অ্যাডভেঞ্চার : স্থলে

অ্যাডভেঞ্চার : স্থলে

ইংরেজরা রকমারি গল্প লেখে, তার মধ্যে এক ধরনের গল্পকে বলে অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী। আর এই ধরনের গল্পই মানুষের পছন্দসই। যে-সব ঘটনার ভিতর বাধা আছে, বিপত্তি আছে—সেই-সব ঘটনা নিয়েই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লেখা হয়; যথা আফ্রিকা দেশে সিংহ-শিকার, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনো নতুন দ্বীপে গিয়ে ওঠা, যেখানকার মানুষগুলো সব মানুষখেকো ইত্যাদি।

আমরা বাঙালিরা অতি নিরীহ জাত; শিকার আমরা করি না, যদিও করি তো ঘুঘু- শিকার। এ শিকারে কোনো বিপদ নেই; কেননা ঘুঘু ও সিংহ এক জাত নয়। সমুদ্র তো বেজায় ব্যাপার; আমরা গঙ্গাও পার হই পুলে চড়ে, নৌকায় চড়ে নয়। কি জানি গঙ্গায় কখন ঝড় উঠবে অথবা জোর জোয়ার আসবে, আর নৌকো তখনই কাত হয়ে মা-গঙ্গার পেটের ভিতর সেঁদবে। কাজেই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লেখা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। জীবনে যা ঘটে না, সাহিত্যে তা ঘটানো সোজা কথা নয়। এ সত্ত্বেও ছোটোখাটো বিপদ আমাদের ভাগ্যেও ঘটে। আমরা বলি যে ‘সাবধানের মার নেই—এর উত্তরে আমার একজন বন্ধু বলতেন যে ‘মারের সাবধান নেই’। কথাটা সত্য।

আমার মতো সাবধানী লোকের জীবনেও মধ্যে মধ্যে এমন দু-একটি বেয়াড়া ঘটনা ঘটেছে যা মহাবিপদ হয়ে উঠতে পারত। আজ তারই একটা ঘটনার কথা তোমাদের বলব। তা শুনলেই বুঝতে পারবে যে, সামান্য ঘটনা কিরকম অ্যাডভেঞ্চার হয়ে উঠতে পারে—যে-অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই, আছে শুধু ভীরুত্ব। আর ভয়ই হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চারের গল্পের প্রাণ।

সে বৎসর আমি দার্জিলিঙে ছিলুম। কোন্ বৎসর ঠিক নেই, বছর পঁচিশ-ত্রিশ আগে হবে। স্কুল ছেড়ে অবধি দার্জিলিঙে বহুবার যাতায়াত করেছি, কিন্তু সে যাতায়াতের হিসেব লিখে রাখি নি; সেইজন্যই আন্দাজে বলছি, বছর পঁচিশ-ত্রিশ আগে হবে।

আমরা অবশ্য পুজোর ছুটিতে হিমালয়ে হাওয়া বদলাতে গিয়েছিলু, যেমন আর পাঁচজন যায়। তফাতের ভিতর এই যে, অপরে যায় দশ-পনেরো দিনের মেয়াদে, কিন্তু আমরা মাস-দুয়েকের জন্য সেখানে ঘরকরনা পেতে বসি।

এর কারণ আমি যাঁদের সঙ্গে যাই তাঁদের বারোমাসই ছুটি। আপিস-আদালত খুললে, তাঁদের কলকাতা ফেরবার গরজ ছিল না। আর নতুন ঘরকরনা পাতাও যেমন হাঙ্গাম, তোলাও তেমনি। ফলে তাঁরা একবার কোথাও গুছিয়ে বসলে সহজে সেখান থেকে নড়তে চাইতেন না। আর আমাদের বন্ধুবান্ধব সব জুটে গেছল যত ভুটিয়া ও পাহাড়ী।

