পূজার বলি

পূজার বলি

উকিল অবশ্য আমরা সবাই হই পয়সা রোজগার করার জন্য। কিন্তু পয়সা সকলের ভাগ্যে জোটে না। তবুও যে আমরা অনেকেই ও ব্যবসার মায়া কাটাতে পারি নে তার কারণ, ও ব্যবসার টান শুধু টাকার টান নয়। আমাদের ভিতর যাঁদের মন পলিটিক্সের উপর পড়ে আছে, তাঁরা জানেন যে, বার-লাইব্রেরির তুল্য পলিটিক্সের স্কুল ভারতবর্ষে আর কুত্রাপি ন ভৃত্যে ন ভবিষ্যতি। ও স্কুলে ঢুকলে আমরা যে জুনিয়ার পলিটিক্সের হাড়হদ্দর সন্ধান পাই, শুধু তাই নয় সেই সঙ্গে আমাদের পলিটিক্যাল মেজাজও নিত্য তর্ক-বিতর্ক বাগবিতণ্ডার ফলে সপ্তমে চড়ে থাকে। এ স্কুলের আর-এক মহাগুণ এই যে, এখানে কোনো ছাত্র নেই, সবাই শিক্ষক; জায়গাটা হচ্ছে, এ কালের ভাষায় যাকে বলে, পুরা ডিমোক্রাটিক। মিটিং তো এখানে নিত্য হয়, উপরন্তু freedom of speech এ ক্ষেত্রে অবাধ। তারপর যাঁদের মন পলিটিক্যাল নয়—সাহিত্যিক, তাঁরাও উকিলের বার-লাইব্রেরিতে ঢুকলেই দেখতে পাবেন যে, এতাদৃশ গল্পের আড্ডা দেশে অন্যত্র খুঁজে পাওয়া ভার। উকিলমহলে একদিকে যে-সব গল্প শোনা যায় তাতে অন্তত বারোখানা মাসিকপত্রের বারোমাস পেট ভরানো যায়।

পৃথিবীর মানুষের দুটিমাত্র ক্রিয়াশক্তি আছে—এক বল, আর এক ছল। মানুষ যে কত অবস্থায় কত ভাবে কত প্রকার বল-প্রয়োগ করে তার সন্ধান পাওয়া যায় সেই-সব উকিলের কাছ থেকে যাঁরা ফৌজদারি আদালতে প্রাকটিস করেন; আর non-violent লোকেরা যে কত অবস্থায়, কত ভাবে, কত প্রকার ছল প্রয়োগ করেন তার সন্ধান পাওয়া যায় সেই-সব উকিলের কাছ থেকে—যাঁরা দেওয়ানি আদালতে প্রাকটিস্ করেন।

আমি জনৈক ফৌজদারি উকিলের মুখে একটি গল্প শুনেছি, সেটি আপনারা শুনলেও বলবেন যে, হাঁ, এটি একটি গল্প বটে। আমার জনৈক উকিলবন্ধু উত্তরবঙ্গের কোনো জিলাকোর্টে একটি খুনী মামলায় আসামীকে defend করেন। কিন্তু তাকে তিনি খালাস করতে পারেন নি। জুরী আসামীকে একমত হয়ে দোষী সাব্যস্ত করেন, আর জজ-সাহেব তার উপর ফাঁসির হুকুম দিলেন। হাইকোর্টে ফাঁসির বদলে হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ।

আমার উকিল বন্ধুটির দেশে criminal lawyer বলে খ্যাতি আছে। এর থেকেই অনুমান করতে পারেন যে, জীবনে তিনি বহু অপরাধীকে খালাস করেছেন আর বহু নিরপরাধকে জেলে পাঠিয়েছেন। খুনী মামলার আসামীর প্রাণরক্ষা না করতে পারলে প্রায় সব উকিলই ঈষৎ কাতর হয়ে পড়েন; বোধ হয় তাঁরা মনে করেন যে, বেচারার অপঘাতমৃত্যুর জন্য তাঁরাও কতক পরিমাণে দায়ী। এ ক্ষেত্রে আমার বন্ধু গলার জোরে আসামীর গলা বাঁচিয়ে-ছিলেন, তবুও তার দ্বীপান্তর-গমনে তাঁর পুত্রশোক উপস্থিত হয়েছিল। এই ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত তিনি এ মামলার কথা উঠলেই রাগে ক্ষোভে অভিভূত হয়ে পড়তেন; তখন তাঁর বড়ো বড়ো চোখ দুটি রক্তবর্ণ হয়ে উঠত আর তার ভিতর থেকে বড়ো বড়ো ফোঁটায় জল পড়ত। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আসামী সম্পূর্ণ নির্দোষ আর জজসাহেব যদি টিফিনের—পরে নয়—পূর্বে জুরীকে ঘটনাটি বুঝিয়ে দিতেন, তা হলে জুরী একবাক্যে আসামীকে not guilty বলত। জজ- সাহেব নাকি টিফিনের সময় অতিরিক্ত হুইস্কি পান করেছিলেন এবং তার ফলে সাক্ষ্য- প্রমাণ সব ঘুলিয়ে ফেলেছিলেন।

মামলায় হারলেই সে হারের জন্য উকিলমাত্রই জজের বিচারের দোষ ধরেন—যেমন পরীক্ষায় ফেল হলে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষকের দোষ ধরে। সেই জন্য আমি আমার বন্ধুর কথায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারি নি। আমার বিশ্বাস ছিল যে, আসামীর প্রতি অনুরাগই তাঁর ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। কারণ, সে ছিল প্রথমত ব্রাহ্মণের ছেলে, তার পর জমিদারের ছেলে, তার উপর সুন্দর ছেলে, উপরন্তু কলেজের ভালো ছেলে। এরকম ছেলে যে কাউকে খুন-জখম করতে পারে, এ কথা আমার বন্ধু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেন নি—তাই তিনি সমস্ত অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করতেন যে, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ।

ঘটনাটি আমরা পাঁচজন একরকম ভুলেই গিয়েছিলুম। কারণ, সংসারের নিয়মই এই যে, পৃথিবীর পুরানো ঘটনা সব ঢাকা পড়ে নব নব ঘটনার জালে, আর আদালতে নিত্য নব ঘটনার কথা শোনা যায়। উক্ত ঘটনার বছর-পাঁচেক পরে আমার বন্ধুটি একদিন বার-লাইব্রেরিতে এসে আমার হাতে এক খানি চিঠি দিয়ে বললেন যে, এখানি মন দিয়ে পড়ো কিন্তু এ বিষয়ে কাউকে কিছু বোলো না। সেদিন আমার বন্ধুর মুখের চেহারা দেখে বুঝতে পারলুম না যে, তাঁর মনের ভিতর কি ভাব বিরাজ করছে—আনন্দ, না মর্মান্তিক দুঃখ? শুধু এইটুকু লক্ষ্য করলুম যে, একটা ভয়ের চেহারা তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে। চিঠির দিকে তাকিয়ে প্রথমে নজরে পড়ল যে, তার উপর কোনো ডাকঘরের ছাপ নেই। তাই মনে হয়েছিল যে, এখানি কোনো স্ত্রীলোকের চিঠি—যে চিঠি সে তাঁকে দেবার সুযোগ অথবা সাহস পায় নি। এরকম সন্দেহ হবার প্রধান কারণ এই যে, আমার বন্ধু আমাকে এ পত্রের বিষয়ে নীরব তাকতে অনুরোধ করেছিলেন। তার পর যখন লক্ষ্য করলুম যে, শিরোনামা অতি সুন্দর পরিষ্কার ও পাকা ইংরাজি অক্ষরে লেখা, তখন সে বিষয়ে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। আমি লাইব্রেরির একটি নিভৃত কোণে একখানি চেয়ারে বসে সেখানি এইভাবে পড়তে শুরু করলাম—যেন সেখানি কোনো brief এর অংশ। ফলে কেউ আর আমার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে সেটি দেখবার চেষ্টা করলে না। উকিল-সমাজের একটা নীতি অথবা রীতি আছে, যা সকলেই মান্য করে, সকলেই পরের ব্রিফকে পরস্ত্রীর মতো দেখে, অর্থাৎ কেহই প্রকাশ্যে তার দিকে নজর দেয় না।

সে চিঠিখানি নেহাত বড়ো নয়, তাই সেখানি এতদিন পরে প্রকাশ করছি। পড়ে দেখলেই ব্যাপার কি বুঝতে পারবেন।

আন্দামান

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

দেশ থেকে যখন চিরকালের জন্য বিদায় নিয়ে আসি, তখন নানারকম দুঃখে আমার মন অভিভূত হয়ে পড়েছিল, তার ভিতর একটি প্রধান দুঃখ ছিল এই যে, আসবার আগে আপনার পায়ের ধুলো নিয়ে আসতে পারি নি। আপনি আমার প্রাণরক্ষার জন্য যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, তা সত্য সত্যই অপূর্ব। আমি জানতুম যে, উকিল- ব্যারিস্টাররা মামলা লড়ে পয়সার জন্য, এবং তারা তাদের কর্তব্যটুকু সমাধা করেই খালাস—মামলার ফলাফল তাদের মনকে তেমন স্পর্শ করে না। এ ক্ষেত্রে পরিচয় পেলুম যে, মানুষ কেবলমাত্র তার কর্তব্যটুকু সেরেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। অনেক মামলা উকিলদের মনকেও পেয়ে বসে। আপনি আমাকে খালাস করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, উপরন্তু আমার বিপদ আপনি নিজের বিপদ হিসেবেই গণ্য করেছিলেন। আমার সাজা হওয়ার ফলে আপনি যে মর্মান্তিক কষ্ট বোধ করেছিলেন তা থেকে আমি বুঝলুম যে, আপনি আমার আপন ভাইয়ের মতো আমার বিপদে ব্যথা বোধ করেছিলেন। এর ফলে আপনার স্মৃতি আমার মনে চিরকালের জন্য গাঁথা রয়ে গিয়েছে।

আর-একটা কথা, আসল ঘটনা কি ঘটেছিল তা আপনার কাছে আমরা গোপন করেছিলুম। আজকে সব কথা খুলে বলছি। সে কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন যে, ঘটনা যা ঘটেছিল তা নিজের প্রাণরক্ষার জন্যও প্রকাশ করতে পারতুম না। আমার বরাবরই ইচ্ছে ছিল যে, সুযোগ পেলেই আপনাকে এ ঘটনার সত্য ইতিহাস জানাব। একটি বাঙালি ভদ্রলোকের এখানকার মেয়াদ ফুরিয়েছে। তিনি দুদিন পরে দেশে ফিরে যাবেন। তাঁর হাতেই এ চিঠি পাঠাচ্ছি। তিনি এ চিঠি আপনার হাতে দেবেন।

আপনি জানেন যে, আমি যখন খুনী মামলার আসামী হই তখন আমি প্রেসিডেন্সী কলেজে বি.এ. পড়তুম। শুধু পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসি। আমি পঞ্চমীর দিন রাত আটটায় বাড়ি পৌঁছই। বাড়ি গিয়েই প্রথমে বাবার সঙ্গে দেখা করি, তারপর বাড়ির ভিতর মার সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। বন্ধুও আমার সঙ্গে মার কাছে গেল। বন্ধু কে জানেন? সেই ফোকরাটি—যে আমার মামলার আগাগোড়া তদ্বির করছিল, আর যে দিবারাত্র আপনার কাছে থাকত, আপনাকে আমাদের defence বুঝিয়ে দিত। বন্ধু আমার আত্মীয় নয়—আমরা ব্রাহ্মণ আর সে ছিল কায়স্থ। কিন্তু এক হিসেবে সে আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের মতোই ছিল। বন্ধুর ঠাকুরদাদা আমার ঠাকুরদাদার দেওয়ান ছিলেন;’ এবং তাঁর দত্ত জোতজমার প্রসাদে ওদের পরিবার গাঁয়ের একটি ভদ্র গেরস্ত পরিবার হয়ে উঠেছিল। ও পরিবার আমাদের বিশেষ অনুগত ছিল। উপরন্তু বন্ধু ছিল আমার সমবয়সী ও সহপাঠী। সে যখন ম্যাট্রিক পড়ত, তখন তার বাপ মারা যান। সে তারই স্কুল ছেড়ে দিয়ে সংসারের ভার ঘাড়ে নিলে। সেই অবধি সে গ্রামেই বাস করত এবং আমার বাবা ও মা যখন তার ঘাড়ে যে কাজের ভার চাপাতেন তখন সে কাজ যেমন করেই হোক, সে উদ্ধার করে দিত। এই-সব কারণে সে যথার্থই ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিল। সুতরাং আমাদের বাড়িতে তার গতিবিধি ছিল অবাধ, এবং তার সুমুখে সকলেই নির্ভয়ে সকল কথাই বলতেন। বাড়ির ভিতর গিয়ে শুনি যে মা তাঁর ঘরে শুয়ে আছেন। বন্ধু ও আমি তাঁর শোবার ঘরে ঢুকতেই তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। আমি তাঁকে প্রণাম করবার পর তিনি আমাকে ও বন্ধুকে পাশের একখানি খাটে বসতে বললেন। আমরা বসবামাত্র মা আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, “কেমন আছ?”

“ভালো।”

“কলকাতায় কেমন ছিলে?”

“ভালোই ছিলুম।”

“তবে কলকাতা ছেড়ে এখানে এলে কি জন্যে?”

“পুজোর সময় বাড়ি আসব না?”

“কার বাড়িতে এসেছ?”

“কেন, আমাদের বাড়িতে?”

“তোমাদের তো কোনো বাড়ি নেই।”

“মা, তুমি কি বলছ, বুঝতে পাচ্ছি নে।”

“এ বাড়ি অবশ্য তোমার চৌদ্দপুরুষের, কিন্তু তোমার নয়। অমন করে চেয়ে রইলে কেন? জিজ্ঞাসা করি, জমিদারি কার, তোমাদের না অন্যের?”

“আমাদের বলেই তো চিরকাল শুনে আসছি।”

“তবে আমি বলি শোনো। তোমাদের এক ফোঁটা দেবার মাটিটুকুও নেই।

“আগে ছিল, এখন গেল কি করে?”

“জমিদারি পাঁচ-আনির কাছে বন্ধক ছিল তা তো জান?”

“হ্যাঁ জানি।”

“এখন পাঁচ-আনি দশ-আনিরও মালিক হয়েছে। তোমাদের অংশ এখন পাঁচ- আনির কাছে আর বন্ধক নেই, এখন তা দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, আর তা কিনেছে পাঁচ-আনি।”

“বল কি! সত্যি?”

“সঙ্গে সঙ্গে বাড়িখানিও গিয়েছে। পাঁচ-আনি এখন তোমাদের ভিটে মাটি উচ্ছন্ন করেছে। যাক, তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে সে এবার পুজো করবে।”

“তা হলে আমাদের পুজো বন্ধ থাকবে?”

“অবশ্য। এ অধিকার এখন পাঁচ-আনির, সে অধিকার সে ছাড়বে না। যে ঠাকুর আমরা এনেছি, সেই ঠাকুরই সে নিজের পুরুত দিয়ে পুজো করাবে, ধুমধামও হবে যথেষ্ট, আমাদের কাঙালি বিদেয় করবে।”

“এর কোনো উপায় নেই মা?”

“থাকবে না কেন, কিন্তু তোমাদের দ্বারা তা হবে না। আমার পেটে হয়েছে শুধু শেয়াল-কুকুর-যদি মানুষের গর্ভধারিণী হতুম, তা হলে আর তোমার চৌদ্দপুরুষের পুজো বন্ধ হত না।”

“উপায় কি?”

“উপায় সোজা, শত্রু নিপাত করা।

যার মুখে এ প্রস্তাব শুনে আমার মাথায় বজ্রাঘাত হল। তাঁর কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে বারবাড়িতে চলে এলুম। বন্ধুও ‘আসছি’ বলে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। দুর্ভাবনায় দুশ্চিন্তায় আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলুম, তাই আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবতে লাগলুম। মনটা এতই অস্থির হয়েছিল যে, তখন কি ভাবছিলুম তা বলতে পারি নে। এই ভাবে ঘণ্টা খানেক গেল। তারপর বন্ধু হঠাৎ এসে উপস্থিত হল। সে এসেই বললে যে, “চল্, মার কাছে যাই, তাঁকে একটা খবর দিয়ে আসি।” বন্ধুর মুখের চেহারা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলুম, তার এত গম্ভীর চেহারা আমি জীবনে কখনো দেখি নি; কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের ভিতর এমনই একটা দৃঢ় আদেশের সুর ছিল যে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার সঙ্গে আমার বাড়ির ভিতর গেলুম। মা তখনো নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। বন্ধু তাঁর ঘরে ঢুকেই বললে, “মা, একটা সুখবর আছে, তোমার শত্রু নিপাত হয়েছে।” এ কথা শুনে মা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে হাঁ করে বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বন্ধু আবার বললে, “মা, কথা মিথ্যে নয়। আমিই তাকে নিজ হাতে নিপাত করেছি। বলি বাধে নি, এক কোপেই সাবাড় করেছি”–এই বলেই সে বুকের ভিতর থেকে একখানা দা বার করে দেখালে, সেখানি তাজা রক্তমাখা; এতই তাজা যে, তা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।

তাই দেখে মা মূর্ছা গেলেন, আর আমি এক মুহূর্তের মধ্যে আলাদা মানুষ হয়ে গেলুম। আমার মনের ভিতর যেন একটা প্রকাণ্ড ভূমিকম্প হয়ে গেল। মনের পুরানো ভাব, পুরানো আশা-ভয় সব চুরমার হয়ে গেল। ভালোমন্দ জ্ঞান মুহূর্তে লোপ পেল, আমার মনে হল যেন আমি একটা মহাশ্মশানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি, আর তখন মনে হল, পৃথিবীতে মৃত্যুই সত্য, জীবনটা মিছে।

আসল ঘটনা যা ঘটেছিল, তা আপনাকে খুলেই লিখলুম। দেখছেন, এ ঘটনা আমি সেকালে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারতুম না, প্রাণ গেলেও নয়। আজ যে আপনার কাছে প্রকাশ করছি, তার করুণ, মা এখন ইহলোকে নেই, বন্ধু তো শুনেছি সংসার ত্যাগ করেছে।

আপনি ঠিকই ধরেছিলেন, খুন আমি করি নি। তবে আমি যে শাস্তি ভোগ করছি, তার কারণ, আসল ঘটনাটা প্রকাশ না পায় তার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি এবং সত্য গোপন করতে হলে যে পরিমাণ মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, তা নিতে কুণ্ঠিত হই নি। এ-সব কথা আপনাকে না বললে আমার মনের একটা ভার নামত না, তাই আপনার কাছে অকপটে তা প্রকাশ করলুম নিজের মনের সোয়াস্তির জন্য। আমি ভালো আছি, অর্থাৎ এখানে এ অবস্থায় মানুষের পক্ষে যতদূর স্বস্তিতে ও মনের আরামে থাকা সম্ভব, ততদূর আছি। ইতি

প্ৰণত শ্ৰী—

এই চিঠি পড়ে আমিও অবাক হয়ে গেলুম। শুধু মনে হতে লাগল যে, রাগের মুখের একটি কথা ও ঝোঁকের মাথায় একটি কাজ মানুষের জীবনে কি প্রলয় ঘটাতে পারে।

আশ্বিন ১৩৩৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *