মেসিডোনিয়ার সৈন্য

রাজা ফিলিপ আলেকজান্ডারের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে গিয়েছিলেন। একপাহাড় সমান সোনা, পুরো গ্রিস আর একদল চৌকস সেনা। এই চৌকস সেনাদলকেই আলেকজান্ডার বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এই সেনারা যুদ্ধ করত তিনটি সারিতে। আর প্রত্যেকেই বিভিন্ন কায়দায় এবং বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে পারত। সেনাদের একেকটা ছোট দলে থাকত ১৬ জন করে। আর একেকটা ইউনিটে থাকত ২৫৬ জন সেনা। এদের হাতে থাকত সারিসা নামের অস্ত্র। এই অস্ত্র ছিল ১৩ ফুট লম্বা। দেখতে অনেকটা বশীর মতো। আর থাকত ১৬ ফুটের চেয়েও লম্বা হাস্তা। এদের সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল এরা যে কোনো অবস্থায় যুদ্ধ করতে পারত। তবে সাধারনত বর্গাকার সারিতেই তারা যুদ্ধ করত। যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনারা কখনো আয়তাকার, কখনো পঞ্চভূজ আকারেও লড়াই চালাতে পারত। পতাকা বহন ও অন্যান্য সংকেতের মাধ্যমেও যুদ্ধ করার কৌশল রপ্ত ছিল তাদের। পশ্চিমা বিশ্বে ওই শতকে এদের মতো এতটা দক্ষ সৈন্য কোনো দেশেই ছিল না। 

এ তো গেল পদাতিক সেনাবহিনীর কথা। আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীতে দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীও ছিল। এই দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীও যে কোনো যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারত। আলেকজান্ডার রাজা হওয়ার পর গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঘোড়া জোগাড় করে আরো শক্তিশালী করেন তার অশ্বারোহী বাহিনী।

গ্রিসের তখন একেক নগরের সৈন্যরা একেক ধরনের অস্ত্রচালনায় পারদর্শী ছিল। যেমন ক্রেটান—এর তীরন্দাজ বাহিনী। তারা বেশ নিখুঁত নিশানায় তীর ছুড়তে পারতেন। ছিল বলুম ছােড়ায় পারদর্শী সেনা। এছাড়াও নানান ধরনের পদাতিক বাহিনী তো ছিলই। তারা প্রত্যেকেই নিজস্ব ঢঙে নিজস্ব রীতিতে যুদ্ধ করত। আর ছিল দারুণ চৌকস এক নৌযোদ্ধাদল। নৌযোদ্ধাদের আলেকজান্ডার জোগাড় করেছিলেন এথেন্স, করিন্থ এবং অন্যান্য নগর থেকে। 

তখন অন্যান্য যোদ্ধাদের চেয়ে আলেকজান্ডারের যোদ্ধাদের দেয়া হতো সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা এবং সবচেয়ে ভালো অস্ত্র। সৈন্যদের নগর অবরোধের নিয়মকানুনও শেখানো হয়েছিল। কেবল শেখানোই হয়নি, নিয়মিত অনুশীলনও করানো হতো। আবার অবরোধ থেকে কী করে বেরোনো যায়, সে শিক্ষাও দেয়া হতো তাদের। সৈন্যদের এতকিছু শেখানোর জন্য শিক্ষকও নিয়োগ করেছিলেন আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীতে প্রকৌশলীও ছিল। নগর দেয়াল ভাঙার জন্য ছিল ১০০ ফুট লম্বা লম্বা পেঁকির মতো যন্ত্র। এসব যন্ত্রকে বলে র‍্যাম। আর ছিল ১৫০ ফুট লম্বা মই। এসব মই ছিল সেতুর মতো। যাতে অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, সেতুর মতো এ ধরনের মইয়ের ব্যবহার আলেকজান্ডারই প্রথম করেন। আরেকটা যন্ত্র ছিল আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীতে। কিংবদন্তি বলে এই যন্ত্র আলেকজান্ডার নিজেই আবিস্কার করেন। এটা হচ্ছে গুলতির মতো। এখন যেমন গুলতিতে ছোট্ট পাথরখণ্ড আটকে পিছনে খানিকটা টেনে তারপর ছেড়ে দেয়া হয়, তেমনি যন্ত্র ছিল ওটা। আকারে বিশাল। বিশাল বিশাল পাথর আটকে তারপর অনেকখানি টেনে ওটা ছেড়ে দেয়া হতো হঠাৎ। বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে সেই পাথরখণ্ড আঘাত হানতো। ওই আঘাতে গুঁড়িয়ে যেত যে কোনো স্থাপনা। সৈন্যও মারা যেত এর আঘাতে। আর অন্যান্য সেনাপতিদের মতো সেনাপরিচালনা ও সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুণাগুণ তো তার মধ্যে ছিলই। 

