ট্রাজেডির সূত্রপাত

ট্রাজেডির সূত্রপাত

আমি একদিন কাগজে দেখলুম যে, তরুণেন্দ্রনাথ রায় এম. এ. পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফার্স্ট হয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি মহা সুখী হলুম। কারণ তরুণ আমার আকৈশোর বন্ধু নৃপেন্দ্রনাথ রায়ের বড়ো ছেলে। ছোকরাটিকে আমিও পুত্রের মতো স্নেহ করতুম। তাকে আমি বাল্যকাল থেকেই জানি, আর সে সব হিসেবেই ভালো ছেলে হয়ে উঠেছিল। তার তুল্য সুস্থ সবল ও সুন্দর ছেলে, লেখাপড়ায় যারা ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়— তাদের মধ্যে প্রায় দেখা যায় না। তরুণ দেখতে তার বাপের মতো সুন্দর নয়। তরুণের মুখে নাক-চোখ অবশ্য মাপজোকের হিসেবে নৃপেনের চাইতে ঢের বেশি correct ছিল; কিন্তু ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি যে, নৃপেনের রূপের ভিতর এ- সবের অতিরিক্ত কি-একটা পদার্থ ছিল, যা মানুষের মনকে আকর্ষণ করে। এ জাতীয় স্ত্রী-পুরুষ বোধ হয় সকলেই দেখেছেন যাদের পাথরের মূর্তিতে তাদের আসল রূপ ধরা পড়ে না; যদি কোথাও ধরা পড়ে তো সে গুণীর হাতের ছবিতে। কারণ এ জাতীয় রূপের যা প্রধান গুণ—তার আকর্ষণী শক্তি, সে গুণ বোধ হয় দেহের নয়, মনের। সে যাই হোক, আমি স্থির করলুম যে, দুপুরবেলা স্নানাহারের পর নৃপেনকে congratulate করতে যাব। তাঁর ছেলে যে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম পদ লাভ করেছে, এতে তিনি অবশ্য মহা আহ্লাদিত হয়েছেন। বিশেষত তিনি যখন নিজে একজন প্রফেসার, আর তরুণের তিনিই ছিলেন প্রাইভেট টিউটর তখন তাঁর ছেলের এই পাসের গৌরবে তিনিও অর্ধেক ভাগীদার।

আমি সেইদিনই বিকেলে নৃপেনের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। কিন্তু আমার বন্ধুর কথাবার্তা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলুম। দেখলুম তরুণের কৃতিত্বে তিনি অবশ্য সুখী হয়েছেন; কিন্তু আমি যতটা উত্তেজিত হয়েছিলুম, তিনি ততটা হন নি। বরং তাঁকে দেখে ঈষৎ মন-মরা বলেই মনে হল। নৃপেন স্বভাবতই ঘোর মজলিসি লোক। তিনি নানা বিষয়ে গল্প করতে ভালোবাসতেন, আর তাঁর নিজের গল্পের রস নিজে উপভোগ করতেন বলে তাঁর শ্রোতারাও তা সমান উপভোগ করত। তিনি অবশ্য চিরজীবন বই- পড়া ও বই-পড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেন নি; কিন্তু আর পাঁচজনের সঙ্গে আলাপে তিনি পুঁথিগত বিদ্যেকে পাশ কাটিয়ে যেতেন। তাঁর আলাপের অন্তরে বিদ্যার বাচালতা ছিল না বলেই তাঁর কথাবার্তা আমাদের এত ভালো লাগত। কিন্তু সেদিন কেন জানি নে, তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বললেন যে, “পাস করাকে আমি খুব একটা বড়ো জিনিস মনে করি নে, এর পর তরুণ জীবনে কি করবে সেই কথাই ভাবছি।” আমি বললুম, “তার কর্মজীবনের পথ তো এখন পরিষ্কার হল। এর থেকে আশা করা যায় যে, তাকে ভিক্ষে করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হবে না।” নৃপেন বললেন, “সে ভাবনা আমার নেই। কিন্তু এই স্কুল-কলেজের পড়া বিদ্যে আমাদের ভিতরের আসল মানুষটিকে স্পর্শ করে না। মানুষের অনেকরকম প্রবৃত্তিকে শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখে। জীবনের সঙ্গে পরিচয় হবার পর কখন্ কোন্ প্রবৃত্তি জেগে উঠবে তা কে বলতে পারে? আর তখন সমস্ত মুখস্থ বিদ্যে এক মুহূর্তে ভেসে যায়। তখন মানুষ প্রকৃতির হাতে খেলনা মাত্র হয়ে ওঠে।”