হাতে কাজ নেই, তাই বলে বসে ভুটিয়াদের মুখে যত গুণজ্ঞানের কথা শুনতুম। মন্ত্রবলে নাকি লামারা অসাধ্য সাধন করতে পারে। তন্ত্রশাস্ত্রে আমি একজন ছোটোখাটো পণ্ডিত; কিন্তু আমি প্রথমে শিখি ভোটতন্ত্র, তাও আবার চাকরবাকরের মুখে শুনে। আমি তাদের পরামর্শমত মানুষের হাতের হাড়ের বাঁশি, আর মাথার খুলির ডমরু সংগ্রহ করি, কিন্তু সে বাঁশি বজিয়ে কাউকে ঘর-ছাড়া করতে পারি নি, বা সে ডমরু বাজিয়ে কোনো নন্দীভৃঙ্গীকে কৈলাস থেকে টেনে আনতে পারি নি।

এমনি করে শীতের দেশে বাজে কাজে সময় কাটাচ্ছি, এমন সময় কলকাতা থেকে চারটি বন্ধু এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের আমি দেখেই অবাক—অর্থাৎ তাঁদের বেশভূষা দেখে। চারজনই পুরোদস্তর ইংরেজি পোশাক পরেছেন— কিন্তু তাঁদের কোটপেন্টলুনের কাপড় অসম্ভব রকম মোটা। বিলেতি কাপড় যে এত মোটা হয় তা আগে লক্ষ্য করি নি। অবশ্য এ কাপড় শীত ঠেকানোর জন্য নয়—শীতের ভয় তাড়াবার জন্য। জিনিস যে ভারী হলেই গরম হয়, এ হচ্ছে চোখের লজিক, চামড়ার নয়। আর মানুষে চোখের লজিকের উপর নির্ভর ক’রে নানারকম বিপদে পড়ে; চোখের ন্যায়—ঘোর অন্যায়।

সে যাই হোক, এই চারটি বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে আমি মহা খুশি হলুম, কারণ এ চারজনই বিদ্বান ও বুদ্ধিমান বেজায়, গল্পেও সুরসিক। চার জনেরই কাজ আছে বটে, কিন্তু কেউ তা মন দিয়ে করে না। আপিস-আদালতের চাইতে আড্ডার মোহ তাদের ঢের বেশি। এর থেকে বুঝতে পারছেন যে, তারা আমারই দলের লোক; অর্থাৎ বাজে কথাই তাদের মতে কাজের কথা।

যাঁদের সঙ্গে আমি ছিলুম, তাঁরাও এদের আগমনে মহা খুশি হলেন। এঁরা মধ্যাহ্ন- ভোজনের পর আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসতেন, আর বেলা পাঁচটা পর্যন্ত নানা সত্যমিথ্যা গল্প করতেন, আর তার ভিতর থেকে রসিকতার স্ফুলিঙ্গ বেরোত। এঁরা হাসতেও পারতেন, হাসাতেও পারতেন। বিকেলে চা-খাবার পর আমরা বেড়াতে বেরোতুম, এবং অন্ধকার হলে যে যার স্বস্থানে ফিরে যেতেন—আমিও ঘরে ফিরতুম।

খালি রাস্তায় টো টো করে ঘুরে আমরা পায়ে-হাঁটার উপর বিরক্ত হয়ে গেলুম। তার পরে একদিন ঘোড়ায় চড়ে একটা লম্বা চক্কর দেব স্থির করলুম।

অবশ্য আমরা কেউ যথার্থ ঘোড়সোয়ার ছিলুম না। ঘোড়ায় চড়বার অভ্যাস আমারই শুধু একটু-আধটু ছিল। কিন্তু আমার বন্ধুরা কোনো বিষয়েই পিছপাও নন। সুতরাং এ প্রস্তাবে সকলেই মহা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। আমাদের সকলেরই তখন পূর্ণযৌবন—শরীর শক্ত, মন বে-পরোয়া। সুতরাং বন্ধুরা ঘোড়ায় চড়তে জানুন আর না জানুন, সকলেই ঘোড়ায় চড়তে রাজি হলেন। পাঁচটি ঘোড়া সংগ্রহ হল। অবশ্য সবগুলিই ভুটিয়া টাট্টু। ভুটিয়া টাট্টু কিন্তু সব পগেয়া টাট্টু নয়, ও-জাতের ভিতর অনেক মেটা তাজা টাট্টু আছে—তারা বেদম ছুটতে পারে, আর কখনো কখনো লিবঙের ঘোড়দৌড়ে বাজি জেতে। আমরা আমাদের সাহেবী পোশাকের সঙ্গে যাতে খাপ খায়, সেইজন্যে সব পয়লা-নম্বরের ঘোড়া জোগাড় করেছিলুম। নইলে লোকে দেখলে বলবে কি! তাড়াতাড়ি চা পান করে আমরা পাঁচ বন্ধু পাঁচটি ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়লুম।

কালিম্পঙের রাস্তা ধরে যত দূরে সন্ধের আগে যাওয়া যায়, তত দূর যাব স্থির করলুম। আমি অবশ্য এ দলের প্রথপ্রদর্শক। আমরা প্রথমে ‘ঘুম’ হয়ে, সিঞ্চল পাহাড়কে ডাইনে ফেলে, কালিম্পঙের পথে অগ্রসর হতে লাগলুম। রাস্তায় কত ভুটিয়া সুন্দরী এক কপাল খয়ের মেখে, দুধের চোঙা ঘাড়ে করে নিজেদের বস্তিতে ফিরছে। সহিসগুলো শিস্ দিতে দিতে ঘোড়ার পিছনে পিছনে ছুটতে লাগল।

আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম বিকেল চারটেয়, যখন ছটা বাজল তখন ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিলুম দার্জিলিঙের দিকে। একে শীতের দেশ তার উপর আবার শীতকাল, তাই যখন দিনের আলো পড়ে এল, তখন বাড়ি ফেরাই সুযুক্তির কাজ মনে করলুম। আমি পূর্বেই বলেছি, আমরা মুখে রাজা-উজীর মারতে প্রস্তুত থাকলেও আসলে ছিলুম অতি সাবধানী লোক; সুতরাং পাহাড়ের দেশে অচেনা পথে ঘোড়া দাবড়ে বেড়াতে আমাদের উৎসাহ দু ঘণ্টার মধ্যেই কমে এসেছিল।

কালিম্পঙের দিকে বোধ হয় বেশি দূর অগ্রসর হই নি, কারণ পথটা উত্রাই পথ, তাই ঘোড়াগুলোকে সিধে দুলকির চালেই চালিয়েছিলুম; নইলে সেগুলো হোঁচট খেয়ে পড়তে পারত। ঘোড়া তো ঘোড়া, ঢালু উত্রাই পথে মোটর গাড়িরও বেগ সম্বরণ করতে হয়।

ফেরার পথে আমরা চাল একটু বাড়িয়ে দিলুম, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই সিঞ্চল পাহাড়ের পাদদেশে এসে পড়লুম। মনে হল, ঘরে এসে পৌঁছলুম। জানা জায়গাকে বিদেশ কিম্বা দূরদেশ বলে কখনো মনে হয় না। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ল যে, এক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে লেখা আছে ‘This way to Sinchal’। আমাদের মধ্যে বীরপুরুষটি বলে উঠলেন, “চলো এই পথে, এধার দিয়ে সিঞ্চলের মাথায় উঠে ওধার দিয়ে নেমে যাব।” বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে, আমাদের মধ্যে একটি বীরপুরুষ ছিল, অবশ্য মুখে। আমি একটু আপত্তি করেছিলুম, কারণ সিঞ্চলশিখর আমার জানা ছিল, আর ওধার দিয়ে নামবার মুখে অন্ধকারে বিপদ ঘটতে পারে, এই ভয়ে।

আমার বন্ধুদের তখন ঘোড়ার ঝাঁকুনিতে মাথায় খুন চড়ে গেছে, সুতরাং তাঁদের ফুর্তি আবার ফিরে এল। সুতরাং আমার আপত্তি তাঁদের কাছে গ্রাহ্য হল না। অবশেষে সেই নতুন পথই আমরা অবলম্বন করলুম। আমি অবশ্য এ পথ না চিনলেও হলুম এ দেশের পথপ্রদর্শক। আমার বীরবন্ধুটিও ‘আগে চল্’ বলে গান ধরলেন। সে গানের না আছে সুর, না আছে তাল।

ঘণ্টাখানেক চলেছি তো চলেইছি, সিঞ্চলশীর্ষের আর দেখাই নেই। আমার বীরবন্ধুটির গান থেমে এল, তিনি ফেরবার প্রস্তাব করলেন। আমি রাজি হলুম না, কেননা আমি বুঝলুম যে আমরা ভুলপথে এসেছি, ফিরতে গেলে কোথায় যাব তার ঠিক নেই। যতক্ষণ একটা লোকের সঙ্গে দেখা না হয় ততক্ষণ আগে চলাই ভালো। আগেই চলি আর পিছু হঠি, কোন্ দিকে যাচ্ছি তা জানা ভালো। আগেই চলতে লাগলুম, কিন্তু ভয়ে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল, কারণ আমরা একটা ঘোর বনের মধ্যে এসে পড়েছিলুম। চার দিকে গায়ে গায়ে বড়ো বড়ো গাছ, আর মাথার উপর ঘোর অন্ধকার! চোরডাকাতের ভয়, বাঘভালুকের ভয়; ভূতের ভয় অবশ্য আমরা পাই নি। ভয়টা প্রধানত অন্ধকারের ভয়, আর সমস্ত রাত ঘোর শীতের ভিতর বনে বনে ঘুরপাক খাবার ভয়। অনির্দিষ্ট ভয়ই হচ্ছে সব চাইতে সেরা ভয়।

রাত যখন আটটা বাজল, তখন দূরে একটা আলো দেখা গেল। আমরা ঘোড়া ছুটিয়ে সেই আলোর দিকে এগোতে লাগলুম। গিয়ে দেখি একটি ছোটো বাঙলো, আর তার বারান্দায় এক ভোজপুরী দারোয়ান একটি হারিকেন লণ্ঠন সুমুখে করে বসে আছে। তার কাছে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে-”আপনারা পথ ভুলে রঙ্গারুণ পথে ঢুকেছেন, আর প্রায় সেনাদহের কাছাকাছি এসেছেন। আজ রাত্তিরে যদি দার্জিলিং ফিরতে চান তা হলে আমি যে পথ দেখিয়ে দিচ্ছি সোজা সেই পথে চলে যাবেন; ডাইনেও বেঁকেবেন না, বাঁয়েও বেঁকবেন না।”

এ কথা শুনে আমাদের ধড়ে প্রাণ এল।

এর পরে আমরা মরিয়া হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলুম। ভয়ে মানুষ যে কি-রকম সাহসী হয় তার প্রমাণ আমাদের সে রাত্রের ঘোড়-দৌড়। প্রায় অর্ধেক পথ এসেছি, এমন সময় আমাদের মধ্যে একজন ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আর খাদের ভিতর গড়াতে গড়াতে গিয়ে একটা গাছের গুঁড়িতে আটকে গেলেন। তাঁর ঘোড়াটা কিন্তু সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল। বন্ধুবর অতঃপর কোনোরকমে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উপরে উঠে ফের ঘোড়ায় চললেন; বললেন, তাঁর কোথাও কিছু লাগে নি।

রাত যখন নটা বাজল, তখন আমরা যেখানে ‘This way to Sinchal” লেখা ছিল, সেইখানে পৌঁছলুম; তার পর বড়ো রাস্তা ধরে রাত দশটার বাড়ি পৌছলুম।

এ গল্প হচ্ছে, যে বিপদ হতে পারত কিন্তু হয়নি—তারই গল্প

আমাদের বাঙালির পক্ষে এই অ্যাডভেঞ্চারই জুতসই। এ গল্প আমার বন্ধুরা এত ফুলপাতা দিয়ে সাজিয়ে আমার আত্মীয়-স্বজনকে বলেছিলেন যে, তার পুনরাবৃত্তি করতে গেলে এই ছোটো গল্প একটি উপন্যাস হয়ে উঠবে। আ সে লম্বা গল্প শুনে তোমরা খুশি হবে কি না জানি নে, যদিচ আমার গুরুজনেরা শুনে চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন। আমি বাদে বাকি চার জন কি অদ্ভুত বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, সে তারই দেড়শো পাতা কাহিনী।

এ গল্পের নৈতিক উপদেশের একটা লেজ আছে। সে উপদেশ হচ্ছে এই—কখনো ভুল পথে যেয়ো না। আর বুড়োরা যে পথে যায় না, সেইটেই ভুল পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *