এবার মিসর

টায়ার জয়ের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে সিরিয়ার প্রায় পুরো অঞ্চলই আলেকজান্ডারের অধিকারে চলে আসে। কেবল গাজা রয়ে যায় জয়ের বাইরে। আলেকজান্ডার এরপর চললেন গাজা দখল করতে। এই গাজা তখন পারস্যের অধিকারে ছিল। গাজা শাসন করতেন পারস্যের গভর্নর।

কিন্তু পারস্যের গভর্নর সহজে ধরা দিলেন না আলেকজান্ডারের সৈন্যদের কাছে। তিনি কোনো যুদ্ধেই যেতে চাইলেন না। নগর ফটক আটকে বসে রইলেন। ফটকের ভিতর থেকে যতখানি সম্ভব লড়াই চালিয়ে গেলেন। আলেকজান্ডার টায়ারের মতো অবরোধ করে রাখলেন গাজা। একটানা তিনমাস। তিনমাস পর গাজার খাবার সরবরাহ যখন শেষ হয়ে এল, নগর ফটক খোলার প্রয়োজন হলো— তখনই আক্রমণ করলেন আলেকজান্ডার। এবং খুব সহজেই জয় করে নিলেন গাজা।

গাজা জয় করে এখানকার পুরো অঞ্চল নিজের অধিকারে নিয়ে এলেন আলেকজান্ডার। 

খৃষ্টপূর্ব ৩৩২ অব্দ। আলেকজান্ডার সামনে যে নগরীই দেখেন, সেটাই জয় করার নেশা জাগে তার। আলেকজান্ডার তার সৈন্য নিয়ে রওনা হলেন নিউবার দিকে। কিন্তু নিউবায় যাওয়ার আগেই তার মুখোমুখি হলেন নিউবার যুদ্ধরানী ক্যানডেক অব মেরো। নিউবার যুদ্ধরানী তার সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উল্টোদিক থেকে একটি হাতির উপরে বসে। কিন্তু কোনো রানীর সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছে আলেকজান্ডারের নেই। তিনি বেশ নিরুৎসাহী হলেন। তাদের যুদ্ধ কৌশলও তাকে যুদ্ধ করার কোনো তাড়া দিল না। তার মনে হলো, এখানে যুদ্ধ করা মানেই সময় নষ্ট করা। এমনিতেই দুটো নগরী জয় করতে প্রায় একবছর সময় লেগে গিয়েছে। কাজেই আর সময় নষ্ট করা যাবে না। 

আলেকজান্ডার রানীর সাথে যুদ্ধ না করে তার সৈন্যদের মিসরের দিকে চলতে নির্দেশ দিলেন। 

খৃষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে আলেকজান্ডার মিসরে প্রবেশ করলেন। মিসরে ঢুকেই অবাক হলেন আলেকজান্ডার। তার পাশে পাশে তখন হেফাস্টিয়ন। আলেকজান্ডার অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী হেফাস্টিয়ন! এখানে দেখি কেউ অভ্যর্থনা করতে আসছে না। 

এই অভ্যর্থনা বলতে আলেকজান্ডার কী বোঝাতে চেয়েছেন, বুঝতে পেরেছেন হেফাস্টিয়ন। হেফাস্টিয়ন আলেকজান্ডারের কথা শুনে হাসলেন। দীর্ঘপথশ্রমে ক্লান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আলেকজান্ডারের বাহিনীর যেন ক্লান্তি নেই। সবাই প্রস্তুত হয়েই মিসরে ঢুকেছে। বলা যায় না, কখন কোথা থেকে আক্রমণ আসে। কিন্তু কিছুই হলো না। কোনো আক্রমণ তো দূরের কথা, বরং মিসরের মানুষদের মধ্যে এক ধরনের উল্লাস দেখলেন আলেকজান্ডার। তাদের এই উল্লাসেই অবাক হয়েছেন তিনি। হেফাস্টিয়ন বললেন, পৃথিবীর সব অঞ্চলের অভ্যর্থনা এক রকম নয় রাজা। 

আলেকজান্ডার বললেন, তাই বলে এদের এখানে কী কোনো যোদ্ধা নেই? একেবারে বিনা বাধায় আমাদের মিসরে ঢুকতে দিল? 

হেফাস্টিয়ন বললেন, আরো ভিতরে যাই, তারপর দেখা যাক কী ঘটে।

কিন্তু কিছুই ঘটল না। বরং কিছুক্ষণ পর মিসরবাসীরা তাকে দেখে মিছিল করতে লাগল আলেকজান্ডারের আগমন, শুভেচছা স্বাগতম। 

এমন মিছিল দেখে আরো অবাক হলেন আলেকজান্ডার। কিছুক্ষণ পর অবশ্য তার অবাক হওয়ার পালা শেষ হয়ে এল। কারণ ততক্ষণে তিনি জেনে নিয়েছেন এর কারণ কী। কেনই বা মিসরবাসীরা তাকে পেয়ে এতটা উফুল্ল হলো। মিসর তখনও পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। পারস্যের অনেক কিছুই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল মিসরীয়দের ওপর। এমন কি পারস্যের দেবতাদের পর্যন্ত পূজো দিতে হতো মিসরীয়দের। ধর্ম, রীতি—নীতি, পোশাক, সংস্কৃতি সবই ছিল পারসিয়ানদের চাপিয়ে দেয়া। এ কারণেই যখন আলেকজান্ডার মিসরে ঢুকলেন, মিসরীয়রা তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবেই মেনে নিল আলেকজণ্ডারকে। মেনে নিল আলেকজান্ডারের বাহিনীকে।

আলেকজান্ডার নীলনদের মুখের কাছে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিলেন। মিসরীয় আর মেসিডোনিয়দের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন একটি শহর। নাম দেয়া হলো আলেকজান্দ্রিয়া। এরপর থেকে আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে ওঠল পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটি শহর। শিক্ষা—দীক্ষা, সংস্কৃতির দিকে থেকে আলেকজান্দ্রিয়া ছাড়িয়ে গেল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আর সব শহরকে। পরবর্তী কয়েক শতক ধরে আলেকজান্দ্রিয়া তার খ্যাতি ধরে রেখেছিল।

খৃষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দের বসন্তকাল। আলেকজান্ডার একটি তীর্থযাত্রার আয়োজন করলেন। মিসরীয়দের সূর্যদেবতা আমান—রা। মিসরের সবচেয়ে বড় আর আঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ ও দেবমন্দির হচ্ছে রা—এর প্রাসাদ। লিবিয়ার দীর্ঘ মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তবে যেতে হয় রা—এর মন্দিরে। ওখানেই তীর্থযাত্রা করবেন আলেকজান্ডার। মিসরীয়রা তো মহাখুশি। খুশি হবে না কেন, কত বছর পর নিজেদের দেবতার অর্ঘ্যে পুজো দেয়ার সুযোগ পেল তারা। সূর্যদেবতা রা—এর মর্যাদা গ্রিকদের দেবতা জিউসের মতো। জিউসকে যেমন গ্রিকরা দেবতাদের রাজা মনে করে, তেমনি মিসরীয়দের কাছে দেবতাদের রাজা হচ্ছেন রা। মিসরীয়দের প্রাচীন শাসক ফারাওদের মনে করা হতো রা এর সন্তান। ফারাওরা যেমন রা—এর সন্তান ছিলেন, তেমনি মিসরীয়রা ভাবতে শুরু করল আলেকজান্ডারও রা—এর আরেক সন্তান। বিশেষ করে তীর্থযাত্রায় আলেকজান্ডার যখন রা—এর কাছে আবেদন জানালেন তাকেও তার সন্তান। হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এতে মিসরীয়রা আরো খুশি। এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল আলেকজান্ডার সত্যি সত্যি রা—এর সন্তান। এত বছর ধরে ভিনদেশী দেবতাকে পূজো দেয়ার পর, নিজেদের দেবতাকে পূজো দেয়ার সুযোগ পেয়েছে তারা। নিজেদের সংস্কৃতি পালনের সুযোগ পেয়েছে। 

এই তীর্থযাত্রায় আলেকজান্ডার গ্রিক পোশাক পরেননি। তিনি পরেছিলেন মিসরীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। ওই পোশাকে আলেকজান্ডারকে একজন দেবতার মতোই মনে হয়েছিল মিসরীয়দের। তারা আলেকজান্ডারকে দেবতার মতো সম্মান দেয়া শুরু করল। দেবতার মতো ভক্তি—শ্রদ্ধা করতে শুরু করল। সেই থেকে আলেকজান্ডার হয়ে গেলেন মিসরীয়দের দেবতা।

মিসরের দিনগুলো দারুণ কাটতে লাগল আরেকজান্ডারের। মিসরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তবু একটা দুশ্চিন্তা তার মধ্যে রয়েই গিয়েছে। বসন্ত শেষ হয়ে আসতে লাগল। আলেকজান্ডারের দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। আর কেউ লক্ষ্য না করলেও, হেফাস্টিয়নের দৃষ্টি এড়ায়নি সেটা। একদিন হেফাস্টিয়ন তাই জানতে চাইলেন, আপনি কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছেন মনে হয়।

আলেকজান্ডার বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ হেফাস্টিয়ন। দুশ্চিন্তাটা কী নিয়ে বলতে পারো?

হেফাস্টিয়ন বললেন, মনে হয় পারি। আপনি নিশ্চয়ই দারিয়ুসকে নিয়ে ভাবছেন।

আলেকজান্ডারের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠল। বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ হেফাস্টিয়ন। আমি দারিয়ুসকে নিয়েই ভাবছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে দারিয়ুসের মুখোমুখি হতেই হবে। যত শিগগির হবে ততই ভালো। 

হেফাস্টিয়ন জানতে চাইলেন, তাহলে আমরা রওনা দিচ্ছি না কেন? 

আলেকজান্ডার বললেন, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করবো আমি। আমার সৈন্যদের আরো কিছুদিন বিশ্রাম দেবো। তারপরই তো শুরু হবে লড়াই। একটানা কতদিন লড়াই করতে হয় কে জানে। 

বসন্তেই মিসর থেকে রওনা দিয়ে প্যালেস্টাইন হয়ে সিরিয়া এসে থামলেন আলেকজান্ডার। সিরিয়ায় থাকতেই একদিন সেনাপতিদের নিয়ে জরুরি আলোচনায় বসলেন। সবাইকে একটা চিঠি দেখালেন। জানতে চাইলেন, এই চিঠিটা কার বলতে পারবেন কেউ?

কার চিঠি কেমন করে জানবেন সেনাপতিরা? কেউ বলতে পারলেন না। কেবল হেফাস্টিয়ন মৃদুস্বরে বললেন, সম্ভবত রাজা দারিয়ুসের।

আলেকজান্ডার বললেন, হেফাস্টিয়ন, এ জন্যই গ্রিক বাহিনীতে বাহিনীতে আমার ঠিক পরেই তোমার অবস্থান। এটা এমনি এমনি হয়নি। তুমি ঠিকই বলেছ। এটা রাজা দারিয়ুসের চিঠি। 

অবাক হলেন সবাই। রাজা দারিয়ুস আলেকজান্ডারকে চিঠি দিয়েছেন! কী লিখেছেন দারিয়ুস? সবার মধ্যেই অপার কৌতূহল। আলেকজান্ডার বললেন, দারিয়ুস আমার সাথে সন্ধি করতে চান। পারস্য সাম্রাজ্যের পশ্চিমের যত প্রদেশ আছে, সবই তিনি আমাকে দিতে চান। বিনিময়ে আমরা একটা শান্তি চুক্তি করবো। এই শান্তি চুক্তি অনুযায়ী আমরা আর পারস্যের কোনো রাজ্য দখল করতে পারবো না। 

আলেকজান্ডারের কোনো সেনাপতি কোনো কথা বলছেন না। তারা জানেন এসব ব্যাপারে আলেকজান্ডারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কেবল যুদ্ধ। কৌশলের বেলায় তিনি সবার মতামতের গুরুত্ব দেন। 

আলেকজান্ডার বললেন, কিন্তু আমি তো পুরো পারস্য সাম্রাজ্যের রাজা। হতে চাই। কেবল পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে কী হবে। আমি রাজা দারিয়ুসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। তবে শান্তি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেইনি। আমি জানিয়েছি কেবল পুরো পারস্য সাম্রাজ্যের বিনিময়ে শাস্তি প্রস্তাব হতে পারে। 

আলেকজান্ডারের কথায় হাসির একটা রোল ওঠল সেনাপতিদের মধ্যে। তারা সবাই আলেকজান্ডারের পক্ষে। কাজেই আর বসে থাকার উপায় নেই। খৃষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে আলেকজান্ডার আবার রওনা দিলেন পারস্যের দিকে। রাজা দারিয়ুসের খোঁজে তার এবারের অভিযান। এবার দারিয়ুসকে খুঁজে বের করতেই হবে।