পুতুলের বিবাহবিভ্রাট

পুতুলের বিবাহবিভ্রাট

“ও চাকরিতে তো ইস্তফা দিলি, তার পর কি করলি ঘোষাল?”

“মাস্টারি।”

“বাহাদুর ছেলে! দুদিন আগে ছিলি যাত্রাদলের ছোকরা, আর তার পরেই হলি মাস্টার?”

“হুজুর! আমি হয়েছিলুম music-master; তার জন্য ব্যাকরণ, অভিধান, হিস্টরি, জিওগ্রাফি কিছুই জানবার দরকার নেই।”

“গান শিখিয়ে লোকের কি পরবস্তি হয়?”

“হুজুর! যাত্রাদলে যা মাইনে পেতুম, তার দশগুণ মাইনে পেলুম; তার উপর থাকবার ঘর আর খাবার অন্ন, উপরন্তু বকশিশ।”

“যাত্রাদলের গান শিখিয়ে এত মাইনে! তার উপর খোরপোষ ফাউ! তোর ছাত্র ছিল পাগল।”

“তা নয় হুজুর। আমি তো গানের মাস্টার হইনি, হয়েছিলুম বাজনার— এসরাজের।”ও যন্ত্র তুই মন্দ বাজাস নে। কিন্তু তোর চাইতে ঢের বড়ো বড়ো খাঁ সাহেবেরা আছেন, যাঁরা ওর সিকি মাইনের নোকরি পেলে বর্তে যেতেন।”

“কিন্তু তাঁরা যে ইংরেজি জানেন না। ছাত্র আমার বেশির ভাগ ইংরেজিতেই কথা কইত; বিলেতি সংগীতে পারদর্শী ছিল— আর সে বিষয়ে সে বিলেতি ভাষায় বক্তৃতা করত।”

“যাক ও-সব কথা। যার টাকা সে জলে ফেলে দেবে, আমি বলবার কে? এদের বুঝি টাকার লেখাজোখা ছিল না?”

“হুজুর! খাজাঞ্চির কাছে শুনেছি তাদের আয়ের অঙ্কের চাইতে ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ঢের বেশি।”

“বনেদি ঘর বটে! আচ্ছা, ছেলেটি বাজনা শিখলে কেমন?”

“হুজুর! শিখেছিল মামুলি ঢঙের বাজনা; কিন্তু বাজাত নিজের ঢঙে। সে চাইত সব জিনিসেরই সংস্কার করতে। কিন্তু সে সংস্কার ও বিকারের প্রভেদ বুঝত না। ফলে সংগীতে শিব গড়তে সে বাঁদর গড়ত।”

“আর তুই এ-সব গোয়াতুর্মির প্রশ্রয় দিয়েছিস?”

“দিয়েছি। কেননা তর্কে তাকে পরাস্ত করতে পারি নি। সে তর্ক ঘোর দার্শনিক, উপরন্তু ইংরেজি ভাষায়। আর স্বাধীনতাভক্ত বলে সে রাগরাগিণীর অসবর্ণ বিবাহের ছিল একনিষ্ঠ ঘটক।”

“তুই মাস্টার হয়ে ছাত্রের কাছে তর্কে হেরে গেলি?”

“হুজুর! আমি তো কোন্ ছার! ইংরেজরাজ যদি তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতেন তা হলে হেরে এ দেশ থেকে নিশ্চয়ই পালাতেন— আর পিঠপিঠ ভারত স্বাধীন হয়ে উঠত। সে কোনো কিছুরই ভেদাভেদ মানত না। তার কাছে গানমাত্রেই খেয়াল।

“আচ্ছা, তা হলে খেয়াল তো সে গ্রাহ্য করত?”

“না হুজুর; আমরা যাকে খেয়াল বলি, তা শুনলে সে কানে হাত দিত। ও ঢঙের গানের নাকি গা নেই, আছে শুধু গহনা। খেয়াল মানে নাকি খামখেয়াল—তার নিজের খেয়াল!”

“এ বুদ্ধি তার হল কোত্থেকে?”

“তার মার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল। গিন্নি ছিলেন মূর্তিমতী খেয়াল। তাঁর নিত্যনতুন খেয়ালের ধাক্কায় ও-পরিবার ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের মতো পাঁচজন আশ্রিত লোকদের কপালে জুটত, ‘ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেকে চাঁদ’।”

“তোর কপালে কি জুটেছিল?”

“হুজুর, চাঁদ!”

“বাড়ির কর্তা কি নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমতেন!”

“করবেন কি? গিন্নির খেয়াল মেটাতে টাকা চাই, দিতে হবে। ‘আসবে কোত্থেকে? ধার কর-না! শুধবে কে? লবডঙ্কা!” এই ছিল সে পরিবারের নিয়ম

“তুই যত অদ্ভুত কথা বানিয়ে বলছিস।”

“হুজুর! তা হলে গিন্নির একটা আজগুবি খেয়ালের কথা শুনুন। খোকাবাবু অনেক দিন বিয়ে করেন নি। কারণ বিয়েতে তাঁর আপত্তি ছিল। বিয়ে করা মানে নাকি একটি স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা হরণ করা!”

“আমার! বলিস কি? বিয়ে করলে তো পুরুষেরই স্বাধীনতা চলে যায়।”

—শেষটায় তার বয়েস যখন তিরিশ পেরোল, তখন তার মায়ের খেয়াল হল পুত্রবধূর মুখ দেখতেই হবে। মায়ের খেয়ালের সঙ্গে ছেলের খেয়ালের বাধল ঝগড়া মায়ের খেয়ালই থাকল বজায়; খোকাবাবু বিয়ে করলে। তার পর গিন্নির নিত্যনতুন বিয়ে দেবার নেশা লাগল। বিয়ে মানে তিনি বুঝতেন বাজনাবাদ্য, চোখঝল্সানো আলো, অলংকার ও পানভোজন। তাঁর খেয়াল হল, পুত্রবধূর পুতুলের সঙ্গে ওঁদের বন্ধু বোসজার পুত্রবধূর পুতুলের বিয়ে দেবেন। খোকাবাবু এ কথা শুনে প্রথমে মহা চটে গেলেন; শেষটায় রাজি হলেন, এ ক্ষেত্রে পুতুলের অসবর্ণ বিবাহ হবে, তাই জেনে! কর্তাও এতে মহা আপত্তি করলেন, কিন্তু গিন্নি যখন বললেন যে এ বিয়ের খরচ তিনি দেবেন, তখন আর তাঁর আপত্তি টিকলো না। বোসজা গিন্নির গহনা বন্ধক রেখে টাকাটা জোগাড় করে দেবেন বললেন। গিন্নির বারোমেসে মহাজন ছিলেন বোসজা। তাতেও বোসজার দু পয়সা লাভ ছিল।

তার পর মাসখানেক গিন্নি বিয়ের জল্পনা-কল্পনায় মত্ত হয়ে রইলেন। মেয়ে তাঁদের, ও ছেলে বোসপরিবারের। বিয়ের সময় কোন্ কোন্ ক্রিয়াকর্ম অবশ্যকর্তব্য, সে বিষয়ে গিন্নির সঙ্গে বোসগিন্নির ঘোর মতভেদ ছিল। কেউ কারো মত ছাড়বেন না। বোসগিন্নি বলেন, ধর্মকর্মের বিষয়, আমরা কারো কথায় তার একচুলও এদিক-ওদিক করতে পারব না। আর খোকাবাবুর মা বলেন, বনেদি ঘরের চাল আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারব না। শেষটায় দাঁড়াল এই যে, এ সম্বন্ধ প্রায় ফেঁসে যাবার জো হল। তার পর গিন্নির আদেশে দু পক্ষের মধ্যস্থতা করতে আমি নিযুক্ত হলুম। আমি গিয়ে বোসগিন্নিকে বললুম যে, আপনাদের বাড়িতে আপনাদের কর্তব্য আপনারা করবেন, আর মেয়ের বাড়িতে কন্যাপক্ষের কর্তব্য আমরা করব। শুধু দেখবেন যেন বরের কপাল জুড়ে চন্দন মাখাবেন না। আর বর যেন জাঁতি হাতে করে বিয়ে করতে না আসে; আসে যেন একটা নখকাটা কাঁচি হাতে করে। আপনি চান যে অমঙ্গল না হয়; আমাদের গিন্নি চান দেখতে যেন অসুন্দর না হয়। আর পিঁড়েয় আলপনা— সে আর্ট স্কুলে ফরমায়েস দেওয়া হয়েছে। মনে রাখবেন, এ হচ্ছে আসলে বড়োমানুষের ছেলেখেলা। এই বলে প্রথম ধাক্কা আমি সামলে নিলুম।

তার পর বরের শোভাযাত্রা কিরকম হবে, তা নিযে গোল বাধল। গিন্নি চান গোরার বাদ্যি, বোসজা তাতে রাজি নন। তিনি বলেন, পুতুলের বিয়েতে ও হবে কেলেঙ্কারি। আমি খেটে-খাওয়া মানুষ, আমি এত সোরগোল করে পুতুলের বিয়ে দিলে ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পারব না। আমার ওকালতি ব্যবসা সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে। কিন্তু গিনি নাছোড়বান্দা। তাঁর কথা হচ্ছে— হয় বিয়ে ভেঙে দাও, নয় গোরার বাদ্যি বাজাও। এ কথা শুনে খোকাবাবু ফোঁস করে উঠলেন, তিনি বললেন— গোরার বাদ্যি সংগীতই নয়। আমি তা হতেই দেব না। ইংরেজরা আমাদের অধীন করেছে কি করে? পলাশীর যুদ্ধের সময় গোরার বাদ্যি বাজিয়ে। ভারত স্বাধীন করতে হবে একতারা বাজিয়ে। শেষটায় ঠিক হল, বর আসবেন মোটর চড়ে, আর গাড়িতে বিজলী বাতি জ্বালিয়ে। তার পর যত-কিছু ধুমধাম এখানে করা যাবে। বরযাত্রীদের জন্য খানা পেলিটির দোকান থেকে আনতে হবে, কিন্তু খেতে হবে কলার পাতায় হাত দিয়ে এবং মাটিতে কুশাসনে বসে। আর বিলেতি পানীয় দেওয়া হবে মাটির ভাঁড়ে। কর্তাবাবু সব শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ঘরে দুয়োর দিয়ে বেদান্ত পড়তে লাগলেন, আর ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই মন্ত্র জপ করতে লাগলেন।

এর পর রায়মশায় বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন, “থাম্, ঘোষাল। ও-সব কেলেঙ্কারির কথা আমি শুনতে চাই নে। ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ের ভোজ, আর খানা আসবে পেলিটির বাড়ি থেকে! তোর গল্প সবই হচ্ছে যা অসম্ভব তাই সম্ভব বলে চালিয়ে দেওয়া। নিজে তো চিরকুমার, বিয়ের ক্রিয়াকর্মের তুই বেটা জানবি কি? এখন যা, ঐ মাটির ভাঁড়ে বিলেতি পানীয় খা গিয়ে। তোর তো পাত্রাপাত্রের বিচার নেই, পানীয় পেলেই হল!”

“হুজুর! এ তো আমার ছেলে মেয়ের বিয়ে নয়—এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তারই বর্ণনা করছি। আর হলপ করে বলছি আমার একটি কথাও বানানো নয়। দুনিয়ার বড়োমানুষমাত্রই কি হুজুরের তুল্য? এদের অনেকেই কি কাণ্ডজ্ঞানহীন নন? আর বিয়ে কি বললেই হয়? লাখ কথার পর তবে একটা বিয়ে স্থির হয়। আর যার যত টাকা, তার তত কথা। আপনি শেষ পর্যন্ত শুনলে খুশি হবেন।”

“আচ্ছা, তবে বলে যা। শোনা যাক কেলেঙ্কারি কতদূর গড়াল!”

“হুজুর! তবে ধৈর্য ধরে শুনুন।”

“বিয়ের শুভদিন শুভক্ষণ সব পাঁজি দেখে ঠিক করা হল। কিন্তু তার পরও একটু গোল হল। বিয়ের পথ কাঁটায় ভরা। আর সেই কাঁটা তোলা হল আমার কাজ।”

প্রথম মতভেদ হল পত্র নিয়ে। গিন্নি পত্রে কিছুতেই রাজি হলেন না। পত্র করলে নাকি বিয়ের আগে বর মারা গেলে কনে বাগদত্তা হয়ে থাকে; তখন তার আবার বিয়ে দেওয়া কঠিন। প্রায়শ্চিত্ত না করলে আর হয় না। আর যে ক্ষেত্রে মেয়ের কোনো দোষ নেই, সেখানে মেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে কেন?

আমি বোসগিন্নির কাছে গিয়ে এ পক্ষের কথা নিবেদন করলুম। বোসগিনি বললেন— বর হচ্ছে পুতুল; তার আবার বাঁচা-মরা কি?

আমি বললুম—পুতুলটি ভেঙে যেতে কতক্ষণ?

এ কথা তিনি বুঝলেন।

তার পর গোল উঠল— পাকা- দেখা নিয়ে। গিন্নি তাতে কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন- আমাদের ঘরের মেয়ে কাউকেও দেখাই নে; সে কাঁচা-দেখাই হোক, আর পাকা-দেখাই হোক। আর বর আমরা বিয়ের আগে দেখতে চাই নে।

এতে বোসগিন্নি অপমানিত বোধ করলেন, বললেন এ হচ্ছে উকিলের উপর জমিদারের অবজ্ঞার চোখে-আঙুল দেওয়া চাল।

আমি, বোসগিন্নিকে গিয়ে বললুম—ও বাড়ির মেয়ে আগে দেখবার কোনো প্রয়োজন নেই। সকলেই জানে, তাদের চাঁপাফুলের মতো রঙ, তিলফুলের মতো নাক, পদ্মফুলের মতো চোখ, গোলাপফুলের মতো গাল, দাড়িমফুলের মতো ঠোঁট, কুন্দফুলের মতো দাঁত। এতে রাগ করবার কিছু নেই।— বলতে ভুলে গিয়েছি, বোস-পরিবার যেমন কালো তেমনি নিরাকার।

গিন্নিমা যে কনে দেখাতে কিছুতেই রাজি হন নি, তার কারণ শুনলুম— তিনি নাকি তাকে সাজাচ্ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর তুল্য অপূর্বরকম কনে-সাজাতে আর কেউ পারে না। কনের সাজ হবে পুরো স্বদেশী, অথচ চমৎকার।

কনে আমি অবশ্য দেখি নি। কিন্তু শুনেছি পুতুলটি ছিল কাশীর গুড়িয়া পুতুল। তাকে পরানো হয়েছিল তাসের কাপড়ের ঘাগরা, কিংখাপের চেলী, দিল্লির ওড়না, পায়ে দেওয়া হয়েছিল পাঞ্জাবের জরীর নাগরা। আর তার গহনা ছিল আগাগোড়া স্বদেশী ও সেকেলে। অবশ্য গহনার বিষয় আমি বেশি কিছু জানি নে। তবে শুনেছি— কঙ্কণ রুলি মরদানা মুড়কিমাদুলি বাজু তাবিজ বাজুবন্ধ চন্দ্রহার রতনচক্র বাঁকমল পায়জোড় চুকি কান কানবালা নথ নোলক নাকচাবি বেসর— তার শোভা বৃদ্ধি করছিল। অবশ্য চিক গোপহার সরস্বতীহার সাতনরীও তার গলায় ওতপ্রোতভাবে দেওয়া হয়েছিল।

এই সালংকারা কন্যার গা ছিল না, কিন্তু শুধু গহনা। খোকাবাবুর খেয়ালের মতো। শুভদিনে, শুভক্ষণের আধ ঘণ্টা আগে বোসজা বরকে সঙ্গে করে মোটর-গাড়িতে এলেন। বাজনার ভিতর গ্রামোফোনে বাজছিল, ‘তুমি কাদের কুলের বউ?’ আর বাড়ির ভিতর মেয়েরা হুলুধ্বনি করতে লাগল।

গিন্নিমা এসে বললেন— দেখি, বর স্বদেশী কি না। দেখে কিছু খুঁত ধরতে পারলেন না। একটা এক-হাত প্রমাণ জাপানি পুতুল, যা জাপান থেকে এসেছিল নেংটা; তাকে পরানো হয়েছে খদ্দরের গান্ধী-টুপি। গিন্নিমা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে, বরের গলায় পৈতে নেই। অমনি অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন— আমাদের বাড়ির মেয়েকে পৈতেহীন বরে সম্প্রদান করতে দেব না। হুকুম হল, ডাকো পুরুতকে। আমি অবশ্য পুরুত সেজেছিলুম। আমি হাজির হয়ে তাঁর মত শুনে বললুম—পুতুলের আবার জাত কি? গিন্নি বললেন—ওদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে তবে তো বিয়ে দিতে হবে? আমি বললুম—অবশ্য তাই। গিন্নি বললেন-প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর ওর জাত কি হবে? বোসজা বললেন— ঘোষাল, দাও তোমার পৈতেগাছি ওটাকে পরিয়ে। গিন্নি বললেন, তা যেন হল; কিন্তু পুরুতের গলায় পৈতে নেই, সে বিয়ে দেবে এ কথা শুনে আমি বললুম— চেনা বামুনের আর পৈতের দরকার কি?

এই সময় খোকাবাবু এসে উপস্থিত হলেন—আর-এক নতুন ফেঁকড়া তুললেন।

খোকাবাবু ঘরে ঢুকেই বোসমশায়কে বললেন— ওস্তাদজির পৈতে ওঁকে ফিরিয়ে দিন। বোসমশায় খোকাবাবুর মুখ-চোখের চেহারা দেখেই বুঝেছিলেন যে, তিনিও অগ্নিশর্মা হয়েছেন; তাই তিনি দ্বিরুক্তি না করে আমার পৈতে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। খোকাবাবু তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করলেন- জাতিভেদ তবে তুমি মান?

খাওয়া-দাওয়ায় মানি নে, বিয়ে পৈতেয় অবশ্য মানি।

তার পর গিন্নিমা প্রশ্ন করলেন—এ বিয়ে কি তা হলে হবে না?

না হয় তো তার জন্য আমি দুঃখিত নই।

তুমি তো এ বিয়েতে প্রথম থেকে আপত্তি কর নি?

আমার এ ছেলেখেলায় মত ছিল না। তবে অমত যে করি নি, তার একমাত্র কারণ এ হচ্ছে অসবর্ণ বিবাহ

পুতুলের আবার জাত কি?

আমাদের সঙ্গে পুতুলের প্রভেদ কি? আমরা রক্তমাংসের পুতুল, আর ওরা মাটির কিংবা নেকড়ার পুতুল। এই তো?

তুমি তো ব্রাহ্মণকন্যা বিয়ে করতে আপত্তি কর নি?

সে তোমার খাতিরে। আমরা যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করছি, তার প্রথম experiment করতে হবে পুতুল নিয়ে। পুতুলের রাজ্যে এ প্রথা চলিত হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে পরে তা প্রচলিত হবে। কি বলেন ওস্তাদজি?

পুতুলের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে আমি অভিজ্ঞ নই। আজীবন পুতুলরাই আমাকে নিয়ে খেলা করেছে, আমি কখনো পুতুল নিয়ে খেলা করি নি; সুতরাং তাদের মতিগতি আমার অবিদিত।

গিন্নিমা বললেন, ঘোষাল ঠিক বলেছ। আমার ছেলেকে নিয়ে একটি পুতুল খেলা করছে। আমার ছেলে এখন হয়েছে পুতুল, সেই পুতুল হয়েছে মানুষ।

খোকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন— কে সেই পুতুল— যে আমাকে নিয়ে পুতুল নাচাচ্ছে?

বউমা। আবার কে?

তোমার তাই বিশ্বাস?

হাঁ। তোমার বিয়ে হয়ে অবধি দেখছি, তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ। তুমি যে পুতুলের বিয়েতে মত করেছিলে, সেও বউমার শখ মেটাতে; আর এখন যে এসে গোলমাল করছ, সেও বউমার কথা শুনে। পাছে বিয়ে ভেঙে যায়, এই ভয়ে বউমা তোমাকে চর পাঠিয়েছেন।

তাই যদি তোমার বিশ্বাস হয়, তবে যা খুশি তাই করো, আমি আর কিছু বলব না।

তাই তো করব। একবার ছেলের বিয়ে দিয়ে হয়েছি বউমার দাসী, আবার কাউকে বিয়ে দিতে আমার শখ নেই। নেড়া দুবার বেলতলায় যায় না। এই দেখো বরের আমি ঘাড় মটকে দিচ্ছি—আর কনেকে ছিঁড়ে টুকরো করে দিচ্ছি।

তিনি মুখে যা বললেন, কাজে তাই করলেন।

খোকাবাবু বললেন, কোনো বিষয়ের শেষ রক্ষা করা তো তোমার ধাতে নেই।

গিন্নিমা উত্তর করলেন, কিন্তু বউমা যখন বিয়ে ভেঙে গেল শুনে চোখের জল ছাড়বেন তখন আর তোমার বুদ্ধির হালে পানি পাবে না। তোমার স্বাধীনতা হচ্ছে এই একরত্তি মেয়ের সম্পূর্ণ অধীনতা। যাও ঘোষাল, বরযাত্রীদের গিয়ে বলে এসো একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই এ বিয়ে আজ হবে না।

আমি বিবাহের সভায় উপস্থিত হয়ে বললুম—একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই আজ বিয়ে বন্ধ। বর ও কনে দুইজনেই sudden heart failure এ মারা গেছে। এদের দুজনেরই যে বেরিবেরি ছিল তা আমরা জানতুম না। কিন্তু বিয়ে বন্ধ হয়েছে বলে, আপনাদের পানভোজন বন্ধ হবে না। খাবার সব প্রস্তুত, এখন উঠুন, সব খেতে চলুন তাঁরা সকলেই উঠলেন এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি সাফ দেখে মাদ্রাজি ব্যাণ্ডের দল ‘God save the King’ বাজাতে শুরু করলে। বাড়ির ভিতর থেকে বউমার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। খোকাবাবু অমনি কি একটা ওষুধের শিশি হাতে করে অন্দরমহলে চলে গেলেন। গিন্নি আর রা কাড়লেন না।

রায়মশায় সব শুনে বললেন, “শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। *

তার পর জিজ্ঞেস করলেন, “পেলিটির বাড়ির খানার কি হল?”

“গিন্নির হুকুমে তা দিয়ে কাঙালী বিদেয় করা হয়। তিনি বললেন— এ তো বিয়ে নয়, শ্ৰাদ্ধ।”

“আর বিলেতি পানীয়?”

“গিন্নি তাও কাঙালীদের দিতে হুকুম করেছিলেন; কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজনরা এই বলে আপত্তি করলেন যে, কাঙালীরা ও-পানীয় গলাধঃকরণ করলে riot করবে; তার পর বেপরোয়া হয়ে বাড়িঘরদোর লুট করবে। গিন্নি তাতে বললেন যে—তা হলে তোমরাই এর সদ্বব্যবহার করো। তার পর তাঁর অনুগত দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা আধ ঘণ্টার মধ্যেই তা শেষ করলেন।”

“আর তুই বেটা কি করলি?”

“আমি সেই রাত্তিরেই বিদায় নিলুম। গিন্নি বললেন, এসো। এ বাড়ি আগে ছিল সংগীতের আলয়, কিন্তু বউমা এখানে অধিষ্ঠান হবার পর হয়েছে হট্টগোলের আখড়া।

“আমি মনে মনে ভাবলুম—যত দোষ বেচারা বউমার। গিন্নির ন-ভূত-ন-ভবিষ্যতি খেয়ালের নয়!”

আশ্বিন ১৩৪৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *