রূপকথার বাঁধন

খৃষ্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দ। বসন্তকাল। বাবা রাজা ফিলিপের মৃত্যুর পর এর মধ্যেই গ্রিস ও মেসিডোনিয়ার মধ্যে যে ঝামেলা ছিল, সেগুলো মিটমাট করে ফেলেছেন আলেকজান্ডার। বিদ্রোহী নগরগুলো নতুন করে জয় করতে হয়েছে তাকে। এবার বিশ্বজয়ের পালা। সেই অনেকদিন আগে থেকেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন আলেকজান্ডার। গ্রিসের বিদ্রোহী নগরগুলো একত্র করে আলেকজান্ডার পরিকল্পনা করলেন বিশ্বজয়ের। বিশ্বজয় করাই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল। আর এই বিশ্বজয়ের জন্য কেবল সৈন্য নয়, তিনি সাথে নিলেন নানান বিষয়ে অভিজ্ঞ নানান মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন চিত্রশিল্পী, ভূগোলতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, প্রাণীবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক। শুধু তাই নয়, তিনি যাকেই তার বিশ্বজয়ের জন্য প্রয়োজন মনে করলেন, তাকেই সাথে নিলেন। 

কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবেন বিশ্বজয়? জরুরি সভা বসালেন অভিজ্ঞদের নিয়ে। শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন। তবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি আলোচনা করে নিলেন তার অতি প্রিয় দুজন মানুষের সাথে। এদের একজন হলেন আলেকজান্ডারের বন্ধু হেফাস্টিয়ন এবং অন্যজন হলেন তার গুরু অ্যারিস্টটল। অ্যারিস্টটলের পরামর্শেই আলেকজান্ডার বেশিরভাগ কাজ করতেন বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। 

আলেকজান্ডার প্রথমেই যেতে চাইলেন ট্রয়। এবং এটা ছিল একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সঠিক সিদ্ধান্ত। যদিও আলেকজান্ডার ভুল সিদ্ধান্ত কখনোই নিতেন বলে মনে করেন না কেউ। ট্রয়ের প্রতি আলেকজান্ডারের দুর্বলতা ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। এই ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই এসেছিলেন তার আদর্শ বীর একিলিস। একটানা দশ বছর যুদ্ধ করেই গ্রিকরা ট্রয়দের বিরুদ্ধে মহান বিজয় অর্জন করেছিল। আলেকজান্ডার আর তার বাহিনী যাত্রা শুরু করল আইওনিয়ান উপকূলের দিকে। আইওনিয়ান প্রদেশ থেকেই একের পর এক নগর জয় করতে শুরু করলেন আলেকজান্ডার। এসব নগর থেকে সংগ্রহ করতে থাকলেন বিপুল পরিমাণ সৈন্য। এদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন তার বাহিনীতে। 

বিভিন্ন নগর জয় করতে করতে আলেকজান্ডার এলেন গ্র্যানিকাস নদীর ধারে। এখানে তার সাথে প্রথম মোকাবেলা হয় পারস্যের প্রাদেশিক শাসকের সাথে। আলেকজান্ডার তখন বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। তার বিজয়রথ থামাতে ব্যর্থ হন পারস্যের প্রাদেশিক শাসকেরা। গ্যানিকাস নদীর তীরের যুদ্ধই ছিল আলেকজান্ডারের জন্য প্রথম সত্যিকারের যুদ্ধ, গ্রিসের বাইরে যুদ্ধ। কারণ এই যুদ্ধ ছিল ভিনদেশী ও ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আলেকজান্ডারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধ জয় দিয়েই আলেকজান্ডার এশিয়া জয় শুরু করলেন। আলেকজান্ডারের বিপক্ষে ছিল প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য। ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত বাহিনীকে আলেকজান্ডার হারিয়ে দিলেন মাত্র ১১০ জন মেসিডোনিয়ান সৈন্যকে সাথে নিয়ে। পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার দুঃসাহস তখন কোনো গ্রিসের অধিপতি দেখাতেন না। পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর আগে আলেকজান্ডারের এক সেনাপতি তার সাথে তর্ক শুরু করে দিয়েছিলেন। সত্যিকার ভাবেই পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল এক ধরনের জুয়াখেলার মতো। এবং এ ধরনের জুয়াখেলা কেবল কোনো পাগল অধিপতির পক্ষেই সম্ভব। আলেকজান্ডার তার সেনাপতির কথা পাত্তাই দিলেন না। কারণ তিনিও তখন বলতে গেলে একরকম পাগলই ছিলেন। রাজ্য জয়ের পাগল। রাজ্য জয়ের নেশা তার চোখে মুখে। তাকে ঠেকিয়ে রাখা তখন অসম্ভব। এবং আলেকজান্ডার খেয়াল করে দেখলেন, তার বাহিনীর সাধারন সৈনিকদের মধ্যেই আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের কোনো কমতি ছিল না। বরং তারা লড়াই করার জন্য টগবগ করে ফুটছিল। এসময় যদি লড়াই না করে ফিরে যান, তাহলে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আলেকজান্ডার ভালো করেই জানেন, যে বিশাল সৈন্যবাহিনীর অধিপতি তিনি হয়েছেন, তাদের নিয়ে দেশে ফিরে গেলে সৈনিকরা বেকার হয়ে পড়বে। তারা হতাশ হয়ে যাবে। আর এই হতাশা থেকেই শুরু হবে নানান ষড়যন্ত্র। সৈনিকদের যতখানি সম্ভব ব্যস্ত রাখার পক্ষেই ছিলেন তিনি। তার সাথে অধিকাংশ সেনাপতিও মত দিলেন। আলেকজান্ডারের এই সিদ্ধান্ত যে কতখানি বাস্তব সম্মত এবং কূটনৈতিকজ্ঞান সম্পন্ন, তা তার পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। 

এ্যানিসাস নদীর তীরের যুদ্ধে জয়লাভ করলেন আলেকজান্ডার। এবার এশিয়া মাইনর অঞ্চলের দিকে চললেন তিনি। আলেকজান্ডার যখন এ্যানিসাসের তীরে যুদ্ধ করছিলেন, ওদিকে গর্ডিয়ামে তখন অভিযানে গিয়েছেন জেনারেল পারমেনিয়ন। গর্ডিয়াম ছিল গ্যালাটিয়ার একটি শহর আর ফ্রিজিয়ানের প্রাচীন রাজধানী। এই গর্ডিয়াম শহরে প্রবেশ পথেই একটি মালটানা গাড়ি বাঁধা থাকত একটি থামের সাথে। মালটানা গাড়িটা যেমন সাধারন, তেমনি সাধারন ছিল সেই থামটা। তবু সেই মালটানা গাড়ি আর থামটা ছিল বিখ্যাত। এটার কথা দুনিয়ার প্রায় সবাই তখন জানতো। মালটানা গাড়িটা একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল থামের সাথে। সেই দড়ির বাঁধনটা ছিল খুবই জটিল। এতই জটিল যে, এটা কারো পক্ষে খোলা সম্ভব ছিল না। অনেকেই চেষ্টা করেছিল ওই বাঁধন খুলতে। কিন্তু কেউ পারেনি। আর অনেকেই ওই বাঁধন খোলার চেষ্টা করারও কারণ ছিল। তবে সেনাপতিরাই ওই বাঁধন খোলার চেষ্টা করতেন বেশি। কারণ তখন কিংবদন্তি ছিল, যে ওই জটিল বাঁধন খুলতে পারবেন, তিনি এশিয়া জয় করতে পারবেন।

এই রূপকথার বাঁধন নিয়ে কৌতূহল সবার মধ্যেই। কৌতূহল ছিল আলেকজান্ডারের সাথে আসা সেনাপতিদের মধ্যেও। সাধারন সৈনিকরা তো কৌতূহলে ফেটে পড়ছিল। সবাই চেষ্টা করতে চায়। সবাই এশিয়া জয় করতে চায়। সবার আগে ওই রহস্যময় বাঁধনের দিকে এগিয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। খুলতে চেষ্টা করলেন বাঁধনটি। যেভাবেই হোক, এই শহর তাকে জয় করতেই হবে। কারণ এশিয়া জয় করতে হলে এই শহর জয় না করে উপায় নেই। তাছাড়া তিনি এর আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন এশিয়া জয় করেই তবে মেসিডোনে ফিরবেন। আর এই বাঁধন না খুলে কোনোভাবেই গর্ডিয়াম ছেড়ে যাবেন না।

একবার, দুবার, তিনবার… অনেকবার চেষ্টা করলেন আলেকজান্ডার। নাহ! বাঁধন খুলতে পারছেন না। তাহলে কি তিনি এশিয়া জয় করতে পারবেন?

বন্ধু হেফাস্টিয়ন তার পাশেই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। আলেকজান্ডার বললেন, তুমি চেষ্টা করে দেখবে নাকি হেফাস্টিয়ন?

হেফাস্টিয়ন বললেন, যেখানে মহান আলেকজান্ডার ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে আমার চেষ্টা করাটা ধৃষ্টতা নয় কি? 

আলেকজান্ডার বললেন, এখন হেঁয়ালির সময় নয় হেফাস্টিয়ন। আমার বাহিনীর অনেকেই চেষ্টা করেছে। অনেকই চেষ্টা করার অপেক্ষায় আছে। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো। 

আলেকজান্ডারের কথা মতো এগিয়ে গেলেন হেফাস্টিয়ন। অনেকবার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন তিনিও।

এর মধ্যেই একটা জটলা তৈরি হয়ে গেল মালটানা গাড়িটাকে ঘিরে। আলেকজান্ডারের বাহিনীর অনেক সেনাপতি চেষ্টা করলেন। কেউ পারলেন না। আলেকজান্ডারের বাহিনীর সাধারন কিছু সৈনিকও চেষ্টা করতে চাইলেন। আলেকজান্ডার কাউকেই হতাশ করলেন না। তিনি সবাইকে চেষ্টা করতে বললেন। যারাই চেষ্টা করার সুযোগ চেয়েছেন, আলেকজান্ডার তাদেরকেই সুযোগ দিলেন। কিন্তু সবাইকে সুযোগ দিয়েও লাভ হলো না। সবাই ব্যর্থ হলেন। তাহলে কি সত্যিকার রূপকথার বাঁধন এটা! 

আলেকজান্ডার ভাবলেন। ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু ভেবেও কিছু করতে পারলেন না। মালটানা গাড়িটার দিকে তাকালেন। ওটার চারপাশের জটলাটা আর নেই। বাঁধনটার চারপাশে আর কেউ নেই। চেষ্টা করে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে সবাই। আবারও বাঁধনটার কাছে গেলেন তিনি। ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করলেন বাঁধনটা। বাঁধনটা সত্যিই বেশ রহস্যময় । একেবারে আঁটোসাটো হয়ে বসে আছে। কোথাও এতটুকু ফাঁকা নেই। যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে, সে দড়ির মাথাও দেখা যাচ্ছে না। আবারও চেষ্টা করলেন আলেকজান্ডার। এবারও ব্যর্থ হলেন আলেকজান্ডার। বাঁধনটার দিকে তাকিয়ে আবারও কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। এবার অন্য কিছু ভাবছেন। ভাবছেন, এসময় যদি তার গুরু অ্যারিস্টটল থাকতেন, তাহলে কী করতেন তিনি? তখনই মনে হলো সমস্যার একটা সমাধান পেয়ে গেছেন তিনি। আর তখনই তার মনে হলো, এটা স্রেফ একটা অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। এই অপপ্রচার দিয়ে মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আলেকজান্ডারের কাছে মনে হয়েছে এটা খুবই দুর্বল একটা অপপ্রচার।

চিৎকার করে ওঠলেন আলেকজান্ডার, তোমরা সবাই দেখে যাও, এটা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সবাইকে বোকা বানিয়ে রাখা হয়েছে। সবাইকে বোকা বানিয়ে কতদিন রাখতে পারবে ওরা? 

আলেকজান্ডারের চিৎকার শুনে আবারও অনেকে জড় হলেন মালটানা গাড়ির চারপাশে। সবাই দেখতে চাইলেন আলেকজান্ডার কী করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলেকজান্ডার তার খাপ থেকে তরবারি বের করলেন। তারপর কেটে ফেললেন রূপকথার বাঁধন। মিটিয়ে ফেললেন রূপকথার বাঁধন রহস্য। এই রহস্যভেদকেই গ্রিক ভাষায় বলা হয় লুইন। যার অর্থ বাঁধনছেড়া। 

এর আরো একটা অর্থ দাঁড়ায় বিচ্ছিন্ন করা বা সমাধান করা। 

আলেকজান্ডারের এই অভিনব রহস্যভেদে অবাক হয়ে গেল উপস্থিত সকলেই। তারা কেউ এভাবে চিন্তাও করেনি। কেউ ভাবেনি এভাবে অনেকদিনের কোনো সমস্যার সমাধান করা যাবে। আর তখন থেকেই একটি প্রবাদ চালু হয়ে গেল— কাট দ্য গর্ডিয়ান নট। এর সরল অর্থ হলো কোনো জটিল সমস্যার সহজ সমাধান। 

জটিল একটি সমস্যার তো সমাধান হলো। তাহলে কি এই সমাধানের মাধ্যমে প্রমাণ হবে যে আলেকজান্ডার এশিয়া জয় করতে পারবেন? আলেকজান্ডারের এমন সমস্যাসমাধানে তার বাহিনীর মনোবল বেড়ে গেল কয়েকগুণ। আর এর পরেই আলেকজান্ডার ও তার বাহিনী মুখোমুখি হলেন পারস্য সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর। এতদিন তো কেবল প্রাদেশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এবার সত্যিকারের একটা বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকলেন আলেকজান্ডার।