মেরি ক্রিসমাস

মেরি ক্রিসমাস

প্রথম যৌবনে বিলেত গেলে প্রায় সকলেই লভে পড়ে। যারা পড়ে না, তারা দেশে ফিরে এসে বড়োলোক হয়। আমিও পড়েছিলুম। শিশুদের যেমন হাম একবার না একবার হয়, বিলেত গেলে এদেশী নবকিশোরদেরও তেমনি এ জাতীয় চিত্তবিকার ঘটে।

এরূপ কেন হয়— তার বিচার বিজ্ঞান-শাস্ত্রীরা করুন। আমি শুধু যা হয়, তাই বলছি।

এ ঘটনার কারণ অবশ্যই আছে। আমরা গল্প-লেখকেরা যদি সে কারণের বিষয় বক্তৃতা করি, তা হলে সাইকোলজি, ফিজিয়োলজি এবং উক্ত দুই শাস্ত্র ঘেঁটে একসঙ্গে মিলিয়ে ও ঘুলিয়ে যে শাস্ত্র বানানো হয়েছে—যার নাম সেক্সোলজি—তারও অনধিকারচর্চা করব।

এ-সব বিদ্যের পাঁচমিশেলি ভেজাল উপন্যাস চলে, বিশেষত শেষোক্ত উলঙ্গ শাস্ত্রের; কিন্তু ছোটো গল্পে চলে না, কেননা তাতে যথেষ্ট জায়গা নেই।

আমরা বিলেত নামক কামরূপ-কামাখ্যায় গিয়ে যে ভেড়া বনে যাই এ কথা শুনে আশা করি কুমারী পাঠিকারা মনঃক্ষুণ্ণ হবে না। বিলেতি মেয়েরা যে রূপে দেশি মেয়েদের উপর টেক্কা দিতে পারে, তা অবশ্য নয়। রাস্তাঘাটে যাদের দুবেলা দেখা যায়, তাদের নিত্য দেখে নারীভক্তি উড়ে যায়। আর তারাই হচ্ছে দলে পুরু। অবশ্য বিলেতে যারা সুন্দরী তারা পরমাসুন্দরী-মানবী নয়, অপ্সরী। সুখের বিষয় এই অপ্সরীদের সঙ্গে প্রেম করার সুযোগ বাঙালি যুবকদের ঘটে না। আর আমরাও সে দেশে বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে উদ্‌বাহু হই নেই।

আমি পূর্বে বলেছি যে, অধিকাংশ দেশি যুবক বিলেতে প্রেমে পড়ে। কিন্তু সকলেই আর কিছু বিলেতি মেয়েদের বিয়ে করে না। নভেল-পড়া দেশি মেয়েরা বোধ হয় বিশ্বাস করেন যে, মানুষ প্রেমে পড়লেই শেষটায় বিয়ে করা স্বাভাবিক। অবশ্য এরকম কোনো বিধির বিধান নেই। প্রেমে পড়াটা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। ও হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লক্ষণ। অপর পক্ষে বিবাহটা হচ্ছে সামাজিক বন্ধনের মূল ভিত্তি। লোকে প্রেমে পড়ে অন্তরের ঠেলায়—আর বিয়ে করে বাইরের চাপে। প্রেমের ফুল বিলেতি নভেলে বিবাহের ফলে পরিণত হতে পারে, কিন্তু জীবনে প্রায় হয় না। জীবনটা রোমান্স নয়, তাই তো রোমান্টিক সাহিত্যের এত আদর।

আমি বিলেতে প্রেমে পড়েছিলুম, কিন্তু বিলেতি মেয়েকে বিয়ে করি নি; করেছি দেশে ফিরে দেশের মেয়েকে, আর নির্বিবাদে সস্ত্রীক সমাজের পিতলের খাঁচায় বাস করছি। কপোত-কপোতীর মতো মুখে মুখ দিয়েও নয়, ঠোক্রাঠুরি নয়। কিন্তু সেই আদিপ্রেমের জের বরাবরই টেনে এনেছি—অন্তত মনে।

জনৈক উর্দু বা ফারসি কবি বলেছেন, “উন্‌সে বুতানং বাকী অন্ত্”। অর্থাৎ অন্তরের মনসিজ ভস্ম হয়ে গেলেও, সেই ছাইয়ের অন্তরে কিঞ্চিৎ উষ্ণতা বাকি আছে। আমরা হিন্দু হলে বলতুম, দগ্ধসূত্রে সূত্রের সংস্কার থাকে। আমার মনে ঐ জাতীয় একটা ভাব ছিল। কখনো কখনো গোধূলিলগ্নে যখন ঘরে একা বসে থাকতুম, তখন তার ছায়া আমার সুমুখে এসে উপস্থিত হত, তার পর অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। বছর চার-পাঁচ আগে শীতকালে বড়োদিনের আগের রাতে মনে হল, সেই বিলেতি কিশোরীটি আমার শোবার ঘরে লুকোচুরি খেলছে—এই আছে, এই নেই। সমস্ত রাত্রি ঘুম হল না, জেগে স্বপ্ন দেখলুম। স্ত্রীকেও জাগালুম না। সে রাত্তিরে আমার জ্বর হয় নি, কিন্তু বিকার হয়েছিল।

পরদিন সকালে বিছানা থেকে উঠে মনে হল, দেহ ও মন দুইই সমান বিগড়ে গেছে, আর বিকারের ঘোর তখনো কাটে নি।

আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কি অসুখ করেছে?”

“কেন?”

“তোমাকে ভারি শুকনো দেখাচ্ছে।”

“কাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হয় নি বলে।”

“তবে কি আজ বেলা সাড়ে নয়টায় থিয়েটারে যাবে?”

“যাব। আর বাড়ি ফিরে দুপুরে নিদ্রা দেব।”

থিয়েটারে যেতে রাজি হলুম—সে আমার শখের জন্য নয়, স্ত্রীর শখের খাতিরে।

আমরা বেলা সাড়ে নটার সময় চৌরঙ্গীর একটা থিয়েটারে গেলুম— কলকাতার শৌখিন সাহেব-মেমদের গান শোনবার জন্য। সে গানবাজনা শুনে মাথা আরো বিগড়ে গেল। একে বিলেতি গানবাজনা, তার উপর সে সংগীত যেমন বেসুরো তেমনি চিৎকারসর্বস্ব। আমি পালাই পালাই করছিলুম। আমার মন বলছিল—’ছেড়ে দে মা, হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।

এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের বাঁ পাশের সারের প্রথম চেয়ারে বসে আছে আমার আদি-প্রণয়িনী। এ যে সে-ই, সে বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই। সেই গ্রীসিয়ান নাক, সেই বায়োলেট চোখ। আর সেই ঠোঁট-চাপা হাসি, যার ভিতর আছে শুধু জাদু। একে দেখে আমার মাথা আরো ঘুলিয়ে গেল। আমার মনে হল—এ হচ্ছে optical illusion; গত রাত্তিরের অনিদ্রা, তার উপর এই বিকট সংগীতের ফল।

একটু পর থিয়েটারের পরদা পড়ল—কিছুক্ষণ বাদে উঠবে। অমনি সেই বিলেতি তরুণী উঠে দাঁড়ালেন ও আমাকে চোখ দিয়ে বাইরে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমিও আমার স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর অনুসরণ করলুম।

বাইরে গিয়ে আমি প্রথমে সিগারেট ধরালুম। তার পর সে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, “আমাকে চিনতে পারছ?”

“অবশ্য। দেখামাত্রই।”

“এতকাল পরে?”

“হাঁ। এতকাল পরেও। আমাকে চিনতে পেরেছ?”

“তোমার তো বিশেষ কোনো বদল হয় নি। ছিলে ছোকরা, হয়েছ প্রৌঢ় এই যা বদল। আমাদের কথা স্বতন্ত্র। যাক ও-সব কথা। তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”

“কি কথা?”

“তোমার পাশে কে বসেছিল?”

“আমার স্ত্রী।”

“তোমার আর কিছু না থাক্, চোখ আছে। কতদিন বিয়ে করেছ?”

“বিলেত থেকে ফিরেই, অল্পদিন পরে।”

“আমাকে বিয়ে করলে না কেন?”

“জানি নে। করলে কি হত?”

“তোমার জীবন আরামের হত না। কিন্তু তোমার স্ত্রীর মতো আমারও আজ রূপ থাকত, প্রাণ থাকত।”

“কেন তুমি তো যেমন ছিলে তেমনি আছ।”

“তার কারণ তুমি তো আর আমাকে দেখতে পাচ্ছ না, দেখছ তোমার স্মৃতির ছবি।”

“তুমি কি বলছ বুঝতে পারছি নে।”

“পারবে আমি চলে যাবার সময়।”

“কখন চলে যাবে?”

“ঐ সিগারেটের পরমায়ু যতক্ষণ, আমার মেয়াদও ততক্ষণ। ও যখন পুড়ে ছাই হবে, তোমার পূর্বস্মৃতিও উড়ে যাবে। তখন দেখবে আমার পঁয়ত্রিশ বৎসর পরের প্রকৃত রূপ।”

আমি জিজ্ঞেস করলুম, “এ রূপ-পরিবর্তনের কারণ কি?”

“আমি বহুরূপী।”

“তা জানি, কিন্তু সে মনে। দেহেও কি তাই? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি নে।”

“কবেই বা তুমি বুঝতে পেরেছ? Prologue এর রূপ আর epilogue এর রূপ কি এক? তা জীবন-নাটক কমেডিই হোক আর ট্রাজেডিই হোক।

“তোমার জীবন-নাটক এ দুয়ের মধ্যে কোন্‌ টি?”

“গোড়ায় কমেডি, আর শেষে ট্রাজেডি।”

“কথা কইবার ধরন তোমার দেখছি সমানই আছে।”

“তুমি কখনো আমাকে ভালোবাস নি। ভালোবেসেছিলে আমার কথাকে। তাই তুমি আমাকে বিয়ে কর নি। পুরুষমানুষ মেয়ে-পুতুলকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু গ্রামোফোনকে নয়।”

“আর তোমার কাছে আমি কি ছিলুম?”

“আমার খেলার সাথি।”

“কোন্ খেলার?”

“ভালোবাসা-বাসি পুতুল-খেলার। তুমি যখন বিলেত থেকে চলে এলে, তখন দু- চারদিন দুঃখও হয়েছিল—পুতুল হারালে ছোটো ছেলে-মেয়েদের যে-রকম দুঃখ হয়।

“তার পর আমার কথা ভুলে গিয়েছিলে?”

“হাঁ, ততদিন যতদিন জীবনটা কমেডি ছিল। আর যখন তা ট্রাজেডি হয়ে দাঁড়াল, তখন আমার মনে তুমি আবার ফিরে এলে।”

“এর কারণ?”

“সুখে থাকতে আমরা অনেক কথা ভুলে যাই। দুঃখে পড়লেই পূর্বসুখের কথা মনে পড়ে।” আমি বললুম, “হেঁয়ালি ছাড়ো। ব্যাপার কি ঘটেছিল বলো।”

সে উত্তর করলে—”অত কথা বলবার আবশ্যক নেই। দু কথায় বলছি। তুমি চলে আসবার পরে আমিও বিবাহ করেছিলুম-একটি ধনী ও মানী লোককে। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন যে আমি একটি পুতুল। পরে তিনি আবিষ্কার করলেন যে আমি স্ত্রীলোক হলেও মানুষ। আর আমিও আবিষ্কার করলুম যে, তিনি পুরুষ হলেও সমাজের-হাতে- গড়া একটি পুতুল মাত্র। কাজেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তারপর থেকেই সামাজিক ও সাংসারিক হিসেবে আমার অধঃপতন শুরু হল। তার পর দুঃখকষ্টের চরম সীমায় পৌঁচেছিলুম। আর সেই সময়ে তোমার স্মৃতি আবার জেগে উঠল, জ্বলে উঠল । এখন আমি সুখ দুঃখের বাইরে চলে গিয়েছি। আবার যখন দেখা হবে সব কথা বলব।

“আবার দেখা কবে ও কোথায় হবে?”

“কবে হবে জানি নে। তবে কোথায় হবে জানি। আমি এখন যেখানে আছি, সেখানে। সে দেশে ঘড়ি নেই। কালের অঙ্ক সেখানে শূন্য—অর্থাৎ অনন্ত। সে হচ্ছে শুধু কথার দেশ।”

এরপর সে বললে, “ঐ যে তোমার স্ত্রী তোমাকে খুঁজতে আসছে। আমি সরে পড়ি।”—এই কথা বলবার পরে, পুরাকালে শূর্পনখা যেমন এক মুহূর্তে পরমাসুন্দরীর রূপ ত্যাগ করে ভীষণ রাক্ষসীমূর্তি ধারণ করেছিল, সেও তেমনি নবরূপ ধারণ করে আমার সুমুখে দাঁড়াল। সেটি একটি জীর্ণশীর্ণা বৃদ্ধা, পরনে তালিমারা ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক। অথচ তার মুখে চোখে ছিল তার পূর্বরূপের চিহ্ন। যদিচ তার চোখের রঙ এখন ভায়োলেট নয়—ঘোলাটে, আর তার নাক গ্রীসিয়ান নয়, ঝুলে পড়ে রোমান হয়েছে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে দেখছি, এমন সময় আমার স্ত্রী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে রোদে দাঁড়িয়ে কি করছ, তোমার না অসুখ করেছিল?”

আমি বললুম, “একটা বুড়ি মেম আমাকে এসে জ্বালাতন করছিল ভিক্ষের জন্য। এই মাত্র চলে গেল।”

“কই আমি তো কাউকে দেখলুম না, বুড়ি কি ছুঁড়ি কোনো মেমকেও। সকাল থেকে দেখছি কেমন মনমরা হয়ে রয়েছ। সমস্ত রাত্রি ঘুমাও নি, তার উপরে এই দুপুর রোদে খালি মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছ। চলো বাড়ি যাই, নইলে তোমার ভির্মি লাগবে।

“যো হুকুম। চলো যাই।”

“ভালো কথা, আজ তোমার হয়েছে কি?”

“আজ আমার Merry Christmas.”

আশ্বিন ১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *