প্রিন্স

প্রিন্স

আপনি আমাকে আপনার কাগজের জন্য একটি ছোটো গল্প লিখতে অনুরোধ করেছেন, কিন্তু কি করে আপনার অনুরোধ রক্ষা করব তা এতদিন ভেবে পাচ্ছিলুম না। আজ কদিন ধরে বহু চেষ্টা করেও মাথা থেকে ছোটো কি বড়ো কোনোরকম গল্প বার করতে পারলুম না। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, পৃথিবীতে নানারকম ছোটোখাটো ঘটনা তো নিত্য ঘটে। আর সেইসব ঘটনার ভিতরও তো যথেষ্ট বৈচিত্র্য আছে। সুতরাং আমার চোখের সুমুখে যা-সব ঘটেছে, তারই মধ্যে একটির বর্ণনা করলেই সম্ভবত সেটি গল্পের মতো শোনাবে।

আমি যখন বিলেতে ছিলুম তখন সে দেশে একটি হিন্দুস্থানী যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় দুদিনেই বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আমরা দুজনেরই ভারতবর্ষের লোক, দুজনেই বিলাত-প্রবাসী, দুজনেরই বয়েস এক; এই সূত্রেই আমাদের পরস্পরের সখ্য জন্মায়। কেননা একটি বিষয় ছাড়া অপর কোনো বিষয়ে আমাদের উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ সাদৃশ্য ছিল না— না বিদ্যায়, না বুদ্ধিতে, না চরিত্রে, না শিক্ষায়, না চেহারায়, না অবস্থায়।

বন্ধুটি ছিলেন পশ্চিমের কোনো রাজবংশের সন্তান। তাঁর উপাধি ছিল Prince- কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থা তাঁর পদের অনুরূপ না হওয়ায় তিনি বিলেতে তাঁর নামে পূর্বে ঐ Prince উপসর্গটি ব্যবহার করতেন না। কিন্তু অপরের কাছে তাঁর বংশমর্যাদা গোপন করলেও তিনি নিজের কাছে সে সত্যটি এক মুহূর্তও গোপন করতে পারতেন না। বরং পৈতৃক সম্পত্তির অভাবে পৈতৃক তাঁর নামটিই তাঁর কাছে পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড়ো জিনিস হয়ে উঠেছিল। তাঁর চাল-চলন কথা-বার্তা আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই খুব উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল। তাঁর ব্যবহারের একটি নমুনা দিচ্ছি, তার থেকেই আপনারা তাঁর সমগ্র চরিত্র বুঝতে পারবেন।

তিনি পোশাকে দেদার টাকা খরচ করতেন, এবং এ বিষয়ে অতিব্যয় করবার জন্য তাঁকে অপরাপর বিষয়ে অতিশয় মিতব্যয়ী হতে হত; এমন-কি, তাঁর আহার একরকম উপবাসের শামিলই ছিল। ইংলণ্ডের রাজপুত্র যে দোকানে পোশাক তৈরি করান তিনিও সেই দোকানে পোশাক তৈরি করাতেন সমান ব্যয় করে, কিন্তু তিনি জীবন-ধারণ করতেন রুটি মাখন ও কলা খেয়ে।

বিলেতে আমরা পাঁচজন দেশী ছোকরা একত্র হলেই নানা বিষয়ে আলোচনা করি ধর্ম সমাজ দর্শন বিজ্ঞান কাব্যকলা রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের তর্কের আর অন্ত ছিল না। এসব আলোচনায় Prince কখনো যোগদান করতেন না। আমাদের বাকবিতণ্ডায় যোগ দেওয়া দূরে থাক আমাদের বকাবকি তিনি কানে তুলতেন কি না সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। ও-সব কথা শুনলে তিনি অমনি চুপ হয়ে যেতেন যে মনে হত তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। অপরপক্ষে তিনি যখন মুখ খুলতেন তখন আবার আমরা সব চুপ হয়ে যেতুম। তার কারণ, যে একটি মাত্র বিষয়ে তাঁর সম্যক অভিজ্ঞতা ছিল সে বিষয়ে আমরা সকলে ছিলুম সমান অনভিজ্ঞ। ভদ্রভাষায় সে বিষয়টির নাম হচ্ছে Love.

আমরা কবিতা পড়ে নভেল পড়ে যে Love এর মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করতে শিখি, সে Love এর সন্ধান তিনি বড়ো একটা রাখতেন না। যেমন চুম্বক ও লৌহের ভিতর, তেমনি স্ত্রী-পুরুষের ভিতর যে নৈসর্গিক টান আছে, সেই আকর্ষণী শক্তিরই বিচিত্র লীলা তাঁর আদ্যোপান্ত মুখস্থ ছিল। এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য তিনি বই পড়ে লাভ করেন নি, শিখেছিলেন হাতে-কলমে। এ শিক্ষা লাভ করবার তাঁর সুযোগও যথেষ্ট ছিল। যে রাজপুরীতে তিনি আশৈশব লালিত পালিত ও বর্ধিত হয়েছিলেন সেখানে মানবজীবনের মুখ্যকর্ম ছিল প্রণয়চর্চা। Prince-এর গল্প আমরা যে হাঁ করে শুনতুম, যেমন ছোটো ছেলে রূপকথা শোনে, তার কারণ তখন আমরা সবাই ছিলুম তরুণের দল। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে আমাদের সকলেরই মনে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল, আর রমণীপ্রসঙ্গ আমাদের সকলেরই অন্তরের এমন একটি তারে ঘা দিত যার উপর দর্শন-বিজ্ঞানের বিশেষ কোনো প্রভাব নেই। সে কথা যাক, এ হেন শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে Prince যে বিলাতে মাসে একবার করে love-এ পড়তেন সে বলাই বাহুল্য। তাতে অবশ্য তাঁর মানসিক কিম্বা সাংসারিক কোনো ক্ষতি হয় নি। তিনি পদে-পদে যেমন বিপদে পড়তেন আবার তেমনি হাত-হাত ফাঁড়া কাটিয়ে উঠতে পারতেন। ফলে তাঁর নিত্যনূতন প্ৰণয়কাহিনী শোনবার জন্য আমরা সদাসর্বদাই প্রস্তুত থাকতুম।

আমি পূর্বেই বলেছি যে, Prince-এর পদমর্যাদার অনুরূপ তাঁর সম্পত্তি ছিল না। যত দিন যেতে লাগল তত তাঁর আর্থিক অবস্থা হীন হয়ে পড়তে লাগল। শেষটা তাঁর মনে হল যে, তিনি যদি কোনো ক্রোরপতির কন্যা বিবাহ করতে পারেন তা হলে তিনি ধর্মের অবিরোধে অর্থ ও কামের অপর্যাপ্ত ফলভোগী হতে পারবেন। বিলাতে অনেক নিঃস্ব লোক আমেরিকার millionaire কলু-কসাইদের কন্যা বিবাহ করেন, অর্থের লোভে ও উপাধির জোরে। যদি Lord উপাধির মূল্য স্বরূপ আমেরিকানরা অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা দান করতে প্রস্তুত হয় তা হলে তারা Prince উপাধির দাম যে আরো বেশি দেবে সে বিষয়ে বন্ধুবরের মনে কোনোই সন্দেহ ছিল না।

এ চিন্তা তাঁর মনে উদয় হবা মাত্র লণ্ডনের একটি বড়ো হোটেলে গিয়ে বাস করতে আরম্ভ করলেন যেখানে আমেরিকার millionaireরা এসে বাস করে।

সাতদিন যেতে না যেতে তিনি সেখানে একটি millionaireএর কন্যার সঙ্গে দস্তুর মতো loveএ পড়ে গেলেন। তারপর তিনি কি উপায়ে সেই মহিলাটির কাছে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করবেন তা স্থির করতে না পেরে আমার কাছে মন্ত্রণা নিতে এলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, আমি যেমন সহৃদয় লোক তেমনি সবিবেচক। তিনি আমাকে একদিন স্পষ্টই বলেছিলেন যে, তিনি যদি কখনো রাজা হন তা হলে তিনি আমাকে তার মন্ত্রী করবেন। কেননা রাজকার্যের ভার আমি হাতে নিলে তিনি নিশ্চিন্ত মনে অন্দরমহলে বাস করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মুশকিল হয়েছিল এই যে, তিনি মেয়েটির কখনো একলা দেখা পেতেন না, তার মা কন্যারত্নটিকে যক্ষের ধনের মতো আগলে নিয়ে বেড়াত।

কথায় কথায় জানতে পেলুম যে মেয়েটি প্রতি সকালে ঘোড়ায় চড়ে Hyde Parkএ বেড়াতে যায় এবং এই একমাত্র সময় যখন তার মাতা তার রক্ষক থাকেন না।

আমি বললুম, “এই তো তোমার সুযোগ। তুমিও একদিন তাই করো-না। ঘোড়সোয়ার অবস্থায় বীরপুরুষের মতো প্রণয় নিবেদন করলে কোনো মহিলা তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না, বিশেষত Hyde Park এ এবং বসন্তকালে ফুলেফলে লতায়পাতায় প্রকৃতি যখন সুসজ্জিত হয়ে ওঠে সে দৃশ্যে মানুষের মন স্বতঃই প্রণয়াকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে ভারতবর্ষে ও ইউরোপে কোনো প্রভেদ নাই। মানুষের স্বভাব মূলত এক।”

আমার এ প্রস্তাব শুনে Prince একেবারে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে আমার প্রতি কথার অসম্ভব রকম তারিফ করতে করতে আশায় বুক বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এই ঘটনার সাতদিন পরে এই রবিবারে ঘুম থেকে উঠে আমি ঘরে বসে কাগজ পড়ছি, এমন সময় একটি Boy mesenger এসে আমার হাতে একখানি চিঠি দিলে। খুলে দেখি সেখানি Princeএর লেখা। তাতে শুধু একটি ছত্র লেখা ছিল— “I am dying”।

পত্রপাঠ আমি একটি গাড়ি ভাড়া করে তাঁর হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি Prince বিছানায় শুয়ে রয়েছেন কম্বল মুড়ি দিয়ে। প্রথমে তাঁকে দেখে আমি চিনতে পারি নি। কারণ তাঁর মুখ এত ফুলেছিল যে তাঁর কান থেকে কান পর্যন্ত সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে আমার চোখে পড়ল যে Prince-এর তিলফুলের মতো নাসিকা তালফলের মতো গোলাকার হয়েছে।

ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করাতে তিনি কটুভাষায় নিজের ভাগ্যের নিন্দে করতে লাগলেন। তাঁর সমস্ত দুঃখের কান্নার ভিতর থেকে আমি এই সার সংগ্রহ করলুম যে, তিনি আমার পরামর্শমত অশ্বারোহী হয়ে Hyde Parkএ কন্যারত্ন আহরণ করতে গিয়েছিলেন। এর জন্য তাঁর পাঁচশো টাকা এক দিনে খরচ হয়ে গিয়েছে ঘোড়ার ভাড়া দিতে ও ঘোড়ায় চড়বার পোশাক তৈরি করাতে।… তিনি যে একজন পয়লা নম্বরের ঘোড়সোয়ার তাঁর প্রণয়পাত্রীকে তাই দেখাতে তিনি একটি খুব তেজী ঘোড়া ভাড়া করেছিলেন। এতেই তাঁর সর্বনাশ ঘটেছে।

ঘোড়াটি রাস্তায় খুব ভালোমানুষের মতো চলেছিল, কিন্তু Hyde Park-এ প্রবেশ করেই সে হঠাৎ ধনুকের মতো বেঁকে চার পা তুলে লাফাতে শুরু করলে। Prince অনেক কষ্টে তাকে কোনো রকমে তার প্রণয়পাত্রীর ঘোড়ার পাশে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে I love you এই কথাকটি বলবার অভিপ্রায়ে যেমন I lo-পর্যন্ত বলেছেন অমনি তাঁর ঘোড়া হঠাৎ এমনি জোরে মাথা তুললে যে সেই অশ্বমস্তকের আঘাতে তাঁর মুখ দিয়ে আর কথা নির্গত না হয়ে তাঁর নাসিকা দিয়ে রক্তস্রাব হতে লাগল। এই দৃশ্য দেখে সেই আমেরিকান মহিলা খিলখিল করে হেসে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন। আর তিনি হোটেলে ফিরে শয্যাশায়ী হলেন।

সত্য কথা বলতে গেলে স্বীকার করতে হয় যে, তাঁর মুখের চেহারা দেখে ও তাঁর নাকী কথা শুনে আমারও বেজায় হাসি পেয়েছিল এবং অতিকষ্টে সে হাসি আমি চাপি। তাঁর কান্নাকাটির উত্তরে কি বলব ভেবে না পেয়ে আমি শেষটা বললুম যে— “Man proposes, God disposes।”

তা উত্তরে তিনি বললেন, “তা যদি হত তো বলবার কোনো কথা ছিল না। কিন্তু আমি যে propose না করতেই ঘোড়া-বেটা সব dispose করে দিলে।”

এ কথার পর আমি তাঁকে আশ্বস্ত করবার বৃথা চেষ্টা না করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলুম এই ভরসায় যে, তাঁর নাকের জখমের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হৃদয়ের জখমও সেরে যাবে। মাস খানেক বাদে দেখা যাবে যে prince আবার love- এর একটি নতুন পালা আরম্ভ করেছেন। আসলে ঘটলও তাই— শুধু পূর্ব-প্রেমের নিদর্শনস্বরূপ তাঁর নাকের উপর একটা বিশ্রী দাগ থেকে গেল।

বৈশাখ ১৩৩১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *