অ্যারিস্টটলের শিষ্য

লিয়নিডাস কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছেন আলেকজান্ডার তার কাছে আর পড়তে আসেন না। ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে না। তিনি কয়েকবার তাড়া দিয়েছেন, কিন্তু আলেকজান্ডারের জেদের কাছে তাকে হার মানতেই হলো। বড় একগুয়ে স্বভাবের। যা ভাববে বা চিন্তা করবে, সেটা তার করা চাই। শেষে উপায় না দেখে রানী অলিম্পিয়াসের কাছে নালিশ করলেন লিয়নিডাস। রানী আলেকজান্ডারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আলেকজান্ডার কারো কথাই কানে তুললেন না। ইদানিং যুদ্ধবিদ্যার দিকে মন দিয়েছেন বেশি। আগেও তো যুদ্ধবিদ্যা শিখতেন, তখন তো এমন করতেন না। তাহলে? শেষ পর্যন্ত রাজা ফিলিপের কানে কথাটা পৌছে গেল। রাজা জানলেন আলেকজান্ডার লেখাপড়ায় বেশ অমনোযোগী হয়ে উঠেছে। কিছুতেই ওকে বাগে আনা যাচ্ছে না। রাজা ডেকে পাঠালেন আলেকজান্ডারকে। 

আলেকজান্ডার সামনে আসতেই রাজা জানতে চাইলেন, তুমি নাকি এখন আর লিয়নিডাসের কাছে পড়তে যাও না। 

আলেকজান্ডার মাথা উঁচু করেই জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তার কাছে আমার আর পড়তে ভালো লাগে না। 

ফিলিপ বললেন, এটা কী ধরনের কথা আলেকজান্ডার? তিনি তো তোমার শিক্ষক। তাকে অবজ্ঞা করা কি ঠিক? 

আলেকজান্ডার বললেন, তাকে আমি অবজ্ঞা করছি না মোটেই। ফিলিপ জানতে চাইলেন, তাহলে তার কাছে পড়তে তোমার ভালো লাগে কেন? 

আলেকজান্ডার বললেন, তিনি যা জানেন, তার সবই আমাকে শিখিয়েছেন। তার কাছে আমার আর শেখার মতো কিছু নেই। তিনি এখন যা শেখাতে চাইছেন, এর সবই আগে শিখিয়েছেন। 

রাজা ফিলিপ বুঝতে পারলেন সব। এজন্য আলেকজান্ডারের দোষ দেয়া যায় না। এই বয়সে সবাই চায় নতুন নতুন জিনিস শিখতে। পুরনো জানা জিনিস কে আবার শিখতে চায়? তিনি আলেকজান্ডারের জন্য গ্রিসের সেরা শিক্ষকের খোঁজ করলেন। এবং পেতেও সময় লাগল না মোটেই। অ্যারিস্টটলের মতো পণ্ডিত শুধু গ্রিসে নয়, দুনিয়াতেই বিরল। তিনি ঠিক করলেন অ্যারিস্টটলের কাছেই ছেলের শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল কি রাজি হবেন রাজপুত্রকে শেখাতে? ফিলিপ ভাবলেন, দেখাই যাক না প্রস্তাব পাঠিয়ে। কাজেই রাজা ফিলিপ খৃষ্টপূর্ব ৩৪৩ অব্দে লেসবেস থেকে ডেকে পাঠালেন গ্রিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে। 

অ্যারিস্টটলের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে থ্রেসের ত্যাজাইরাতে। ১৭ বছর বয়সে বাবা—মাকে হারান। এরপরই জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসেন এথেন্সে। ভর্তি হন প্লেটোর বিদ্যালয়ে। প্লেটো ছিলেন আরেকজন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক। প্লেটোর সান্নিধ্যে থেকে যতখানি সম্ভব জ্ঞান অর্জন করেন। ফলে প্লেটোর বিদ্যালয়ে প্রথমে ছাত্র থাকলেও পরে অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রদের শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এখানে ছিলেন বিশ বছর।

জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক পথের সন্ধান দিয়েছেন অ্যারিস্টটল। ন্যায়শাস্ত্র, অধিবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, মনস্তত্ত্ব, শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, কাব্যশাস্ত্র, সাহিত্য ও সাহিত্যসমালোচনাসহ সকল বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ছিল তার। কেবল জ্ঞানই ছিল না, এসব জ্ঞান তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন। আলোচনাও করেছেন এসব বিষয়ে। দুই রকমভাবে তিনি তার রচনাভঙ্গী প্রকাশ করেছেন। পণ্ডিতদের জন্য গবেষণাধর্মী এবং সাধারন মানুষদের জন্য কথোপকথনের ভঙ্গীতে লিখিতরূপে প্রকাশ করেন। তার সর্বাধিক আলোচিত ও বিশ্বখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে আনালোতিকা প্রায়োরিয়া, পোস্তেরিওরা, ততাপিকা, মেটাফিজিক্স, সফিজম, মেটেওরোলজিকা, পোয়েটিকস।

রাজা ফিলিপের প্রস্তাব গ্রহণ করেন অ্যারিস্টটল। প্লেটোর বিদ্যালয় ছেড়ে তিনি চলে আসেন মেসিডোনের এক অজপাড়াগা মাইসিয়ায়। আলেকজান্ডারের বয়স তখন ১৩ বছর। তার শিক্ষক যুক্ত হলেন অ্যারিস্টটল। অল্প কয়েকজন ছাত্র নিয়ে মাইসিয়ায় তার স্কুল। এই স্কুলের ছাত্র হলেন আলেকজান্ডার। এখানে অ্যারিস্টটলের কাছে আলেকজান্ডার শিখলেন রাজনীতি, দর্শন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, কবিতা, নাটক, বিজ্ঞান। সাহিত্যের প্রতি আলেকজান্ডারকে আগ্রহী করে তোলেন অ্যারিস্টটল। নিয়মিত তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাও গ্রহণ করেন আলেকজান্ডার। এছাড়া মানুষের আচরণবিধি, পশুপাখি, জীবজন্তু ও শস্যসহ নানান বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন আলেকজান্ডার। যদিও এসব বিদ্যা অ্যারিস্টটলের কাছে পুঁথিবদ্ধ ছিল না। তাই খুব যত্ন করেই আলেকজান্ডারকে এসব শিক্ষা দেন অ্যারিস্টটল। অ্যারিস্টটল জানতেন কেবল জ্ঞান অর্জন করলেই হয় না, জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শরীর গঠনও প্রয়োজন। তাই আলেকজান্ডারের শরীর গঠনের জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করার অভ্যাসও তৈরি করিয়ে দেন তিনি। শিক্ষক অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারের হাতে একখানি ইলিয়াড তুলে দেন। ইলিয়াডের এই সংস্করণ অ্যারিস্টটল নিজের হাতে তৈরি করেন। আলেকজান্ডার সবসময় নিজের কাছে কাছে রাখতেন গুরুর দেয়া এই কাব্যগ্রন্থটি। আর যখনই সময় পেতেন তখনই পড়তেন। 

অ্যারিস্টটলের স্কুলে পড়ার সময় আলেকজান্ডারের একজন বন্ধুও জুটে যায়। দেখতে আলেকজান্ডারের মতোই সুদর্শন। বয়সেও তার সমান। নাম হেফাস্টিয়ন। তাদের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। যতদিন বেঁচে ছিলেন, তারা একে অপরের সুখ—দুঃখের সাথী ছিলেন, একে অপরের অনুরক্ত ছিলেন। তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদেরও কোনো দ্বিমত ছিল না।