নৃপেনের কথাবার্তা সেদিন যে একটু অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, শুধু তাই নয়; সেই সঙ্গে হয়েছিল ইংরেজিতে যাকে বলে cynical। তাঁর মুখ থেকে paradox নিত্য নির্গত হলেও, সে-সব paradox আমরা রসিকতা হিসেবেই ধরে নিতুম। কিন্তু সেদিনকার paradoxগুলোর ভিতর থেকে কি যেন একটা অপ্রিয় সত্য উঁকি মারছিল আর মনকে চিন্তাকুল করে তুলছিল।

তা ছাড়া তিনি মধ্যে মধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন; যেন শুধু একটা কথাই ভাবছেন, অথচ সে ভাবনার বিষয় আমার কাছ থেকেও লুকিয়ে রাখতে চান। শ্রোতা যখন অন্যমনস্ক হয়, তখন অবশ্য তাঁর সঙ্গে আলাপ সংক্ষেপে সারতে হয়।

আমি বিদায় নেবার জন্য উস্ করছি দেখে তিনি বললেন, “আমার মনটা আজ প্রকৃতিস্থ নেই।”

আমি জিজ্ঞেস করলুম, “তোমার ছেলের পাসের খবর শুনে তোমার মন বিগড়ে গেল নাকি?”

“না, একখানা বই পড়ে।”

“বই পড়ে?”

“হাঁ, বই পড়ে।”

“কি বই?”

“Bergsonর Rire।”

“ফরাসীতে “Rire” মানে ‘হাসি’, নয়?”

“হাঁ, তাই।”

“হাসির কথা পড়ে তোমার কান্না এল?”

“তার কারণ, তিনি কমেডির আলোচনা করতে গিয়ে ট্রাজেডি সম্বন্ধে দু-চার কথা বলেছেন। তাঁর মোদ্দা কথা এই যে, ট্রাজেডির বীজ আমাদের সকলের অন্তরেই আছে। কথাটা আমার মনে লেগেছে। কারণ আমি নিজে এক সময় এমন পথে পা বাড়িয়েছিলুম, যে পথে আর অগ্রসর হলে শুধু আমার নয়, আর-পাঁচজনের জীবনকেও ট্রাজেডি করে তুলতুম।”

এ কথা শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম, “তুমি তো আজীবন নৈতিক বাঁধা পথে চলে এসেছ; এক, মাথায় অকস্মাৎ বাজ ভেঙে পড়া ছাড়া তোমার জীবনে আর কি ট্রাজেডি ঘটতে পারে?”

নৃপেন্দ্র একটু হেসে উত্তর করলে— কোনো ট্রাজেডি ঘটে নি, কিন্তু ঘটতে পারত। আমি অবশ্য সংসারের বাঁধা পথেই সোজা চলেছি; কিন্তু ভুলে যাচ্ছ যে, ও পথ জীবনের একমাত্র পথ নয়। চলতে গেলেই দেখা যায় যে, আশেপাশে অনেক ছোটোখাটো অলিগলি আছে, যা কখনো কখনো মনকে টানে। মনে হয় ঐ গলিপথে যেন কোনো অপরূপলোকে গিয়ে পৌঁছনো যায়, আর সে-সব পথে নিজের প্রকৃতি অনুসারে স্বাধীনভাবে চলা যায়, সমাজবন্ধন ছিন্ন করে। অথচ এই-সব পথেই ট্রাজেডি ঘটে। এখন বলি ঘটনা কি ঘটেছিল। আমি এইরকম একটি পথে পা বাড়িয়েছিলুম, কিন্তু ঘটনাচক্রে এগোতে পারি নি; নইলে আমার জীবন একটা মস্ত ট্রাজেডি হয়ে উঠত। শুধু সাংসারিক জীবনটাই যে ভেস্তে যেত তাই নয়—আমার মানসিক জীবনেও ঘোর অরাজকতা ঘটত। সেই কথা মনে করে আমার মন আজ এমন অস্থির হয়ে উঠেছে। তাইতেই আমার কথাবার্তা ও ব্যবহার তোমার কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগছে। অবশ্য আমাদের ঠিক স্বভাবটা যে কি, তা আমরা নিজেই জানি নে তো আমাদের বন্ধুবান্ধবেরা তা কি করে জানবে? যখন কোনো অবস্থাবিশেষে তা হঠাৎ ফুটে বেরোয়, তখন নিজের স্বভাবের সাক্ষাৎকার লাভ করে মানুষ নিজেই অবাক হয়ে যায়।

এখন ব্যাপার কি হয়েছিল বলছি, শোনো। সেটি মন খুলে কাউকে না বললে, মনের শান্তি আবার ফিরে পাব না। রোমান ক্যাথলিকেরা বলে, confession করায় পাপ ক্ষয় হয়; এই কথাটিই Freud এ যুগে বৈজ্ঞানিক হিসেবে বলেছেন। সাইকো- অ্যানালিসিসের অর্থ, রোগীকে কৌশলে confession করিয়ে নিতে পারলেই সে রোগমুক্ত হয়। অর্থাৎ এ বিষয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞানের একই মত physiologyর উপরে। ভালো কথা, কোথায় দেহ শেষ হয়, আর মন আরম্ভ হয়, তার পাকা সীমানা কি কেউ নির্ণয় করতে পেরেছেন?— এ অবশ্য ফিলজফির সমস্যা, কিন্তু আমরা জীবনে নিত্যই দেখতে পাই যে, আমাদের মনোভাব ও ব্যবহার দেহমন দুয়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। এ- সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, তোমার কাছেও এ confession করতে আমি ইতস্তত করছি। কাজেই বাজে কথা বলে আসল কথার ভূমিকা করছি।

তোমার মনে থাকতে পারে যে, বছর সাতেক আগে আমি একবার ইস্টারের ছুটিতে দেহ ও মনের হাওয়া বদলাতে কার্শিয়ং যাই। তখন আমার বয়েস পঁয়তাল্লিশ ও তরুণের বয়েস প্রায় ষোলো। কার্শিয়ং যাই বিশেষত এই কারণে যে, জায়গাটা দার্জিলিংএর মতো ঠাণ্ডা নয়, উপরন্তু দার্জিলিংএর মতো সেখানে যাত্রীর ভিড় নেই। তাই আমি rest-cureএর লোভে ঐ গিরিশিখরেই আশ্রয় নেই। বলা বাহুল্য, আমার কোনোরূপ cureএর প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল শুধু restএর। যদিও তখন আমার মাথার চুল পাকতে আরম্ভ করেছে তবুও আমার রক্তমাংসের দেহ যৌবনের জের টেনে চলেছে।

কার্শিয়ং গিয়ে আমার দৈনিক কাজ হল, খাই দাই আর ঘুরে বেড়াই। অবশ্য সেখানে ঘুরে বেড়াবার বেশি জায়গা নেই। তাই আর সকলে যা করে, আমিও তাই করতে আরম্ভ করলুম; অর্থাৎ সকালে মেল আসবার সময় একবার স্টেশনে হাজির হতুম, কলকাতা থেকে কে কে দার্জিলিং যাচ্ছে তাই দেখবার জন্য। আর বিকেলে আর একবার হাজির হতুম, কে কে কলকাতায় ফিরছে তাই দেখবার জন্য। দার্জিলিং- যাত্রীদের গমনাগমনটাই কার্শিয়ংএর প্রধান দৃশ্য; কারণ সেখানকার একঘেয়ে জীবনে এই সূত্রেই দিনে দুবার বৈচিত্র্য ঘটে।

একদিন স্টেশনে আমার কলেজের একটি ভূতপূর্ব ছাত্র রমেনের সঙ্গে দেখা হল। ছোকরাটি আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিল; কেননা প্রথমত সে ছিল প্রিয়দর্শন, তার উপরে সে মন দিয়ে পড়াশুনা করত। তার ধরনধারণ একটু মেয়েলি গোছের ছিল; ফলে কলেজের খেলোয়াড়-দল তাকে পছন্দ করত না, কিন্তু প্রফেসাররা করত। সে ছোকরা কার্শিয়ংএই নামল ও আমাকে দেখে খুব খুশি হল। বললে, সে শুধু দুদিনের জন্য এখানে এসেছে তার মার সঙ্গে দেখা করতে; আবার পরশুই ফিরে যাবে। তার পর আমাকে তাদের বাড়ি একবার যেতে অনুরোধ করলে। তার মা নাকি আমার পরিচয় লাভ করে বড়ো খুশি হবেন; আর তা ছাড়া এখানে শুধু তার মা ও ছোটো বোন আছেন, আমি তাঁদের একটু তত্ত্বাবধানও করতে পারব। তার মার শরীর অসুস্থ, তাই তিনি কার্শিয়ংএ থাকেন। চাকরবাকর ব্যতীত বাড়িতে আর কোনো পুরুষমানুষ নেই; তাই ছোকরাটি কলকাতায় তাদের জন্য উদ্‌বিগ্ন থাকে। আমার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিলে সে একটু নিশ্চিত থাকতে পারবে। তার পর সে আমার বাসার ঠিকানা জেনে নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

পরদিন সকালে রমেন আমার বাসায় এসে উপস্থিত হল। আর তার সঙ্গে আমি তাদের বাড়িতে তার মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলুম। গিয়ে দেখি বাড়িটি মন্দ নয়, ছোট্টো কিন্তু দিব্যি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

মিনিট-পাঁচেক অপেক্ষা করবার পর রমেনের মা বসবার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। দেখলুম, তিনি প্রায় আমার সমবয়সী।

যৌবনে বোধ হয় সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু হয় ডিপেপসিয়া নয় অপর কোনো নাছোড়বান্দা রোগে নিতান্ত জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলুম যে তাঁর যথেষ্ট পড়াশুনা আছে; এবং তাঁর মতামত সবই, ইংরেজিতে যাকে বলে, advanced। বোধ হয় রুগ্ণ শরীরে ঘরে বসে বই পড়ে পড়ে তাঁর মনটাই অসামাজিক হয়ে গিয়েছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, “কতদিন আপনার এখানে থাকা হবে?” আমি উত্তর করলুম, “আরো মাসখানেক।” তখন তিনি বললেন যে, “আপনার যদি কোনো অসুবিধে না হয় তো ইতিমধ্যে আমার মেয়েকে ঘণ্টাখানেক করে ইংরেজি পড়ালে বড়ো ভালো হয়। তার বয়স প্রায় ষোলো, সে এবার ম্যাট্রিক দেবে। আর রমেনের কাছে শুনেছি যে ইংরেজি আপনি অতি চমৎকার পড়ান। আপনার কাছে পড়ে শুনতে পাই ছেলেরা সাহিত্যরসের আস্বাদ পায়। আমার মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করে কিনা তার জন্য আমি মোটেই কেয়ার করি নে; তার অন্তরে যাতে সাহিত্যের প্রতি একটু টান জন্মায় আমি তাই চাই।” আমি ভদ্রতার খাতিরে তাঁর প্রস্তাবে স্বীকৃত হলুম। কিন্তু মনে মনে বললুম, “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে—এই হিমালয়ে বেড়াতে এসেও আবার পড়ানো!’— মা রমেনকে বললেন, “প্রতিমাকে ডেকে আনো তো!”

প্রতিমা যখন ঘরে এসে ঢুকল, তখন তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলুম। এ যে সাক্ষাৎ প্রতিমা! কিন্তু এ প্রতিমার মূর্তি দেবীমূর্তি নয়, মানবীমূর্তি। বাঙালির ঘরে যে এমন অপরূপ সুন্দরী জন্মলাভ করতে পারে তা আমি কখনো কল্পনাও করি নি। মাথায় সে তার দাদার চাইতেও একটু উঁচু, অথচ তার প্রতি অঙ্গ সুডৌল নিটোল। আর চোখ পটলচেরা বটে, কিন্তু সে চোখের সৌন্দর্য শুধু তার আকার অথবা পরিমাপের উপরে নির্ভর করে না; তার ভিতর প্রাণের কি এক রহস্য ছিল যা আমরা ঠিক জানি নে, কিন্তু আমাদের অন্তরাত্মা জানে। রক্তমাংসের দেহের রূপের ভিতর যে মাদকতা আছে তা যে statueর ভিতর নেই, এ সত্য আমি সেই মুহূর্তে প্রথম আবিষ্কার করলুম।

সেদিন মায়েতে ছেলেতে কি কথাবার্তা হয়েছিল তা আমার মনে নেই; কারণ আমি অপর কারো প্রতি মনোনিবেশ করতে পারি নি, অপরের কথাবার্তায় মনোযোগও দিতে পারি নি।

প্রতিমাকে দেখে যে আমার বাহ্যজ্ঞান লোপ হয়েছিল, তা অবশ্য নয়; আমি শুধু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম, আমার মন বাইরের চারি দিক থেকে আলগা হয়ে পড়েছিল।

এই পর্যন্ত মনে আছে যে, স্থির হল আমি তার পরদিন থেকেই প্রতিমাকে ইংরেজি কবিতা পড়াব। আর এইটুকু মনে আছে যে, সেদিন আমি সমস্ত দিন একলা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলুম, আর সমস্ত রাত শুয়ে শুয়ে শুধু দিবাস্বপ্ন দেখেছিলুম।

তার পরের দিন থেকেই আমার অধ্যাপনা শুরু হল। রমেনের উপদেশমত Golden Treasuryর চতুর্থ ভাগ থেকে প্রতিমাকে কতকগুলি কবিতা পড়াবার ভার আমার ঘাড়ে পড়ল। প্রতিমার মা চেয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার মারফত ইংরেজি সাহিত্যের রুচি তাঁর মেয়ের মনে জাগাতে। এতেই হল মুশকিল। প্রথমত, প্রতিমা ইংরেজি ভাষা এতদূর জানত না, যাতে করে সে ইংরেজি কবিতার সাহিত্যরস আস্বাদ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এ স্বর্ণ-ভাণ্ডারের অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের কবিতা। প্রেম করবার বয়স আমি বহুদিন হল উত্তীর্ণ হয়েছি, আর প্রতিমার মনে প্রেমের প্রবৃত্তি আজও জন্মায় নি। সুতরাং এ বিষয়ে আমিও তার উপযুক্ত শিক্ষক নই, সেও উপযুক্ত ছাত্রী নয়। সে যে নয়, প্রথম দিনের আলাপেই তার পরিচয় পেলুম। দেখলুম নানা বিষয়ে তার কৌতূহল আছে, জানবার ইচ্ছে আছে; কিন্তু ভাষার সৌন্দর্য সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। সে দেহে না হোক মনে এখনো বালিকা, স্ফুটনোন্মুখ কলিকামাত্র। তার পর দুদিনেই বুঝলুম যে, মেয়েটির দর্শন লাভ করে অবধি আমার ভিতরে একটা মস্ত পরিবর্তন ঘটেছে। আমার মন আর আত্মবশে নেই। যেন সে মন রূপলোকে উঠে গেছে, যে- লোকে মর্তের কোনো বিধিনিয়ম নেই;. আমি যে-সব বিধিনিয়ম জীবনে ও মনে এতদিন গ্রহণ ও পালন করে এসেছি, আর যাদের সাহায্যে নিজেকে একরকম গড়ে তুলেছি, সে-সব বিধিনিষেধের বন্ধন আমার শিথিল হয়ে এসেছে। সংক্ষেপে প্রতিমার সুমুখে বসে তার চোখের আলোতে মানবসমাজ যে শুধু পারিবারিক সমাজ নয়, সে সত্য প্রত্যক্ষ করলুম। এ সমাজের বাইরে যে একটা আনন্দ ও বেদনার জগৎ রয়েছে, তার সন্ধান পেলুম। দুদিন না যেতেই আমার মনের অকারণ চঞ্চলতা, অজানা আনন্দ ও তার সঙ্গে অজানা ভয়—এই-সব অস্পষ্ট মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি বুঝলুম যে, আমি এই মেয়েটির ভালোবাসায় পড়েছি। এ সেই জাতীয় ভালোবাসা বা প্রথমযৌবনে মানুষের মন কখনো কখনো অভিভূত করে; আর এ ভালোবাসার বেগ এত তীব্র যে, তার মুখে আমার ধর্মজ্ঞান, সামাজিক জ্ঞান, সব ভেসে গেল। আমি নিজের কাছেও আমার এই মনের কথাটি গোপন রাখতে প্রাণপণে চেষ্টা করলুম। কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না; বরং আমার মনের কথাটি প্রতিমাকে বলবার একটি অদম্য আকাঙ্ক্ষা আমার মনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললে। আমার এ বয়সে এ মনোভাব হওয়া যতদূর সম্ভব ridiculous, আর সে কথাটি প্রতিমাকে বলা তার চাইতে বেশি ridiculous, তা অবশ্য আমি জানতুম। তৎসত্ত্বেও আমি মন স্থির করলুম যে, কথাটি প্রতিমাকে বলে তার পর পলায়ন করব। স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে তার পর যে কোথায় যাব, কি করব, তা অবশ্য একবার ভাবিও নি। তার পরদিন আমি প্রতিমাকে বললুম যে, “আমি তাকে আর পড়াতে আসব না।” সে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন?” আমি উত্তর করলুম, “শেলীর সে কবিতাটি কি তোমার মনে আছে?” প্রতিমা বললে, “কোনটি?”

আমি বললুম,

“One word is too often profaned
For me to profane it.
One passion too falsely disdained
For thee to disdain it.”

সে wordটি কি তা জান, কিন্তু সে passionটি কি তা অবশ্য জান না। সুতরাং সে wordটি তোমার কাছে profane করব না, কারণ তুমি আমার passionটি disdain করবে।”

আমার মুখে এ কথা শুনে প্রতিমার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল; সে এক মুহূর্তে মনেও বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠল, কুঁড়ি যেমন এক মুহূর্তে ফুটে ফুল হয়। যেন

love কথাটির অন্তরেই কী মন্ত্রশক্তি আছে। এর পর আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলুম, বাসায় ফিরে যাবার জন্য। প্রতিমা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তার পর জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে কাল থেকে আর আসবেন না?”

আমি বললাম, “আমার তো ইচ্ছে তাই।”

প্রতিমা বললে, “যদি আসতে ইচ্ছে হয় তো পড়াতে আসবেন।”

এই কটি কথা বলে, সে দ্রুতপদে অন্য ঘরে চলে গেল।

এ কথা তার অন্তরের বালিকা বললে, কিম্বা নবজাত কিশোরী বললে, বুঝতে পারলুম না। তাই এর পর কিংকর্তব্য স্থির করতে না পেরে ধীরে ধীরে বাসায় ফিরে এলুম।

আসবামাত্র একখানি Urgent Telegram পেলুম, Tarun seriously ill come at once.

আমার ছেলের মৃত্যু-আশঙ্কা আমার প্রেমের স্বপ্ন ভেঙে দিলে। সেইদিন বিকেলের ট্রেন ধরেই কলকাতায় ফিরে এলুম।

ভেবে দেখো তো ও পথে যদি অগ্রসর হতুম তো কি ট্রাজেডি ঘটত।

“তোমার দেখছি একটা মস্ত ফাঁড়া উতরে গেছে। আশা করি, ও মনোভাবের এখন লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই?”

“এ ঘটনার স্মৃতি এখন আমার মনে দগ্ধসূত্র সংস্কারের মতো রয়েছে। সে ছাইয়ের অন্তরে এখন আগুন নেই।”

“তুমি ভাবছ যে তরুণের ভাগ্যেও একদিন এরকম বিপদ ঘটতে পারে? কিন্তু সে বিপদ সে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে।’

“কি উপায়ে?”

“যদি কখনো সে অস্থানে প্রেমে পড়ে তা হলে তুমিও seriously ill হয়ে পোড়ো। তা হলেই তার ফাঁড়া কেটে যাবে।”

আমার এ উক্তির ভিতর অবশ্য একটু বিদ্রূপ ছিল; কারণ তাঁর জীবনের অসম্পূর্ণ ট্রাজেডি যে তাঁর অন্তরের গোপন ট্রাজেডিতে পরিণত হয় নি, এ কথা আমি বিশ্বাস করি নি। তবে আশা করি এ confessionএ তিনি তাঁর মনের শান্তি ফিরে পাবেন।

ভাদ্র ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *