সারদাদাদার সন্ন্যাস
ফার্স্ট ক্লাস ভূতের গল্প শোনবার দু-চারদিন পরে সারদাদাদাকে জিজ্ঞেস করলুম, “আপনি ভূতের গল্প ছাড়া আর-কোনো গল্প কি জানেন না? ভূতের গল্প নিত্য শুনলে তা আর অদ্ভুত ঠেকে না।”
আমার এ প্রশ্নের কারণ—আমার ছোট্দা ছিলেন বিজ্ঞ প্রকৃতির লোক। যে গল্পের ভিতর কোনো শিক্ষা নেই, সে গল্প তাঁর মতে বাজে গল্প। ছোট্দা পড়তেন শুধু Smilesএর ‘Self-help’। ঐ বইটিই ছিল তাঁর বিলেতি হিতোপদেশ।
সারদাদাদা উত্তর করলেন, “আমি তো আর বঙ্কিম চাটুজ্যে নই যে, দেখে নি, শুনি নি, এমন গল্প মন থেকে বানিয়ে বলব আর হিজিবিজি জগৎসিংহ লিখব? আমি যা নিজে দেখেছি, তাই তোমাদের শোনাতে পারি। থাকি পাড়াগাঁয়ে, বাঁশ ও বেতের বনে আর জমিদারদের দলে— সেখানে ভূত ছাড়া আর কি দেখব? তবে জেল থেকে বেরিয়ে আর-একটা বিপদে পড়েছিলুম, তারই গল্প বলতে পারি।”
আমি বললুম, “তাই বলুন। মানুষের গল্পমাত্রেই তো বিপদের গল্প আর প্রেমের গল্প। আর মাস্টারমশায় আমাদের বলেছেন, কারো যেন প্রেমে পোড়ো না; কেননা প্রেমে পড়ার মানেই বিপদে পড়া।”
২
ছোট্দা বললেন— বিপদের গল্প তিনিও শুনতে চান, কারণ বিপদ কাটাবার একমাত্র উপায় self-help!
ছোট্দা অভয় দেবার পর, সারদাদাদা তাঁর বিপদের কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন— শ্রবণ করো। আমার অপূর্ব কারাবাসের কথা আর কিছু বলব না। অপূর্ব বলছি এই কারণে যে, কারাবাস ইতিপূর্বে আর কখনো ভোগ করি নি।
সে যাই হোক, আমার বেরোবার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল ততই ভয় হতে লাগল— জেল থেকে বেরোব কি পরে, এই কথা ভেবে। বর্ধমানে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অনুগ্রহ করে যে পাছাপেড়ে শাড়িখানা দিয়েছিলেন— যেখানি পরে জেলে আসি— সেখানি জেলেই চুরি গিয়েছিল। আর জেলের উর্দি তো জেলেই রেখে আসতে হবে। একবার বিবস্ত্র হয়ে রেল থেকে নেবে জেলে গিয়েছিলুম, আবার বিবস্ত্র হয়ে রাজপথে বেরোলে পাগলা গারদে যেতে হবে –এই ভয়ে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেল। ভেবেচিন্তে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে শেষটা ‘জেলদার’বাবুর কাছে গিয়ে আমার বস্ত্রের অভাব জানালুম। জেলারবাবুর পিতৃদত্ত নাম জলধর; কয়েদীরা তাঁকে জেলদারবাবু বলেই জানে। জেলদারবাবু অতি সহৃদয় লোক। তিনি আমার কথা শুনে বললেন, “এর জন্য আর ভাবনা কি? বাড়ি থেকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা আনান, আমার স্ত্রী সব কিনে-কেটে দেবেন। কয়েদীদের টাকা আনবার নিয়ম নেই— তাই লুকিয়ে আনতে হবে। আমার স্ত্রী যে-সে স্ত্রী নয়, শিক্ষিতা মহিলা ও হিসেবে পাকা। শুভংকরী তাঁর মুখস্থ; আর তা ছাড়া তাঁর রুচিও পয়লা নম্বরের। সাহেবসুবোরাও তাঁর রুচির তারিফ করেন। আমার ধর্মপত্নী আদরিণী আগুরানীর নামে যেন মনিঅর্ডার আসে।” আমি এ প্রস্তাব শুনে আশ্বস্ত হলুম। কেননা কয়েদীদের মধ্যে আমি জেল-গৃহিণীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলুম; এতদূর প্রিয়পাত্র যে, আমি ভয় পেয়েছিলুম হয়তো তিনি কবে বলে বসবেন—’আবার বলি জেলদার! এই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর!— ভয় পাবার কারণ এই যে, আদরিণী ছিল রূপে বাঁদরিণী।
সুখদাকে চিঠি লিখলুম, টাকা এল। তার পর জেলদারবাবু আমাকে রেলির লাট্টু মার্কা আট-হেতো কোরা ধুতি, জেলেবোনা ঝাড়নের একটি কুর্তা, আর পাঁচহাতি একখানি গামছা এনে দিলেন; সেইসঙ্গে কাশীর একখানি থার্ডক্লাসের টিকিট এবং খোরাকির জন্য চার আনা দিলেন। শিক্ষিতা মহিলার রুচি দেখেই আমার চক্ষুস্থির। তবে বুঝলুম যে, শিক্ষিতা মহিলা স্বয়ং শুভংকরী। আর তখন আমার মনে পড়ে গেল যে, আমার সেই ভিক্ষালব্ধ শাড়িখানি উক্ত শিক্ষালব্ধ মহিলার শ্রী-অঙ্গের শোভাবর্ধন করছে দেখেছি। শুধু নীলবড়ির রঙে ছুপিয়ে তাকে নীলাম্বরী করা হয়েছে।
তার পরদিন ভোরবেলায় কোরা ধুতিখানা লুঙ্গির মতো পরে, জেলের ঝাড়নের কুর্তি গায়ে দিয়ে, গামছাখানি কোমরে বেঁধে, পয়সা চার আনা ট্যাকে গুঁজে, খালি পায়ে স্টেশনে গিয়ে উঠলুম। ভাগ্যিস রাস্তায় কোনো লোকজন ছিল না। কারণ সেজেছিলুম নীচে মুসলমান, উপরে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত।
স্টেশনে গিয়ে যে গাড়ি সুমুখে পেলুম তাতেই চড়ে বসলুম। শুনলুম এ গাড়ি কাশী যাত্রা করবে। দেখলুম থার্ডক্লাস কামরা লোকে ভর্তি; সব সাঁওতাল ও বাউরি মেয়ে ও পুরুষ। সবই কয়লার খনির মজুর ও মজুরনী। মেয়েরা আদরিণী আগুরানীয় তুল্য কয়লার মতো কালো; আর পুরুষরা জলধরবাবুর মতো কদাকার। কি ময়লা তাদের কাপড়, আর কি দুর্গন্ধ তাদের গায়ে! সে যাই হোক, কতক নেবে গেল রানীগঞ্জে, বাদবাকি আসানসোলে। গাড়িতে রইলুম শুধু আমি আর অস্থিচর্মসার একটি সাধুবাবাজি—পরনে গেরুয়া ও মাথায় জটা।
তিনি আমাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, “মশায় বাঙালি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“নাম কি?”
“সারদা সান্যাল।”
“বাড়ি কোথায়?”
“নানা স্থানে। যেখানে যখন থাকি, সেখানেই আমার বাড়ি।”
“কি করেন?”
“কিছুই না।”
“তা হলে আপনি ভবঘুরে?”
“হ্যাঁ তাই”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“কাশী।”
“আসছেন কোথা হতে?”
“জেল থেকে।”
“জেলে গিয়েছিলেন কি অপরাধে?”
“গাঁজা খাই বলে। যদিচ গাঁজা আমি কস্মিনকালেই খাই নি।”
“খেলে যেতেন না।”
“কেন?”
“ত্বরিতানন্দ সেবন করলে সাধু হতেন। জেলে খুব কষ্ট হয়েছিল?”
“সে আর বলতে।”
“আপনি ভবঘুরে নিষ্কর্মা গৃহহীন—আপনার পক্ষে সাধু হওয়াই কর্তব্য।”
“তাতেও তো বহু কষ্ট।”
“মোটেই না।”
“কিরকম?”
“সাধুর ‘ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে’।”
“সে ভোজন কীদৃশ?”
“কোনোদিন আটা ও ঘি, কোনোদিন লঙ্কা ও ছাতু, আর দুধ না চাইতেই পাওয়া যায় মেয়েদের কাছে। আর হট্টমন্দির শ্বশুরমন্দিরের চাইতে ঢের ভালো আর শ্রীঘরের তুলনায় তো স্বর্গ।”
“আপনি কখনো জেলে গিয়েছিলেন?”
“পূর্বাশ্রমের কথা বলা আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ। তবে গৃহস্থাশ্রম মাত্রেই তো জেল, সন্ন্যাসেই মুক্তি।”
“পরিবারের মায়া কাটান কি করে?”
“তুমি কার কে তোমার’ এই মন্ত্র জপ করে।”
“মহারাজের নাম কি?”
“গুরুদত্ত নাম ভূমানন্দ, কিন্তু লোকে বলে ধূমানন্দ। এই লৌকিক নামেই আমি পরিচিত এবং ঐ নামই আমি পছন্দ করি।”
“কেন?”
“ধূম্রলোকই তো আনন্দলোক।”
“মহারাজের যাওয়া হচ্ছে কোথায়?”
“কেদারনাথ। যেখানে ‘পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ।”
এর পর তিনি ঝুলি থেকে একটি গাঁজার কল্কে বার করে তাতে বড়ো তামাক সেজে এক টান ধূম পান করে ‘ব্যোম ভোলানাথ’ বলে চোখ বুজলেন। সে চোখ আর কাশী পর্যন্ত খুললেন না। আমি ভাবলুম—আমি গাঁজা না খেয়ে নরকে গেলুম, আর ভূমানন্দ স্বামী বোধ হয় খেয়ে সশরীরে স্বর্গে গেলেন! কাশী স্টেশনে পৌছেই দেখি সুখদার পুরাতন ভৃত্য কাশীমোহন প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। কাশীমোহন একটি এক্কা করে আমাকে বাঙালিটোলায় সুখদার বাড়িতে নিয়ে গেল। আমাকে দেখেই সুখদা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল এবং বললে, “এ কি চেহারা, এ কি সাজ!”
জেলে আমার মাথা নেড়া করে দিয়েছিল এবং রেখে দিয়েছিল একটি আধ হাত লম্বা টিকি। মাসাবধি দাড়িগোঁফ কামানো হয় নি, তাই ঠোঁটে আর থুতনিতে শুয়োরের কুচির মতো চুলগুলো খাড়া হয়েছিল। আর বেশ? পয়লা নম্বরের রুচিওয়ালী শিক্ষিতা মহিলার রুচির সঙ্গে একটি পাড়াগেঁয়ে অশিক্ষিতা ব্রাহ্মণকন্যার রুচির মিল হল না। সুখদা বললেন, “হয় তুমি জেলে ফিরে যাও, নয়তো ও বেশভূষা ত্যাগ করো।”
আমি বললুম, “ছাড়তে রাজি আছি, কিন্তু পরি কি?”
সুখদা কাশীমোহনকে হুকুম দিল, “সান্যাল মশায়ের ও-জামা ছিঁড়ে ফেলো, আর কেদারঘাটে গিয়ে দাড়িগোঁফ কামিয়ে গঙ্গাস্নান করিয়ে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে ভদ্রলোক সাজিয়ে নিয়ে এসো। আর মাথার একটা টুপি কিনে দিয়ো।”
আমি আর কোনো প্রতিবাদ করলুম না, কেননা সুখদার তখন রাগে হিস্টিরিয়া হয়েছে। কাশীমোহন সুখদার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে। আমি ভদ্রলোক সেজে ফিরে এসে দেখি সুখদার হিস্টিরিয়া কেটে গিয়েছে। অনেক দিন পরে সুখদার ওখানে ভূরি-ভোজন করে অবশ্য তৃপ্তিলাভ করলুম। কিন্তু মাসাধিকাল জেলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করে তার পর রেলগাড়িতে ধূমানন্দ স্বামীর পরামর্শ শুনে আমার মনে ঘোর বৈরাগ্যের উদয় হয়েছিল। তাই সন্ন্যাস অবলম্বন করবার মনস্থ করলুম।
বিকেলে আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় কাশীবাসী প্যারীমোহনদাদার ওখানে গেলুম তাঁর মত নিতে। তিনি ছিলেন একজন মস্ত বড়ো ফিলজফার।
প্যারীমোহনদাদা বললেন যে, “এতে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। আমিও সন্ন্যাস অবলম্বন করতুম, যদি-না আমি ঘোর নাস্তিক হতুম। ভগবান দর্শন করবার যার লোভ নেই, তার পক্ষে সন্ন্যাস বিড়ম্বনা। আমি তোমাকে একটি বিশিষ্ট চতুর ভদ্রলোকের কাছে নিয়ে যাব, যাঁর সঙ্গে সাধুদের দহরম-মহরম আছে। তিনিই তোমার দীক্ষার বন্দোবস্ত করে দেবেন। লোকটি নিজে গৃহস্থ হলেও সাধুদের মুরুব্বি। লোকটির নাম রতিলাল মোতিলাল, কুলীন ব্রাহ্মণ ও কান্তিলাল কাঞ্জিলালের মাসতুতো ভাই। ছিলেন পুলিসের বড়ো কর্মচারী, এখন পেনসন নিয়ে কাশীতে ধর্মকর্মে মন দিয়েছেন। কাঞ্জিলালও পুলিসের একটি লোক— কাশী এসেছেন তদন্তে।”
প্যারীমোহনদাদার সঙ্গে সন্ধ্যার পর রতিলাল মোতিলালজির ওখানে গেলুম। তাঁর ঘর সুসজ্জিত ইংরেজি কায়দায়, সাহেবসুবো প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে বলে। প্যারীমোহনদাদার কাছে আমাদের আগমনের কারণ জেনে তিনি আমাকে একনজর ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, “একে সন্ন্যাসে দীক্ষিত করা চলবে, কারণ এঁর দেখছি ধর্মে মতি আছে।” প্যারীমোহনদাদা জিজ্ঞাসা করলেন, “কি করে জানলেন?” তিনি উত্তর করলেন, “ওঁর মুণ্ডিত মস্তক ও দীর্ঘ শিখাই তার প্রমাণ।” তার পর মোতিলালজি ও প্যারীমোহনদাদা উভয়ে ব্রাণ্ডি পান করতে শুরু করলেন। প্যারীমোহনদাদা মদ কিনে খান না, কিন্তু অন্যে দিলে ছাড়েন না। আমাকে একপাত্র গলাধঃকরণ করতে মোতিলালজি অনুরোধ করায় আমি অস্বীকৃত হলুম। তিনি বললেন, “সন্ন্যাসীর একটা-না-একটা নেশা চাই-হয় গাঁজা, নয় আফিং, নয় সুরা। তা না হলে সন্ন্যাসের নেশা ছুটে যায়। সাদা চোখে ভগবানের দর্শন মেলে না।”
প্যারীদাদা বললেন, “লাল চোখে যদি মিলত, তা হলে আপনি আর আমি একদিন-না-একদিন নিরাকার ভগবানের দর্শন পেতুম।”
মোতিলালজি বললেন, “তোমার ও আমার পান তামসিক পান। মন্ত্রপুত সাত্ত্বিক পান নয়।”
“তবে আপনি সারদাকে পানানন্দ স্বামীর চেলা করে দিন।”
মোতিলালজি উত্তরে বললেন, “প্যারীমোহন, তুমি ঘোর নাস্তিক। সিদ্ধযোগী প্রাণানন্দ স্বামীকে কিনা পানানন্দ বললে!
“লোকসমাজে তো তিনি পানানন্দ বলেই পরিচিত।”
“সে তোমার মতো নাস্তিকদের দলেই।”
অতঃপর স্থির হল, আমি প্রাণানন্দ স্বামীর কাছেই দীক্ষিত হব।
রতিলাল মোতিলালজি অসাধারণ করিৎকর্মা লোক। তার পরের দিনই প্রাণানন্দ স্বামী ওরফে পানানন্দ স্বামী আমাকে দীক্ষা দিলেন। গুরুজি আমার নাম দিলেন, পঞ্চানন্দ ব্রহ্মচারী। কেননা মানুষের ভিতরে আছে পঞ্চপ্রাণ, বাইরে পঞ্চ ভূত, আর পঞ্চভূতের সঙ্গে পঞ্চপ্রাণের যোগসাধন করতে হয় পঞ্চমকার দিয়ে। তার পর গুরুজি বললেন, “আমাকে কিছুদিনের জন্য মানসসরোবরে যেতে হবে। ফিরে এসে তোমাকে সন্ন্যাসের দীক্ষা দেব। তখন তুমি লোটাকম্বলের অধিকারী হবে। যে কদিন আমি মানসসরোবরে থাকব, সেই কদিন তুমি আমার স্থানাভিষিক্ত থাকবে। তোমাকে প্রতি সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেক শিবনেত্র হয়ে থাকতে হবে, অর্থাৎ চোখের পাতা উল্টে। তার পর আমার ভক্তদের ধর্মোপদেশ দিতে হবে।”
আমি জিজ্ঞেস করলুম, “কি উপদেশ দেব?”
তিনি বললেন, “বর্ণপরিচয় তো পড়েছ, যে-সব গুণে গোপাল সুবোধ বালক হয়েছিল সেই-সব গুণের চর্চা করতে উপদেশ দিয়ো। ঐ উপদেশ সদুপদেশের প্রথম ও শেষ কথা।”
আমি রাজি হলুম। সেই রাত্তিরেই গুরুজি অন্তর্ধান হলেন।
তার পরদিন আমি বর্ণপরিচয় মুখস্থ করে প্রাণানন্দ স্বামীর আশ্রমে শিবনেত্র হয়ে আসন গ্রহণ করলুম। এমন সময় রতিলাল মোতিলালের মাসতুতো ভাই কান্তিলাল কাঞ্জিলাল জনকতক লাল পাগড়িধারী সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে আমাকে না-বলা-কওয়া গ্রেপ্তার করলেন; হাতে দিলেন হাত-কড়া আর পায়ে বেড়ি।
আমার নাম ডাকি ঝড়ু তালুকদার ও আমি নাকি লাল খাঁকে হাড়কাঠে ফেলে বলিদান দিয়েছি। তার পর ফেরার হয়ে স্বামীজি হয়ে বসেছি। সেখানে মুন্সিবাবুদের সঙ্গে আর-একটি জমিদারের মহা কাজিয়া হয়েছিল। এই কাজিয়াতে ঝড়ু তালুকদার খুন করে।
আমি কিছু বলবার আগেই মোতিলালজি বললেন, “বেটা তো আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।” তার পর বললেন, “তোমার কিছু ভয় নেই, আমি তোমাকে জামিনে খালাস করব আর বড়ো উকিল ভোজপুরী গিরিধারিলালকে দিয়ে defend করাব।”
সেই রাত্তিরেই তিনি খোট্টা হাকিমের বাড়ি গিয়ে আমাকে জামিনে খালাস করলেন ও জামিন হলেন প্যারীমোহনদাদা। তার পর আমরা হাকিমের বাড়ি থেকে উকিলের বাড়ি গেলুম ও তাকে সঙ্গে নিয়ে সুখদার বাড়ি চললুম। উকিলবাবুর বিশাল বপু, গলার আওয়াজও তদ্রূপ। মামলার বিবরণ শুনে তিনি বললেন যে আমাকে খালাস করা কঠিন, এর জন্য ঢের তলিফ করতে হবে। তবে ফি ৫০০ ও হাকিমের বক্শিশ আর ৫০০ টাকা। এ টাকা না দিলে আমার নিশ্চয়ই ডবল ফাঁসি হবে।
প্যারীমোহনদাদা জিজ্ঞেস করলেন, “ডবল ফাঁসির মানে কি?”
উকিলবাবু চটে জবাব দিলেন, “আইনের কথা তোমরা কি বুঝবে?”
সুখদা পর্দার আড়াল থেকে সব শুনছিল। সে বললে, “আমি এক টাকাও দেব না। তুমি নিজে মামলা চালাও। তুমি তো জমিদারদের তরফ থেকে চিরকালই মামলার তবির করেছ। ঐ ছাতুখোর নির্বুদ্ধি উকিলের চাইতে তুমি মামলা ঢের ভালো চালাতে পারবে।”
প্যারীমোহনদাদাও সুখদার সঙ্গে সায় দিলেন ও বললেন, “বেটা বলে কিনা ডবল ফাঁসি! ওকে মারতে হলে অবশ্য ডবল ফাঁসি দিতে হত। একবার ফাঁসি ছিঁড়ে পড়বে তার পর ওকে তুলে আর-একবার ঝোলানো হবে।”
অগত্যা আমাকে self-helpই অবলম্বন করতে হল। গিরধারি মহা রেগে চলে গেলেন এই বলে যে—বাঙালি লোক “বহুত বেওকুফ আওর বখিল হ্যায়”।
পরদিন এগারোটায় আদালতে হাজির হলুম—আমি, মোতিলালজি ও প্যারীমোহনদাদা। গিয়ে দেখি গিরধারি উকিল সেখানে বসে আছেন। কান্তিলাল কাঞ্জিলাল আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী তিনজন খাড়া করেছিলেন—ভাগ্নে ও চুলপাকা দুজন লেঠেল। ভাগ্নে যে-বাড়ির দৌহিত্র, আমি সেই বাড়িরই দৌহিত্রের দৌহিত্র। আর লেঠেল দুজনেই আন্দামানফেরত। একজন লাল খাঁর মামাতো ভাই, অপরটি তাঁর সাকরেদ। প্রমাণ হল, উক্ত কাজিয়ায় লাল খাঁর গলা কাটা গিয়েছিল। কিন্তু কে কেটেছে কেউ তো তা স্বচক্ষে দেখেন নি। ভাগ্নে শুধু পরের মুখে শুনেছেন। আর লেঠেল দুটি বললে, তারা লাল খাঁর কাটা মুণ্ডু দেখেছে, কিন্তু সে কাটা মুণ্ডু কোনো কথা কয় নি ।
আর প্রমাণ হল তখন আমি সব জন্মেছি, আর আমি ঝড়ু তালুকদার ওরফে প্রাণানন্দ স্বামীও নই। হাকিম বললেন যে, facts সবই আমি যে নির্দোষ তাই প্ৰমাণ করে।
গিরধারি লাফিয়ে উঠে বললেন যে, আপনার কথায় একটিও law-point নেই। হাকিম এতয়ারী তেওয়ারী বললেন, “কেঁও নেহি হ্যায়? এ মামলা তামাদি হো গিয়া।”
ভোজপুরী গিরধারি বললে, “তামাদি হো নেহি সকতা। ইকো ফাঁসিকা হুকুম দিজিয়ে।”
তার পর উকিলে ও হাকিমে তামাদির আইনের মহাতর্ক বাধল “।
সে তর্কের কথা আর বলব না। কেননা তার কোনো মাথামুণ্ডু ছিল না। তার পর প্যারীদাদার পরামর্শে আমি বললুম, “হুজুর, ভোজপুরী গিদ্ধর চিল্লাতা কেঁউ?”
উকিল বললেন, “হাম গিদ্ধর নেই, সিংহ হ্যায়।”
আমি বললুম, “হো সকতা, মগর সরকারকো ওকিল তো নেহি হ্যায় হাকিম বললেন, “এ বাৎ ঠিক।” এবং আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন।
.
এ গল্প শুনে ছোট্দা খুশি হলেন, কারণ এর ভিতর বিপদও আছে; self-helpও আছে।
মা বললেন, “এ গল্প আগাগোড়া মিথ্যে।”
১৩৪৮