আলেকজান্ডারের মৃত্যু রহস্য

আলেকজান্ডার মারা গিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নেই কোনো রহস্য। কিন্তু কেমন করে মারা গেলেন? মারা যাওয়ার মতো বয়স কি তার হয়েছিল? যদিও মৃত্যুর কথা বলা যায় না। মানুষের মৃত্যু যে কোনো সময়ই হতে পারে । তবু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নেয়া কষ্টকর হয়ে যায়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুটাও তেমনি। মাত্র বত্রিশ বছর শেষ করে তেত্রিশে পা দিয়েছিলেন। তখনই মৃত্যু এসে হানা দিল। বিশাল সাম্রাজ্য তার করতলে। আরো সামরিক অভিযান করার পরিকল্পনাও ছিল তার। তবে কি মেসিডোনের সামরিক কর্মকর্তারা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী? কারণ মেসিডোনিয়ানরা আর যুদ্ধ চাচ্ছিল না। গ্রিকরাও যুদ্ধের বিপক্ষে। খুব অল্প সময়ে বিশাল এক সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তা তারা। তাদের ইচ্ছে, অনেক তো হলো। এবার ক্ষমতা উপভোগ করার পালা। কিন্তু আগেই জানানো হয়েছে যে, আলেকজান্ডার মোটেই সে রকম নৃপতি নন। রাজ্য শাসন উপভোগ করার চেয়ে, রাজ্য জয়, রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর প্রতিই তার আগ্রহ। কিন্তু তার আগ্রহের প্রতি তার সামরিক কর্মকর্তারা একমত ছিলেন না। হেফাস্টিয়নের মৃত্যুর পর নির্ভর করার মতো কাউকে বেছে নিতে পারেননি আলেকজান্ডার। কাউকে তিনি বিশ্বাসও করতেন না। অনেকেই মনে করেন, আলেকজান্ডার যদি নতুন রাজ্য দখলের পরিকল্পনা না করতেন, তাহলে হয়ত তাকে অকালে মরতে হতো না। বিশেষ করে আরবে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করার পর থেকেই মৃত্যু তার পিছু নিয়েছিল। নতুন করে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল তাকে নিয়ে।

আলেকজান্ডারের জীবনীলেখক জাস্টিন এবং কার্টিয়াসের মতে বিষ প্রয়োগেই হত্যা করা হয়েছে তাকে। কারণ আর কিছুই নয়, চক্রান্ত। আর এই চক্রান্তে জড়িত ছিলেন গ্রিসের ক্যাসান্ডার। ক্যাসান্ডার ছিলেন গ্রিসের ভাইসরয় অ্যান্টিপ্যাটারের ছেলে। ক্যাসান্ডার জানতেন পারস্য থেকে তিনি কখনোই বিষ জোগাড় করতে পারবেন না। কারণ আলেকজান্ডার ততদিনে পারসিয়ানদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। বিশেষ করে তিনি যখন গ্রিকদের সাথে পারসিয়ানদের ভাতৃত্ববন্ধন জোরালো করার ওপর জোর দিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাতেই পারসিয়ানরা তাকে নিজেদের আপনজন হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ক্যাসান্ডার এই বিষ সংগ্রহ করেছিলেন গ্রিস থেকেই। গ্রিস থেকে বিষ বয়ে পারস্যে আনাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কোনোভাবে ফাঁস হয়ে যায় যে, আলেকজান্ডারকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিষ বহন করা হচ্ছে, তবে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড। নিজের এবং দেশের প্রতি বিদ্রোহকারীদের মোটেই বরদাস্ত করেন আলেকজান্ডার। শেষ পর্যন্ত খচ্চরের খুরের মধ্যে লুকিয়ে বিষ আনা হয় ব্যাবিলনে। বিষটা দেয়া হয় ক্যাসাভারের ভাই আইওলাসের হাতে। আইওলাস ছিলেন আলেকজান্ডারের ভোজোৎসবের দেখাশোনাকারী। রাজকীয় কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এ কাজ করা যাবে না কোনোভাবেই। আর রাজকীয় কর্মচারী যখন নিজের সহোদর, তখন এরচেয়ে নিরাপদ আর কী হতে পারে। ব্যস। আলেকজান্ডারকে বিষ প্রয়োগ শুরু করা হলো। আলেকজান্ডারকে দেয়া হয়েছিল হেলিবার এবং স্ট্রিকনাইন জাতীয় বিষ। হেলিবার হচ্ছে গোলাপ জাতীয় এক ধরনের ফুল। প্রাচীন গ্রিসে এর ব্যবহার ছিল উম্মাদ রোগের দাওয়াই হিসেবে। আলেকজান্ডার যেহেতু রগচটা মেজাজের ছিলেন, কাজেই তাকে উম্মাদ হিসেবেই এমন দাওয়াই দেয়া হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এর পাশাপাশি চলছিল আরেকটা দাওয়াই। আলেকজান্ডার অতিরিক্ত পান করতেন। স্ট্রিকনাইন হচ্ছে বিষাক্ত ক্ষার জাতীয় বস্তু। ওটা তার পানীয়র সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হতো। এবং ধীরে ধীরে তার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে কেউ সন্দেহ করতে পারে। কিন্তু আলেকজান্ডার গবেষক আর লেইন ফক্সের মত হচ্ছে ভিন্ন। প্রাচীন দুনিয়ায় এমন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা বিষ না থাকার কথা জোরালোভাবে জানিয়েছেন তিনি। তার মতে, অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বারোদিন জীবিত ছিলেন আলেকজান্ডার। এবং এই বারোদিন একটানা অসুস্থ ছিলেন। বারোদিন ধরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া হবে শরীরে, এমন বিষ তখন না পাওয়ারই কথা।

এখানে একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন ফক্স। তাহলে গ্রিস থেকে খচ্চরের খুরে করে কী এসেছিল? আসলে ফক্সের ধারণা আলেকজান্ডারের মৃত্যু বিষক্রিয়ায় হয়নি। আর স্ট্রিকনাইনের মতো বিষ পাওয়া তখন কোনো বিষয়ই ছিল না। কারণ মেসিডোনের যোদ্ধাদের একটা রেওয়াজ ছিল স্ট্রিকনাইন নিয়ে। তারা তাদের তরবারিতে স্ট্রিকনাইন মেখে নিতেন। অনেক প্রাচীন ইতিহাসবিদও এ তথ্য জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে পুটারাক এবং অ্যারিয়ন বিখ্যাত। তাদের দুজনের মতেই আলেকজান্ডার কখনোই বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি। স্বাভাবিক রোগে ভুগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তারা মনে করেন আলেকজান্ডার হয় ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিলেন, নয় তো টাইফয়েডে। কারণ ব্যাবিলনেই তখন ওই দুটো রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। আবার কারো কারো মতে আলেকজান্ডার অসুখে ভুগেই মারা গিয়েছিলেন, তবে তার অসুখটা ম্যালেরিয়া কিংবা টাইফয়েড নয়। হয় তিনি অগ্নাশয়ের রসক্ষরণে মারা গিয়েছিলেন, নয় তো পশ্চিম নীল নদের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

সম্প্রতি আরো একটা তথ্য জানা গেল আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে। এই গবেষকরা বলছেন আসলে এসবের কিছুই হয়নি আলেকজান্ডারের। তিনি মারা গিয়েছিলেন ভুল চিকিৎসায় । উম্মাদনার ওষুধ হিসেবে হেলিবার যতখানি পরিমাণে দেয়ার কথা ছিল, দাওয়াই হিসেবে তাকে দেয়া হতো তার চেয়ে বেশি। আর এটা আলেকজান্ডার নিজেই চাইতেন। কারণ মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই অধৈর্য। তার ধারণা ছিল যত বেশি করে ওষুধ খাবেন তত দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠবেন। যে কারণে হেলিবার আলেকজান্ডারের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু করল। তার শরীর ভেঙে গেল। তবে তার শরীর ভেঙে যাওয়ার পিছনে অন্য যুক্তিও পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, ভারতে সামরিক অভিযান চালানোর সময় কঠিন প্রতিকূলতার কারণে প্রচুর পান করা শুরু করেন আলেকজান্ডার। এই অতিরিক্ত পান করা এক সময় তার নেশা হয়ে যায়। সে কারণেই তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তারপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন আলেকজান্ডার। সত্যি সত্যি তখন অতিরিক্ত পান করতেন আলেকজান্ডার। ভারতের সামরিক অভিযানের পাশাপাশি তার দুই প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুও এই অতিরিক্ত পানের কারণ বলে অনেকে মনে করেন। একে একে বুকাফেলাস এবং হেফাস্টিয়নকে হারানোর পর আর শোক সইতে পারেননি। যে কারণে হেফাস্টিয়নের মৃত্যুর অল্পকিছুদিন পরেই মারা যান তিনি। কারণ এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বন্ধুর জন্য কেউ শোক করে না। আগেই জানা আছে, আলেকজান্ডার হেফাস্টিয়নের মৃত্যুতে ছয় মাস একটানা শোক করেছিলেন।

আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে নানান সময় নানান ধরনের যুক্তিতর্ক চলে আসছে। কিন্তু কোনো যুক্তিই শেষ পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। কাজেই আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সত্যিকার কারণ কী ছিল, সেটা এখনও রহস্যময়। তবে বেশিরভাগ পন্ডিতের মতেই জুরে ভুগে মারা গেছেন তিনি। আর তার মৃত্যুর দিন নিয়েও মতভেদ আছে। কারো মতে তিনি মারা গেছেন জুনের ১০ তারিখ । কেউ মনে করেন তিনি মারা গেছেন জুনের ১১ তারিখ। তার মৃত্যুর সাল নিয়ে অবশ্য কারো দ্বিমত নেই। সালটা ছিল খৃষ্টপূর্ব ৩২৩।