ঘোষালের হেঁয়ালি
সেদিন সন্ধ্যায় একা বাড়ি বসে ছিলুম। শরীরটে ছিল মাদা, তার উপর সেদিন পড়েছিল একটু বেশি শীত। তাই বাড়ি থেকে না বেরোনই শ্রেয় মনে করলুম।
এ সময় বেকার বাড়ি বসে থাকাটা আমার পক্ষে ঈষৎ বিরক্তিকর। এ দেশে কোনো evening paper নেই যার মারফত দুনিয়ার টাটকা খবর পাওয়া যায়; যে খবরের জন্য আমরা কেউ ব্যস্ত নই, তবুও যা আমরা পড়ি। তাই বসে বসে একখানি futurist নভেলের পাতা ওল্টাচ্ছিলুম। দু-চার পাতা উল্টেই মনে হল, বাংলার তরুণ সাহিত্যের কোনো future নেই।
এমন সময় বেহারা এসে খবর দিল— “একঠো বাবু আপকো সাথ মুলাকাত করনে আয়া।” আমি বললুম, “বাবুকো আনে বোলো।” যদিচ এ অসময়ে কে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল বুঝতে পারলুম না। সে যাই হোক, বাবুর আগমন-সংবাদ শুনে খুশি হলুম। কেননা বুঝলুম যে, আগন্তুকটি যিনিই হন, তাঁর সঙ্গে হয় কাজের, নয় বাজে কথা কয়ে এই ফাঁকা সময়টা ভরিয়ে দিতে পারব।
ভদ্রলোকটি ঘরে ঢোকবামাত্র বুঝলুম, তিনি বিল সাধতে আসেন নি। কারণ তাঁর পরনে সাদা কাগজের মতো ধবধবে খদ্দরের জামা ও ধুতি, গায়ে ধুপছায়ারঙের মুর্শিদাবাদী বালাপোষ, আর মাথায় খদ্দরের গান্ধী-টুপি। দেখে মনে হল, তিনি হয়তো স্বরাজের জন্য চাঁদা সাধতে এসেছেন। যদি তাই হয় তো ভাবী স্বরাজের অনেক খবর পাওয়া যাবে। ভদ্রলোক টুপিটি খুলতেই দেখি তিনি স্বয়ং ঘোষাল। কারণ তার হচ্ছে সেই জাতের স্বপ্রকাশ চেহারা যা একবার দেখলে জীবনে আর ভোলা যায় না।
কথাপীঠ
আমি তাকে স্বাগত-সম্ভাষণ করেই জিজ্ঞাসা করলুম, “কি খবর?”
ঘোষাল উত্তর করলে, “unemployed ।”
“রায় মশায়ের সঙ্গে তোমার কি ফারকৎ হয়ে গিয়েছে?”
“না। যা হয়েছে, তাকে একরকম judicial separation বলা যেতে পারে।”
“Divorce নয়?”
“না। তবে যে-কোনো মুহূর্তে আমি তাঁকে তালাক দিতে পারি। ব্যাপার কি ঘটেছে তা পরে বলব। আগে কাজের কথাটা সেরে নেওয়া যাক। আমি স্বরাজ-দলে ভর্তি হতে চাই।”
আমি ঘোষালের মুখে এ প্রস্তাব শুনে বুঝলুম কথাটা নেহাত বাজে। সে বলতে চায় গল্প। আর এ প্রস্তাব তার গল্পের ভূমিকা মাত্র, ও সে ভূমিকা G. B. S.-এর নাটকের ভূমিকার মতো, যার আস্থায়ীর সঙ্গে অন্তরার কোনো সম্বন্ধ নেই। তা হলেও ঐ বিষয়েই আলাপ শুরু করলুম। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, “সেইজন্যই বুঝি খদ্দরমণ্ডিত হয়েছ?”
“অবশ্য। মুখপাত্র তো দুরস্ত চাই। তা ছাড়া দেশই তো বেশ গড়ে। নব রাশিয়া গড়েছে লাল কুর্তা, আর নব ইতালি কালো কুর্তা।”
“তথাস্তু। এখন দেশের কাজে এত লোভ কেন?”
“ও কাজটা sinecure বলে।”
“তুমি বলতে চাও কিছু না করারই অর্থ দেশের কাজ করা?”
“আমার মতো অকর্মণ্য লোকের পক্ষে তাই। স্বরাজের কেষ্টবিষ্টুদের অবশ্য অগাধ খাটুনি। তাঁরা আলেয়ার মতো নিয়ত ভ্রাম্যমাণ। আজ জ্বলে উঠছেন পুরুষপুরে, কাল কামাখ্যায়। আর আমরা ‘Hail! holy light!” বলে সেই উদ্ভ্রান্ত আলোর পিছনে ছুটছি। এখন আপনার কাছে কিঞ্চিৎ সাহায্য চাই-পয়সার নয় মুখের কথার।”
“এ দলের বড়োকর্তাদের কাছে না হোক, উপকর্তাদের কাছে গিয়ে তোমার প্রস্তাব জানাতে হবে?”
“আপনার মুখের কথা রসিকতা বলে উপেক্ষিত হবে। রসিকতা কর্মক্ষেত্রে অগ্রাহ্য।”
“তবে কি সার্টিফিকেট লিখে দেব?”
