যুদ্ধও জয় করেছিল। কাজেই সৈন্যদের কাছে আলেকজান্ডারের একটা অবস্থান তৈরি হয়েই ছিল। আর তারাই আলেকজান্ডারকে খুব করে আশা করছিল। রাজা ফিলিপের সভাসদদের মধ্যে অনেকেই নতুন রানীকে মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু প্রকাশও করতে পারছিলেন না। আলেকজান্ডার চলে যাওয়ায় তারাও রাজার প্রতি বিরক্ত। রাজা সবকিছু বুঝতে পেরেই ডেকে পাঠালেন আলেকজান্ডারকে। রাজা প্রতিশ্রুতি দিলেন, আলেকজান্ডার এবং রানী অলিম্পিয়াসের অসম্মান হয়, এমন কোনো কাজ কিংবা আচরণ তিনি করবেন না। কাউকে করতেও দেবেন না। তাদের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তার। 

অভিমানী রাজপুত্র আলেকজান্ডার রাজার অনুরোধে ফিরে এলেন মেসিডোনে। ফিরে এলেন পেল্লায়। ফিরে এলেন রাজপ্রাসাদে। প্রিয় ঘোড়া বুকাফেলাসও পরিচিত জায়গায় ফিরতে পেরে যেন খুশি। পেল্লায় ঢোকার পর থেকেই কয়েকবার চিহি রবে নিজের উল্লাস ধ্বনি প্রকাশ করেছে ঘোড়াটা । কিন্তু রাজার সামনে গিয়ে ধারণা পাল্টে গেল আলেকজান্ডারের। মনে হচ্ছে যেন সহ্য করতে হয় বলে, সহ্য করছেন নিজের সন্তানকে। নইলে দূরেই সরিয়ে রাখতেন। কেবল নিজের প্রয়োজনেই কাছে ডেকেছেন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই আবার দেশ ত্যাগে বাধ্য করবেন, নয় তো নির্বাসনে পাঠাবেন।

রাজার মুখোমুখি হওয়ার পর মনটাই দমে গেল আলেকজান্ডারের। তবু তো নিজের জন্মভূমিতে ফিরেছেন— এতেই খুশি তিনি। তবে রাজাকে দেখার পর হুঁশিয়ার হয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। রাজাকে আর বিশ্বাস করা যায় না । যে কোনো সময় যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারেন। 

এর মধ্যেই রাজা তার শেষ সন্তান অ্যারিডাইয়াসের বিয়ে ঠিক করলেন এক পারসিয়ান গভর্নরের কন্যার সাথে। আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন, এর অর্থই হচ্ছে অ্যারিডাইয়াসকে গুরুত্ব দেয়া। অথচ রাজার বড় সন্তান তিনি। তার বিয়ের আয়োজন না করে অ্যারিডাইয়াসের বিয়ের আয়োজন করার মানেই হচ্ছে অ্যারিডাইয়াসকেই রাজা ফিলিপ মেসিডোনের নতুন রাজা বানাবেন। কিন্তু এটা কোনো মতেই হতে দেয়া যাবে না। যে ভাবেই হোক এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে। বন্ধু হেফাস্টিয়নের সাহায্য চাইলেন আলেকজান্ডার। 

বুদ্ধি দিলেন হেফাস্টিয়ন, আলেকজান্ডার নিজেই যেন গভর্নরের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেন। 

পরিকল্পনা অনুযায়ী পারসিয়ান গভর্নরের মেয়েকে নিজেই গোপনে বিয়ে করতে চাইলেন আলেকজান্ডার। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। রাজা ফিলিপ তার পরিকল্পনার কথা কেমন করে যেন জেনে গেছেন। তিনি আলেকজান্ডারকে গৃহবন্দি করলেন। আলেকজান্ডারের সাথে তার চেনাপরিচিত সবার যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। কেবল হেফাস্টিয়ন ছাড়া। একমাত্র হেফাস্টিয়নই দেখা করার সুযোগ পেতেন আলেকজান্ডারের সাথে। এবং আলেকজান্ডারের এই পরিকল্পনায় রাজা এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি রানী অলিম্পিয়াসকেও তালাক দিতে চেয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এমন বুদ্ধি বুঝি আলেকজান্ডারের মা রানী অলিম্পিয়াসের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। এবং কোনো একদিন তাকে হটিয়ে সিংহাসন দখলের পায়তারাও করতে পারে তারা। কাজেই রানী অলিম্পিয়াসকে সরাতেই হবে। 

এর মধ্যেই আলেকজান্ডারের বোন ক্লিওপেট্রার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। বিয়ে উপলক্ষে বিশাল এক ভোজ উৎসবের আয়োজন করলেন রাজা ফিলিপ। দেশের অনেক গণ্যমান্য মানুষ উপস্থিত হলেন সে উৎসবে। ভোজের পর থিয়েটারে নাটক উপভোগ করার জন্য সবাই এসে বসেছেন। রাজা ফিলিপ এসে বসলেই নাটক শুরু হবে। রাজা আসছেন। নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘিরে রেখেছে রাজাকে। নিরাপত্তা রক্ষীদের ক্যাপ্টেন পজানিয়াস। রাজার খুবই বিশ্বস্ত। কয়েকদিন ধরে রাজা ফিলিপ খুব বেশি সতর্ক হয়ে চলাফেরা করেন। তিনি কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে, বুঝতে পেরেছেন তিনি। এবং তার সভাসদ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও দুটো দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, সেটাও জানেন রাজা। এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছে আলেকজান্ডারকে নিয়ে। রাজা জানেন এই বিভক্তি অনেকদিন থাকবে। এবং তার পরে যে মেসিডোনের রাজা হবেন, তাকেই এই বিভক্তি দূর করতে হবে। তার পক্ষে এখন আর এই বিভক্তি দূর করা সম্ভব নয়। 

থিয়েটার হলের পাশে বিশাল আঙুর বাগান। এখানে ওখানে আঙুর লতার ঝোপ। ওই আঙুরের ঝোপ পেরিয়ে তবে থিয়েটারে আসতে হয়। রাজা আঙুরের ঝোপ পেরোনোর সময় হঠাৎ একটা শব্দ পেলেন। তাহলে কি কোনো গুপ্তঘাতক অপেক্ষা করে আছে তার জন্য? ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে ঘিরেই রেখেছে বলা যায়। এদের ডিঙিয়ে তাকে আঘাত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। একটা আঙুরের ঝোপ লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। আঙুরের ঝোপের কাছে যেতেই আঘাতটা এল। একটা আঘাত নয়, আঘাতের পর আঘাত আসতে শুরু করল। এবং রাজা ফিলিপ অবাক হয়ে দেখলেন, তার নিরাপত্তারক্ষীদের তিনজন তাকে আঘাত করছে। এবং যারা আঘাত করছে না, তারাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে কি তিনি এই ষড়যন্ত্রে হেরে গেলেন? একদিন তিনিও কৌশলে মেসিডোনের রাজা হয়েছিলেন। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন অ্যামিনটাসকে। কিন্তু তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র কে করল? 

রাজা ফিলিপ আর কিছুই ভাবার সময় পেলেন না। তলোয়ার আর ছুরির আঘাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার শরীরে। তাকে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। আঙুর ঝোপের ভিতর। এবং একসময় নিভে গেল তার দুচোখের আলো। তবু চোখ দুটো খোলা ছিল ফিলিপের। ওই দু’চোখে অবাক বিস্ময়। মেসিডোনের নতুন রাজাও ঠিক করে যেতে পারেননি ফিলিপ। তাহলে কী হবে মেসিডোনের?

রাজা ফিলিপ মারা গেলেন খৃষ্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে। রাজা ফিলিপের মৃত্যুর পর রানী ক্লিওপেট্রার দল শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা রটিয়ে দিয়েছিল রানী অলিম্পিয়াস আর আলেকজান্ডার মিলে খুন করিয়েছেন রাজাকে। কিন্তু ক্লিওপেট্রার দল মোটেই সুবিধা করতে পারল না। প্রজাদের কাছেও এটা প্রচার করার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। প্রাসাদের ভিতর থেকেই সমর্থন আদায় করতে পারেননি ক্লিওপেট্রা। সেনাবাহিনীও ওই দলের সাথে তাল মেলাতে চায়নি। বরং সেনাবাহিনী একেবারেই নিরব থেকেছে। আবার কেউ কেউ ভেবেছেন, রাজাকে খুন করার কথা অলিম্পিয়াস আর আলেকজান্ডার জানতেন। কিন্তু তারা জেনেও না জানার ভান করে ছিলেন। কারণ রাজার সাথে মা ছেলের সম্পর্ক খুব খারাপ যাচ্ছিল। আর প্রাসাদের একটা অংশ ভেবেছেন, রানী অলিম্পিয়াস এবং আলেকজান্ডার কিছুই জানতেন। তারা ছিলেন একেবারেই নির্দোষ। বিশেষ করে আলেকজান্ডার তো কদিন ধরে গৃহবন্দিই ছিলেন। রানী অলিম্পিয়াসও বলতে গেলে একপ্রকার কোনঠাসা হয়েই ছিলেন। রানী ক্লিওপেট্রার তো খুন করার প্রশ্নই আসে না। কারণ রাজা ফিলিপ নিহত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তিনি। তাহলে কে খুন করাল রাজাকে? কেন করাল?

অনেকই এমন ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অতো ভাবার সময় তাদের ছিল না । মেসিডোনের নতুন রাজা কে হবেন, সেটাই তখন ভাবনার বিষয়। নিয়ম অনুযায়ী আলেকজান্ডার রাজা হতে পারেন না। তাহলে একটাই উপায় আছে, অ্যামিনটাস । রাজা ফিলিপ যাকে বঞ্চিত করে রাজা হয়েছিলেন, তাকেই রাজা হিসেবে ঘোষণা করা। এবং অ্যামিনটাস তখন মেসিডোনের রাজা হিসেবে একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। অ্যামিনটাসই কেবল নন, আলেকজান্ডারের সভাই অ্যারিডাইয়াসও রাজা হতে চান। 

আলেকজান্ডার তখন মাত্র বিশ বছর বয়সী এক তরুণ। তিনি এসব নিয়ম কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করলেন না। তখনই তিনি নিজেকে রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডার হিসেবে ঘোষণা দিলেন। প্রাসাদের সভাসদরা কেউই তার বিরোধিতা করেননি। কিংবা বলা যায় বিরোধিতা করার সাহস দেখাননি। এমনকি সেনাবাহিনী থেকেও কোনো বাধা আসেনি। বরং সেনাবাহিনী তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। 

রাজা হয়ে চাচাতভাই অ্যামিনটাসকেও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেননি আলেকজান্ডার। তাকে সবসময় পাশে পাশে রেখেছেন। মাঝে মাঝে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন। বলা যায় একজন ছায়া রাজা হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছেন অ্যামিটাসকে। এটুকু পেয়েই ভীষণ খুশি অ্যামিনটাস। সহজেই আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। আর এটাই হলো আলেকজান্ডারের কৌশল। তার অবর্তমানে মেসিডোনের সিংহাসন থাকবে নিরাপদ। তাকে আর সিংহাসন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। বরং নতুন নতুন দেশ জয়ে পুরো মনোযোগ দিতে পারবেন তিনি। 

আলেকজান্ডারের রাজা হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে ফিলিপের পঞ্চম রানী ক্লিওপেট্রা মেনে নিতে পারেননি। তিনি ভয় পেলেন আলেকজান্ডার আর অলিম্পিয়াস এবার নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু তাদের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দিলেন না। আলেকজান্ডার রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসার খবর পেয়েই তিনি আত্মহত্যা করলেন।