ফরমায়েশি গল্প

ফরমায়েশি গল্প

মকদমপুরের জমিদার রায়মশায় সন্ধ্যা-আহ্নিক করে সিকি ভরি অহিফেন সেবন করে যখন বৈঠকখানায় এসে বসলেন তখন রাত এক প্রহর। তিনি মসনদের উপর তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়ে ঝিমতে লাগলেন। সভাস্থ ইয়ার- বক্সির দল সব চুপ করে রইল; পাছে হুজুরের ঝিমুনির ব্যাঘাত হয়, এই ভয়ে কেউ টু শব্দও করলে না। খানিকক্ষণ বাদে রায়মশায় হঠাৎ জেগে উঠে গা-ঝাড়া দিয়ে বসে প্রথম কথা বললেন, “ঘোষাল! গল্প বলো।”

রায়মশায়ের মুখ থেকে এ কথা পড়তে-না-পড়তে তাঁর ডান ধার থেকে একটি গৌরবর্ণ ছিপছিপে টেড়িকাটা যুবক হাসিমুখে চাঁচা গলায় উত্তর করলে,

“যে আজ্ঞে হুজুর, বলছি।”

“আজ কিসের গল্প বলবি বল তো?”

“বর্ষার গল্প, হুজুর।”

“একে শ্রাবণ মাস, তায় আবার তেমনি মেঘ করেছে, তাই আজ ঘোষাল বর্ষার গল্প বলবে। ওর রসবোধটা খুব আছে। কি বলেন, পণ্ডিত মহাশয়?”

একটি অস্থিচর্মসার দীর্ঘাকৃতি পুরুষ এক টিপ নস্য নিয়ে সানুনাসিক স্বরে উত্তর করলেন, “তার আর সন্দেহ কি? তা না হলে কি মশায়ের মতো গুণগ্রাহী লোক আর ওকে মাইনে করে চাকর রাখেন? তবে জিজ্ঞাস্য হচ্ছে এই যে, ঘোষাল আজ কি রসের অবতারণা করবে?”

ঘোষাল তিলমাত্র দ্বিধা না করে বললে, “মধুর রসের। বর্ষার রাত্তিরে আর কি রস ফোটানো যায়?”

রায়মশায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন, ভূতের গল্প চলবে না? কি বলেন স্মৃতিরত্ন?”

“আজ্ঞে চলবে না কেন, তবে তেমন জমবে না। ভয়ানক রসের অবতারণা শীতের রাত্রেই প্রশস্ত।”

ঘোষাল পণ্ডিত মশায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, “এ লাখ কথার এক কথা। কেননা মানুষের বাইরেটা যখন শীতে কাঁপছে, তখনি তার ভিতরটাও ভয়ে কাঁপানো সংগত। এই দুই কাঁপুনিতে মিলে গেলে গল্পের আর রসভঙ্গ হয় না।”

পণ্ডিতমশায় এ কথা শুনে মহা খুশি হয়ে বললেন, “তা তো বটেই! আর তা ছাড়া মধুর রসের মধ্যেই তো ভয়ানক প্রভৃতি সকল রসই বর্তমান, তাতেই—না অলংকারশাস্ত্রে ওর নাম আদিরস।”

রায়মশায়ের মুখ দিয়ে এতক্ষণ শুধু অম্বরি তামাকের ধোঁয়ার একটি ক্ষীণ ধারা বেরোচ্ছিল, এইবার আবার কথা বেরোল; কিন্তু তার ধারা ক্ষীণ নয়।

“আপনার অলংকারশাস্ত্রে যা বলে বলুক, তাতে কিছু আসে যায় না। আমার কথা হচ্ছে এই, আমি এখন বুড়ো হতে চললুম—বয়েস প্রায় পঞ্চাশ হল। এ বয়েসে প্রেমের কথা কি আর ভালো লাগবে? ওসব গল্প, যাও ছেলে-ছোকরাদের শোনাও গিয়ে।”

উপস্থিত সকলেই জানতেন যে, রায়মশায় তাঁর বয়েস থেকে তাঁর তৃতীয় পক্ষের সহধর্মিণীর বয়েস—অর্থাৎ ঝাড়া পনেরো বৎসর চুরি করেছেন, অতএব তাঁর কথার আর কেউ প্রতিবাদ করলেন না। শুধু ঘোষাল বললে, “হুজুর, ছেলে-ছোকরারা নিজেরা প্রেম করতে এত ব্যস্ত যে প্রেমের গল্প শোনার তাদের ফুরসৎ নেই। তা ছাড়া আদিরসের কথা শোনায় ছেলেদের নীতি খারাপ হয়ে যেতে পারে, হুজুরের তো আর সে ভয় নেই।”

“দেখেছেন পণ্ডিতমশায়, ঘোষাল কেমন হিসেবী লোক! যাই বলুন, কার কাছে কোন্ কথা বলতে হয়, তা ও জানে।”

“সে কথা আর বলতে! শাস্ত্রে বলে, যৌবনে যার মনে বৈরাগ্য আসে সেই যথার্থই বিরক্ত, আর বৃদ্ধ বয়সেও যার মনে রস থাকে সেই যথার্থই রসিক। ঘোষাল কি আর না বুঝে-সুঝে কথা কয়? ও জানে আপনার প্রাণে এ বয়সেও যে রস আছে, এ কালের যুবাদের মধ্যে হাজারে একজনেরও তা নেই।”

“ঠিক বলেছেন পণ্ডিতমশায়। আমি সেদিন যখন সেই ভৈরবীর টপ্পাটাই গাইলুম, হুজুর শুনে কত বাহবা দিলেন; আর সেই গানটাই একটা পয়লা-নম্বরের এম. এ.র কাছে গাওয়াতে সে ভদ্রলোক কানে হাত দিলে, বললে, অশ্লীল।”

“কোন্ গানটা ঘোষাল?”

“গোরী তুনে নয়না লাগাওয়ে যাদু ডারা—“

“কি বলছিস ঘোষাল, ঐ গান শুনে ইস্টুপিট্ কানে হাত দিলে? অমন কান মলে দিতে পারলি নে? হতভাগাদের যেমন ধর্মজ্ঞান তেমনি রসজ্ঞান! ইংরেজি পড়ে জাতটে একেবারে অধঃপাতে গেল!”

এই কথা শুনে সে-সভার সব চাইতে হৃষ্টপুষ্ট ও খর্বাকৃতি ব্যক্তিটি অতি মিহি অথচ অতি তীব্র গলায় এই মত প্রকাশ করলেন যে-অধঃপাতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন আবার উঠছে।

“তুমি আবার কি তত্ত্ব বার করলে হে উজ্জ্বলনীলমণি?”

রায়মশায় যাঁকে সম্বোধন করে এ প্রশ্ন করলেন, তা নাম নীলমণি গোস্বামী। ঘোষাল তার পিছন থেকে ‘গোস্বামী’টি কেটে দিয়ে সুমুখে ‘উজ্জ্বল’ শব্দটি জুড়ে দিয়েছিল। তার এক কারণ, গোস্বামী মহাশয়ের বর্ণ ছিল, উজ্জ্বল নয়— ঘোর শ্যাম; আর-এক কারণ, তিনি কথায় কথায় উজ্জ্বলনীলমণির দোহাই দিতেন। এই নামকরণের পর সে রোগ তাঁর সেরে গিয়েছিল।

জমিদার মশায়ের প্রশ্নের উত্তরে গোঁসাইজি বললেন, “আজ্ঞে, ইংরাজি-নবীশদের যে মতিগতি ফিরছে তা আমি জেনেশুনেই বলছি। আমারই জনকত পাস-করা শিষ্য আছে, যাদের কাছে ঘোষাল যদি ও গানটা না গেয়ে গান ধরত—

গেলি কামিনী গজবরগামিনী
বিহসি পালটি নেহারি

তা হলে আমি হলপ করে বলতে পারি তারা ভাবে বিভোর হয়ে যেত।”

“ও দুয়ের তফাতটা কোথায়?”

“তফাতটা কোথায়?— বললেন ভালো পণ্ডিতমশায়! একটা টপ্পা আর একটা কীৰ্তন!”

“অর্থাৎ তফাত যা, তা নামে!”

“অবাক করলেন। তা হলে সোরী মিয়ার সঙ্গে বিদ্যাপতি ঠাকুরের প্রভেদও শুধু নামে? নামের ভেদেই তো বস্তুর ভেদ হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আসল প্রভেদ রসে। যাক, আপনার সঙ্গে রসের বিচার করা বৃথা। রসজ্ঞান তো আর টোলে জন্মায় না।”

“বটে! অমরুশতক থেকে শুরু করে নৈষধের অষ্টাদশ সর্গ পর্যন্ত আলোচনা করে যদি রসজ্ঞান না জন্মায়, তা হলে মনু থেকে শুরু করে রঘুনন্দনের অষ্টাদশ তত্ত্ব পর্যন্ত আলোচনা করেও ধর্মজ্ঞান জন্মায় না।”

“রাগ করবেন না পণ্ডিতমশায়, কিন্তু কথাটা এই যে, সংস্কৃত কাব্যের রস আর পদাবলীর রস এক বস্তু নয়—ও দুয়ের আকাশ-পাতাল প্রভেদ।”

“আপনি তো দেখছি এক কথারই বারবার পুনরুক্তি করছেন। মানলুম টপ্পা ও কীর্তন এক বস্তু নয়, কাব্যরস ও পদাবলীর রস এক বস্তু নয়। কিন্তু পার্থক্য যে কোথায় তা তো আপনি দেখিয়ে দিতে পারছেন না।”

“তফাত আছে বৈকি। যেমন তালের রস ও তাড়ি এক বস্তু নয়—একটায় নেশা হয়, আর-একটায় হয় না। সংস্কৃত কবিতা পড়ে কেউ কখনো ধুলোয় গড়াগড়ি দেয়?”