যুদ্ধক্ষেত্রে আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ার সৈন্যদের রাখতেন মাঝখানে। জেনারেল পারমেনিয়ন সৈন্যদের বামপাশে থেকে নির্দেশনা দিতেন। আলেকজান্ডার থাকতেন ডানপাশে। তিনি নির্দেশ দিতেন অশ্বারোহী বাহিনীকে। আলেকজান্ডারের যুদ্ধের একটা কৌশল ছিল। তিনি সরলরেখায় তার সৈন্যদের যুদ্ধ করার নির্দেশ দিতেন না। তার সৈন্যরা সবসময় তীর্যকভাবে শক্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত। দুপাশের সৈন্যরা বেশকিছুদূর এগিয়ে যেত শত্রুসৈন্যদের লক্ষ্য করে, যেন কোনো বিশাল বাজপাখি তার ডানা বাড়িয়ে সবকিছু নিজের কাছে নিয়ে আসত। জেনারেল পারমেনিয়নের কাজ ছিল এগিয়ে আসা শত্রুসৈন্যদের ব্যস্ত রাখা এবং তাদের হত্যা করা । তবে আলেকজান্ডারের সেনাদল যখন যা করার প্রয়োজন, ঠিক সময় মতো নিজেদের দায়িত্ব সম্পন্ন করতো। 

কেবল এতসব যুদ্ধকৌশলের জন্যই কি আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ী যোদ্ধা হতে পেরেছিলেন? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে, না। কারণ আলেকজান্ডারের অসম সাহস আর বুদ্ধিমত্তা তার সৈন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। তিনি সবসময় সৈন্যদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। যেখানে সৈন্যসংখ্যা কম থাকত, সেখানেই এগিয়ে যেতেন আলেকজান্ডার। তখনকার দিনে যা ছিল একেবারেই বিপরীত ধর্মী যুদ্ধ কৌশল। তখন সেনাপতিরা সৈন্যদের পিছনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন। কারণ একেবারে সামনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া সেনাপতিদের জন্য ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুকিটী কোনো সেনাপতিই নিতেন না। ঝুকি নেয়ার এই সাহস ও বীরত্বের জন্য আলেকজান্ডার তার সৈন্যদের কাছে হয়েছিলেন আরো মহান, আরো বড় বীর। পুরো গ্রিসে তখন এত বড় বীর আর দ্বিতীয়জন ছিলেন না। 

সামনে থেকে যুদ্ধ করার কারণে আলেকজান্ডারকেও কম ভুগতে হয়নি। গ্রেনিসাস নদীতে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি কাঁধ এবং মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। ইসাসে যুদ্ধ করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন উরুতে। গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন ঘাড়ে। তুর্কিস্তানের যুদ্ধে তার একটি পা ভেঙে গিয়েছিল। এজন্য তাকে বেশ কিছুদিন ভুগতেও হয়েছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার সময় তিনবার আহত হয়েছিলেন। আর সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত পেয়েছিলেন ভারতে যুদ্ধ করতে এসে। ভারতের যুদ্ধ করার সময় একটি তীর তার ফুসফুস বিদ্ধ করেছিল। তবু যে কোনো নগরের দেয়াল ভাঙার সময় বা নগর ডিঙোনোর সময়, একেবারে প্রথম যোদ্ধাটিই থাকতেন তিনি নিজে।

যুদ্ধই ছিল আলেকজান্ডারের ধ্যানজ্ঞান। জীবনে যতকয়টা যুদ্ধ করেছেন, কোনো যুদ্ধেই হারেননি আলেকজান্ডার। যুদ্ধ করা মানেই জয়লাভ করা। তিনি মনে করতেন তিনি অজেয়। তাকে হারানোর সাধ্য কারো নেই। তার এই আত্মবিশ্বাস তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার সৈন্যদের মাঝে। তার সৈন্যরাও ভাবত, তারা এক অজেয় বীরের যোদ্ধা। তাদের হারলে চলবে না। তারা জয়ের জন্য যুদ্ধ করতো। তারা কখনো হারেনি। 

মহান সেনাপতিদের মতে, আলেকজান্ডার জানতেন কেমন করে সৈন্যদের ভালোবাসতে হয়। তিনি সত্যিকার অর্থেই তার অধীনস্থ সৈন্যদের ভালোবাসতেন। তার একটা অসাধারণ গুণ ছিল। তিনি তার সৈন্যদের নাম মনে রাখতে পারতেন। কোনো যুদ্ধের আগে যখন তারা রণকৌশল ঠিক করার জন্য বৈঠকে বসতেন, তখন তিনি তার অধীনস্থ সৈন্যদের নাম ধরে ডাকতেন। তাদের মতামত নিতেন। তার পুরনো সৈন্যদের তিনি ছুটিও দিতেন, যাতে তারা তাদের বাড়ি গ্রিস থেকে ঘুরে আসতে পারে। তাদের পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটিয়ে আসতে পারে। সৈন্যদের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানের ব্যবস্থাও রাখতেন আলেকজান্ডার। 

আর এসব কিছু মিলেই আলেকজান্ডারের বাহিনী ছিল সত্যিই একটা অজেয় বাহিনী, যাদের কেউ থামাতে পারেনি। আলেকজান্ডারের এসব গুণের কারণেই তার বাহিনীর উজ্জলতা কখনো এতটুকু ফিকে হয়নি। বরং আলেকজান্ডার এবং তার বাহিনী দুনিয়ায় এখনও বেঁচে আছে একেবারে রূপকথার মতো। এই রূপকথার নায়ক একজনই, আলেকজান্ডার। বিজয়ের এমন রূপকথা খুব কমই রচিত হয়েছে পৃথিবীতে। তবু যা হয়েছে, তার মধ্যে আলেকজান্ডারের বীরত্ব সবার চেয়ে সেরা, সবার চেয়ে উপরে— এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেনি কখনো। কখনো পারবেও না। কারণ পৃথিবীতে আলেকজান্ডার যে কেবল একজনই।