“মাফ করবেন। আপনি তো লিখবেন যে ঘোষাল একজন জাতগুণী, চমৎকার টপ্পা-গাইয়ে, আর নিত্য নতুন স্বরচিত গল্প বলতে পারে। আপনি কি জানেন না যে, গান ও গল্প স্বরাজ্যে থাকবে না?”
“তবে থাকবে কি?”
“বক্তৃতা আর তার স্বরলিপি, অর্থাৎ খবরের কাগজ।”
“তবে আমাকে কি তোমার application লিখে দিতে হবে?”
“দরখাস্ত আমি নিজেই লিখব। স্বরাজের ভাষা আমি জানি। সে ভাষা তো দেশি মনের তাঁতে বোনা বস্তাপচা বিলেতি শব্দ।”
“তবে কি চাও?”
“As regards my qualifications সম্বন্ধে কি লিখব, সেই বিষয় আপনার পরামর্শ চাই। যে মার্কার qualificationএর কিঞ্চিৎ বাজার-দর আছে সে qualificationএর কথা লিখতে ভয় হয়।”
“কেন বলো তো?”
“সেই qualificationএর কথা একবার মুখ ফস্কে বেরিয়ে পড়েছিল, তার ফলেই তো আমার এই ন যৌ ন তস্থৌ অবস্থা।”
“হেঁয়ালি ছেড়ে ব্যাপার কি হয়েছিল স্পষ্ট করে বললে বুঝতে পারি। সত্য কথা বলতে হলে তোমার ভবিষ্যৎ কস্মিনকালেও ছিল না, এখনো নেই; কেননা তুমি সামাজিক ও সাংসারিক জীব নও। সমাজে তোমরা হচ্ছ সব উদ্বৃত্তের দল। সুতরাং তুমি কোনো দলে ভর্তি হও আর না হও, তাতে কিছু আসে যায় না— তোমারও নয়, সমাজেরও নয়।
“তোমার গত চাকরি কি করে ছুটিতে পরিণত হল, তাই জানবার কৌতূহল আমার হচ্ছে।”
মুখবন্ধ
“আচ্ছা, সেই নিকট-অতীত কাহিনী বলছি।”
এই বলে ঘোষাল চেয়ারের উপর জোড়াসন হয়ে বসে ইংরাজিতে বললেন, “Beastly cold. May I have a drop of—”
“What will you have- whishky or brandy?”
“Cognac, s’il vous plais?”
আমি বেহারাকে একটি brandy-peg আনতে হুকুম দিলে ঘোষাল বললে, “Merci, monsieur.”
আমি প্রশ্ন করলুম, “Vous parlez francaise, monsieur?”
“Pardon, monsieur, ও অপরাধ আমার স্বেচ্ছাকৃত নয়। এই Cognacই ঐ ফরাসি বুলি টেনে এনেছে। Cognacএর সঙ্গে ‘if you please ‘ কি খাপ খেত? আর ‘thank you’এর মতো মিছে কথা কি কোনো ভাষায় আছে?”
এ কৈফিয়তে আমি হেসে উঠলুম, সঙ্গে সঙ্গে সেও। বেহারা brandypegটি সঙ্গে soda সংযোগ করতে উদ্যত হলে ঘোষাল বললে, “ও ব্র্যাণ্ডিটুকুকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে দিন। আমি হিন্দুধর্ম রক্ষা করে পানাহার করি। জাত যায় সোডায়, ব্র্যাণ্ডিতে নয়।”
“Unfiltered water?”
“সে তো গঙ্গামৃত্তিকা। আমি চাই ইভাগান্ত বিলেতি ঔষধ দিয়ে শোধন-করা গঙ্গার জল— যার নাম কলের জল।”
তার পর সজল ব্র্যাণ্ডি এক চুমুকমাত্র গলাধঃকরণ করে ঘোষাল তার কাহিনী বলতে শুরু করবার পূর্বে দু কথায় তার মুখবন্ধ করলেন। তিনি বললেন, “এ উপন্যাস নয়, ইতিহাস। এর রস অতি ফিকে—গঙ্গাজলি ব্র্যাণ্ডির মতো। সুতরাং একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। আশা করি রায়মশায়ের সভার নবরত্নদের সব মনে আছে— যথা পণ্ডিতমশায়, উজ্জ্বলনীলমণি প্রভৃতি।”
“হাঁ, আছে।”
“তা হলে শুনুন।”
কথামুখ
“একদিন মধ্যাহ্নভোজনের পর ঘরে বসে বিশ্রাম করছি, অর্থাৎ আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় গীতা পড়ছি—”
“তুমি কি আবার গীতাপাঠ কর নাকি?”
“করি। অবসর-বিনোদনের জন্য নয়, পণ্ডিতমশায়ের আদেশে আমার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। ভয়ানক ঘুম পাচ্ছিল, তার পর এই শ্লোকটি পড়বামাত্র জেগে উঠলুম—
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥”
“ও শ্লোকের অর্থ কি বুঝলে?”
“এর অর্থ ঘুমের ঘোরে বোঝা যায়, কিন্তু জেগে অপরকে বোঝানো যায় না। ও শ্লোকটা ‘We are such stuff as dreams are made on’-এর সগোত্র।”
“তুমি Shakespeare পড়েছ নাকি?”
“টেমপেস্ট ও হ্যামলেট-এর সুভাষিতাবলী তো মুখে মুখেই চলে। ও-সব কি আর বই পড়ে শিখতে হয়?”
“তার পর?”
“এমন সময় দুয়োর ঠেলে কে ঘরে প্রবেশ করলে। বই থেকে মুখ তুলে দেখি ‘তন্বী শ্যাম শিখরিদশনা’ সখীরানী সুমুখে দাঁড়িয়ে। তার চোখেমুখে লেগে রয়েছে অর্ধস্ফুট হাসি। ও মূর্তি দেখলে স্বতই মুখ থেকে বেরিয়ে যায়—অরালা কেশেষ প্রকৃতিসরলা মন্দহসিতে-”
“এ দেবীটি কে?”
“এ রমণী দেবী নয়, বোষ্টমের মেয়ে। তার পিতৃদত্ত নাম শ্যামদাসী। সখীরানী নাম আমি দিয়েছি, রানীমার প্রিয় সখী বলে। রানীমা তাকে বাপের বাড়ি থেকে সঙ্গে করে এনেছেন, তার বাল্যবন্ধু বলে। প্রায় তার সমবয়সী, বছর দুত্তিনের বড়ো হবে। এ বাড়িতে তার কাজ হচ্ছে রানীমার কাছে গল্প করা, কীর্তন গাওয়া ও চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি বৈষ্ণবগ্রন্থ সব তাঁকে পড়ে শোনানো, আর রানীমার নেপথ্যবিধান করা। কিন্তু রাজবাড়ি এসেও তার চাল বিগড়ে যায় নি। সে পরনপরিচ্ছদে আহার-বিহারে বোষ্টমী কায়দা পুরো বজায় রেখেছে। তার পানে একখানি চাঁপাফুলের রঙের তসরে শাড়ি, গায়ে নামাবলী, গলায় তুলসী কাঠের মালা, নাকে রসকলি, একরাশ ঢেউখেলানো চুল কপালের ডান ধারে চুড়ো করে বাঁধা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় একটি জীবন্ত ছবি। রাধিকা একবার অভিমান করে কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে, ‘আপনি হইয়ে শ্রীনন্দের নন্দন, তোমারে করিব রাধা।’ শ্রীনন্দের নন্দন যদি হঠাৎ মেয়ে হয়ে যেতেন, তা হলে তাঁর রূপ হত ঠিক সখীরানীর মতো।”
সখীরানীর দৌত্য
তাকে দেখে আমি একটু চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলুম, “এ অবেলায় তোমার হঠাৎ আগমনের কারণ কি?”
“আমি নিজের গরজে আসি নি, এসেছি মীনারানীর দূত হয়ে।”
“মীনাক্ষী দেবীর, থুড়ি, রানীমার কী হুকুম?”
“আজ সন্ধেয় তোমাকে গানগল্প করতে হবে তাঁর সভায়।”
“সে সভা কিরকম সভা?”
“মেয়ে-মজলিস।”
“সে মজলিসে বোধ হয় নিম্পুরুষ নাটকের অভিনয় হয়?”
“ধরে নাও যে তাই হয়।”
“শুনেছি পুরাকালে কোনো বীরপুরুষ ‘একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনংবনম্।’ আমাকেও দেখছি তাঁর পদানুসরণ করতে হবে।”
“কী বলছ, ভাষায় বলো।”
“এ কথা শুনে আমি বললুম, “তুমি দেখছি এখন কথায় কথায় সংস্কৃতের ফোড়ন দাও।”
“এ অভ্যাস হয়েছে পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গদোষে। নইলে আমার ফরাসি বিদ্যা যন্ত্রপ, সংস্কৃত বিদ্যাও তদ্রূপ। এক বর্ণ গাইতে না পারলেও যে লোক খাঁ-সাহেবের সহবৎ করেছে, সে কি শ্রুতি কপচায় না?”
সে যাই হোক, কথাটা বাঙলায় বুঝিয়ে দেবার পর সখীরানী বললেন, “তুমি যে বীরপুরুষ নও, তা আমি জানি। দুবেলা ঐ মুগুর ভেঁজে তোমার বুক চওড়া হয়েছে, কিন্তু বুকের পাটা হয় নি। তবে ভয় নেই। তোমাকে ঘোড়াও চড়তে হবে না, একাত্ত যেতে হবে না। পণ্ডিতমশায় থাকবেন তোমার প্রহরী। আর রায়মশায়ের অন্দরমহল গহন বন নয়, ফুলের বাগান।”
“তা হলে সেখানে গিয়ে দেখব—
“কোন ফুল জপত হরিনাম,
কোন ফুল ফুকারে অলি অলি’।
“ও দুই কাজ করা ছাড়া মেয়েদের আর উপায় কি? প্রথমে অলি অলি, শেষে হরি হরি। সে যাই হোক, তোমাকে আজ একটি সাদাসিধে গল্প বলতে হবে, যা মেয়েরা বুঝতে পারে। রায়মশায়ের আড্ডায় যে-সব গল্প বল তা শুনলেই আমার বলতে ইচ্ছে যায়— এহ বাহ্য, আগে কহো আর।”
“কেন?”
“তার দু-আনা গল্প, আর পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনা তর্ক—অর্থাৎ বাক্যি।”
“আচ্ছা গল্পটা যথাসাধ্য সাদা করব, তবে সিধে হবে কি না বলতে পারি নে।”
“যাক, তাতে কিছু আসে যায় না। গুটি-দুচ্চার ভালো ভালো গানও শোনাতে হবে।”
“আচ্ছা, তা হলে কীর্তন গাইব, যা মেয়েরা বুঝতে পারে। যথা ‘প্রাণবধূর সনে কথা কইতে পেলেম না’।”
“না, কীর্তন নয়।”
“কেন?”
“কীর্তন তুমি আমার মতো গাইতে পারবে না। ধরো ঐ গানটার ভিতর যত মনের আক্ষেপ প্রকাশ করতে হবে আখর দিয়ে নয় সুরের টান টেনে। নইলে কীর্তন হয়ে পড়ে নেড়া গান।”
“তুমি বলতে চাও নেড়ানেড়ির গান। যথা, আমি চাপান দিলুম ‘যদি গৌর চাস, কাঁথা নে ধনী’; আর তুমি উতোর গাইলে, ‘এ পুজোতে ঝুমকো দিবি, তবে ঘরে রব’।”
এ কীর্তনে অবশ্য আবদার আছে, আক্ষেপ নেই। আর তা ছাড়া ও-সব ভাবের কীর্তন নয়, অভাবের সং-কীর্তন। ও সংপনা এ দরবারে চলবে না।”
“তা হলে আমাকে কী গাইতে হবে?”
“হিন্দি।”
“তোমাকে যে কটি গান শিখিয়েছি, তারই মধ্যে দুয়েকটি?”
“হ্যাঁ। ‘গোরে গোরে মুখপর’ও চলবে, ‘চমেলি ফুলি চম্পা’ও চলবে।”
“তুমি বলতে চাও সে মজলিসে ‘গোরে গোরে মুখ’ও থাকবে, ‘চমেলি ফুলি চম্পা’ও থাকবে— তবে কথা হচ্ছে, আমার সঙ্গে সঙ্গত করবে কে?”
“খেয়ালের ভারি তো তাল! আমি খঞ্জনিতে ঠেকা দেব এখন। তোমার তাল আমি সামলে নেব।”
“তা হলে আমি নির্ভয়ে গাইতে পারব।”
“আচ্ছা, তবে আসি। মেয়েদের সন্ধে-আহ্নিক হয়ে যাবার পর রাধানাথ শিকদের এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, হুকুম ঠিক তামিল করব। ইতিমধ্যে দুর্গানাম জপ করি।”
“মধ্যে মধ্যে মার নাম স্মরণ করা ভালো, বিশেষত চিরকুমারের পক্ষে।”
সখীরানীর গুণাগুণ
আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি যে, সখীরানী আমার পূর্বপরিচিত। এ বাড়িতে তার গতিবিধি ছিল অবাধ। তার তুল্য স্বাধীন জেনানা আমি আর-একটিও দেখি নি। সে বোষ্টমের মেয়ে তাই মনুর বিধিনিষেধের সে তোয়াক্কা রাখত না। সংসারে তার কোনোরকম বন্ধন ছিল না; কারণ সে কুমারীও নয়, সধবাও নয়, বিধবাও নয়। উপরন্তু সে সুন্দরী ও গুণী। তার যে রূপ আছে, সে তা জানত; কারণ না জানবার তার উপায় ছিল না। আর সে কীর্তন গাইত চমৎকার। তার পর সে ছিল আমার শিষ্য। রানীমার ইচ্ছায় আর রায়মশায়ের আদেশে আমি তাকে হিন্দিগান শেখাতুম-টপ্পাঠুংরি নয়, সাদাসিধে মামুলী গান; অর্থাৎ সেই-সব গান যা আজও বাতিল হয় নি, যদিচ লোকে সেগুলো নবাবী আমল থেকে গেয়ে আসছে। আমি তাকে তান শেখাই নি, পাছে তার গলার অপূর্ব টান নষ্ট হয়। সুরের প্রাণ তার কাঁপুনির উপর নির্ভর করে না; করীকর্ণের মতো অবিরত চঞ্চল হওয়া প্রাণের একমাত্র লক্ষণ নয়।
আমি পূর্বেই বলেছি রানীমার নাম হচ্ছে মীনাক্ষী দেবী। শ্যামদাসী তাঁকে আজন্ম মীনা বলেই ডেকে এসেছে; এ বাড়িতে এসে শুধু তার পিছনে রানী জুড়ে দিয়েছে। কারণ গবর্নমেন্টে রায়মশায়কে রাজা খেতাব না দিলেও এ দেশের লোকে তাঁকে রাজাবাবুই বলত। সে যাই হোক, আমি সখীরানীর প্রস্তাব শুনে একটু অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলুম। কেননা আমি জানতুম যে, এই মজলিসে একজন উপস্থিত থাকবেন, যাঁর সুমুখে কী ব্যবহারে, কী কথাবার্তায়, পান থেকে চুন খসলেই সভা বন্ধ হবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তিনি কে?”
ঘোষাল বললেন, “তিনি এই রাজপুরীর পুরদেবতা।”
“মানবী না পাষাণী?”
“ক্রমশ প্রকাশ্য।”
সখীসমিতি
সন্ধের পর রাত যখন আটটা বাজে, পণ্ডিতমশায় আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন, সঙ্গে রায়মশায়ের প্রিয় খানসামা রাধানাথ শিকদার। রাধানাথ আমাদের ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে চলল। বার-বাড়ি এবং অন্দরমহলের মধ্যস্থ মহলটি হচ্ছে পূজার মহল। পশ্চিমে প্রকাণ্ড পূজার দালান, তার সুমুখে নাটমন্দির, আর তিন পাশে প্রশস্ত ভোগের দালান; সব আগাগোড়া সাদা মার্বেলে মোড়া— পবিত্রতার নিদর্শন
আমাদের পথপ্রদর্শক আমাদের দুজনকে নিয়ে গিয়ে নাটমন্দিরে একখানি গালিচার উপর বসালে। তাকিয়ে দেখি, ঠাকুরদালান স্ত্রীজাতি নামক উপদেবতায় গুলজার শুনলুম এঁরা সবাই ব্রাহ্মণকন্যা—রায়মশায়ের কুটুম্বিনী। আর দাসী-চাকরানীরা বসেছে সব নাটমন্দিরের ডাইনে বাঁয়ে ভোগের দালানের বারান্দায়। প্রথমেই চোখে পড়ে এ দুই দলের বর্ণের পার্থক্য। যাক, সে স্ত্রীরাজ্য আর বর্ণনা করব না, তা হলে পুঁথি বেড়ে যাবে। ছায়া পিছনে ফেলে আলোর দিকে ফিরে দেখি যে, ঠাকুরদালানের সামনে প্রথমেই বসে আছেন রানীমা, তাঁর বাঁয়ে তাঁর তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী সখীরানী। রানীমাকে এই প্রথম দেখলুম। দিব্যি সুশ্রী, যেন একটি ননীর পুতুল—’ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনি বহিয়া যায়’।
মূর্তিমতী আনন্দলহরী! এর চেয়ে তাঁর বিষয় বেশি কিছু বলবার নেই।
তাঁর ডাইনে বসে আছেন একটি বিধবা— the woman in white। ইনি হচ্ছেন এ পুরীর পুরদেবতা। তাঁর রূপ বাঙলা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কারণ এ তরল ভাষার কোনো সংহত গাঢ়বন্ধরূপ নেই। সংস্কৃত কবি হয়তো বলতেন— ‘তড়িল্লেখা তন্বী তপনশশিবৈশ্বানরময়ী’।
ঠাকুরানী
এই সংস্কৃত বচন আউড়েই ঘোষাল বললেন, “আর চার ড্রাম, liquor glass-এ। এখন আমি সুর বদলে নেব, নইলে এ ইতিহাস কাব্য হয়ে উঠবে—অর্থাৎ প্রলাপ।”
চার ড্রাম একটা বুড়ো আঙুলের মতো গেলাসে এল; এক চুমুকে গেলাসটি খালি করেই ঘোষাল আবার তার গল্প আরম্ভ করলে-
যে মহিলাটির রূপবর্ণনা করতে পারি নি, এখন তার গুণবর্ণনা করি। তাঁর নাম ত্রিপুরাসুন্দরী, এ বাড়িতে তিনি ঠাকুরানী নামেই পরিচিত। তার কারণ তিনি রায়মশায়ের দ্বিতীয় পক্ষের শ্যালক হরিসত্য শর্মা ঠাকুরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। বিবাহের পর থেকে তিনি এই বাড়িতেই বাস করছেন, বিদেহ আত্মার মতো; কেননা তাঁর দেখাসাক্ষাৎ সকলে পায় না। অথচ তিনি হয়ে উঠেছেন এ পরিবারের হর্তাকর্তাবিধাতা। এরই নাম নীরব প্রভুত্ব। এক কথায়, সকলেই ছিল তাঁর বশীভূত; হয়তো তাঁর রূপের জ্যোতিই ছিল তাঁর বশীকরণ-মন্ত্র, নয় তো তাঁর অন্তরের কোনো এক্স-রে।
উপরন্তু তিনি ছিলেন বিদুষী। বিয়ের বছরখানেক পরে তাঁর স্বামীবিয়োগ হয়, তার পর থেকেই তিনি বিদ্যাচর্চা শুরু করলেন। সংস্কৃত ভাষায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুপণ্ডিতা। পণ্ডিতমশায় ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তিনি বিধবার আচার ‘ক’ থেকে ‘ক্ষ’ পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন, যদিচ শাস্ত্রে তাঁর কোনোরূপ ভক্তি ছিল না। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে শুনেছি, কিছুদিন বেদান্তচর্চা করে তিনি তাঁকে বলেন যে, ও আধ্যাত্মিক ধূমপানে আমার অরুচি হয়ে গিয়েছে। পণ্ডিতমশায় তখন বলেন যে, তবে কাব্যামৃতরসাস্বাদ করুন। তার পর থেকেই শুরু হল রামায়ণ, কালিদাস ও ভবভূতির চর্চা। এ-সব কাব্য-ইতিহাস চর্চা করেও তিনি তৃপ্তিলাভ করেন নি। তিনি নাকি বলতেন যে, যা হওয়া উচিত তার কথা একরঙা, আর সে রঙও জ্বলা। যা হয়, তাই বিচিত্র। এর পর থেকে তিনি ইংরাজি শিখেছেন, আমিও পণ্ডিতমশায়ের অনুরোধে এ শিক্ষার কিছু সাহায্য করেছি। এই মেয়ে-মজলিসে তিনিই ছিলেন আমার গল্পের একমাত্র বিচারক। তিনি হাসলে সকলে হাসতেন, তিনি গম্ভীর হলে সকলে গম্ভীর হতেন— শুধু সখীরানী ছাড়া। কেননা ত্রিপুরাসুন্দরীর কাছে ছিল শ্যামদাসীর সাত খুন মাপ। শুধু তাঁরা উভয়ে সমবয়সী বলে নয়, কতকটা সহধর্মী বলেও বটে।
প্রফেসর
তার পর মুখ ফিরিয়ে দেখি পাশে একটি মহা বেরসিক বসে রয়েছেন। তাঁকে দেখে একটু অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলুম।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “ভদ্রলোকটি কে?”
“রায়মশায়ের তৃতীয় পক্ষের শ্যালক—নাম ভূঙ্গেশ্বর ভট্টাচার্য, প্রফেসর বলেই এখানে গণ্য ও মান্য। তিনি একজন ডবল এম. এ. – প্রথম পক্ষে পিওর ম্যাথমেটিক্সের, দ্বিতীয় পক্ষে মিক্সড ফিলজফির। মিক্সড ফিলজফি এইজন্য বলছি যে, তিনি হিন্দুদর্শন ও বিলেতিদর্শন তেলের সঙ্গে জলের মতন বেমালুম মিলিয়ে দিয়েছিলেন। সে মিশ্রদর্শন উজ্জ্বলনীলমণি ছাড়া আর কেউ গলাধঃকরণ করতে পারত না। এই অতিবিদ্যের ফলে তিনি সত্য কথা ছাড়া আর কিছু বলতেন না। সত্য কথা যে অপ্রিয় হতে পারে, তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, অপ্রিয় কথামাত্রই সত্য হতে বাধ্য, আর সে কথা যত অপ্রিয় হবে, তত বেশি সত্য হবে। ফলে তিনি একটি মহা ক্রিটিক হয়ে উঠেছিলেন—প্রায় আপনারই জুড়ি। আমি একদিন রায়মশায়ের আড্ডায় গল্পচ্ছলে বললুম যে, কৃষ্ণ কদমতলায় একা দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, আর সেই বংশীধ্বনি শুনে এক দিক থেকে রাধিকা আর-এক দিক থেকে চন্দ্রাবলী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলেন, তার পর পাঁচজনে মিলে মহা-গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলে। প্রফেসর অমনি নাক সিঁটকে মন্তব্য করলেন যে, দুই আর একে তিন হয়, পাঁচ হয় না। এ বিষয়ে দেখি রায়মশায় থেকে দেওয়ানজি পর্যন্ত সকলেই একমত। তখন আমি বললুম—শ্রীকৃষ্ণ যে একে তিন আর তিনে এক। আমার জবাব শুনে রায়মশায় বললেন, ‘বহুত আচ্ছা!’—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি একাধারে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর নন?— তাই তাঁর লীলাখেলা হচ্ছে এক দিকে সৃষ্টি আর-এক দিকে প্রলয়। প্রফেসর বললেন যে, একে তিন ধর্মে হতে পারে, অঙ্কে হয় না। আমি বললুম— গণিতেও হয়, কেননা কৃষ্ণ হচ্ছেন বীজগণিতের X, তাঁকে বিন্দুও করা যায়, তেত্রিশকোটিও করা যায়।— এর থেকে বুঝতে পারছেন, তিনি কত বড়ো ক্রিটিক!”
কথারম্ভ
সে যাই হোক, রানীমার মুখপাত্র হয়ে সখীরানী আদেশ করলেন যে, আজ একটি আজগুবি গল্প বলো। প্রফেসর অমনি বলে উঠলেন যে, “ঘোষাল-মহাশয় যা বলবেন, তাই আজগুবি হবে।” আমি সখীরানীকে সম্বোধন করে বললুম, “শুনলে তো আমি যা বলব তাই আজগুবি হবে, সেই ভরসায় আমি গল্প শুরু করছি।” প্রফেসর একটু বিরক্ত হয়ে বললেন যে, “ঘোষাল যা বলবে তা শুধু গল্পই হবে— অর্থাৎ গল্প হবে না; তার ভিতর দর্শন বিজ্ঞান কিছুই থাকবে না; ওরকম গল্প একালে চলে না। এ যুগে কাব্য হচ্ছে শাস্ত্রে বেনামদার।”
আমি বললুম, “তা যদি হয় তো পণ্ডিতমশায় গল্প বলুন, তার পরে আমি শাস্ত্রচর্চা করব।”
এ কথা শুনে সখীরানী খিল খিল করে হেসে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও মায় ঠাকুরানী। ফলে তাঁদের দন্তরুচিকৌমুদীতে আকাশবাতাসও হেসে উঠল ।
তার পর সখীরানী আবার আদেশ করলেন— “এখন গল্প বলো, কাল বৈঠকখানায় বসে তর্ক কোরো।”
আমি মনে করেছিলুম, গল্প বলব অচেতন প্রেমের। কিন্তু বেগতিক দেখে শেষটা নেহাৎ বেপরোয়া গল্প শুরু করে দিলুম। তার পত্তন করলুম চীনদেশে। কল্পনাকে দিলুম দেশের ঘুড়ির মতো উড়িয়ে, আর সেই চীনেমাটির দেশের ফুল ফল ও নরনারীর বাঁকা চেহারার বর্ণনা করলুম। সে-সবই এড়ো, সবই তেরচা, চীনেদের চোখের মতো। বলা বাহুল্য, প্রফেসর কথায় কথায় আমার ভুল ধরতে লাগলেন, জিয়োগ্রাফি এবং বটানি ইত্যাদির। অতঃপর আমি তখন বললুম যে, আমি বালিকা-বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তো এখানে উপস্থিত হই নি, আমি এসেছি রূপকথা বলতে। রূপকথার রাজ্য ম্যাপে কোথায় আছে? আমার কথার রূপ আছে কি না, তার বিচারক মা-লক্ষ্মীরা ও স্বয়ং সরস্বতী।
কথার অপমৃত্যু
তার পর, আমি আমার চীনে নায়ককে উপস্থিত করলুম। নায়কের যেরকম রূপগুণ অলংকার শাস্ত্রমতে থাকা উচিত, তার অবশ্য সে-সব ছিল। তার চোখ ছিল, যে চোখ দিয়ে সে দেখতে পারত; কান ছিল, যে কান দিয়ে সে শুনতে পারত; আর যদিও চীনে, তবু তার নাক ছিল। নায়কের রূপবর্ণনা করবার পর আমার অপরাধের মধ্যে বলেছিলুম যে, সে চীনদেশের পাস-করা মুখস্থবাগীশ ম্যাণ্ডারীনদের মতো স্থূলদেহ ও স্থূলবুদ্ধির লোক নয়, একটি মানুষের মতো মানুষ। এতেই হল যত গোল! প্রফেসর চটে উঠে বললেন যে— “নিজে কখনো স্কুলকলেজে পড় নি বলে তুমি ফাঁক পেলেই বিদ্বান লোকদের বিদ্রূপ কর।” আমি একটু বেসামাল হয়ে বললুম, “আমিও স্কুলে পড়েছি।”
“কলেজে?”
“আজ্ঞে তাও।”
“পাস তো কখনো কর নি?”
“আজ্ঞে তাও করেছি।”
“কি পাস করেছ?”
“এম. এ.।”
“কোন্ বিষয়ে?”
“প্রথমে মিক্সড ম্যাথমেটিক্স, পরে পিওর ফিলজফি।”
“কোন বৎসর?”
“ক্যালেণ্ডারে আমার নাম পাবেন না। ঘোষাল আমার ছদ্মনাম। *
“চুরি করে জেলে গিয়েছিলে বুঝি? বেরিয়ে এসে, পুনর্জন্ম লাভ করে ঘোষাল রূপ ধারণ করেছ?”
“হয়তো তাই। আমি জাতিস্মর নই, পূর্বজন্মের পাতা ওল্টাতে পারব না।”
এর পরে তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন যে, “আমি মিথ্যাবাদী ও চোরের সঙ্গে এক আসনে বসি নে।”
আমি বললুম, “যদভিরোচতে।”
উপসংহার
এর পরেই তিনি সরোষে চলে গেলেন। ঠাকুরানী আদেশ দিলেন যে, আজকের মতো সভা বন্ধ। পণ্ডিতমশায় আর আমি ধীরে ধীরে বাসায় ফিরে এলুম। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন অবাক, আর আমি নির্বাক।
তার পর রাত যখন সাড়ে দশটা, সখীরানী আমার ঘরে উপস্থিত হয়ে বললেন যে, “ঠাকুরানী আপনাকে ডাকছেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “এত রাত্তিরে কিসের জন্য?”
“সে গেলেই বুঝতে পারবেন।”
“তবু?”
“শ্যালাবাবু রেগে রায়মশায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করেছে যে, তুমি ভদ্রমহিলাদের সামনে তাঁকে গায়ে পড়ে অপমান করেছ। রায়মশায় তাই শুনে মহা চটে— তোমার উপর নয়, শ্যালাবাবুর উপর-রানীমার কাছে গিয়ে তাঁর ভ্রাতার উপর ঝাল ঝাড়ছিলেন। মীনারানীও তোমার দিক নিলেন দেখে ক্ষণে-রুষ্ট ক্ষণে-তুষ্ট রায় উল্টা রেগে বললেন যে, “ঘোষালটাকে আজই বাড়ি থেকে বার করে দেব।” মীনারানী বললেন, “তার আগে একবার ঠাকুরানীর মত জেনে নাও।” অমনি তিনি ঠাকুরানীর মন্দিরে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। ফলাফল ঠাকুরানীর কাছেই শুনতে পাবে।”
“আচ্ছা যাচ্ছি। তোমার রায় কি?”
“ও রসিকতাটা না করলেই ভালো হত। প্রফেসরের যে অজীর্ণ বিদ্যায় মাথা ঘুরে গেছে তা আমরা সকলেই জানি— এমন-কি, মীনারানীও। তাঁর মত— তোমার কথা সত্যও হতে পারে, রসিকতাও হতে পারে। কিন্তু তুমি ও কথা বলে ভালোই করেছ। মানুষের ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। এখন ঠাকুরানীর মত কি, তা তুমি তাঁর কাছে গেলেই শুনতে পাবে। আমি জানি নে।”
আমি “আচ্ছা” বলে আবার ঠাকুরবাড়িতে ফিরে গেলুম, কারণ শুনলুম, তিনি সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ঠাকুরানী আমাকে আসন গ্রহণ করতে অনুমতি দিয়ে ধীরে শান্তভাবে বললেন, “আমার বিশ্বাস তুমি সত্য কথা বলেছ, কেননা তুমি যে কৃতবিদ্য, তা প্রত্যক্ষ। ছদ্মবেশ গায়ে যত সহজে পরা যায়, মনে তত সহজে নয়। মন জিনিসটে হাজার ঢাকতে চাইলেও যখন-তখন বেরিয়ে পড়ে।
“তুমি বোধ হয় জান যে, মীনা আমার আত্মীয়া। যখন দেখলুম যে বিপত্নীক রায়মশায়ের তৃতীয় পক্ষ করতে আর তর সয় না, আর বাল্যবিবাহেও তাঁর আপত্তি নেই, বিধবাবিবাহেও নয়— তখন বাল্যবিধবাবিবাহরূপ যুগপৎ অধর্ম থেকে তাঁকে রক্ষা করবার জন্য মীনাকে তাঁর হস্তে সমর্পণ করলুম। এ কাজ ভালো করেছি কি না জানি নে। সনাতন ধর্মের বিধি-নিষেধ সকলের পক্ষে ভালো হতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকের পক্ষে নয়। কোনো কোনো রমণীর স্বধর্ম হচ্ছে ফুটে ওঠা, আর শাস্ত্রের ধর্ম হচ্ছে তাকে ফুটতে না দেওয়া। তাতেই এ জাতীয় স্ত্রীলোকের জীবন হয় প্রাণহীন শরীরধারণ মাত্র। এ কথা অবশ্য ভূঙ্গেশ্বর বোঝে না। কারণ সে জীবনের মূলও জানে না, ফুলও জানে না। তার বিদ্যে হচ্ছে জীবনের ভাষা ভুলে তার বানান শেখা। সে যাই হোক, তোমায় আজ শেষ রাত্তিরেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। কাল সকালে যেন কেউ তোমার দেখা না পায়। এতে তোমারও মর্যাদা রক্ষা হবে, ভূঙ্গেশ্বরেরও শিক্ষা হবে
“রায়মশায় তোমার ছ মাসের ছুটি মঞ্জুর করেছেন; পুরো মাইনেয়। তুমি যেখানে যাও, যেখানে থাক, শ্যামদাসীকে চিঠি দিয়ে জানিও, আর আমাদেরও যদি কিছু বলবার থাকে তো শ্যামদাসী তোমাকে জানাবে।
“দেখো, আমার বিশ্বাস কলেজ ছেড়ে, সংসারে ঢুকেই তোমার জীবনে কোনো একটা ট্রাজেডি ঘটেছিল, আর সেই থেকে তোমার জীবনযাত্রার মোড় ফিরে গেছে। তুমি যে জীবনটাকে প্রহসনরূপে দেখতে ও দেখাতে চাও, সে হচ্ছে ঐ ট্রাজেডির বাহ্য আবরণ মাত্র।
“আজ তবে এসো। শ্যামদাসী পরে তোমার সঙ্গে দেখা করবে।”
আমি বাসায় ফিরে আসবার কিছুক্ষণ পরে শ্যামদাসী এসে যথেষ্ট টাকা দিয়ে বললেন, “বিদেশে কখনো যদি কোনো বিপদে পড় আমাকে জানিও, ঠাকুরানী তোমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে। তুমি চলে গেলে এ পুরী নিরানন্দপুরী হবে।”
তার পর থেকেই তীর্থভ্রমণ করছি, অর্থাৎ নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পরশু শ্যামদাসীর একখানি চিঠি পেয়ে কাল কলকাতায় এসেছি। এ দিকে শ্যামদাসীও আজ উপস্থিত হয়েছেন। আজ রাত্তিরের ট্রেনেই নাকি মকদমপুর রওনা হতে হবে। আমার সেখানে পদবৃদ্ধি হয়েছে, সে বাড়িতে আমি এখন শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছি। ঠাকুরানীকে শেখাতে হবে ইংরেজি, সখীরানীকে সংগীত ও মীনারানীকে অঙ্ক। ঠাকুরানী এখন আয়ব্যয়ের হিসাব তাঁর কাছে বুঝিয়ে দিতে চান, সেইজন্যই তাঁর তেরিজ-খারিজ শেখা দরকার। দেখেছেন, একবার কোয়ালিফিকেশনের কথা বলে কি মুশকিলেই পড়েছি। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলুম যে, দেশের কাজ
যে, দেশের কাজ করতে গেলে কি কোয়ালিফিকেশনের প্রয়োজন?
“তোমার বিপদটা কি ঘটল, তা তো বুঝতে পারছি নে।”
“একটি বালবিধবা আর একটি বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা, আর-একটি স্বাধীনভর্তৃকা, এই তিনজনের ত্রিসীমানায় ঘেঁষলে কি বিপদের সম্ভাবনা নেই? সখীরানী তো আগেই বলেছে যে, আমার বুকের পাটা নেই। আমি তো আর শেলী নই যে, এ অবস্থায় এপিসাইকিডিয়ন লিখে পরে ত্রি-রানী সংগমে ডুবে মরব?”
“একটু ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে হয়তো দেখবে যে, এ তিনই এক।”
“অর্থাৎ তড়িল্লেখা, তপন ও শশী তিনই এক—অর্থাৎ আলো। কিন্তু ঐ তিনের মধ্যে এক যদি উপরন্তু বৈশ্বানরময়ী হন? “
“সখীরানী তো আগেই বলেছে, ঠাকুরানী তোমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।”
তার পর ঘোষাল বললে, “তবে আসি, সখীরানী অনেকক্ষণ আমার জন্য একা অপেক্ষা করছে।”
“কোথায়?”
“রাস্তায় ট্যাক্সিতে।”
তার পর ঘোষাল “au revoir” বলে অন্তর্ধান হল।
শেষ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলুম না যে, ঘোষালের গল্পটি সত্য কিম্বা সর্বৈব রসিকতা—অথবা অসম্বদ্ধ প্রলাপ।
আপনাদের কি মনে হয়?
ভাদ্র ১৩৪২