ঘোষালের এ মন্তব্য শুনে মায় স্মৃতিরত্ন সভাসুদ্ধ লোক হেসে উঠল। উজ্জ্বলনীলমণি মহাক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “পণ্ডিতমশায়, আপনিও এই-সব ইয়ারকির প্রশ্রয় দেন? আশ্চর্য! যেমন ঘোষালের বিদ্যে তেমনি তার বুদ্ধি।”

রায়মশায় ঘোষালকে চব্বিশ ঘণ্টা ধমকের উপরেই রাখতেন; কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপর কাউকেও একটি কথা বলতে দিতেন না। ‘আমার পাঁঠা আমি লেজের দিকে কাটব, কিন্তু অপর কাউকে মুড়ির দিকেও কাটতে দেব না’— এই ছিল তাঁর ‘মটো’। তিনি তাই একটু গরম হয়ে বললেন, “কেন, ওর বুদ্ধির কমতিটে দেখলে কোথায় হে উজ্জ্বলনীলমণি! তোমাদের মতো ওর পেটে বিদ্যে না থাকতে পারে, কিন্তু মগজে ঢের বেশি বুদ্ধি আছে; তাপমাফিক অমনি একটি জুতসই উপমা লাগাও তো দেখি!”

“আজ্ঞে, ওর বুদ্ধি থাকতে পারে কিন্তু রসজ্ঞান নেই।”

“রসজ্ঞান ওর নেই, আর তোমার আছে? করো তো অমনি একটা রসিকতা!”

“আজ্ঞে ঐ রসিকতাই প্রমাণ, ওর মনে ভক্তির নামগন্ধও নেই। যার ধর্মজ্ঞান নেই, তার আবার রসজ্ঞান!”

স্মৃতিরত্ন এ কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারলেন না; বললেন, “এ আবার কি অদ্ভুত কথা! ঘোষালের ধর্মজ্ঞান না থাকতে পারে, তাই বলে কি ওর রসজ্ঞান থাকতে নেই?”

“অবশ্য না। ও দুই তো আর পৃথক জ্ঞান নয়?”

“আমাদের কাছে যা সামান্য, আপনার কাছে যখন তা বিশেষ, আমাদের কাছে যা বিশেষ আপনার কাছে তা অবশ্য সামান্য; এ এক নব্যন্যায় বটে!”

“শুনুন পণ্ডিতমশায়, যার নাম রসজ্ঞান তারি নাম ধর্মজ্ঞান; আর যার নাম ধর্মজ্ঞান তারি নাম রসজ্ঞান। নামের প্রভেদে তো আর বস্তুর প্রভেদ হয় না।”

“বলেন কি গোঁসাইজি! তা হলে আপনাদের মতে, যার নাম কাম তারই নাম ধর্ম, আর যার নাম অর্থ তারই নাম মোক্ষ?”

“আসলে ও সবই এক। রূপান্তরে শুধু নামান্তর হয়েছে।”

“বুঝছেন না পণ্ডিতমশায়, কথা খুব সোজা! গোঁসাইজি বলছেন কি যে, যার নাম ভাজা-চাল তারই নাম মুড়ি—নামান্তরে শুধু রূপান্তর হয়েছে।”

মদের পিঠ-পিঠ এই চাটের উপমা আসায় রায়-মশায়ের পাত্রমিত্রগণ মহাখুশি হয়ে অট্টহাস্যে ঘোষালের এ টিপ্পনীর অনুমোদন করলেন। উজ্জ্বল-নীলমণি এর প্রতিবাদ করতে উদ্যত হবামাত্র তার মাথার উপর থেকে একটা টিকটিকি বলে উঠল, ঠিক ঠিক ঠিক।’ সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের প্রস্ফুরিত ও বিস্ফারিত নাসিকারন্ধ্র হতে একটা প্রচণ্ড সহাস্য ‘হুঁচ্চ’ ধ্বনি নির্গত হয়ে উজ্জ্বলনীলমণির বক্ষদেশ যুগপৎ হাস্য ও নস্য- রসে সিক্ত করে দিলে। তিনি অমনি ‘রাধামাধব’ বলে সরে বসলেন। রায়মশায় এইসব ব্যাপার দেখে শুনে ভারি চটে বললেন, “তোমরা কটায় মিলে ভারি গণ্ডগোল বাধালে তো হে! আমি শুনতে চাইলুম গল্প আর এঁরা শুরু করে দিলেন তর্ক, আর সে তর্কের যদি কোনো মাথামুণ্ডু থাকে! ঘোষাল! গল্প বলো।”

“হুজুর, এই বললুম বলে।“

“শিগগির, নইলে এরা আবার তর্ক জুড়ে দেবে। একি আমার শ্রাদ্ধের সভা যে নাগাড় পণ্ডিতের বিচার চলবে?”

উজ্জ্বলনীলমণি বললেন, “আজ্ঞে, সে ভয় নেই। যে-সভায় ঘোষাল বক্তা, সে- সভায় যদি আমি আর মুখ খুলি তো আমার নামই নয়—”

“ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে।“

“পণ্ডিতমশায়ের বচনটি খাপে খাপে মিলে গিয়েছে। কাল যে বর্ষা, তা তো সকলেই জানেন। তার উপর গোঁসাইজির কোকিলের সঙ্গে যে এক বিষয়ে সাদৃশ্যও আছে, সে তো প্ৰত্যক্ষ।”

উজ্জ্বলনীলমণির গায়ে এই কথার নখ বসিয়ে দিয়ে ঘোষাল আরম্ভ করলে—”তবে বলি, শ্রবণ করুন।”

“দেখ্, মধুর রসের গল্প যেন একদম চিনির পানা করে তুলিস নে। একটু নুনঝাল যেন থাকে।’

“হুজুর যে অরুচিতে ভুগছেন, তা কি আর জানি নে!”

“আর দেখ, একটু অলংকার দিয়ে বলিস, একেবারে যেন সাদা না হয়।”

“অলংকারের শখই যে আজকাল হুজুরের প্রধান শখ, তা তো আর কারো জানতে বাকি নেই।”

“কিন্তু সে অলংকার যেন ধার-করা কিংবা চুরি-করা না হয়।”

“হুজুর, ভয় নেই। পরের সোনা এখানে কানে দেব না, তা হলে গোঁসাইজি তা হেঁচকা টানে কেড়ে নেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজের জিনিস ব্যবহার করলে সবাই সোনাকে বলবে পিতল, আর বড়ো অনুগ্রহ করে তো—গিণ্টি।”

“অন্যে যে যা বলে বলুক; কিন্তু আসল ও নকলের প্রভেদ আমার চোখে ঠিক ধরা পড়বে।”

“হুজুর জহুরী, সেই তো ভরসা। তবে শুনুন।

“শ্রাবণ মাস, অমাবস্যার রাত্তির, তার উপর আবার তেমনি দুর্যোগ। চার দিক একেবারে অন্ধকারে ঠাসা। আকাশে যেন দেবতারা আবলুস কাঠের কপাট ভেজিয়ে দিয়েছে; আর তার ভিতর দিয়ে যা গলে পড়ছে তা জল নয়—একদম আলকাতরা। আর তার এক-একটা ফোঁটা কি মোটা, যেন তামাকের গুল—”

“কাঠের কপাটের ভিতর দিয়ে জল কি করে গলে পড়বে বল্ তো মূর্খ? যখন বৰ্ণনা শুরু করে দিস, তখন আর তোর সম্ভব-অসম্ভবের জ্ঞান থাকে না। বল্, জল চুঁইয়ে পড়ছে।”

“হুজুর বলতে চান আমি বস্তুতন্ত্রতার ধার ধারি নে। আজ্ঞে তা নয়, আমি ঠিকই বলেছি। জল গলেই পড়ছে, চুঁইয়ে নয়। কপাট বটে, কিন্তু ফারফোরের কাজ, ভাষায় যাকে বলে জালির কাজ। সেই জালির ফুটো দিয়ে—”

“দেখলেন স্মৃতিরত্ন, ঘোষালের ঠিকে ভুল হয় না।”

এই শুনে দেওয়ানজি বললেন, “দেখলে ঘোষাল! ঠিকে ভুল কর্তার চোখ এড়িয়ে যায় না।“

“সে আর বলতে। হুজুর হিসেব-নিকেশে যদি অত পাকা না হতেন তা হলে তাঁর বাড়িতে আর পাকা চণ্ডীমণ্ডপ হয়, আগে যাঁর চালে খড় ছিল না।”

“তুমি কার কথা বলছ হে, আমার?”

“যে নল চালায় সে কি জানে কার ঘরে গিয়ে সে নল ঢুকবে? যাক ও-সব কথা, এখন গল্প শুনুন।“

“এই দুর্যোগের সময় একটি ব্রাহ্মণের ছেলে, বয়েস আন্দাজ পঁচিশ-ছাব্বিশ, এক তেপান্তর মাঠের ভিতর এক বটগাছের তলায় একা দাঁড়িয়ে ঠায় ভিজছিল।”

“কি বললি! ব্রাহ্মণের ছেলে রাতদুপুরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ভিজছে, আর তুই ঘরের ভিতর বসে মনের সুখে গল্প বসে যাচ্ছিস! ও হবে না ঘোষাল, ওকে ওখান থেকে উদ্ধার করতেই হবে।”

“হুজুর, অধীর হবেন না; উদ্ধার তো করবই। নইলে মধুর রসের গল্প হবে কি করে? কেউ তো আর নিজের সঙ্গে নিজে প্রেম করতে পারে না।”

“তা তো জানি, কিন্তু তুই হয়তো ঐখানেই আর-একটাকে এনে জোটাবি। গল্প শুরু করে দিলে তোর তো আর কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।“

“দেখুন রায়মশায়, ঘোষাল যদি তা করে, তাতেও অলংকারশাস্ত্রের হিসেবে কোনো দোষ হয় না। সংস্কৃত কবিরাও তো অভিসারিকাদের এমনি দুর্যোগের মধ্যেই বার করতেন।”

“দেখুন পণ্ডিতমশায়, সেকালে তাদের হাড় মজবুত ছিল, একালের ছেলে- মেয়েদের আধঘণ্টা জলে ভিজলে নির্ঘাত নিউমনিয়া হবে। এ যে বাঙলাদেশে, তায় আবার কলিকাল!”

এ কথা শুনে উজ্জ্বলনীলমণি আর স্থির থাকতে পারলেন না, সবেগে বলে উঠলেন, “তাতে কিছু যায় আসে না মশায়। পদাবলী পড়ে দেখবেন, কি ঝড়জলের মধ্যে অভিসারিকারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন এবং তাতে করে তাঁদের কারো যে কখনো অপমৃত্যু ঘটেছে এ কথা কোনো পদাবলীতে বলে না। আসল কথাটা কি জানেন, মনের ভিতর যার আগুন জ্বলেছে, বাইরের জলে তার কি করবে?”

“হুজুর তো ঠিকই ভয় পেয়েছেন। অভিসারিকাদের চামড়া মোমজামা হতে পারে, কিন্তু তাই বলে ব্রাহ্মণসন্তানকে জলে ভেজালে যে ব্রহ্মহত্যা হবে না, কে বলতে পারে? অভিসারক বলে তো আর কোনো জানোয়ার নেই! দেখুন হুজুর, ব্রাহ্মণের ছেলে ভিজছিল বটে, কিন্তু তার গায়ে জল লাগছিল না। তার মাথায় ছিল ছাতা, গায়ে বর্ষাতি, আর পায়ে বুটজুতো। তার পর শুনুন—

“শুধু ঝড়জল না। মাথার উপর বজ্র ধমকাচ্ছিল আর চোখের সুমুখে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সে এক তুমুল ব্যাপার! লাখে লাখে তুবড়ি ছুটছে, ঝাঁকে ঝাঁকে হাউই উড়ছে, তারই ফাঁকে ফাঁকে বোমা ফুটছে—সেদিন স্বর্গে হচ্ছিল দেওয়ালি।”

“কি বললি ঘোষাল, শ্রাবণ মাসে দেওয়ালি!— তুই দেখছি পাঁজি মানিস নে! “ “আজ্ঞে আমি মানি, কিন্তু দেবতারা মানেন না। স্বর্গে তো সমস্ত ক্ষণই শুভক্ষণ। কি বলেন পণ্ডিতমশায়?”

“তা তো ঠিকই। আমাদের পক্ষে যা নৈমিত্তিক দেবতাদের পক্ষে তা কাম্য। সুতরাং তাঁরা যখন যা খুশি তখনই সেই উৎসব করতে পারেন।“

“শুধু করতে পারেন না, করেও থাকেন। স্বর্গে তো আর উপবাস নেই, আছে শুধু উৎসব। স্বর্গে যদি একাদশী থাকত তা হলে কে আর সেখানে যেতে চাইত? আমি তো নয়ই—”

“উনি ত ননই! যেন উনি যেতে চাইলেই স্বর্গে যেতে পেতেন!”

“হুজুর, আমি কোথাও যেতে চাই নে, যেখানে আছি সেখানেই থাকতে চাই।”

“যেখানে আছেন সেইখানেই থাকতে চান! যেন উনি থাকতে চাইলেই থাকতে পেলেন! তুই বেটা ঠিক নরকে যাবি।”

“হুজুর যেখানে যাবেন আমি সঙ্গে সঙ্গে যাব।”

“দেখেছেন পণ্ডিতমশায়, ঘোষালের আর যাই দোষ থাক্, লোকটা অনুগত বটে। যাক ও-সব বাজে কথা, যার কপালে যা আছে তাই হবে। তুই এখন বল, তার পর কি হল!”

“তার পর দেবতারা একটা বিদ্যুতের ছুঁচোবাজি ছেড়ে দিলেন। সেটা ঐ কপাটের ফাঁক দিয়ে গলে এসে অন্ধকারের বুক চিরে ব্রাহ্মণের ছেলের চোখের সুমুখ দিয়ে লাউডগা সাপের মতো এঁকে বেঁকে গিয়ে সামনে পড়ল। তার আলোতে দেখা গেল যে দশ হাত দূরে একটা পর্বতপ্রমাণ মন্দির খাড়া রয়েছে। ব্রাহ্মণের ছেলে অমনি ‘ব্যোম ভোলানাথ’ বলে হুংকার দিয়ে ছুটে গিয়ে সেই মন্দিরের দুয়োরে ধাক্কা মারতে লাগল। একটু পরে ভিতর থেকে কে একজন হুড়কো খুলে দিলে। তার পর ব্রাহ্মণসন্তান ঢোকবার আগেই ঝড়-জল হো হা করে মন্দিরের ভিতর গিয়ে পড়ল, আর অমনি বাতি গেল নিবে। এই অন্ধকারের মধ্যে ব্রাহ্মণের ছেলেটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।”

“মন্দিরে ঢুকে ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো দাঁড়িয়ে রইল? আর পায়ের জুতো খুললে না, আচ্ছা ব্রাহ্মণের ছেলে তো!”

“হুজুর, সে জুতোয় কিছু দোষ নেই, রবারের।“

“এই যে বললি বুট?”

“বুট বটে, কিন্তু রবারের বুট। হুজুর, আমার গল্পের নায়ক কি এতই বোকা যে মন্দির অশুদ্ধ করে দেবে?”

“তার পর অনেক ডাকাডাকিতে কেউ জবাব না করায় সে ভদ্রলোক অগত্যা হাতড়ে হাতড়ে কপাটের হুড়কো বন্ধ করে দিলে। তার পর পকেট থেকে দিয়াশলাই বার করে জ্বালিয়ে দেখলে যে বাঁ দিকে একটা হারিকেন-লণ্ঠন কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে সেই লণ্ঠনটি জ্বেলে দেখতে পেলে ডান দিকে দেয়ালের গায়ে খাড়া রয়েছে চিত্রপুত্তলিকার মতো একটি মূর্তি। আর সে কি মূর্তি! একেবারে মারবেল পাথরে খোদা। ব্রাহ্মণসন্তান একদৃষ্টে সেই মূর্তির দিকে চেয়ে রইল। সে দেখবার মতো জিনিসও বটে। নাকটি তিলফুলের মতো, চোখ-দুটি পদ্মফুলের মতো, গাল-দুটি গোলাপফুলের মতো, ঠোঁট-দুটি ডালিম ফুলের মতো, কান-দুটি—”

“রাখ্ তোর রূপবর্ণনা। লোকটা দেখছি অতি হতভাগা। দেবতার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল, প্রণাম করলে না!”

“আজ্ঞে তার দোষ নেই। মূর্তিটি যে কোন্ দেবতার, তা সে ঠাওর করতে পারছিল না। কালী শীতলা মনসা চণ্ডী প্রভৃতি কোনো জানাশুনো দেবতা তো নয়।”

“তা নাই হোক, দেবতা তো বটে! দেবতা তো তেত্রিশ কোটি—মানুষে কি তাদের সবাইকে চেনে? আর চেনে না বলে প্রণাম করবে না?”

“আজ্ঞে লোকটা সন্ন্যাসী। ওদের তো কোনো ঠাকুর-দেবতাকে প্রণাম করতে নেই, ওরা যে সব স্বয়ংব্রহ্ম।

“দেখ্‌ ঘোষাল, মিথ্যে কথা তোর মুখে আর বাধে না দেখছি। এই মাত্র বলেছিস ব্রাহ্মণের ছেলে।”

“আজ্ঞে মিথ্যে কথা নয়, তার গলা-ওল্টানো কোটের ভিতর দিয়ে পৈতা দেখা যাচ্ছিল।”

“আবার বলছিস সন্ন্যাসী! দেখ্‌, যে কোনো সাধু-সন্ন্যাসী দেখে নি তার কাছে গিয়ে এই-সব ফক্কুড়ি কর্। পরমহংস বল, অবধূত বল, নাগা বল, আকালি বল, গিরি বল, পুরি বল, ভারতী বল, বাবাজি বল, আর কত নাম করব—রামায়েৎ লিঙ্গায়েৎ কানফাটা ঊর্ধ্ববাহু দাদুপন্থী অঘোরপন্থী— দেশে এমন সাধু-সন্ন্যাসী নেই যে আমার পয়সা খায় নি, যার ওষুধ আমি খাই নি। কিন্তু কারো তো কখনো পৈতা দেখি নি— এক দণ্ডী ছাড়া। তাদেরও তো বাবা, পৈতা গলায় ঝোলানো থাকে না, দণ্ডে জড়ানো থাকে।”

“হুজুর, এ ছোকরা ও-সব দলের নয়। এ হচ্ছে একজন স্বদেশী সন্ন্যাসী।”

“সন্ন্যাসী তো বিদেশীই হয়ে থাকে। তুই আবার স্বদেশী সন্ন্যাসী কোত্থেকে বার করলি? জানিস নে, গেঁয়ো যোগী ভিখ্ পায় না?”

“হুজুর, আমি বার করি নি, এরা নিজেরাই বেরিয়েছে। এরা ভিখ্ চায়ও না, নেয়ও না। এদের পয়সার অভাব নেই। এরা আপনার ছাইমাখা কোপনি-আঁটা টো টো কোম্পানীর দল নয়। এর দীক্ষিত নয়, শিক্ষিত সন্ন্যাসী। এরা গেরুয়াও পরে, জুতো- মোজাও পরে, স্বামীও হয়, পৈতাও রাখে। এরা একসঙ্গে ভবঘুরে ও শহুরে, একরকম গেরস্ত-সন্ন্যাসী।”

“এরা কিছু মানে-টানে?”

“আজ্ঞে এরা কিছুই মানে না, অথচ সবই মানে।”

“কথাটা ভালো বুঝলুম না।”

“বোঝা বড়ো শক্ত হুজুর! এরা হচ্ছে সব বৈদান্তিক শাক্ত।”

“বৈদান্তিক শাক্ত আবার কি রে! এ বেখাপ্পা ধর্মমত পয়দা করলে কে?”

“হুজুর জর্মনরা। যার সঙ্গে যা একদম মেলে না, তার সঙ্গে তা বেমালুম মিলিয়ে দিতে ওদের মতো ওস্তাদ দুনিয়ায় আর কে আছে! ওরা যেমন পাটে আর পশমে মিলিয়ে কাশ্মীরী শাল বুনে এ দেশে চালান দেয়, তেমনি ওরা শংকরের সঙ্গে শংকরী মিলিয়ে এ দেশে চালান দিয়েছে।”

“চোর বেটারা যেন ভেল চালায়, কিন্তু দেশের লোক তা নেয় কেন?”

“আজ্ঞে সস্তা বলে।”

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকা উজ্জ্বলনীলমণির ধাতে ছিল না। তিনি বললেন, “ঘোষাল যাদের কথা বলছে তারা সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। আমার পাস-করা শিষ্যেরাই হচ্ছে খাঁটি বৈদান্তিক বৈষ্ণব।”

“অর্থাৎ এঁদের কাছে সাকার ও নিরাকারের ভেদ শুধু উপসর্গে; এবং সে ভেদজ্ঞানও এঁদের নেই, এঁরা খুশিমত ‘সা’র জায়গায় ‘নি’ এবং ‘নি’র জায়গায় ‘সা’ বসিয়ে দেন।”

রায়মশায়ের আর ধৈর্য থাকল না। তিনি বেজায় রেগে উঠে চীৎকার করে বললেন, “তোমার টীকা-টিপ্পনী রাখো হে ঘোষাল! আমার কাছে ও-সব বুজরুকি চলবে না। ইস্টুপিটরা দুপাতা ইংরেজি পড়ে সব সোহহং হয়ে উঠেছে। আমি জানি এরা-সব কি–হয় বর্ণচোরা নাস্তিক, নয় বর্ণচোরা খৃস্টান। ঐ অকালকুষ্মাণ্ডটা বৈদান্তিক শাক্তই হোক আর বৈদান্তিক বৈষ্ণবই হোক, গেরস্তই হোক আর সন্ন্যাসীই হোক, স্বদেশীই হোক আর বিদেশীই হোক, তোমার ঐ ব্রাহ্মণের ছেলের ঘাড় ধরে ঐ দেবতার পায়ে মাথা ঠেকাও।”

“হুজুর, ওকে দিয়ে যদি এখন প্রণাম করাই তা হলে আমার গল্প মারা যায়।”

“আর যদি প্রণাম না করে তো কান ধরে মন্দির থেকে বার করে দে।”

“হুজুর, তা হলেও আমার গল্প মারা যায়।”

“যাক মারা। আমি ঐ-সব গোঁয়ারগোবিন্দ লোকের যথেচ্ছাচারের কথা শুনতে চাই নে।”

“হুজুর, যদি জোর করেন তো আমি নাচার। গল্প তা হলে এইখানেই বন্ধ করলুম।”

“বেশ! এ মাসের মাইনেও তা হলে এইখানেই বন্ধ হল।”

এই কথা শুনে ঘোষাল শশব্যস্তে বলে উঠল, “হুজুর, আপনি মিছে রাগ করছেন। মূর্তিটে যদি দেবী না হয়ে মানবী হয়?”

“এ আবার কি আজগুবি কথা বার করলি? এই ছিল দেবতা আর এই হয়ে গেল মানুষ!”

“দেবতা যে মানুষ আর মানুষ যে দেবতা হয়, এ তো আর আজগুবি কথা নয়। এ কথা তো সকল দেশের সকল শাস্ত্রেই আছে, তবে আমি তো আর পুরাণকার নই। এরকম ওলোটপালোট আমি করলে কেউ তা মানবে না, আপনিও বলবেন ওর ভিতর বস্তুতন্ত্রতা নেই। ব্যাপারখানা আসলে কি তা বলছি। হুজুর মনোযোগ করবেন। ব্রাহ্মণের ছেলে যখন মন্দিরের দরজা ঠেলছিল তখন ভিতরে যদি জনপ্রাণী না থাকত তা হলে হুড়কো খুলে দিলে কে? আর যখন দেখা গেল যে মন্দিরের মধ্যে অপর কোনো কিছু নেই, তখন আগে যাঁকে প্রতিমা বলে ভুল হয়েছিল, তিনিই যে ও দ্বার মুক্ত করেছিলেন, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। সেটি যখন দেখতে দেবীর মতো নয় তখন অপ্সরা না হয়ে আর যায় না।’

“খুব কথা উল্টে নিতে শিখেছিস বটে!”

“ব্রাহ্মণের ছেলে যখন দেখলে যে, সেই মূর্তিটির চোখে পলক পড়ছে, নাকে নিশ্বাস পড়ছে, তখন আর তার বুঝতে বাকি থাকল না যে স্বর্গের কোনো অপ্সরা অভিসারে বেরিয়েছিল, অন্ধকারে পথ ভুলে পৃথিবীতে এসে পড়েছে, আর এই ঝড়বৃষ্টির ঠেলায় এই মন্দিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বেচারা মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। দেবী হলে পুজো করতে পারত, মানবী হলে প্রণয় করতে পারত, কিন্তু অপ্সরাকে নিয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তার মনের ভিতর এক দিক থেকে ভক্তি আর-এক দিক থেকে প্রীতি ঠেলে উঠে পরস্পর লড়াই করতে লাগল।“

“কি বললি, ভক্তি ও প্রীতি পরস্পর লড়াই করতে লাগল? ও দুই তো একসঙ্গেই থাকে।“

“ও দুই শুধু একসঙ্গে থাকে না, একই জিনিস। আমাদের মতে ভক্তি পরাপ্রীতি, আর প্রীতি অপরাভক্তি।”

“মাপ করবেন গোঁসাইজি। ভক্তির জন্ম ভয়ে, আর প্রীতির জন্ম ভরসায়। ও দুই একসঙ্গে ঘর করে বটে, কিন্তু সে বোন-সতীনের মতো।”

“ব্রাহ্মণের ছেলেকে ওরকম অকষ্টবদ্ধে ফেলে রাখা ঠিক নয়। অপ্সরাদের প্রতি ভক্তি! রামো, সে তো হবারই জো নেই, তবে প্রণয়ে দোষ কি?”

“হুজুর, দোষ কিছু নেই, সম্পর্কে বাধে না। তবে লোকে বলে অপ্সরার সঙ্গে প্রেম করলে মানুষ পাগল হয়।”

“কথা ঠিক, কিন্তু সে হচ্ছে একরকম শৌখিন পাগলামি। স্ত্রীলোকের সঙ্গে ভালোবাসায় পড়লে লোকে মাথায় মধ্যমনারায়ণ মাখে না, মাখে কুন্তলবৃষ্য। আর অপ্সরার টানে মানুষ হয় উন্মাদ পাগল। তখন স্বর্গে না গেলে আর মানুষের নিস্তার নেই, অথচ সেখানে প্রবেশ নিষেধ। কি বলেন পণ্ডিত-মশায়?”

“প্রমাণ তো হাতেই রয়েছে—বিক্রমোর্বশী।”

“শুনলেন হুজুর, পণ্ডিতমশায় কি বললেন? এ অবস্থায় ব্রাহ্মণসন্তানটিকে কি করে ভালোবাসায় ফেলি?”

“তা হলে কি গল্প এইখানেই বন্ধ হল?”

আজ্ঞে তাও কি হয়! যা হল তা শুনুন-

“ব্রাহ্মণের ছেলেকে অমন উস্ করতে দেখে সেই মূর্তিটিও একটু ভীত ত্রস্ত হয়ে উঠল, অমনি তার কাঁধ থেকে অঞ্চল পড়ল খসে। ব্রাহ্মণের ছেলে দেখতে পেলে তার কাঁধে ডানা নেই, ব্যাপারটা যে কি তখন আর তার বুঝতে বাকি থাকল না। এখন বুঝছেন হুজুর, ওকে দিয়ে প্রণাম করালে কি অনর্থটাই ঘটত? একে তরুণ বয়েস, তাতে আবার হাতের গোড়ায় পড়ে-পাওয়া ডানাকাটা পরী! তার উপর আবার এই দুর্যোগের সুযোগ! এ অবস্থায় পঞ্চতপা ঋষিদেরই মাথার ঠিক থাকে না—ব্রাহ্মণের ছেলে তো মাত্র বালাযোগী। পরস্পর পরস্পরের দিকে চাইতে লাগল; ব্রাহ্মণ যুবক সিধেভাবে, আর যুবতীটি আড়ভাবে। চার চক্ষুর মিলন হবামাত্র সেই সুন্দরীর নয়নকোণ থেকে একটি উল্কাকণা খসে এসে ব্রাহ্মণের ছেলের চোখের ভিতর দিয়ে তার মরমে গিয়ে প্রবেশ করলে। ব্রাহ্মণের ছেলের বুক্ বিলেতি বেদান্ত পড়ে পড়ে শুকিয়ে একেবারে শোলার মতো চিমসে ও খড়খড়ে হয়ে গিয়েছিল, কাজেই সেই সুন্দরীর চোখের চকমকি-ঠোকা আগুনের ফুলকিটি সেখানে পড়বামাত্র সে বুকে আগুন জ্বলে উঠল। আর তার ফলে, তার বুকের ভিতর যে ধাতু ছিল সে-সব গলে একাকার হয়ে উথলে উঠতে লাগল, আর অমনি তার অন্তরে ভূমিকম্প হতে শুরু হল। তার মনে হল যেন তার পাঁজরা সব ধসে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপতে লাগল, মুখের ভিতর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল, মাথা দিয়ে ঘাম পড়তে লাগল। এক কথায় ম্যালেরিয়া জ্বর আসবার সময় মানুষের যে অবস্থা হয় তার ঠিক সেই অবস্থা হল। ব্রাহ্মণের ছেলে বুঝলে, তার বুকের ভিতর ভালোবাসা জন্মাচ্ছে।”

এই বর্ণনা শুনে উজ্জ্বলনীলমণি অত্যন্ত ঘৃণাব্যঞ্জক স্বরে বলে উঠলেন, “আহা! পূর্বরাগের কি চমৎকার বর্ণনাই হল! রসশাস্ত্রে যাকে বলে সাত্ত্বিক ভাব, তার উপমা হল কিনা ম্যালেরিয়া জ্বর! ঘোষাল যখন মধুর রসের কথা পেড়েছিল তখনই জানি ও শেষটায় বীভৎস রস এনে ফেলবে। আর লোকে বলবে, ঘোষাল কি রসিক!”

ঘোষাল এ-সব কথার কোনো উত্তর না করে স্মৃতিরত্নের দিকে চাইলে। সে চাউনির অর্থ— মশায়, জবাব দিন।

স্মৃতিরত্ন বললেন, “ত্রিগুণের সাম্যাবস্থাতেই তো চিত্ত প্রকৃতিস্থ থাকে। আর তুমি যাকে সাত্ত্বিক ভাব বলছ, সেও তো একটা চিত্তবিকার ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং ও মনোভাবকে মনের জ্বর বলায় ঘোষাল কি অন্যায় কথা বলেছে?”

“পণ্ডিতমশায়, শুধু তাই নয়। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে ও জিনিসের আরো অনেক মিল আছে। দুয়ের চিকিৎসাও এক, মধুর রসেরও ওষুধ তিক্ত রস। তত্ত্বকথার কুইনিন খাওয়ালে ভালোবাসা মানুষের মন থেকে পালাতে পথ পায় না।”

দেওয়ানজি এ কথার প্রতিবাদ করে বললেন, “কুইনিনে বুঝি জ্বর ছাড়ে? শুধু আটকে দেয়। শিশি-শিশি কুইনিন গিলেছি, কিন্তু আমার পিলে—”

রায়মশায় এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবছিলেন। উজ্জ্বলনীলমণি ও স্মৃতিরত্নের কথায় তিনি কান দেন নি, কিন্তু দেওয়ানজির কথাটি তাঁর কানে পৌচেছিল। তিনি মহা গরম হয়ে বললেন, “চুপ করো হে দেওয়ানজি, তোমার পিলে কত বড়ো হয়ে উঠেছে সে কথা শুনে শুনে আমার কান পচে গেল। ঘোষালের যে যকৃৎ শুকিয়ে যাচ্ছে, কই, ও তো তা নিয়ে রাত নেই দিন নেই যার-তার কাছে নাকে-কাঁদতে বসে না! পিলে- যকৃতের চাইতে যা দশগুণ বেশি সাংঘাতিক, তাই হয়েছে ঐ ব্রাহ্মণের ছেলের—হৃদরোগ। ও যে কি ভয়ানক রোগ তা আমি ভুগে ভুগে টের পেয়েছি। সে যা হোক, ঘোষাল যে একটা ব্রাহ্মণের ছেলেকে রাতদুপুরে একটা তেপান্তর মাঠের ভিতর একটা মন্দিরের মধ্যে একটা মেয়ের হাতে সঁপে দিলে, অথচ তার কে বাপ কে মা, কি জাতি কি গোত্র জানা নেই, সে বিষয়ে দেখছি তোমাদের কারো খেয়াল নেই। হ্যাঁ দেখ্‌ ঘোষাল, তুই ব্রাহ্মণের ছেলের জাত মারবার আচ্ছা ফন্দি বার করেছিস! উজ্জ্বলনীলমণি যে বলেছিল তোর ধর্মজ্ঞান নেই, এখন দেখছি সে কথা ঠিক।”

“আজ্ঞে সে কথা আমি অন্য সূত্রে বলেছিলুম। যা ঘটনা হয়েছে তাতে ঘোষালের দোষ নেই। পূর্বরাগ তো আর জাতবিচার করে হয় না। এ বিষয়ে বিদ্যাপতি ঠাকুর বলেছেন, ‘পানি পিয়ে পিছু জাতি বিচারি’—“

“বটে! তবে যাও মুসলমানের ঘরে খাও পানি বদনায় করে। তার পর এখানে একবার জাতবিচার করতে এসে দেখো কি হয়।”

“হুজুর, গোঁসাইজি কথা ঠিকই বলেছেন, শুধু একটা কথায় একটু ভুল করেছেন। ‘পানি’ না বলে ‘ব্রাণ্ডিপানি’ বললে আর কোনো গোলই হত না। জল অবশ্য যার-তার হাতে খাওয়া যায় না, কিন্তু মদ সকলের হাতেই খাওয়া যায়। আর ভালোবাসা জিনিসটে তো দুনিয়ার সেরা মদ।“

“তোর দেখছি হতভাগা শুঁড়িখানা ছাড়া আর কোথাও উপমা জোটে না। তোরা দুটোয় মিলেছিস ভালো। একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। একে ঘোষাল মূলগায়েন, তার উপর আবার উজ্জ্বলনীলমণি দোহার। এ বিষয়ে আমি পণ্ডিত মশায়ের মত শুনতে চাই, তোদের কথা শুনতে চাই নে।”

“অজ্ঞাতকুলশীলার প্রতি ভালোবাসার ঐরূপ আচম্বিতে জন্মলাভটা স্মৃতির হিসেবে নিন্দনীয়, কিন্তু কাব্যের হিসেবে প্রশস্ত। শকুন্তলা দময়ন্তী মালবিকা বাসবদত্তা রত্নাবলী মালতী প্রভৃতি সব নায়িকারই তো—”

“আজ্ঞে তা তো হবেই। স্মৃতির কারবার মানুষের জীবন নিয়ে, আর কাব্যের কারবার তার মন নিয়ে।“

“কাব্যের শিক্ষা আর স্মৃতির শিক্ষা যদি উল্টো হয়, তা হলে মানুষের কোন্‌টা মেনে চলবে?”

“দুটোই। কাজকর্মে স্মৃতি আর লেখাপড়ায় কাব্য।”

“দেখুন রায়মশায়, ঐখানেই তো স্মার্ত ভট্টাচার্য মশায়দের সঙ্গে আমাদের মতের অমিল। আমরা বলি রস একতা সে জীবনেরই হোক আর কাব্যেরই হোক।“

“তা হলে আপনারা কি চান যে গল্পটা হোক জীবনের মতো, আর জীবনটা হোক গল্পের মতো?”

“আজ্ঞে তা নয় হুজুর। ভট্টাচার্য-মতে জীবনে ফেন ফেলে দিয়ে ভাত খেতে হয়, আর কাব্যে ভাত ফেলে দিয়ে ফেন খেতে হয়; কিন্তু গোস্বামী-মতে কি জীবনে কি কাব্যে একমাত্র গলা ভাতেরই ব্যবস্থা আছে।”

“তুমি থামো ঘোষাল, এ-সব বিষয়ে বিচার করবার অধিকার তোমার নেই। পরিণামবাদ কাকে বলে যদি বুঝতে—”

ঘোষাল তা না বুঝতে পারে, কিন্তু অপরিণামবাদ কাকে বলে তা বুঝলে আপনি ও-সব বাক্য মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতেন না। অলংকারশাস্ত্র যদি ধর্মশাস্ত্রের সিংহাসন অধিকার করে, তা হলে তার পরিণাম সমাজের পক্ষে কি ভীষণ হয় ভেবে দেখুন তো।”

“ঠিক বলেছেন পণ্ডিতমশায়, উনি কাব্যে ও সমাজে ভেস্তে দিতে চান যে দুয়ের প্রভেদ আকাশপাতাল। সমাজে হয় আগে বিয়ে, পরে সন্তান, তার পরে মৃত্যু; আর কাব্যে হয় আগে ভালোবাসা, তার পর হয় বিয়ে, নয় মৃত্যু। এক কথায়, মানুষের জীবনে যা হয় তার নাম প্রাণান্ত। কাব্য কিন্তু হয় মিলনান্ত, নয় বিয়োগান্ত; হয় ঘটক, নয় ঘাতক হওয়া ছাড়া কবিদের আর উপায় নেই।“

“তা হলে তুই দেখছি ঐ ব্রাহ্মণের ছেলের হয় জাত মারবি, নয় প্রাণ মারবি।”

“আজ্ঞে প্রাণে মারতে পারি, কিন্তু জাত কিছুতেই মারব না। হুজুরের কাছে গল্প বলছি, আর আমার নিজের প্রাণের ভয় নেই?”

“দেখ্‌ তোকে আগেই বলেছি, ব্ৰহ্মহত্যা কিছুতেই হতে দেব না।”

“আজ্ঞে যদি আখেরে মাথায় বাজ পড়ে লোকটা মারা যায়, সেও কি আমার দোষ? এ দুর্যোগ কি আমি বানিয়েছি?”

“কি বললি? ব্রাহ্মণের অপমৃত্যু—মন্দিরের ভিতরে—আর আমার সুমুখে! বেটা আজ গাঁজা টেনে এসেছিল বুঝি! যেমন করে পারিস মিলনান্ত করতেই হবে—বিয়োগান্ত কিছুতেই হতে দেব না।“

“আজ্ঞে আমিও তো সেই চেষ্টায় আছি। তবে ঘটনাচক্রে কি হয় তা বলতে পারি নে। একটা কথা আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, যেমন করেই হোক আমি ওর জাত আর প্রাণ—দুই টিকিয়ে রাখব, তার পর যা হয়। হুজুর আমার বেয়াদবি মাপ করবেন, যদি একটু ধৈর্য ধরে না থাকেন তা হলে গল্প এগুবে কি করে, আর যদি না এগোয় তো তার অন্তই বা হবে কি করে।

“আচ্ছা, বলে যা।”

“তবে শুনুন—

“ব্রাহ্মণের ছেলে প্রথমটা যতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল, শেষে আর ততটা থাকল না। সব বিপদের মতো ভালোবাসার প্রথম ধাক্কাটা সামলানো মুশকিল, তার পর তা সয়ে আসে। ক্রমে যখন তার জ্ঞান-চৈতন্য ফিরে এল, তখন সে সেই মেয়েটিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। প্রথমেই তার চোখে পড়ল যে মেয়েটির মাথার চুল কপালের উপর চুড়ো করে বাঁধা, আমাদের মেয়েরা নেয়ে উঠে চুল যেমন করে বাঁধে তেমনি করে, বোধ হয় চুল ভিজে গিয়েছিল বলে। তার পর চোখে এসে ঠেকল তার গড়ন। সে অঙ্গসৌষ্ঠবের কথা আর কি বলব! তার দেহটি ছিল তার চোখের মতো লম্বা, তার নাকের মতো সোজা আর তার ঠোঁটের মতো পাতলা। কিন্তু বেচারি ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গিয়েছিল। তার শাড়ি চুঁইয়ে দরবিগলিত ধারে জল পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন তার সর্বাঙ্গ রোদন করছে। এই দেখে ব্রাহ্মণের ছেলের ভারি মায়া হল, সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভিতরও আত্মাপ্রাণী কাঁদতে শুরু করে দিল।”

“চলে নীলশাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিত মোর।”

“কি? কি? উজ্জ্বলনীলমণি আবার কি বলে?”

“হুজুর, গোঁসাইজির ভাব লেগেছে, তাই ইনি পদাবলী আওড়াচ্ছেন। উনি বলছেন, চলে নীলশাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিত মোর।”

“ঘোষাল! মেয়েটার পরনে কি রঙের শাড়ি ছিল রে?”

“হুজুর, লাল।“

“আঃ! ঐ এক কথায় সব মাটি করলে হে!—চলে লাল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিত মোর বললে ও কবিতার আর থাকে কি! আর যার তুল্য কবিতা ভূ-ভারতে কখনো হয়ও নি, হবে না, তারই কিনা জাত মেরে দিলে!”

“গোঁসাইজি, গোসা করছেন কেন? আমি যে রঙ চড়িয়েছি তাতেই তো উপমা মেলে। মানুষের পরান যদি কেউ নিঙড়ায় তা হলে তা থেকে যা বেরোবে তার রঙ তো লাল। তবে বলতে পারি নে, হতে পারে যে কারো কারো রক্তের রঙ ও চামড়ার রঙ এক—ঘোর নীল।”

“নাই পেয়ে পেয়ে এখন দেখছি তুমি ভদ্রলোকের মাথায় চড়ছ!”

“রাগ করেন কেন মশায়! কোনো সাহেবকে যদি বলা যায় যে তোমার গায়ের রঙ নীল, তা হলে তো সে না চাইতে চাকরি দেয়।”

আবার একটা বকাবকির সূত্রপাত দেখে রায়মশায় হুংকার ছেড়ে বললেন, “যদি কথায় কথায় তর্ক তুলিস তা হলে রাত-দুপুরেও গল্প শেষ হবে না—আর তুই ভেবেছিস এইখানেই আজ রাত কাটাব?”

“হুজুর, তর্ক আমি করি! আমি একজন গুণী লোক— নভেলিস্ট। কথায় বলে, যাদের আর-গুণ নেই তাদের ছার-গুণ আছে। যারা গল্প করতে পারে না তারাই তো তর্ক করে।“

“ভারি গুণী! কি চমৎকার গল্প বলছেন! “

“বটে! আমি এইখান থেকেই ছেড়ে দিচ্ছি; আপনি গোসাইজি, তার পর চালান দেখি তো কতক্ষণ চালাতে পারেন, হুজুরের এক প্রশ্নের ধাক্কাতেই উল্টে চিৎপাত হয়ে পড়বেন।“

“ওরে ঘোষাল, ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস। আমার আর-একটা প্রশ্ন আছে, মেয়েটার বয়েস কত?”

“উনিশ কি বিশ।”

“সধবা কি বিধবা?”

“কুমারী। কাব্যে হুজুর, কুমারী ছাড়া আর-কিছু তো চলে না।“

“আমাকে বোকা পেয়েছিস, না খোকা পেয়েছিস? ছ ছেলের মার বয়েসি, আর তিনি হলেন কুমারী! বাঙালির ঘরে কোথায় এত বড়ো আইবুড়ো মেয়ে দেখেছিস বল্ তো?

“হুজুর, মেয়েটি তো বাঙালি নয়— হিন্দুস্থানী।“

“যেই একটা মিথ্যে কথা ধরা পড়েছে অমনি আর-একটা মিথ্যে কথা বানাচ্ছিস! কোথাও কিছু নেই, বলে দিলি হিন্দুস্থানী!”

“হুজুর, তার গায়ে ঝুলছিল সলমাচুমকির কাজ করা ওড়না, আর তার শাড়ির সুমুখে ঝুলছিল কোঁচা।”

“হোক-না হিন্দুস্থানী। হিন্দুস্থানীও তো হিন্দু, আর তোদের চাইতে ঢের পাকা হিন্দু! জানিস, দুধের দাঁত পড়বার আগে মেয়ের বিয়ে না হলে তাদের জাত যায়? কোনো হিন্দুস্থানী হিঁদুর বাড়িতে অত বড়ো মেয়ে আইবুড়ো দেখেছিস—বল্ তো গাধা!”

“হুজুর, মেয়েটা হিদু নয়, মুসলমান।”

“কি বললি? মুসলমান! হিন্দুর মন্দিরে যেখানে শূদ্রের প্রবেশ নিষেধ, সেইখানে—রাস্কেল, মুসলমান ঢুকিয়েছিস! মন্দির অপবিত্র হবে, ব্রাহ্মণের ছেলের জাত যাবে, কি সর্বনাশের কথা! লক্ষ্মীছাড়িকে এখনই মন্দির থেকে বার করে দে।”

“হুজুর, এই দুর্যোগের মধ্যে—“

“দুর্যোগ-দুর্যোগ জানি নে, এই মুহূর্তে ঐ মুসলমানীকে দে অর্ধচন্দ্র।”

“হুজুর, বাইরে তো দেবতা অপ্রসন্ন আর ভিতরেও যদি দেবতা আশ্ৰয় না দেন তো বেচারা যায় কোথায়? হোক-না মুসলমান, মানুষ তো বটে, আমাদের মতো ওরও রক্ত- মাংসের শরীর।”

“খপ্‌রতি দেখে বেটার ধর্মজ্ঞান লোপ পেয়েছে! আমার হুকুম মানবি কি না বল? হয় ওকে মন্দির থেকে বার কর, নয় তোকে ঘর থেকে বার করে দিচ্ছি। এই জমাদার! ইস-কো গরদান পাকড়াকে নিকাল দেও।”

“হুজুর, একটু সবুর করুন। হুজুরের হুকুম তামিল না করতে হলে আমাকে কি আর এতটা বেগ পেতে হত? ওকে কি আমাকে কাউকে গরদানি দিতে হবে না! মেয়েটি হিন্দুস্থানীও নয়, মুসলমানীও নয়, বাঙালি কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ে।”

“আবার মিথ্যে কথা! কুলীনের মেয়ের গায়ে ওড়না ওড়ে আর সে কোঁচা দিয়ে শাড়ি পরে!”

“হুজুর, ও আমার দেখবার ভুল। শাড়িটে ভিজে সুমুখের দিকে জড়ো হয়ে গিয়েছিল তাই দেখাচ্ছিল যেন কোঁচা, আর গায়ে ছিল চেলির চাদর তাই ওড়না বলে ভুল করেছিলুম।”

“এই যে বললি সলমাচুমকির কাজ করা?”

“হুজুর, ঐ চাদরের উপর গোটাকতক জোনাকি বসেছিল তাই চুমকির মতো দেখাচ্ছিল।”

“তাই বল্। আঃ! বাঁচা গেল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।”

“হুজুর, আপনার না হোক আমার তো তাই। জমাদারের নাম শুনে ভয়ে তো আমার পাঁচ-প্রাণ দশ দিকে উড়ে গেছল। ভুল করে একটা কথা–

“অমন ভুল করিস কেন?“

“হুজুর, অমন ভুল অনেক বড়ো বড়ো কবিরাও করেন, আমি তো কোন্ ছার, তবে তাঁদের বেলায় সে-সব ছাপার ভুল বলে পার পেয়ে যায়।”

“সে যাই হোক। ঘোষাল এতক্ষণে গল্পটা বেশ গুছিয়ে এনেছে। কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ে—এতদিন বিয়ে হয় নি, শেষটায় ভগবানের অনুগ্রহে কেমন বর জুটে গেল। একেই তো বলে প্রজাপতির নির্বন্ধ। ঘোষাল, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তুই যে খালি ব্রাহ্মণের ছেলের জাত বাঁচিয়েছিস তাই নয়— ব্রাহ্মণের মেয়ের বাপেরও জাত বাঁচিয়েছিস। এখন নিশ্চিন্ত মনে গল্প বলে যা। কি খেয়ে গল্প বলিস বল্ তো? এবার তোকে বিলেতি খাওয়াব।”

“হুজুরের প্রসাদ চরণামৃত জ্ঞানে পান করব, তার পরে মুখ দিয়ে বেরোবে অনর্গল বিলেতি গল্প। এখন যা হল শুনুন—

“ভালোবাসা জিনিসটে অন্তত কাব্যে একটা সংক্রামক ব্যাধি। কবিরা একজনের মনের সিগারেট থেকে আর-এক জনের মনের সিগারেট ধরিয়ে নেন। কাব্যের এ হচ্ছে মামুলী দস্তুর। তাই আমাকে বলতেই হবে যে, ব্রাহ্মণের ছেলের ভালোবাসার ছোঁয়াচ লেগে সেই কুলীন-কুমারীর মনে শ্যাম্পেনের নেশার মতো আস্তে আস্তে ভালোবাসার রঙ ধরতে শুরু করল।”

“কি বললি? শ্যাম্পেনের নেশার মতো আস্তে আস্তে! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! বিলেতির নাম শুনেই অজ্ঞান হয়েছিস আর বেফাঁস বকছিস! বেটা খাঁটির খদ্দের, শ্যাম্পেনের গুণাগুণ তুই কি জানিস! পোর্ট বল, ক্লারেট বল, জিন বল, রম্ বল, হুইস্কি বল, ব্রাণ্ডি বল আমার তো আর কিছু জানতে বাকি নেই! শ্যাম্পেনের নেশা হয় ধরে না, নয় চট্ করে মাথায় চড়ে যায়। ভালোবাসার নেশা যদি আস্তে আস্তে চড়াতে চাস তো শেরীর সঙ্গে তুলনা দে— গেলাসের পর গেলাসে যা রেক্তার গাঁথুনি গেঁথে যায়।“

“হুজুর ঠিক বলেছেন, মেয়েমানুষের মনে ভালোবাসা আস্তে আস্তে বাড়ে বটে কিন্তু তার বনেদ খুব পাকা হয়। ওদের মনে ও বস্তু একবার শিকড় গাড়লে তা আর উপড়ে ফেলা যায় না, কেননা সে শিকড় শুধু ভিতরের দিকেই ডুব মারে। কিন্তু হুজুর, এইখানে একটু মুশকিলে পড়েছি। স্ত্রীলোকের ভালোবাসা বর্ণনা করা যায় না, কেননা তার কোনো বাইরের লক্ষণ দেখা যায় না; আর যদি দেখা যায়, তা হলেই বুঝতে হবে সে- সব হাবভাব, ভিতরে সব ফাঁকা।”

“তবে কি ওদের মনের কথা জানবার জো নেই?”

“আমি তো তা বলি নি, আমি বলছি জানা দুঃসাধ্য, কিন্তু অসাধ্য নয়। ওদের মুখ ওদের বুকের আয়না নয়। যেমন পুরুষের পাণ্ডুরোগ, তেমনি স্ত্রীলোকের হৃদরোগ ধরা পড়ে চোখে, এখানেও মেয়েটা ঐ চোখেই ধরা দিলে। কি হল শুনুন-

‘তার চোখের ভিতর একটা অতি ঢিমে অতি ঠাণ্ডা আলো ফুটে উঠল। কিন্তু সে আলো বিদ্যুৎ, স্ত্রী-বিদ্যুৎ বলে অত ঠাণ্ডা। সেই স্ত্রী-বিদ্যুতের টানে ব্রাহ্মণের ছেলের চোখ থেকে পুং-বিদ্যুৎ ছুটে বেরিয়ে এল, তার পর সেই দুই বিদ্যুৎ মিলে লুকোচুরি খেলতে লাগল।”

“নয়ন ঢুলাচুলি লহু লহু হাস, অঙ্গ হেলাহেলি গদগদ ভাস।”

“উজ্জ্বলনীলমণি আবার কি বলে হে?”

“আজ্ঞে ওঁর ভাবোল্লাস হয়েছে তাই উনি আখর দিচ্ছেন।”

“আখরই দিন আর যাই দিন আমি বলে রাখছি যে আখেরে ঐ ‘নয়ন ঢুলাচুলি ল‍হু লহু হাসে’র বেশি আর আমি যেতে দেব না।”

“আজ্ঞে এর একটা তো আর একটার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম।”

“রাখো হে তোমার পরিণামবাদ, অমন ঢের ঢের দর্শন দেখেছি।”

“হুজুর, গোঁসাইজির কথা শুধু দর্শন নয়, বিজ্ঞানসম্মতও বটে। কোনো বস্তুর ভিতর বিদ্যুৎ সেঁদুলে তা আপনি হয়ে ওঠে চুম্বক।”

“বটে! হতভাগারা মরবার আর জায়গা পেলে না, দেবমন্দিরকে করে তুললে একটা কুঞ্জবন! যেমন আক্কেল ঘোষালের, তেমনি উজ্জ্বলনীলমণির—এখন দেখছি এ দুটো মাসতুতো ভাই!”

“হুজুর, বড়ো বড়ো কবিরাও এ কাজ পূর্বে করে গিয়েছেন।”

“সত্যি নাকি পণ্ডিতমশায়?”

“আজ্ঞে, আমি তো কোনো সংস্কৃত কাব্যে দেখি নি যে দেবালয় হয়েছে প্রেমের রঙ্গালয়।”

“আমাদের পদাবলীতেও ও-সব ব্যাপার মন্দিরের বাইরেই ঘটে। বিদ্যাপতি ঠাকুর বলেছেন, ‘যব গোধূলি সময় ভেলি ধনী মন্দির বাহির ভেলি’।”

“ঘোষাল, নিজে করবি কুকীর্তি আর বড়ো বড়ো কবিদের ঘাড়ে চাপাবি দোষ!”

“হুজুর, আমি মিথ্যে কথা বলি নি, বাঙলার বড়ো বড়ো লেখকরা এ কাজ না করলে আমার কি সাহস যে আমি আগে-ভাগেই তা করে বসব, আমি তো একজন ছোটো গল্পকার। ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা’ হিসেবেই আমি চলি।”

“বাঙলা আবার ভাষা, তার আবার লেখক, তার আবার নজীর! মন্দিরের ভিতর আমি মধুর রসের চর্চা আর বেশি করতে দেব না, কে জানে তোদের হাতে পড়ে সে রস কতদূর গড়াবে।”

“তা হলে বলি হুজুর, ওটা আসলে মন্দির নয়, ভোগের দালান।”

“আবার মিথ্যে কথা? এই হাজার বার বলছিস মন্দির, আর এখন বলছিস ভোগের দালান!”

“হুজুর, মন্দির হলে আর তার ভিতর ঠাকুর থাকত না? আগেই তো বলেছি যে সেখানে একটি ছাড়া দুটি মূর্তি ছিল না।“

“তাও তো বটে! খুব ডিগবাজি খেতে শিখেছিস। তুই আর-জন্মে ছিলি গেরবাজ।”হুজুরের কৃপায় এখন লোটন না হলেই বাঁচি।”

“আচ্ছা যাক, এখন তুই গল্প বলে যা, এতক্ষণে জমছে।”

“হুজুর, তার পর ব্রাহ্মণসন্তানটি এমনি স্নেহভরে ব্রাহ্মণকন্যাটির দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল যে তার গায়ে সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণগুলি সব ফুটে উঠল। তার কপাল বেয়ে ঘামের সঙ্গে সিঁথের সিঁদুর গলে তার ঠোঁটের উপর পড়ল, আর তার অধর পান- খাওয়া ঠোঁটের মতো লালটুকটুকে হয়ে উঠল।”

“রোস রোস, সিঁদুরের কথা কি বললি?”

“কই হুজুর, সিঁদুরের নামও তো ঠোঁটে আনি নি!”

“উঃ, তুই কি ঘোর মিথ্যাবাদী! সিঁদুর শুধু নিজের ঠোঁটে আনিস নি, ওর ঠোঁটেও মাখিয়েছিস।“

“তা হলে হুজুর, ও মুখ ফস্কে হয়ে গেছে।”

“ও-সব জুয়োচ্চুরি কথা আর শুনছি নে। একটা সধবাকে, রাসকেল, আমাকে ঠকিয়ে কুমারী বলে চালিয়ে দিচ্ছিলি!”

“আজ্ঞে সধবাই যদি হয়, তাতেই-বা ক্ষতি কি?”

“কি বললে উজ্জ্বলনীলমণি, ক্ষতি কি?”

“আজ্ঞে আমি বলছিলুম কি, নায়িকা তো পরকীয়াও হয়—“

এ কথা শুনে সভাসুদ্ধ লোক একবাক্যে ছি-ছি করে উঠল। উজ্জ্বলনীলমনি তাতে ক্ষান্ত না হয়ে বললেন, “হয় কি না হয় তা বিবর্তবিলাস, মীরাবাইয়ের কড়চা প্রভৃতি পড়ে দেখুন, এমন-কি, কবিরাজ গোস্বামী পর্যন্ত—”

এই কথায় একটা মহা হৈচৈ পড়ে গেল, সকলে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে— কেউ তার কথায় কান দিতে রাজি হল না। উজ্জ্বলনীলমণি তাঁর মিহি মেয়েলি গলা তারায় চড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন। ‘পিকোলো’র আওয়াজ যেমন ব্যাণ্ডের গোলমালকে ছাড়িয়ে ওঠে, তাঁর আওয়াজও এই হৈচৈ-এর উপরে উঠে গেল। সকলে শুনতে পেলে তিনি বলছেন, “আগে আমার কথাটা শেষ করতে দিন তার পর যত খুশি চেঁচামেচি করবেন। স্বকীয়া তো পদকর্তাদের মতে ‘কর্মীনারী’– সে না হলে সংসার চলে না; কিন্তু রস-সাহিত্যে তার স্থান কোথায়? দেখান তো পদাবলীতে—”

“রক্ষা রকুন গোঁসাইজি, থামুন, আপনার ও-সব মত এখানে চলবে না, আপনার পাস-করা শিষ্যেরা হলে ওর যা হয় তা একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বার করতে পারত, কিন্তু দেখছেন-না পণ্ডিতমশায় রাগ করে উঠে যাচ্ছেন! আপনার পাপের বোঝা আমার ঘাড়ে নিতে আমি মোটেই রাজি নই। দাঁড়ান পণ্ডিতমশায়। ব্যাপারটা কি তা না বুঝেই আপনারা সব চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। আসলে ঘটনা এই যে, মেয়েটি সধবা বটে, কিন্তু পরকীয়া নয়।”

“তুই দেখছি বেটা একেবারে বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিস, যা মুখে আসছে তাই বলছিস। স্ত্রীলোকটা হল সধবা, অথচ কারো স্ত্রী নয়। এমন অসম্ভব কাণ্ড মগের মুলুকেও হয় না।

“হুজুর, আমি মিছে কথা বলি নি। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল বটে, কিন্তু দশ বৎসর স্বামী নিরুদ্দেশ। আর সে যখন স্বামীর পথ চেয়ে বসে বসে শেষটায় হতাশ হয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে তখন তাকে বেওয়ারিশ হিসেবেই ধরতে হবে।“

““নষ্টে মৃত প্রব্রজিতে’ এ বচন শাস্ত্রে থাকলেও কাব্যে নেই। এ কালে ও-সব কথা মুখে আনতে নেই, কেননা তা শুনে অর্বাচীনদের মতিভ্রম হতে পারে। আজ যদি তোমরা ও-সব কাব্যে চালাও, দুদিন পরে তা সমাজে চলবে, তার পর সব অধঃপাতে যাবে। দেখো ঘোষাল, তুমি আমার অতিশয় প্রিয়পাত্র, পুত্রতুল্য, কেননা তোমার নবনবউন্মেষশালিনী বুদ্ধি আছে; কিন্তু রঙ্গরসের ভূত যখন তোমার ঘাড়ে চাপে, তখন তুমি এত প্রলাপ বক যে প্রবীণ লোকের পক্ষে সে ক্ষেত্রে তিষ্ঠানো ভার। আজ যেরকম উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় দিচ্ছ, তাতে আমি তোমাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছি।”

এই বলে পণ্ডিতমশায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কি ভেবে তাঁর গতিরোধ হল। এই সুযোগে ঘোষাল তাঁর কাছে জোড়হস্তে নিবেদন করলে—’আপনি আমার ধর্মবাপ। আপনার পায়ে ধরি, আমাকে বিনা অপরাধে ত্যাজ্যপুত্র করে চলে যাবেন না। এতটা উতলা হবার কোনোই কারণ নেই। সিঁথেয় সিঁদুর থাকলেই যে সধবা হতেই হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। ও মেয়েটি ছিল ভৈরবী, তাই না তার মাথায় ছিল সিঁদুর।”

এ কথা শুনে সভা আবার শান্ত হল, স্মৃতিরত্ন তাঁর আসন গ্রহণ করলেন। রায়মশায় কিন্তু খাড়া হয়ে বসে বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন, “ঘোষাল, তোর গল্প বন্ধ কর, নইলে কত যে মিথ্যে কথা বানিয়ে বলবি তার আর আদি অন্ত নেই। আজ তোর ঘাড়ে রসিকতার নয়, মিথ্যে কথার ভূত চেপেছে, ঝাঁটা দিয়ে না ঝাড়লে তা নামবে না।”

“হুজুর, আমার একটি কথাও মিছে নয়। ভৈরবী না হলে কি গেরস্তর ঝি-বউ লাল শাড়ি পরে, লাল দোপাট্টা ওড়ে, কাছা-কোঁচা দেয়, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধে, এক কপাল সিঁদুর লেপে–“

“হোক-না ভৈরবী, তাতেই তুই বাঁচিস কি করে? ভৈরবীর আবার প্রেম কি রে?”

“হুজুর এতক্ষণই যদি ধৈর্য করে থাকলেন, তবে আর-একটু থাকুন। গল্পের শেষটা শুনলে আপনি নিশ্চয় খুশি হবেন। শুনুন—

“ঐ ভৈরবীটি আর কেউ নয়, ঐ ব্রাহ্মণের ছেলেরই স্ত্রী। ভদ্রলোক দশ বৎসর নিরুদ্দেশ হয়েছিল। দেশের লোক বললে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পতিপ্রাণা রমণী সে কথায় বিশ্বেস করলে না। ‘আমার সিঁথের সিঁদুরের যদি জোর থাকে, তবে আমার হাতের লোহা নিশ্চয়ই ক্ষয় যাবে। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, আমার স্বামী হয়েছেন স্বামীজি।’ এই বলে সে স্বামীর সন্ধানে ভৈরবী সেজে বেরিয়ে পড়ল। ভগবানের ইচ্ছায় এই পুণ্যস্থানে দুজনের আবার মিলন হল। স্ত্রী স্বামীকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছিল, কারণ এই দশ বৎসর শয়নে-স্বপনে সেই ঐ মূর্তিই ধ্যান করেছিল। কিন্তু স্বামী তাকে চিনতে পারে নি দেখে সে স্বামীকে একটু খেলিয়ে সন্ন্যাসের ঘোলাজল থেকে গার্হস্থ্যের শুকনো ডাঙায় তোলবার মতলবে এতক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে ও মুড়িসুড়ি দিয়ে ছিল। তার পরে যখন সে চাদরখানি মাথা থেকে ফেলে দিয়ে সটান এসে স্বামীর সুমুখে দাঁড়াল, তখন ব্রাহ্মণসন্তান বুঝতে পারল–এই সেই; অমনি সেই বৈদান্তিক শাক্ত ‘তত্ত্বমসি’ বলে ছুটে তাকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে হাতের মধ্যে কিছু পেলে না, শুধু দেওয়ালে তার মাথা ঠুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা হাওয়ায় মন্দিরের দুয়োর খুলে গেল, আর তার ভিতরে ভোরের আলোয় দেখা গেল মন্দির একেবারে শূন্য!”

“এ আবার কি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালি!”

“হুজুর ভূতের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন, তাই শোনালুম।”

বলা বাহুল্য, ঘোষালের হাতে গল্পের এইরূপ অপমৃত্যু ঘটায় সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন উজ্জ্বলনীলমণি। তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “ভূতের গল্প না তোমার মাথা! পেত্নীর গল্প।“

এই সময়ে বাড়ির ভিতর থেকে খবর এল যে মা-ঠাকুরানীর মাথা ধরেছে। রায়মশায় অমনি হুড়মুড় করে উঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাঁর পঁয়ষট্টি বৎসরের ভোগায়তন দেহের বোঝা কায়ক্লেশে অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সভাও সেদিনকার মতো ভঙ্গ হল।

চৈত্র ১৩২৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *