সোনার গাছ হীরের ফুল

সোনার গাছ হীরের ফুল

নব রূপকথা

অচিনপুরের রাজকুমারের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার পূর্বরাত্রে ঘুম হয় নি। অবশেষে শেষরাত্রে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সে তো নিদ্রা নয়, সুষুপ্তি। এই সুষুপ্ত অবস্থায় তাঁর সুমুখে একটি জ্যোতির্ময় দিব্যপুরুষ আবির্ভূত হলেন। তিনি অল্পক্ষণ পরেই জলদগম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “সে দেশ কখনো দেখেছ, যে দেশে সোনার গাছে হীরের ফুল ফোটে?”

রাজকুমার বললেন, “না।”

“দেখতে চাও?”

“হাঁ।”

“আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।”

“কত দূরে সে দেশ?”

“সহস্ৰ যোজন।”

“যেতে কতদিন লাগবে?”

“চোখের পলক না পড়তে। তুমি যদি এখনই পাত্র-মিত্র নিয়ে যাত্রারম্ভ কর, তা হলে এ দীর্ঘ পথ আমি তোমাকে নিয়ে ভোর হতে না হতে উৎরে যাব।”

“কি উপায়ে?”

“তুমি আর তোমার বন্ধুরা জামাজোড়া পরে হাতিয়ার নিয়ে নিজ নিজ ঘোড়ায় সওয়ার হও; আমি সে-সব ঘোড়াকে পক্ষিরাজ করে দেব; অর্থাৎ তাদের পাখা বেরোবে, আর তারা উড়ে চলে যাবে।”

রাজকুমার দৌবারিককে ডেকে বললেন, “এখনই যাও, মন্ত্রীপুত্র সওদাগরের পুত্র ও কোটালের পুত্রকে নিজ নিজ ঘোড়ায় চড়ে, জামাজোড়া পরে, হাতিয়ার নিয়ে এখানে চলে আসতে বলো। আমিও রণবেশ ধারণ করছি।”

অল্পক্ষণ পরেই রাজকুমার নীচে নেমে এলেন। এসে দেখেন যে মন্ত্রীপুত্র সওদাগরপুত্র আর কোটালের পুত্র সব সাজসজ্জা করে এসে উপস্থিত হয়েছেন। রাজপুত্রের কান হীরের কুণ্ডল, মাথায় হীরকখচিত উষ্ণীষ, গলায় হীরের কণ্ঠী, পরনে কিংখাবের বেশ, পায়ে রত্নখচিত নাগরা। আর তাঁর ঘোড়ার রঙ পিঙ্গল। মন্ত্রীপুত্রের কানে মুক্তোর কুণ্ডল, মাথায় ধবধবে সাদা পাগড়ি, গলায় মোতির মালা, পরনে শ্বেতাম্বর, পায়ে শ্বেত মৃগচর্মের পাদুকা। আর তাঁর ঘোড়ার রঙ রুপোর মতো।

সওদাগরের পুত্রের কানে সোনার কুণ্ডল, মাথায় জরির পাগড়ি, গলায় সোনার কণ্ঠী, পরনে পীতাম্বর, পায়ে সেই রঙের বিনামা। আর তাঁর ঘোড়ার রঙ তামার মতো। কোটালের পুত্রের কানে পলার কুণ্ডল, মাথায় লাল পাগড়ি, গলায় পলার কণ্ঠী, পরনে রক্তাম্বর, পায়ে গণ্ডারের চামড়ার জুতা। আর তাঁর ঘোড়ার রঙ লোহার মতো।

যাত্রারম্ভ

রাজপুত্র আসবামাত্র একটি দৈববাণী হল—”এখন তোমরা ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা আরম্ভ করো।”

রাজপুত্র তাঁর ঘোড়ার সোনার রেকাবে পা দিয়ে, মন্ত্রীপুত্র রুপোর রেকাবে, সওদাগরের পুত্র তামার রেকাবে আর কোটালের পুত্র লোহার রেকাবে পা দিয়ে ঘোড়ায় চড়লেন। অমনি ঘোড়া চারটি আকাশদেশে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেশকে আমরা কাল দিয়ে মাপি। যেখানে কাল বলে কোনো জিনিস নেই, সেখানে কত পথ অতিক্রম তাঁরা করলেন তা বলতে পারি নে। বোধ হয় সাত-সমুদ্র তেরো- নদী, নানা মরুকান্তার ও পর্বত ডিঙিয়ে তাঁরা প্রত্যুষে একটি রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই সময় আর-একটি দৈববাণী হল—”এইখানেই তোমরা আজকের দিনটা বিশ্রাম করো। তোমাদের মধ্যে যিনি এখানে সোনার গাছ ও হীরের ফুলের সাক্ষাৎ পাবেন, তিনি এখানে থেকে যাবেন। বাদবাকি সকলে শেষরাত্রে নিজের নিজের ঘোড়াকে স্মরণ করলে তারা তখনই আবির্ভূত হবে, ও নিজের নিজের সওয়ার নিয়ে দেশান্তরে চলে যাবে।”

এই আকাশবাণী শুনে তাঁরা সব ঘোড়া থেকে নেবে পড়লেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ঘোড়াও অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিষ্ণুপুর

বিষ্ণুপুর চার দিকে মালঞ্চে ঘেরা। সে মালঞ্চের কি বাহার! অসংখ্য ফুল কাতারে কাতারে ফুটে রয়েছে। সে-সব ফুলের রঙ হয় সোনার, নয় পিতলের মতো, যথা—চাঁপা সূর্যমুখী স্বর্ণবর্ণ বড়ো বড়ো গ্যাদা হলদে গোলাপ কল্কে ফুল—আর কত ফুলের নাম করব! মধ্যে মধ্যে ফলের গাছও আছে—কলা কমলালেবু স্বর্ণবর্ণ আম; সব সাজানো আর গোছানো। বিষ্ণুপুরে প্রবেশ করে তাঁরা দেখলেন, রাস্তাগুলি প্রকাণ্ড চওড়া এবং তাতে একটুকুও ধুলো নেই। রাস্তায় অসংখ্য লোক; সকলের পরনে পীতাম্বর। লোকের রঙ পীতাভ, নাক-চোখ অতি সুন্দর, কপালে একটি করে হলদে চন্দনের ফোঁটা, আর স্ত্রীলোকের নাকে রসকলি। স্ত্রী-পুরুষের বেশ একই ধরনের; শুধু স্ত্রীলোকের শাড়িতে জরির পাড়।

রাস্তার দু-ধারে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভোজনালয়। বিষ্ণুপুরের লোকের বাড়িতে রন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই; সকলেই এই-সব ভোজনালয়েই আহার করেন। বিষ্ণুপুরের লোক অতি অতিথিবৎসল; এই চারটি নতুন আগন্তুককে দেখে তারা তাদের একটি ভোজনালয়ে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেল। সেখানে স্ত্রী-পুরুষ সব একত্রে আহার করছে। খাদ্যদ্রব্য সব নিরামিষ এবং অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ স্ফটিকের পাত্রে রয়েছে পানীয়। এ পানীয় জল নয়, সুরা—স্ত্রীলোকের জন্য হলদে এবং পুরুষের জন্য সবুজ রঙের। এ পোখরাজ— গলানো পান্না-গলানো সুরা পান করে সকলেরই গোলাপী নেশা হয়। পীত সুরায় নেশা কম হয়, এবং হরিত সুরায় বেশি। এর ফলে সকলেই ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, মেয়েদের রূপের লজ্জৎ বাড়ে, এবং পুরুষরা হয় বাচাল।

বিষ্ণুপুরে পর্দা নেই। স্ত্রী-পুরুষ সকলেই সমান স্বাধীন ও সমান শিক্ষিত। দু-দলেরই প্রবৃত্তিমার্গ সমান উন্মুক্ত। ভোজনালয়ে সওদাগরের পুত্রের পাশে উপবিষ্ট একটি তরুণীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন শুরু হল। সওদাগরপুত্র এ দেশের ঐশ্বর্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এত ধন তোমরা সংগ্রহ করলে কোত্থেকে?”

“বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।”

“আমিও বণিকপুত্র।”

“তুমি ইচ্ছা করলেই এই বণিক-সমাজের অন্তর্ভূত হতে পারো।”

“কি করে?”

“আমাকে বিবাহ করে। আমরা স্ত্রী-পুরুষ এ দেশে সকলেই সমান ধনী।”

“বিবাহ কি করে করতে হয়?”

“অতি সহজে, শুধু মালা বদল ক’রে।”

“আমি বিষ্ণুপুর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় তোমার প্রস্তাবের উত্তর দেব।”

আহারান্তে সওদাগরপুত্র সেই মেয়েটির গাড়িতে শহর প্রদক্ষিণ করতে বেরোলেন। সে গাড়ি মানুষে কি ঘোড়ায় টানে না, কলে চলে। তার পর তাঁরা দুজনে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখলেন, সেখানে অসংখ্য অর্ণবপোত রয়েছে; কোনোটি থেকে মাল নামাচ্ছে, কোনোটিতে তুলছে। রমণী বললেন, “এই আমদানি-রপ্তানিই হচ্ছে আমাদের ঐশ্বর্যের মূল।”

তার পর সূর্য অস্তে যাবার পূর্বে তাঁরা বিষ্ণুমন্দিরে গেলেন। সে মন্দির অপূর্ব সুন্দর ও বিচিত্র কারুকার্যমণ্ডিত। সেখা ন গিয়ে সওদাগরপুত্র দেখলেন যে, মেয়েরা সব কীর্তন গাইছেন। এবং মধ্যে মধ্যে এব? সুরাপান করে নৃত্য করছেন। সওদাগরপুত্রের সঙ্গিনীটি সব-চাইতে ভালো গাইয়ে ও ফালো নর্তকী। আর সকলেই ভক্তিরসে গদগদ। এই ভক্তিরসই নাকি তাদের সভ্যতার যন্ত্রার্থ উৎস।

এই-সব দেখেশুনে সওদাগরপুত্র মনস্থির করলেন যে, তিনি এই রমণীটিকে বিবাহ করবেন এবং বিষ্ণুপুরে থেকে যাবেন। সূর্য অস্ত যাবার পরেই তিনি এই মেয়েটির সঙ্গে মালা-বদল করলেন। তার পর তাঁর বন্ধুদে। গিয়ে বললেন যে, “আমি এইখানেই সোনার গাছ ও হীরের ফুল দেখেছি। আমি আর-কোথায়ও যাব না, এইখানেই থাকব।”

রাজপুত্র বললেন, “বেশ, তবে তুমি থাকো, আমরা চললুম।”

মন্ত্রীর পুত্রও বললেন তাই। কোটালের পুত্র বললেন, “আমি কিন্তু আর একদণ্ডও এখানে থাকতে চাই নে। কারণ এখানে সভ্যতার নানা উপকরণ থাকলেও অস্ত্রশস্ত্র নেই এবং এদের ভাষাতেও অস্ত্রশস্ত্রের কোনো নাম নেই।”

সেইদিন শেষ রাত্রে রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র ও কোটালের পুত্র তাঁদের ঘোড়াদের স্মরণ করলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে তারা এসে আবির্ভূত হল। তাঁরা তিনজন নিজ নিজ ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠলেন, আর তৎক্ষণাৎ আকাশদেশে অদৃশ্য হলেন।

কালীপুর

ভোর হয় হয় এমন সময় তাঁরা একটি নূতন নগরের সাক্ষাৎ পেয়ে ভয় খেয়ে গেলেন। সেখানে উষার চেহারা রক্তসন্ধ্যার মতো। নগরটি দোতলার সমান উঁচু লাল পাথরের প্রাচীরে ঘেরা। আর তার নীচে দিয়ে রক্তগঙ্গার মতো নদী বয়ে যাচ্ছে। রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র ও কোটালের পুত্র ঘোড়া থেকে অবতরণ করে দেখেন, সেখানে সব ফুলই লালে লাল। কৃষ্ণচূড়া, বলরামচূড়া এবং পলাশের গাছে যেন আগুন ধরেছে। আর অশোক, শিমুল ও রাঙাজবা অসংখ্য ফুটে রয়েছে। আম জাম প্রভৃতি ফলের গাছও অনেক আছে, কিন্তু তাতে ফল ধরে শুধু মাকাল—লাল মাটির গুণে কিম্বা দোষে।

রাস্তায় অসংখ্য লোক যাতায়াত করছে। সকলেরই পরনে মালকোঁচামারা রক্তাম্বর, গায়ে সেই রঙের একটি ফতুয়া, কোমরে লোহার শিকলের কোমরবন্ধ— তার এক পাশে একটি মদের বোতল ঝোলানো, অপর পাশে একটি একহাত-প্রমাণ ছোরা। মাথা সকলেরই ন্যাড়া। তাদের মুখের রঙ ইঁটের মতো, মাথারও তদ্রূপ। সকলেই প্রকাণ্ড পুরুষ, যেমন স্থুলকায় তেমনি বলিষ্ঠ। এরা নাকি সকলেই সৈনিক। অল্পক্ষণের মধ্যে তিনটি সৈনিক এসে রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র ও কোটালপুত্রকে গ্রেপ্তার করলে এবং বললে, “এ নগরে বিনা অনুমতিতে বিদেশী প্রবেশ করলে তার শাস্তি হচ্ছে প্রাণদণ্ড। চলো, তোমাদের সেনাপতির কাছে নিয়ে যাই।”

সেনাপতির কাছে তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোমরা কোন্ দেশ থেকে কি উপায়ে এখানে এলে?”

“আমরা আকাশ থেকে পড়েছি। এসেছি সব পক্ষিরাজ ঘোড়ায়।”

“সে ঘোড়া কোথায়?”

“আকাশে চরতে গেছে।

“কখন আসবে?”

“আজ রাত্রে। যদি না আসে, তা হলে আমাদের প্রাণদণ্ড দেবেন।”

“আচ্ছা। আজকের দিন তোমরা নজরবন্দী থাকবে। এবং আমাদের সৈনিকরাই তোমাদের খাবার ও থাকবার সব বন্দোবস্ত করে দেবে।”

তার পর সৈনিকরা তাঁদের ভোজনালয়ে নিয়ে গেল। সে-সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘর। দু পাশের কাঠের বেঞ্চি পাতা, মধ্যে কাঠের টেবিল। কালীপুরে পর্দা আছে। কুলবধূরা সব পর্দানশীন। কিন্তু এ ভোজনালয়ে খিদমতগার, খানসামা সবই স্ত্রীলোক। তারা নাকি সবই গণিকা। তারাও পুরুষদের মতোই দীর্ঘাকৃতি এবং বলিষ্ঠ। সকলেরই পরনে মালকোঁচামারা রক্তাম্বর। পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের বেশের প্রভেদ এই মাত্র যে, স্ত্রীলোকদের মাথায় বাকিাটা চুল, আর কোমরে একখানি করে রাম-দা ঝোলানো।

দেওয়ালের পাশে সব বড়ো বড়ো মদের পিপের সারি। নীচের একটি চাবি খুললেই সামনের নলমুখ দিয়ে সুরা পড়ে। বলা বাহুল্য, যারা ভোজন করছে তারা সকলেই পুরুষ। এবং বড়ো বড়ো গালার রঙ করা, পেট-মোটা গলা-সরু কাঠের ঘটিতে সেই মদ্য পান করছে। সে মদ্যের রঙ পাটকেলে, আর তার অর্ধেক ফেনা, অর্ধেক তরল। সেই ফেনাসুদ্ধ সুরা গলাধঃকরণ করতে হয়, ফেনা যায় মাথায়, এবং তরলাংশ যায় পেটে। আহার্যদ্রব্য পরিমাণে প্রচুর। মাছ মাংস নিরামিষ সবই আছে। মাছের কোপ্তা এক-একটি গোলার মতো। মাংসের দোলমা এক-একটি কাঁকুড়ের মতো। কালীপুরের লোক তা অনায়াসে গলাধঃকরণ করে। গলায় যদি আটকায় তো এক ঘটি সফেন সুরা দিয়ে তা নাবিয়ে দেয়। মন্ত্রীপুত্র খালি নিরামিষ আহার করলেন। রাজপুত্র ও কোটালের পুত্র মাছ মাংস কিঞ্চিৎ আহার করলেন।

তার পর তিন বন্ধুতে ব্যায়ামশালা দেখতে গেলেন। গিয়ে দেখেন যে, হঠযোগ ও ডনমুগুর কুস্তি সবরকমের ব্যায়াম একসঙ্গে করা হয়। তার পর তাঁরা এখানকার বিদ্যালয় দেখতে গেলেন। সেখানে সব মুণ্ডিত মস্তক এবং শিখাধারী অধ্যাপক যুদ্ধবিদ্যার নানারকম কলাকৌশল শিক্ষা দিচ্ছেন।

সন্ধ্যার সময় কোটালের পুত্র তাঁর বন্ধুদের বললেন, “আমি এইখানেই থেকে যাই। সোনার গাছ, হীরের ফুল দেখবার কোনো লোভ আমার নেই। হীরের ফুলের কোনো গন্ধ নেই। আমি এখানে কিছুদিন থাকবার অনুমতি সেনাপতির কাছে পেয়েছি। এই গণিকাদের মধ্যে কাউকে বিবাহ করলেই বিদেশী স্বদেশী হিসাবে গণ্য হয়। বিবাহপ্রথাও অতি সহজ। মেয়ের লোহার কণ্ঠী, ভাষায় যাকে বলে হাঁসুলি, সেইটি বরের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়। আর বর একটি হাঁসুলি এনে কনের গলায় পরিয়ে দেয়। সেই হাঁসুলি খুলে ফেললেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়।

কোটালের পুত্র এইরূপ বিবাহ করে সেখানেই রয়ে গেলেন।

শেষরাত্রে মন্ত্রীপুত্র ও রাজপুত্র তাঁদের পক্ষিরাজ ঘোড়াকে স্মরণ করলেন এবং তাতে চড়ে আর-এক দেশে আকাশপথে চলে গেলেন।

ব্রহ্মপুর

পরদিন ঊষাকালে দুই বন্ধুতে এক স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন। সে স্থানে উষার রঙ ঈষৎ রক্তিমাভ। সে স্থান নগর নয়, পল্লী নয়, একটি অপূর্ব আশ্রম। বাড়িঘরদোর যা দেখতে পেলেন, তা সবই পর্ণকুটির। স্ত্রী-পুরুষের রূপ অলৌকিক। স্ত্রী মাত্রেই তুষারগৌরী এবং পুরুষরা দীর্ঘকেশ ও গুল্মশ্মশ্রুধারী। এ আশ্রমে ফল-ফুলের বৃক্ষসকল একরকম স্তিমিত। বাতাস যা বয় তা অতি মৃদু। এখানে গাছপালা লতাপাতা ফুলফলে কোনো বর্ণবিচার নেই। সব রঙেরই সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু সে-সব রঙ নিতান্ত ফিকে ও সাদাঘেঁষা। শান্তি এখানে অটুট। কারো কোনোরকম কর্ম নেই। এঁরা সকলে আহার করেন ফল ও মূল, বিশেষত আঙুর; তাতে তাঁদের ক্ষুধাতৃষ্ণা দুইই দূর হয়। সকলেই সংস্কৃতভাষী।

এ আশ্রমে প্রকৃতি বোবা। চার পাশে সবই নীরব ও নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে যে ক্ষীণ অস্ফুট নিনাদ শোনা যায় তার থেকে অনুমান করা যায় যে, গাছপাতার গায়ে অতি মুদ্‌মন্দ বাতাস স্পর্শ করছে। সে প্রকৃতি যেন সমাধিস্থ। পূর্বেই বলেছি যে, এখানকার স্ত্রী-পুরুষের কোনো কর্ম নেই—একমাত্র সকালসন্ধ্যা বেদমন্ত্র উচ্চারণ আর মধ্যে মধ্যে সামগান করা ছাড়া।

এখানে ইস্কুল আছে। সেখানে বালকবালিকাদের বেদমন্ত্র মুখস্থ করানো হয়। আর অবসর সময়ে বেদমন্ত্রের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। এই বৈদিক ঋষিদের কারো সঙ্গে কারো মতে মেলে না। সুতরাং এ বিষয়ে আলোচনা খুব দীর্ঘ হয়। তাই সেখানে কাজ নেই, কিন্তু কথা আছে।

মন্ত্রীপুত্র এ আশ্রমে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনিও কিছু বৈদিক শাস্ত্র চর্চা করেছিলেন। তিনি বললেন যে, তিনি এইখানেই থেকে বেদ অভ্যাস করবেন। এবং রাজপুত্রকে বললেন, “সোনার গাছ আর হীরের ফুল যদি কোথাও থাকে তো এখানেই আছে। আমি যখন বেদাভ্যাস করতে করতে দিব্যদৃষ্টি লাভ করব, তখন তা দেখতে পাব। এই ফলমূলাহারী বল্কলধারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে থাকাই আমি শ্রেয় মনে করি।”

রাজপুত্র বললেন, “বেশ। আমি কিন্তু আজ শেষরাত্রেই এ আশ্রম ত্যাগ করব। আমি স্বকর্ণে দৈববাণী শুনেছি। দিব্যপুরুষ কখনোই মিথ্যা কথা বলেন না। সম্ভবত তোমরা তিনজনে আমার সঙ্গে ছিলে বলেই দিব্যপুরুষ আমাদের এ অলৌকিক তরু দেখান নি। আমার বিশ্বাস আমি একা গেলেই, যার সন্ধানে আমরা বেরিয়েছি তার সাক্ষাৎ পাব।”

অনামপুর

রাজপুত্র সেইদিন শেষরাত্রে ব্রহ্মপুর ত্যাগ করে একাকী হয়মারুহ্য জগাম শূন্য মার্গং। তাঁর কোনো সঙ্গী না থাকায়, অর্থাৎ কথা কইবার কোনো লোক না থাকায়, তিনি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলেন। শেষটা ঘুমিয়ে পড়লেন।

হঠাৎ জেগে উঠে যেখানে উপস্থিত হলেন সে স্থানের কোনো নাম নেই, কেননা তার কোনো রূপ নেই। সেখানে চার পাশে যা আছে, তা হচ্ছে নিরেট অন্ধকার। এ স্থানকে বলা যায় অনামপুর। কখন গিয়ে সেখানে তিনি পৌঁছলেন তা বলতে পারি নে। কারণ, সেখানে কাল নেই, কাল মাপবার কোনো যন্ত্রপাতিও নেই। কোনো জিনিসের কোনো গতিও নেই। অতএব, পক্ষিরাজ ঘোড়া সেখানে থেমে গেল।

এমন সময়, সেই জ্যোতির্ময় দিব্যপুরুষ রাজপুত্রের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “সে গাছ এখানে নেই; কোথায় আছে তা তোমাকে পরে বলব।” এই বলে তিনি অন্তর্ধান হলেন।

ঘোড়া অমনি মুখ ফিরিয়ে উলটো দিকে চলতে আরম্ভ করলে। অন্ধকারের রাজ্য ছাড়িয়ে রাজপুত্র যেখানে গেলেন সে কুয়াশার রাজ্য। সে কুয়াশা শুভ্র, হালকা ও মলমলের মতো পাতলা। রাজপুত্রের হঠাৎ চোখে পড়ল যে, মন্ত্রীর পুত্র এই কুয়াশার দেশ ভেদ করে আসছেন। তাঁর মুখ অত্যন্ত বিবর্ণ ও বিষণ্ণ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সোনার গাছ, হীরের ফুলের সাক্ষাৎ পেয়েছ?”

“না। কিন্তু কোথায় আছে তা দিব্যপুরুষ পরে জানাবেন বলেছেন।”

“আমি মনতান্ত্রিক ব্রহ্মপুরে থাকতে পারলুম না। সে পুরে সকলে প্রাণকে দমন ক’রে মনকে ঊর্ধ্বলোকে তোলবার চেষ্টা করছেন, একমাত্র মন্ত্রের সাহায্যে। ফলে, তাঁদের মনও সব প্রাণহীন হয়ে পড়ছে।”

তার পর তাঁরা দুজনে একটি দেশে এলেন, যেখানে আকাশে রক্তসন্ধ্যা হয়েছে। সেখানে রক্তাম্বরধারী কোটালের পুত্রের সাক্ষাৎ তাঁরা পেলেন। তিনি বললেন, “আমি, রণতান্ত্রিক কালীপুরে আর থাকতে পারলুম না। সেখানে লোকের একমাত্র উদ্দেশ্য নরহত্যা। তার ফলে রক্তপাত যে কি নিষ্ঠুর আর কি ভীষণ তা অবর্ণনীয়। কালীপুরের পুরদেবতা হচ্ছেন ছিন্নমস্তা।”

তার খানিকক্ষণ পর যেখানে আকাশ পাণ্ডু, সেখানে সওদাগরের পুত্র তাঁদের সঙ্গে এসে জুটলেন। তিনি বললেন, “বিষ্ণুপুরের ধনতান্ত্রিক রাজ্যে মোরালিটি নেই। প্রতি স্ত্রীলোক বহুবিবাহ করে এবং প্রতি পুরুষ দরিদ্রদের উপর চোরা অত্যাচার করে। অথচ তাদের শ্রমেই এঁরা ধনী হয়েছেন। তাই আমি চলে এলুম।”

রাজপুত্র সব শুনে বললেন, “এ-সব দেশের লোকের হৃদয় নেই। দিব্যপুরুষ বলেছেন যে, সোনার গাছ হীরের ফুলের মূল মানুষের হৃদয়ে। এবং যে-সব দেশে তোমরা মানবসমাজের বিকৃতরূপ দেখে এলে, সেই-সব বিকার থেকে মুক্ত হলেই তোমরা নিজ নিজ হৃদয় থেকেই সোনার গাছে হীরের ফুল গড়ে তুলতে পারবে। তখন এই অচিনপুর শিবপুরী হয়ে উঠবে।”

এই কথা বলবার পরে তাঁরা চারজনই অচিনপুরে নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করলেন। ভোর হতে না হতেই রাজপুত্র তাকিয়ে দেখেন যে, উষার আলোকে গাছপালা সব স্বর্ণবর্ণ হয়েছে, এবং তাতে বেল জুঁই মল্লিকা প্রভৃতি সাদা ফুল জ্বলজ্বল করছে। তখন তিনি বুঝলেন যে, এতক্ষণ তিনি শুধু স্বপ্ন দেখছিলেন।

কার্তিক ১৩৪৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *