চাহার দরবেশ

চাহার দরবেশ

বি. এন. আর. যখন প্রথম খোলে, তার কিছু দিন পরেই আমি উক্তপথে C.P.র কোনা শহরে যাত্রা করি।

রেলগাড়ি আমি প্রথম দেখি ও তাতে চড়ি পাঁচ বৎসর বয়েসে। যে গাড়ি গোরুতে টানে না, ঘোড়ায় টানে না, আপনি চলে— সে গাড়ি দেখে আমি আনন্দে অধীর হই নি।

তার পর রেলগাড়িতে অসংখ্য বার যাতায়াত করেছি। কিন্তু এই C.P. যাত্রার পথে একটু নতুনত্ব ছিল। সেই কথাই আজ বলব।

কলকাতা থেকে আসানসোল যাই—আর বোধ হয় সেখানেই ই. আই. আর. এর গাড়ি ছেড়ে বি. এন. আর.এর গাড়িতে চড়ি।

রাত্তিরে কোনো হোটেলে এসে ডিনার খেতে পাব—আশা করি। আমি ভোজনবিলাসী নই। চব্বিশ ঘণ্টা উপবাস করলেও আমার নাড়ী ছেড়ে যায় না— এমন- কি, পিত্তিও পড়ে না। তা হলেও রাত্তিরে কিছু খাওয়া আমার অভ্যাস ছিল। সেইজন্যই ডিনারের আশায় গাড়িতে বসেছিলুম।

পুরুলিয়া ছাড়বার ঘণ্টা-দুয়েক পর আমি গাড়ির চালচলন দেখে অবাক হয়ে গেলুম। গোরুর গাড়ির চাইতে সে গাড়ির চলন কিছু দ্রুত নয়। মধ্যে মধ্যে গাড়িটা পা টিপে টিপে হেঁটে যেতে আরম্ভ করলে। আমি ছিলুম সেকেণ্ড ক্লাসের যাত্রী— আর আমার সহযাত্রী ছিলেন একটি রেল-কর্মচারী। রেলের এই বিলম্বিত চাল সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন—এ দেশের মাটি Black Cotton soil বলে রেলের রাস্তা আজও consolidated হয় নি, তাই সাবধানে যেতে হয়।

গোরুর গাড়ি যদি রেলগাড়ির মতো দৌড়ায়, তা হলে তার আরোহীদের ভয় হওয়া স্বাভাবিক। অপর পক্ষে রেলগাড়ি যদি গোরুর গাড়ির মন্দগতিতে চলে, তা হলে সে গাড়ির আরোহীদেরও মন প্রসন্ন হয় না। আমি এই অচল ট্রেনে বসে বসে ঈষৎ কাতর হয়ে পড়লুম। আমার সহযাত্রীটি ছিলেন নিম্নশ্রেণীর ইংরেজ, কিন্তু কথায়বার্তায় ভদ্র। তিনিও একটি ছোটো স্টেশনে নেমে গেলেন, যেখানে তাঁর বাসস্থানে তাঁর মেম ছিল ও খানাপিনা ছিল।

তার পর সারা রাত্তির গাড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে, হাঁপাতে হাঁপাতে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে অগ্রসর হতে লাগল। প্রতি স্টেশনে এঞ্জিনের দম জিরোতে ও একপেট জল খেতে অন্তত আধঘণ্টা লাগল।

পথিমধ্যে খোঁজ করে জানলুম যে, চক্রধরপুরে অন্তত এক পেয়ালা চা পাব। তার পরদিন সকালে অর্থাৎ বেলা বারোটায় চক্রধরপুর পৌছলুম। কিন্তু সেখানেও এক পেয়ালা চা মিলল না। আমি চা- খোর নই, কিন্তু সকালে এক পেয়ালা চা না পেলে ভীষণ অসোয়াস্তি অনুভব করি।

সে যাই হোক, চক্রধরপুরে দুটি ভদ্রলোক এসে আমার গাড়িতে চড়লেন; তার ভিতর একজন যেমন বেঁটে, অন্যটি তেমনি লম্বা। বেঁটে ভদ্রলোকের গায়ে আলপাকার কোট ও জিনের পেন্টলুন, মাথায় একটি বনাতের গোলটুপি, হাতে একটি ছোটো ব্যাগ। লম্বা ভদ্রলোকের পরনে লংক্লথের চুড়িদার পায়জামা, আজানুলম্বিত গরম কোট আর মাথায় স্বরচিত পাগড়ি। লম্বা লোকটিকে দেখে প্রথমে নজরে পড়ল— তাঁর চোখ। এমন প্রকাণ্ড, এমন হাঁ-করা চোখ মানুষের মুখে ইতিপূর্বে দেখি নি। তার পর মনে হল সে-চোখ আলাপী চোখ— অর্থাৎ কথা কয়। তার পরেই প্রমাণ পেলুম ভদ্ৰলোক চোখেমুখে কথা কন—আর সে কথার স্রোত আমাদের রেলগাড়ির চাইতে দ্রুত। তিনি কামরাতে ঢুকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”

“কলকাতা।”

“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

“রায়পুর।”

“মশায়ের নাম?”

আমি আমার নাম বললুম। তিনি তা শুনে বললেন, “ ‘চৌধুরী’ যে কোন্ জাত তা জানা যায় না।”

আমি বললুম, “ব্রাহ্মণ।”

“ব্রাহ্মণেভ্যো নমঃ।”

তার পর বেঁটে ভদ্রলোকটিকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করলেন, “মশায়ের নাম?”

“পতিরাম পাঞ্জা।

“কি বললেন?”

“পাঞ্জা।”

“আমি শুনেছিলুম পাঞ্জাবী। আপনার পাঞ্জাবীর মতো চেহারাও নয়, বেশও নয়। মশায় ব্রাহ্মণ?”

“না।”

“বাঁচালেন। তিন ব্রাহ্মণে একত্র যাত্রা করা নিরাপদ নয়। মশায়ের বাড়ি কোথায়?”

“বাঁকুড়া জেলায়।”

“কি করা হয়?”

“ডাক্তারি।”

“এম. বি.?”

“না, আমি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।”

“এই বুনোর দেশে ডাক্তারি ব্যবসা চলে?”

“চলে তো যাচ্ছে।”

“ওষুধ তো আপনাদের হয় এক ফোঁটা জল, নয় তিল প্রমাণ বড়ি!”

“ওষুধের গুণ কি তার পরিমাণের উপর নির্ভর করে? “

“অবশ্য নয়। সব গুণী লোক তো তালগাছের মতো লম্বা হয় না।”

“সে যাই হোক, মশায়ের নাম কি, জিজ্ঞেস করতে পারি?”

“সরদার শরকেল।”

“বাংলা তো আপনি আমাদের মতোই বলেন “

“তার কারণ, আমিও বাঙালি।”

“আমি ভেবেছিলুম বুঝি পাঞ্জাবী, আপনার চেহারা দেখে ও বেশভূষা দেখে, তার পর আপনার নাম শুনে-”

“আমার নাম শ্রীধর সরখেল। খোট্টাদের মুখ থেকে শ্রীধর বেরোয় না, তাই ওরা সরদার বলে, আর সরখেলকে বলে শরকেল।”

“আপনার বাড়ি কোথায়?”

“বর্ধমান জেলায়, কুলীনগ্রামে।”

“মশায় ব্রাহ্মণ?”

“শুধু ব্রাহ্মণ নয়, একেবারে নৈষ্য কুলীন। ইচ্ছে করলে ৩৬৫টি বিয়ে করতে পারতুম, আর পুরো বছর ৩৬৫টি শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ খেয়ে কাটাতে পারতুম।”

“বিয়ে কটি করেছেন?”

“একটিও না। বাঁশবনে ডোম কানা।”

“কি করা হয়?”

“কিছুই নয়। আমি এখন ভবঘুরে।”

“আগে কি করতেন?”

“জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। তার অর্থ, কি যে করি নি বলা শক্ত।”

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি নে।”

“বুঝতে পারবেনও না। আমি ছিলুম পল্টনে।”

“সেপাই?”

“না। Camp-follower.”

“তাদের কাজ কি?”

“তার কোনো লেখাজোখা নেই। ক্ষেত্রে কার্যো বিধীয়তে। কখনো পাচকব্রাহ্মণ, সেপাইদের বিয়ে-শ্রাদ্ধে পৌরোহিত্য, কখনো রসদ কেনা, কখনো খাতা লেখা—ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি শিখ পল্টন আমাদের গাঁয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমার বয়স চৌদ্দ বৎসর। তাদের সঙ্গেই আমি জুটে যাই। আর কুচ করতে করতে লাহোর যাই। তারপর চল্লিশ বৎসর তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। পল্টনের একটা নেশা আছে, সেই নেশাই আমাকে পেয়ে বসেছিল। এতদিনে সে নেশা ছুটেছে।”

“আপনি নেহাৎ ছোকরা বয়সেই পল্টনে ভর্তি হলেন?”

“আমি তো ছোকরা, Camp-followerদের মধ্যে দেদার স্ত্রীলোক পর্যন্ত থাকে। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতি সুন্দরী, তারা কর্নেল সাহেবদের প্রিয়পাত্রী হয়।”

“আপনি এখন বুঝি পেনসন নিয়েছেন?”

“আমার চাকরির পেনসন নেই। চাকরি থাকতে যা রোজগার করতে পার। আর মাইনে যদিচ নামমাত্র, উপরি-পাওনা বেহিসেবী।”

“কিরকম?”

“যুদ্ধের সময় লুট, আর শান্তির সময় চুরি। হিন্দুস্থানীতে একটি কথা আছে—সরকারকে মাল, দরিয়ামে ঢাল। এ দরিয়া হচ্ছে Army, আর আমরা Camp- followerরা সেই বেহিসেবী খরচের ভাগ পাই। আমি এই খাতে দেদার রোজগার করেছি।”

“তাই আপনারা পেনসনের তোয়াক্কা রাখেন না।”

“এই ছুটো চাকরির আয়ও যেমন, ব্যয়ও তেমনি। আমরা মরণের যাত্রী, সব বেপরোয়া। ফলে, এখন আমার বিশেষ কিছু নেই। তাই এ জঙ্গলে এসেছি বুনো রাজাদের ঘাড় ভেঙে কিছু আদায় করতে পারি কি না দেখতে।”

“কি কাজ খুঁজছেন?”

“এক ডাক্তারি ছাড়া যে কাজ জোটে তাই করতে পারি। এমন-কি, গুরুগিরি পর্যন্ত। হিমালয়ে যোগ অভ্যাস করেছি।”

চক্রধরপুরেও এক পেয়ালা চা পেলুম না, কিন্তু শ্রীধরবাবুর সত্য-মিথ্যা গল্প শুনে ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে গিয়েছিলুম। শেষটায় তিনি বললেন, “আর তিন-চার ঘণ্টা বসে আঙুল চুষুণ—ঝাড়সুগড়ায় গিয়ে চা, রুটি, মাখন সব জোগাড় করে দেব। স্টেশনমাস্টার আমাদের রেজিমেন্টে soldier ছিলেন— আমরা এক সানখির ইয়ার। লোকটা যেমন অসম্ভব লড়িয়ে, তেমনি অসম্ভব ভালো লোক।”

বেলা চারটেয় গাড়ি আমার চব্বিশ ঘণ্টার নির্জলা উপাস্য শেষ হবে শুনে একটা সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেললুম।

শ্রীধরবাবু বকেই চললেন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে; আর তাঁর কাছে এ দেশের রাজাদের বিষয় অনেক তথ্য সংগ্রহ করলেন। ডাক্তারবাবুর নাকি এই রাজারাজড়াদের মধ্যেই প্র্যাকটিস বেশি। কারণ তাঁরা দিনে এক বোতল ব্রাণ্ডি খান, কিন্তু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তাঁদের সহ্য হয় না— বেশি কড়া বলে। আর তাঁরা নাকি সব গোরু গাধা ও বোকা পাঁঠা—আর শিকার করেন গেরস্তের ঝি-বউ। আর তাঁদের সহায় রাজমন্ত্রী ও রাজপুরোহিত।

বেলা চারটেয় ঝাড়সুগড়া স্টেশনে পৌঁছল, আর শ্রীধরবাবুর আদেশে তাঁর সঙ্গে আমি প্ল্যাটফরমে নামলুম। তিনি বললেন, “আপনি খানাকামরায় ঢুকুন, আমি স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে একটা কথা কয়ে আসছি।”

খানাকামরায় ঢুকে আমি তার মাদ্রাজি ম্যানেজারকে চা ও রুটি-মাখনের অর্ডার দিলুম। সে বললে—কিছুই নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে।

আমি অগত্যা, শ্রীধরবাবু গোরা স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে যেখানে কথোপকথন করছিলেন, সেইখানে গেলুম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “চা পেলেন?”

আমি বললুম, “না।”

শ্রীধরবাবু স্টেশনমাস্টারকে পল্টনী ইংরেজিতে আমার দুরবস্থার কথা বললেন। তিনি তখনই শ্রীধরবাবুকে হুকুম দিলেন, “শালা মাদ্রাজিকো কান পাকড়কে লে আও।”

শ্রীধরবাবু অমনি খানাকামরায় ঢুকে ম্যানেজারের কান ধরে নিয়ে এলেন। সাহেব হুকুম দিলেন যে, “চা বানাও, আর রুটি-মাখন বাবুকে দাও।”

মাদ্রাজি বললে, “নেই হ্যায়।”

“সরদারজি! উস্কো এক থাপ্পড় লাগাও, আওর আলমারি খোলো। শালা চোর হ্যায়।” শেষে সবই পেলুম ও খেলুম।

গাড়িতে ফেরবার পথে শ্রীধরবাবু বললেন, “স্টেশনমাস্টারকে জানালুম যে সঙ্গে টিকিট নেই—গার্ডকে বলে দেবেন, রাস্তায় কেউ যেন উৎপাত না করে। তিনি বললেন, all right। আর ঐ মাদ্রাজিটা এক টাকার জিনিস আপনার কাছে দু টাকা নেবার ফন্দী করেছিল, এক থাপ্পড়ে বিনা পয়সায় হয়ে গেল। এরই নাম পল্টনী কায়দা।”

গাড়িতে ঢুকেই দেখি, দুটি নতুন ভদ্রলোক বসে আছেন। দুজনেরই পরনে ইংরেজি পোশাক; একজনের চাঁদনির তৈরি, আর-এক জনের ব্রিচেসপরা আর হাঁটু পর্যন্ত পট্টি জড়ানো।

শ্রীধরবাবু গাড়িতে উঠেই জেরা শুরু করলেন। তার ফলে আমরা জানলুম একজনের নাম তারক তলাপাত্র-Timber merchant। আর যাঁর বেশ ঘোড়সোয়ারের মতো, তিনি হচ্ছেন Forest officer, নাম সুষেণ সেন। তাঁর পৈতৃক উপাধি ছিল দাস, তিনি অনুপ্রাসের খাতিরে ‘সেন’ অঙ্গীকার করেছেন।

তার পর ঘণ্টা তিন-চার ধরে শ্রীধরবাবু মজলিস জমিয়ে রাখলেন। এমন অনর্গল বকতে আমি দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কখনো দেখি নি। তিনি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করেছেন, তাই তিনি নতুন যাত্রীদের ব্যবসার বিষয় সব জানেন। তিনিও কিছুদিন কাঠের ব্যবসা করেছিলেন— যেখানে হিমালয়ের গায়ে প্রকাণ্ড শালবন আছে, আর তার মধ্যে মধ্যে ছোটোখাটো নদী—যার বর্ষাকালে হয় অসম্ভব তোড়। বড়ো বড়ো শালগাছ কেটে সেই নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে হয়, যেখানে গিয়ে সেই গুঁড়িগুলো ঠেকে, সেখানে সেগুলি জল থেকে তুলে বেচতে হয়। এ ব্যবসায় লাভ খুব বেশি। কিন্তু কোটা কার গুঁড়ি, এই নিয়ে ঝগড়া হয়— আর এই ঝগড়াঝাঁটিতে লাভ সব খেয়ে যায়। শ্রীধরবাবু বললেন, “তা যদি না হত, তা হলে আমি আজ লক্ষপতি হতুম। একা মানুষ, তাই আমি পয়সার জন্য কেয়ার করতুম না। হিমালয়ের ট্যাকে-গোঁজা ছোটো- ছোটো রাজ্যের রাজারা সব রাজপুত, আর সকলেই আফিংখোর। এদের আদালত আছে, কিন্তু আইন-কানুন নেই। এদের বিচারপ্রার্থী হওয়া ঝকমারি।”

তারকবাবু বললেন, “লোকে কাজ কি শুধু স্ত্রীপুত্রের জন্য করে? আমার স্ত্রীপুত্র নেই।” ডাক্তারবাবু বললেন, তাঁরও নেই। ফরেস্ট-অফিসার বললেন, তাঁরও নেই।

সহযাত্রীদের কারো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নেই শুনে শ্রীধরবাবু সন্তুষ্ট কি অসন্তুষ্ট হলেন তা তাঁর বক্তৃতায় বোঝা গেল না। তিনি শুধু বললেন, “আপনারা সকলেই দেখছি চিনির বলদ। টাকার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।” তিনিও অবিবাহিত, কিন্তু তাঁর যেমন কামিনী নেই, তেমনি কাঞ্চনও নেই। ভূতের ব্যাগার খাটা তাঁর ধাতে নেই। তার পর তিনি গেরস্ত লোকের যে বিবাহ করা উচিত, সে বিষয়ে নানা যুক্তি দেখালেন। তাঁর কথা কেউ বিশেষ আপত্তি করলেন না। কিন্তু সকলেই আলোচনায় যোগ দিলেন। বিবাহ জিনিসটা এ দেশে জন্ম-মৃত্যুর মতো নিত্য হয়, এ বিষয়ে যে এত মতভেদ আছে তা জানতুম না। আমি একমনে এই-সব তর্ক-বিতর্ক শুনছি, এমন সময় বাঁ দিকে একটি বেজায় ফাঁপা ও ফুলো নদী দেখতে পেলুম—তার নাম বোধ হয় মহানদী। বর্ষায় তার এই চেহারা, গ্রীষ্মে কিন্তু এ নদীতে কোমর-জল থাকে না। ডাক্তারবাবু বললেন যে, রাতভর হয়তো তীরে বসে ঢেউ গুনতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন?” তিনি উত্তর করলেন, “এ রেলগাড়ি গোরুর গাড়ি হতে পারে, কিন্তু জাহাজ নয়। আর ঘোড়া পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তারা সিন্ধু-ঘোটক নয়।”

ডাক্তারবাবু যা বলেছিলেন, তাই ঘটল। রাত্তির প্রায় সাড়ে আটটায় রায়গড় স্টেশনে পৌঁছে শুনলুম যে, সে রাত্তির আর গাড়ি এগোবে না। এর পরের রাস্তা বানের জলে ডুবেছে ও সম্ভবত বিপর্যস্ত হয়েছে। রাস্তা যদি কোথাও বেমেরামত হয়ে থাকে আজ রাত্তিরেই তা মেরামত হয়ে যাবে। অগত্যা আমরা কি করে রাত কাটাব, সেই ভাবনাতে অস্থির হয়ে পড়লুম।

স্টেশনমাস্টার ত্রিলোচন চক্রবর্তী বললেন, “আমি দু-একখানা বেঞ্চি জোগাড় করে দিচ্ছি, তাতেই পালা করে রাত কাটাতে পারবেন। অবশ্য আপনাদের কষ্ট হবে। কিন্তু উপায় নেই।”

শ্রীধরবাবু বললেন যে, “যাত্রা শুনেও তো সারারাত জেগে কাটানো যায়। এ যাত্রা আমরা বকে ও গল্প করে রাত কাবার করে দেব। কি বলেন বনবিহারীবাবু?”

ফরেস্ট-অফিসার বললেন, “তার আর সন্দেহ কি?”

তার পর শ্রীধরবাবু স্টেশনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “খাবার কিছু পাওয়া যায়?”

স্টেশনবাবু বললেন, “দেদার ভুট্টা।”

“তাই আনিয়ে দিন।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “পোড়াবে কে?”

ফরেস্টবাবু বললেন, “আমার চাকর গোপাল।”

ভুট্টা এল। পোড়ানো হল। শ্রীধরবাবু বললেন, “এক বোতল ‘রম্’ থাকলে ভুট্টার চাটের সঙ্গে খাওয়া যেত।”

ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, “আপনি ‘রম্’ খান নাকি?”

“আমি পল্টনে চাকরি করতুম, মদ-মাংস খেয়েই মানুষ। পল্টনে কেউ হবিষ্যি করে না। বিলিতি সভ্যতা পঞ্চ-’ম’ কারের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।”

“তা যেন হল। কিন্তু ‘রম্’ তো অতি খারাপ জিনিস?”

ফরেস্টবাবু বললেন, “গোপালের কাছে দু-এক বোতল হুইসকি আছে।” শ্রীধরবাবু বললেন, “ব্যোম ভোলানাথ!”

গোপাল এক বোতল হুইস্কির ছিপি খুললে।

ফরেস্টবাবু বললেন, “থাকি একা বন-জঙ্গলে, বাঘভালুকের মধ্যে। বিদ্যের মধ্যে শিখেছি এই হুইস্কি খাওয়া।”

ডাক্তারবাবু বললেন যে, তিনি হোমিওপ্যাথিক নিয়মে, অর্থাৎ dilute করে, খেতে পারেন।

তারকবাবু বললেন, তিনি dilute না করেই গলাধঃকরণ করবেন। কেননা মদ সকলের হাতে খাওয়া যায়, কিন্তু জল নয়।

আমি একা নির্জলা উপবাস করলুম।

অতঃপর আমার সহযাত্রীরা ধীরে সুস্থে হুইস্কি পান করতে আর মধ্যে মধ্যে ভুট্টা চিবোতে লাগলেন।

শ্রীধরবাবু বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারেন না। তিনি হঠাৎ প্রস্তাব করলেন যে, “আমরা সকলেই অবিবাহিত, অবশ্য বিভিন্ন কারণে। কেন আমরা গার্হস্থ্য ধর্ম অবলম্বন করি নি, তারই ইতিহাস বলা যাক। আমার নিজের কথাই প্রথমে বলছি—

“আমি যে বিবাহ করি নি তাতে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই। চল্লিশ বৎসর নানা পল্টনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। মধ্যে মধ্যে বেশ পয়সাও রোজগার করি। কিন্তু সে রোজগার অনিশ্চিত। তাই বহু স্ত্রীলোক দেখেছি, কিন্তু তাদের কাউকেও বিয়ে করবার কথা কখনো মনে হয় নি। পল্টনে অবশ্য বিয়ে হয়, কিন্তু সে বিয়ে নিকে ও ঠিকে মাত্র। ও একরকম গান্ধর্ব বিবাহ যার ভিতর জাতবিচার নেই, দেনা-পাওনা নেই। এমন-কি, সৈনিকের দৈনিক বিবাহও চলে।

“আমি কুলীনের ছেলে, বহুবিবাহে আমার আপত্তি নেই। আমরা বিবাহ করি কুলীন-কন্যাদের কুল রক্ষা করবার জন্য, কিন্তু তাতে তাদের শীল রক্ষা হয় না। আমরা বিবাহ করেই খালাস—তারাও তাই। আমাদের ঐ শ্রেণীর স্ত্রীদের বিশেষরূপে বহন করতে হয় না। তারা luggage নয়। আর luggage ঘাড়ে করে পল্টনের camp- follower হওয়া যায় না। এখন বুঝলেন, আমি কিসের জন্য চিরকুমার। বয়স যখন পঞ্চাশ পেরোল, তখন আমি পল্টন থেকে আলগা হলুম। কিছু টাকা হাতে করে দেশে ফিরি নি, হিমালয়েই থেকে গেলুম—কখনো ডালহৌসী ও কখনো সিমলায়।

“এই সময় আমার এক ভাইপো আমার এক বিয়ের প্রস্তাব করে পাঠালেন। আমি উত্তরে তাঁকে লিখলুম—গতা বহুতরা কান্তা, স্বল্পা তিষ্ঠতি শর্বরী। এই তো শুনলেন আমার ইতিহাস! চৌধুরীমশায়, আপনি অবশ্য এখনো বিয়ে করেন নি। আপনি কলেজের ছোকরা। আমার পরামর্শ শোনেন তো বাড়ি ফিরেই বিয়ে করুন।”

এর পর ডাক্তারবাবু তাঁর আত্মজীবনচরিত বলতে শুরু করলেন—

“আমার বাড়ি বাঁকুড়া জেলায়। আমি ব্রাহ্মণ নই; যদি হতুম তো পাচক ব্ৰাহ্মণ হতুম। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ডাক্তারি। অ্যালোপ্যাথি নয়, হোমিওপ্যাথি নয়—হাতুড়েপ্যাথি। আজকাল হাতুড়েপ্যাথির ব্যবসা চলে না। তাই কাকার পরামর্শে হোমিওপ্যাথির একখানা বাংলা বই মুখস্থ করে ডাক্তারি শুরু করলুম। প্ৰথমে গাঁয়ে। আমাদের একটা বদনাম আছে, আমরা নাকি হামবড়ামি করি। Baileyর ভাই Kelly যে-রোগ সারাতে পারে না, আমরা নাকি এক ফোঁটা ওষুধে তা সারাই। কিন্তু আমরা নিজের বিদ্যের বড়াই করি নে, আমাদের ওষুধের গুণগান করি।

“আমি ব্যবসা শুরু করলুম। আমারি কাকা আমার বিয়ে স্থির করলেন একজন মোক্তারের মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে দেখে আমি ভড়কে গেলুম। কাকা কিন্তু নাছোড়বান্দা—টাকাটা-সিটোর লোভে। মেয়ের হল ওলাউঠো—আমি বললুম, আমি এক বড়িতে সারিয়ে দেব। আমিও বড়ি খাওয়ালুম, সেও মারা গেল।

“মোক্তারবাবু বললেন যে, আমি বিষবড়ি খাইয়ে তাকে মেরেছি। এর পর গাঁয়ের লোক রটালে যে, আমি খুনে ডাক্তার। বেগতিক দেখে আমি দেশ থেকে পলায়ন করে বানপ্রস্থ অবলম্বন করলুম। সেই অবধি এই বুনো দেশে আমাদের ছোটো ছোটো সাদা বড়ি দিয়ে চিকিৎসা করছি, আর তাতেই খোরপোষ চলে যাচ্ছে। যে যাই বলুন, ঐ নিরীহ বড়ির তুল্য ওষুধ আর নেই।”

এক গুলি হোমিওপ্যাথিক ওষুধে যে লোক মারা যায়—এ কথা শুনে সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। একমাত্র শ্রীধরবাবু বললেন যে, তিনি এক বাক্স হোমিওপ্যাথিক ওষুধ গিলতে প্রস্তুত।

তার পর তারকবাবু বললেন-

“এখন আমার কথা শুনুন। আমার দাদা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন পরমাসুন্দরী। তিনি একদিন হঠাৎ heart failureএ মারা গেলেন — কিন্তু দাদাকে ছেড়ে গেলেন না। যখন-তখন দাদার সুমুখে এসে উপস্থিত হতেন, কিন্তু কোনো কথা কইতেন না। দাদা তাঁর স্ত্রীর প্রেতাত্মার উৎপাতে প্রায় পাগল হয়ে উঠলেন, আর আমাদের সকলকেই প্রায় পাগল করে তুললেন। আমরা গয়ায় প্রেতশিলায় বৌদিদির শ্রাদ্ধ করলুম। কিন্তু পারলৌকিক বৌদিদি দাদাকে ছাড়লেন না। এমন-কি, দাদা ট্রেনে যাচ্ছেন, হঠাৎ তাঁর স্ত্রী এসে তাঁর কাছে আবির্ভূত হলেন। তিনি অমনি ভয়ে চীৎকার করতে শুরু করলেন। শেষটায় তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন, এবং দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুদিন পরে তিনিও মারা গেলেন। আমি, তাঁর সঙ্গেই ঘুরতুম, কিন্তু কখনো তাঁর স্ত্রীর ছায়া দেখি নি। দেখেছি শুধু দাদার অসাধারণ কষ্ট। ডাক্তাররা বললে যে, দাদার যা হয়েছে তা mental disease। যদি তাই হয় তো mental disease যে কি ভয়ংকর বস্তু, তা বলা যায় না। এই ব্যাপারে আমার মনে যে ধাক্কা লেগেছিল, তাতে বিয়ের নাম শুনলে আমার আতঙ্ক উপস্থিত হয়। সেই ধাক্কায় আমি চিরকুমার।”

শ্রীধরবাবু বললেন, “monogamyতে এই বিপদ; বহুবিবাহের বিপদ নেই। আপনারা বুঝি কুলীন নন, তাতেই আপনার দাদা এই ঘোর বিপদে পড়েছিলেন।” অন্য কেউ রা কাড়লেন না।

শেষটায় বনবিহারীবাবু বললেন-

“আমার বিয়ে না করবার কারণ আরো অদ্ভুত। আমার বাবা ছিলেন একজন বড়ো ফরেস্ট-অফিসার। তিনিই সাহেবদের বলে-কয়ে আমাকে এ চাকরিতে বাহাল করেন। আমি ছিলুম Rangaroon ফরেস্টের অফিসার। ঐ প্রকাণ্ড বনের ভিতর একটা ছোট্ট ইনস্পেকশন বাংলো আছে। মধ্যে মধ্যে আমাকে সেখানে গিয়ে দু তিন রাত কাটাতে হত। সে বাংলোর খবরদারি করত একটি বৃদ্ধ নেপালী, আর তার সঙ্গে থাকত তার একটি নাতনী। অমন সুন্দরী মেয়ে আমি আর কখনো দেখি নি। রঙ ফরসা, আর নাক চোখ বাঙালির মতো। আমার তখন যাকে বলে প্রথম যৌবন। তাই আমি সেই মেয়েটিকে বিবাহ করব স্থির করলুম। তার পর শুনলুম যে, সে পূর্ব অফিসার দাস- সাহেবের মেয়ে। দাস-সাহেব হচ্ছেন আমার পিতা। এ কথা শুনে আমি গভর্নমেন্টের চাকরি ইস্তফা দিয়ে চলে আসি। তার পর এ অঞ্চলের একটি রাজার ফরেস্ট-অফিসার হয়েছি। এর পর থেকে বিয়ের নাম শুনলে আমার গা পাক দিয়ে ওঠে।”

চার চিরকুমারের চারটি গল্প শুনে শ্রীধরবাবু বললেন, “এখানে যদি কোনো লেখক থাকত তো এই চারটি গল্প লিখলে একখানি নতুন চাহার দরবেশ হত।”

ডাক্তারবাবু বললেন যে, “আমরা তো দরবেশ নই।”

শ্রীধরবাবু উত্তর করলেন, “যে কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করে সেই দরবেশ। আমার ও দুই নেই। আপনারা অবশ্য এখনো কাঞ্চন ছাড়েন নি। ও শুধু ভূতের ব্যাগার খাটা। শুনতে পাই যে শাস্ত্রে বলে, গৃহিণী গৃহমুচ্যতে। যার গৃহিণী নেই, তার গৃহও নেই। আর যে গৃহহীন, সেই তো দরবেশ।

অগ্রহায়ণ— পৌষ ১৩৪৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *