শুরু হলো নতুন লড়াই

আলেকজান্ডার মেসিডোনের সিংহাসনে বসার পর থেকেই শুরু হলো বিদ্রোহ। রাজা ফিলিপ গ্রিসের যেসব রাজ্য জয় করে মেসিডোনের সাম্রাজ্য বাড়িয়েছিলেন, এদের মধ্যেই বেশ কিছু রাজ্য আলেকজান্ডারের আনুগত্য মেনে নিতে চাইল না। সাধারনত এটাই নিয়ম। নতুন যে কোনো রাজাকে আগে এমন বিদ্রোহের মুখে পড়তে হতো। এবং এই বিদ্রোহ সামলিয়ে যিনি সঠিকভাবে রাজ্য শাসন করতে পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন জগত সেরা শাসক। আর যদি কোনো শাসক নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে নতুন কোনো রাজ্য জয় করতে পারেন, তাহলে তো তিনি বীর হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা করে নেন। 

প্রতিদিনই নানান জায়গা থেকে খবর আসছে, অনেক রাজ্যই মেসিডোনের অধীন হয়ে থাকতে চায় না। যেহেতু রাজা ফিলিপের সময় সেনাবাহিনীর একটা অংশের অধিনায়ক ছিলেন আলেকজান্ডার, এবং যুদ্ধও করেছিলেন। কাজেই সেনাবাহিনীর নিয়মনীতি সম্পর্কে বেশ জ্ঞান আছে তার। তাছাড়া রাজা ফিলিপও একটা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী রেখে গিয়েছেন। তবু সন্তুষ্ট হতে পারলেন না আলেকজান্ডার। তিনি সেনাবাহিনী নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করলেন। রাজা ফিলিপের সময় মেসিডোনের নাগরিকরাই কেবল সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেত। মেসিডোনের অন্য কোনো অঞ্চল কিংবা বৃহত্তর গ্রিসের অন্য কোনো রাজ্যের নাগরিকরা সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেত না। আলেকজান্ডার এই নিয়মও ভাঙলেন। তিনি গ্রিসের নানান অঞ্চলের নাগরিকদের নিয়ে একটি সমন্বিত সেনাবাহিনী গঠন করলেন। এমন সেনাবাহিনী গঠন করার পিছনে তার যুক্তিও ছিল। শুধুমাত্র একই এলাকার সেনাবাহিনী দিয়ে সব অঞ্চলে যুদ্ধ করা যায় না। বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিক দিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীতে যেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলের এবং নানান ধরনের মানুষ থাকে, কাজেই যে কোনো জায়গায় যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়। অচেনা জায়গায় নতুন করে সেনাবাহিনীকে খাপ খাওয়াতে হয় না। 

মেসিডোনের ক্ষমতা তো পৈত্রিক সূত্রেই পেয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। কিন্তু গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলের আনুগত্য তো আর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া যায় না। রাজা ফিলিপের সময় গ্রিসের এমন অনেক রাজ্য আছে, যেগুলো সানন্দেই ফিলিপের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু বিশ বছরের তরুণ আলেকজান্ডার রাজা হওয়ার পর, তার বশ্যতা মেনে নিতে চায়নি অনেক রাজ্য। গ্রিসের রাজ্যগুলো নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালানোর জন্য একটা শাসন কমিটিও গঠন করেছিল। এই শাসন কমিটির নাম ছিল লিগ অব করিনথ । লিগ অব করিনথ পরিচালিত হতো রাজা ফিলিপের নির্দেশে। আর এই শাসন কমিটির নেতৃত্ব দিত এথেন্স। ফিলিপের মৃত্যুর পর, শাসন কমিটিও মুখ ঘুরিয়ে নিল আলেকজান্ডারের কাছ থেকে। তার আনুগত্য মানতে রাজি হলো তারা। আলেকজান্ডার গ্রিসের দক্ষিণে ও থেসেলিতে সৈন্য পাঠালেন। আর নির্দেশ দিলেন শাসন কমিটিকে, যেন তারা তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। খৃষ্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে, মানে আলেকজান্ডার যে বছর রাজা হলেন, সে বছরের হেমন্তে করিনথ নামক জায়গায় শাসন কমিটির সদস্যের সাথে নতুন করে চুক্তি করতে চাইলেন। স্পার্টা আলেকজান্ডারের সাথে আলোচনাতেই বসতে চায়নি। বাকি সবাই পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনুমতি দিল আলেকজান্ডারকে। শুধু তাই নয়, বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ার সবরকম সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিল তারা। কিন্তু আলেকজান্ডার তখনও পারস্য অভিযানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগে নিজের শক্তি সম্পর্কে আরো অবগত হতে চাইলেন। খৃষ্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে দানিয়ুবের দক্ষিণদিকের ব্রেসিয়ান ট্রিলিয়ান জয় করলেন। জেনারেল পারমেনিয়ন তখন আলেকজান্ডারের হয়ে এশিয়া মাইনর অভিযানে নেমে পড়েছেন। এবং আলেকজান্ডারের হয়ে মেসিডোনের প্রতিনিধিত্ব করছেন গভর্নর হিসেবে। জেনারেল পারমেনিয়নের সাহায্য ছাড়াই দানিয়ুবের দক্ষিণাংশ জয় করে মেসিডোনের উত্তর সীমান্ত নিরাপদ করে ফেললেন আলেকজান্ডার। 

আলেকজান্ডার যখন দানিয়ুবের দক্ষিণাংশ জয় করে মেসিডোনের উত্তর সীমান্ত নিরাপদ করার কাজে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বিদ্রোহ করে বসল থেবস। তবে থেবসের বিদ্রোহ করার কারণ আছে। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল আলেকজান্ডার যুদ্ধে মারা গেছেন। বিশেষ করে জেনারেল পারমেনিয়নের সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয় বলে অনেকেই ভেবেছিল। আর সেখান থেকেই গুজব ছড়ায়। আলেকজান্ডার তবু জেনারেল পারমেনিয়নকে ডেকে পাঠাননি। তিনি নিজেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আলেকজান্ডার অভিযান চালালেন ঘরের শত্রু থেবসের বিরুদ্ধে। ততদিনে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী বেড়েছে কয়েকগুণ। তরুণ যোদ্ধাদের পদচারণায় ভারী হয়ে আছে তার সৈন্যদল। যুদ্ধ করার জন্য টগবগ করে ফুটছে তরুণ যোদ্ধারা। যত দ্রুত সম্ভব থেবসে হামলা চালালেন আলেকজান্ডার। মাত্র দুই সপ্তায় ২৪০ মাইল পথ অতিক্রম করলেন তার বাহিনী নিয়ে।

হঠাৎ আক্রমণে ঘাবড়ে যায় থেবসের যোদ্ধারা। দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা। অসহায় থেবস সাহায্যের আবেদন জানায় এথেন্সের কাছে। কিন্তু এথেন্সে এই সাহায্যের খবর পৌছানোর আগেই আলেকজান্ডারের সৈন্যদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করে থেবস। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা থেবসে রক্তনদী বইয়ে দেয়। ঝড় তোলে থেবসের অলিতে—গলিতে, প্রতিটি ঘরে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় পুরো নগরীতে। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায় থেবস। থেবসে যত ভবন ছিল, সব গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। কেবল দুটো ভবন রেহাই পায় আলেকজান্ডারের ক্রোধ থেকে। এক হচ্ছে থেবসের মন্দির আর কবি পিন্ডারের বাড়ি। কবি পিন্ডারকে খুব শ্রদ্ধা করেন আলেকজান্ডার। গ্রিসের গীতিকবিতার পুরোধা পিন্ডার। তাকে অসম্মান করার কোনো ইচ্ছেই আলেকজান্ডারের ছিল না। আর ছিল না বলেই তিনি বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কবি পিন্ডারের বাড়ির যেন সামান্যতম ক্ষতিও না হয়। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা তার কথা রেখেছিল। 

রাজা হলেও শিল্প সাহিত্যের প্রতি অসাধারন ঝোঁক ছিল আলেকজান্ডারের। মেসিডোনে তার মতো শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সঙ্গীতপিপাসু শাসক আর জন্মায়নি। না জন্মানোটাই স্বাভাবিক। শুধু মেসিডোন কেন, গ্রিসের আর কোন রাজার সৌভাগ্য হয়েছিল অ্যারিস্টটলের মতো মহান জ্ঞানী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করার? আর কারো হয়নি। আর হয়নি বলেই আলেকজান্ডার সবার চেয়ে ব্যতিক্রম, সবার সেরা।

বেবসকে একপ্রকার ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হলো। বন্দি করা হলো থেবসের ৩০ হাজার নাগরিককে। তাদের বিক্রি করে দেয়া হলো দাস হিসেবে। এই দাসদের মধ্যে শক্ত—সমর্থ জোয়ান পুরুষ যেমন ছিল, তেমনি অসহায় বৃদ্ধ এবং নারী ও শিশুরাও ছিল । কেউ রেহাই পায়নি। আলেকজান্ডার যেন তার শক্তির কিছুটা ঝলক দেখিয়েছিলেন থেবসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। এবং তার ঝলক দেখেছেও গ্রিকরা। আর দেখেছে বলেই এথেন্স সাহায্য করতে আসেনি। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের কারণে গ্রিসের বাকি নগর তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। আগের মতো বহাল রাখা হলো লিগ অব করিনথ। লিগ অব করিন—এর সকল সদস্য আলেকজান্ডারের নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকারও করল। 

এরপর থেকে আর কখনো ঘরের শত্রুদের মুখোমুখি হননি আলেকজান্ডার। কিন্তু তাই বলে চুপচাপ থাকার মতো যোদ্ধাও নন তিনি। থেবসকে শায়েস্তা করার কিছুদিনের মধ্যেই উসখুস করতে লাগলেন তিনি। থেবসকে শায়েস্তা করে ফিরেও এসেছেন মেসিডোনে। কিন্তু এক দণ্ড স্থির হতে পারছেন না। প্রিয় ঘোড়া বুকাফেলাসও যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। পারস্যের দিকে ছুটতে হবে। ততদিনে পুরো গ্রিস জুড়ে একক বীর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন তিনি। গ্রিসের সীমানা বাড়ানোর অনুমতি তো তিনি পেয়েছেনই লিগ অব করিনথ থেকে। তাহলে আর সময় নষ্ট কেন? নিজের মনেই কয়েকবার আওড়ালেন আলেকজান্ডার, তাহলে আর সময় নষ্ট কেন? 

একরাতে বুকাফেলাসের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর খুব ইচ্ছে করছিল তার। আস্তাবলে গিয়ে প্রিয় ঘোড়ার গায়ে হাত বোলালেন আলেকজান্ডার। অবুঝ প্রাণীটা প্রিয় প্রভুর সাড়া পেয়ে ডেকে ওঠল। আর ছটফট করতে লাগল। আলেকজান্ডার বুকাফেলাসের গলায় হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে বললেন, বোকা বুকাফেলাস, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন? এই তো আর কদিন পরেই আমরা লম্বা একটা যাত্রা করবো। একটু সবুর কর।

তারপর লাগম তুলে বুকাফেলাসের পিঠে চড়ে হারিয়ে গেলেন অন্ধকারে। মাঝে মাঝেই এমন হারিয়ে যান তিনি। কিছুদূর যাওয়ার পরই শুনতে পেলেন পিছনে আরেকটা ঘোড়ার খুরের শব্দ। চলা থামিয়ে ওঁৎ পেতে রইলেন আলেকজান্ডার। একটু পর চিনতে পারলেন। তার বন্ধু হেফাস্টিয়ন। এই হেফাস্টিয়নের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ আলেকজান্ডার। তাকে একেবারে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। বন্ধুর কোনো বিপদ—আপদ হলো না তো, এই নিয়ে উৎকণ্ঠা তার। 

সম্ভবত হেফাস্টিয়ন বুঝতে পারেননি আলেকজান্ডার যে লুকিয়ে আছেন। সামান্য একটু এগিয়েই গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সামনের দিক থেকে আলেকজান্ডারের গায়ের কোনো গন্ধ পাচ্ছেন না হেফাস্টিয়ন। কাজেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ঠিক তখনই তার সামনে এসে দাঁড়ালেন আলেকজান্ডার। জানতে চাইলেন, কী খবর হেফাস্টিয়ন। কাউকে খুঁজছ? 

হেফাস্টিয়ন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, কাউকেই খুঁজছি না। আলেকজান্ডার বললেন, তাহলে এত রাতে এখানে কেন? 

হেফাস্টিয়ন বললেন, এখন আপনি রাজা হয়েছেন। এভাবে ঝটপট প্রাসাদ থেকে বেরোনো আপনার মানায় না। 

আলেকজান্ডার জানতে চাইলেন, ভয় কিসের? এখন তো আমার কোনো শত্রু নেই।

হেফাস্টিয়ন বললেন, শত্রুর অভাবও তো নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন শক্রর জন্ম হচ্ছে। কে কখন কিভাবে আঘাত করে বলা যায়?

আলেকজান্ডার হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, আমি বীর হেফাস্টিয়ন। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। কারো ভয়ে আমি ভীত নই। মৃত্যু যখন আসবে, হাসিমুখেই তাকে বরণ করে নেবো। ভীতুর জন্যও মৃত্যু যেমন অপেক্ষা করে আছে, বীরের জন্যও তেমনি। কাজেই মৃত্যুর ভয়েও আমি ভীত নই। বরং যে কোনো সময়, যে কোনো আঘাত এলে সেটা যাতে মোকাবেলা করতে পারি, সেটাই ভাবি। 

অন্ধকারে আলেকজান্ডারের মুখটা দেখতে পাচ্ছিলেন না হেফাস্টিয়ন। কিন্তু এ সময় এ মুখটা দেখার খুব ইচ্ছে করছিল তার। বিশেষ করে আলেকজান্ডারের উজ্জল দুটো চোখ। ওই চোখ থেকে যেন দ্যুতি বেরোয় সবসময়। সে দ্যুতি দেখতে খুব ভালো লাগে হেফাস্টিয়নের। কিন্তু রাজা হওয়ার পর সেটা দেখার সৌভাগ্য খুব কমই হয়েছে তার। যদি কখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, তখন যদি আলেকজান্ডারের পাশে থাকা হয়, তাহলে সে দ্যুতি দেখার সৌভাগ্য আবার হবে। এবং এখন খুব ইচ্ছে করছিল হেফাস্টিয়নের, যাতে আলেকজান্ডারের সাথে দীর্ঘ কোনো পথ পাড়ি দিতে পারেন। কিংবা নতুন কোনো দেশ জয়ে বেরিয়ে পড়া যেত। এই গ্রিসের বাইরের কোনো দেশ। হবে কি এমন কিছু?