বুনো বুকাফেলাসের পিঠে

মেসিডোনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ। সভাসদদের নিয়ে একটা ঘােড়া দেখতে এসেছেন। একজন থেসেলিয়ান ঘোড়াটা বিক্রি করতে এনেছে। ঘোড়াটাকে কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। বুনো ঘোড়া। কিছুতেই বশ মানতে চাইছে না। কেউ ওটার পিঠে উঠলেই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ওটার পিঠে উঠতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। নাহ্! এমন ঘোড়া রাজপ্রাসাদে রাখা যায় না। রাজা ফিলিপও তাই ঘোড়াটাকে রাখতে চাইলেন। যদিও ঘোড়াটা দেখতে অসাধারন সুন্দর। কালো স্ট্যালিয়ন জাতের ঘোড়া। কালো রঙটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এমন চোখ ধাঁধানো কালো ঘোড়া খুব একটা দেখা যায় না। একটু দুঃখও হলো রাজার । এমন ঘোড়াটাকে হারাতে হচ্ছে শুধুমাত্র এর পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো কেউ নেই দেখে। তার রাজ্যে কি এমন কেউ নেই যে এই ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারবে? নেই এমন কোনো বীর?

সভাসদ আর তার আশপাশে থাকা মেসিডোনের বীরদের দিকে তাকালেন ফিলিপ। কারো মুখে তেমন বীরত্বের ছায়া দেখা যাচ্ছে না। একে একে অনেকেই চেষ্টা করেছে। কেউই বশে আনতে পারেনি বুনো স্ট্যালিয়নটাকে। ওটাকে দেখলেই যেন সবার মধ্যে অজানা আতঙ্ক এসে ভর করে। কাজেই এমন ঘোড়া আর রেখে লাভ কী। ওটার পিঠে চড়ার মতো কেউ যখন নেই, তখন ওটাকে না কেনাই ভালো। রাজা ঘোড়াটা ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তখনই এগিয়ে এল দশ বছরের এক বালক। হ্যাঁ। দশ বছরের বালক। এই বুনো ঘোড়াটাকে সে একটু আগেই দেখেছে। দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে। এমন একটি ঘোড়ার কল্পনাই যেন করতো ও। কিন্তু কাউকে বলেনি সে কথা। বললেই কি আর কেউ তাকে ওই ঘোড়ার পিঠে চড়তে দিত? দিত। হোক না সে রাজপুত্র রাজা ফিলিপের ছেলে। তাতে তো বরং ভয় আরো বেশি। রাজপুত্র ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, বিষয়টা নিশ্চয়ই কারো জন্য সুখকর নয়। অথচ ওই কালো স্ট্যালিয়নের পিঠে চড়ার কল্পনা ও এর মধ্যেই করে ফেলেছে। এমন একটি ঘোড়ার স্বপ্ন ওর কতদিনের! এমন একটি বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে কল্পনায় ভর করে কতদিন ও ঘুরে বেড়িয়েছে মাঠের পর মাঠ, দিগন্তের পর দিগন্ত। কিন্তু কোথায় কি। ওই ঘোড়া না পেলে তো সব কল্পনাই থেকে যাবে। কিন্তু কেবল কল্পনায় ভর করে চলার জন্য ওই কিশোরের জন্ম হয়নি। ওর জন্ম হয়েছে পৃথিবী শাসন করার জন্য। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হওয়ার জন্য। সেটা তখনও কেউ জানতো না। জানতেন না ওর বাবা ফিলিপ। জানতেন না ওর মা রানী অলিম্পিয়াসও।

ঘোড়ার দিকে এগিয়ে আসা দশ বছরের কিশোরের দিকে তাকালেন বাবা ফিলিপ। ও তো তারই ছেলে আলেকজান্ডার। বাবার মনে তখনও সংশয়, আলেকজান্ডার কি পারবে এই বুনো ঘোড়াটাকে বশ মানাতে? কত অভিজ্ঞ সহিস চেষ্টা করেছে। কাউকে পাত্তাই দেয়নি ঘোড়াটা। সন্দেহের দোলাচলে দুলছেন ফিলিপ। দুএকজন সভাসদ কিশোর রাজপুত্রকে বাধা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ফিলিপ তাদের থামিয়ে দিলেন। দেখা যাক, আলেকজান্ডার কী করতে পারে।

বাবা ফিলিপের মনে হলো আলেকজান্ডার সত্যিই হয়ত ঘোড়াটাকে বশ মানাতে পারবে। তখনই তার মনে পড়ল এই আলেকজান্ডারের জন্মের আগের কথা। এক রাতে ফিলিপ আর তার রানী অলিম্পিয়াস অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবা ফিলিপ স্বপ্ন দেখলেন, তিনি অলিম্পিয়াসের গর্ভে সিংহের মোহর প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। আর রানী স্বপ্নে দেখলেন, তার গর্ভে এক সিংহের জন্ম হতে যাচ্ছে। যেন এক সঙ্কেত পেলেন তারা। 

রাজা ফিলিপ ডেকে পাঠালেন রাজগণককে। এই রাজগণক রাজা রানী আর রাজ্যের ভবিষ্যৎ বলে দেন। রাজা ফিলিপ তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন। রাজগণক অনেক গণনা করে বললেন, মহারাজ, সম্ভবত রানীও একই ধরনের স্বপ্ন দেখেছেন। 

রাজা ফিলিপ অবাক হয়ে বললেন, আপনি কেমন করে বুঝলেন? 

রাজগণক বললেন, আপনি যে ধরনের স্বপ্নের কথা বলছেন, তা একা আপনার পক্ষে দেখা সম্ভব নয় । আমার গণনা সেটাই বলে। আমাদের কোনো রানীও কি এই স্বপ্ন দেখেছেন?

সত্যিই রাজার চার রানীর এক রানী এমন স্বপ্ন দেখেছেন। রাজা ফিলিপ বললেন, আপনার গণনা সঠিক। রানী অলিম্পিয়াসও সিংহ স্বপ্ন দেখেছেন।

রাজগণকের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। তিনি আবার গণনা করতে শুরু করলেন। রাজা ফিলিপ আর সভাসদরা অধীর আগ্রহে গণনা দেখতে লাগলেন। একসময় থামলেন রাজগণক। গণনা থামিয়ে বললেন, রানী অলিম্পিয়াস মা হয়েছেন। তার গর্ভে আছে এমন এক ছেলে শিশু, যে হবে সিংহের মতো বিক্রমশালী। এজন্যই আপনারা দুজনই সিংহ স্বপ্ন দেখেছেন।

রাজগণক ভেবেছিলেন রাজা খুব খুশি হবেন তার কথা শুনে। সত্যি সত্যি রাজা ভীষণ খুশি হয়েছেন। কিন্তু পরক্ষণেই রাজার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সবাই অবাক হলেন বিষয়টা দেখে।

একজন সভাসদ তো বলেই বসলেন, মহারাজ, একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে। রাজপুত্রের জন্মের খবর শুনে আপনি প্রথমে খুশি হলেন, তারপর আবার আপনার মুখটা মলিন হয়ে গেল। বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে বিষয়টা। আমরা কি জানতে পারি এর কারণ কী?

রাজা ফিলিপ সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর বললেন, সত্যিই আমি খুশি হয়েছি। আর দুঃখ পেয়েছি একটা কারণে। সেটা আমি আর আজ আপনাদের বলতে চাই না। অন্য কোনোদিন বলবো। আজ এই খুশির খবরে, এই আনন্দের দিনে কাউকে দুঃখ দিতে চাই না।

এর কদিন পরেই জন্ম নিলেন আলেকজান্ডার। খৃষ্টপূর্ব ৩৫৬ সালের ২০ জুলাই রাতে। জানা যায়, আলেকজান্ডারের জন্মের রাতে নাকি অরণ্যদেবী আর্টেমিসের প্রাসাদ এফাসাসে আগুন জ্বলে উঠেছিল। খবরটা শোনার পর রাজা ফিলিপও ভাবনায় পড়েন। গর্বও হয় তার। তাহলে তার এই ছেলেই হবে পৃথিবীর অন্যতম সেরা একজন বীর। 

রাজা ফিলিপ নিজেও তো কম বড় বীর নন। তিনি তার সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। গ্রিসের অন্যান্য রাজ্য জয় করার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। তিনি নিজেও অনেক যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করেছেন। শিখেছেন রাজনীতি, অর্থনীতি। এবং তার বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি রাজা হয়ে বসেন। ফিলিপ রাজা হন খৃষ্টপূর্ব ৩৫৯ সালে। পৈত্রিকসূত্রে যে রাজ্য ফিলিপ পেয়েছেন, তাতে অনেক বিভাজন। শহর আর গ্রামের মধ্যে পার্থক্য। কৃষকরা থাকত নিচু জমিতে। আর রাজ্যের গণমান্য ব্যক্তিরা থাকতেন পাহাড়ে। তিনি এসব বিভাজন মিটিয়ে তার রাজ্য মেসিডোনকে একক শক্তিতে পরিণত করে ফেললেন। 

গ্রিসের অন্যান্য রাজ্যের সৈন্যরা কিন্তু সারা বছর সেনাবাহিনীতে থাকার সুযোগ পেত না। কেবল যখনই যুদ্ধ—বিগ্রহ থাকত, তখনই তারা সেনাবাহিনীতে নাম লেখাত। যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে যেত যার যার কাজে। মেসিডোনের রাজা ফিলিপ এই ধারা ভাঙলেন। তিনি স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরি করলেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর জন্য সেনানিবাস তৈরি করলেন এবং যখন যুদ্ধ থাকত না, তখন তাদের মহড়ায় ব্যস্ত রাখতেন। রাজা ফিলিপ জানতেন, প্রয়োজন মতো যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়ে বেতনভুক সেনাবাহিনী দিয়ে পৃথিবী জয় করা সম্ভব। এই রাজা ফিলিপের সন্তান আলেকজান্ডার। বাবার মতো জ্ঞান তো ওর থাকবেই।

রাজা ফিলিপ কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। আনমনা ভাব কাটতেই তাকালেন আলেকজান্ডারের দিকে। আলেকজান্ডার ততক্ষণে কালো স্ট্যালিয়নের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, আলেকজান্ডারকে দেখেই কালো স্ট্যালিয়নটা মাথা নামিয়েছে। যেন রাজপুত্রকে কুরনিশ করল। আর আলেকজান্ডার বিশালদেহী ঘোড়ার কানে ফিস ফিস করে কিছু একটা বললেন। তারপর একলাফে উঠে বসলেন ঘোড়ার পিঠে। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, এবার আর ঘোড়াটা তার সওয়ারীকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার কোনো চেষ্টাই করল না। বরং তাকে নিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। জীবনে প্রথম কোনো মনের মতো সওয়ারী পেয়ে ঘোড়াটাও বুঝি খুশি হয়ে ছুটতে শুরু করেছে। তারপর থেকে এই কালো স্ট্যালিয়নই হলো আলেকজান্ডারের সবসময়ের সঙ্গী। আলেকজান্ডার ঘোড়াটার নাম রাখেন বুকাফেলাস। আলেকজান্ডারের বীরত্বপূর্ণ জীবনের সাথে সেই থেকে জড়িয়ে আছে বুকাফেলাস। এমনকি আলেকজান্ডারের যে ছবি চিত্রিত হয়েছে, তাতেও দেখানো হয়েছে তিনি সেই কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়া বুকাফেলাসের পিঠেই চড়ে আছেন। কোনো মানুষের সাথে কোনো প্রাণীর এমন টান— খুব কমই দেখা যায়। আর সেই টান যদি হয় বুনো বুকাফেলাস আর দিগ্বিবিজয়ী আলেকজান্ডারের মধ্যে, তাহলে কে তাদের রুখতে পারে? কে তাদের হারায় সম্মুখ যুদ্ধে? কে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে? কেউ পারে না। কেউ পারেও নি। আর পারেনি বলেই আলেকজান্ডার হলেন পৃথিবীর সেরা বীরযোদ্ধা।