প্রফেসারের কথা

প্রফেসারের কথা

আমি যে বছর বি. এস্-সি. পাস করি, সে বছর পুজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে জ্বরে পড়ি। সে জ্বর আর দু-তিন মাসের মধ্যে গা থেকে বেমালুম ঝেড়ে ফেলতে পারলুম না। দেখলুম, চণ্ডীদাসের অন্তরের পীরিতি-বেয়াধির মতো আমার গায়ের জ্বর শুধু ‘থাকিয়া থাকিয়া জাগিয়া ওঠে, জ্বালার নাহিক ওর।” শেষটায় স্থির করলুম, চেঞ্জে যাব। কোথায়, জান? উত্তরবঙ্গে! ম্যালেরিয়ার পীঠস্থান! এর কারণ, তখন বাবা সেখানে ছিলেন এবং ভালো হাওয়ার চাইতে ভালো খাওয়ার উপর আমার বেশি ভরসা ছিল। এ বিশ্বাস আমার পৈতৃক। বাবার জীবনের প্রধান শখ ছিল আহার। তিনি ওষুধে বিশ্বাস করতেন কিন্তু পথ্যে বিশ্বাস করতেন না, সুতরাং বাবার আশ্রয় নেওয়াই সংগত মনে করলুম। জানতুম, তাঁর আশ্রয়ে জ্বর বিষম হলেও সাবু খেতে হবে না।

একদিন রাতদুপুরে রাণাঘাট থেকে একটি প্যাসেঞ্জার-ট্রেনে উত্তরাভিমুখে যাত্রা করলুম। মেল ছেড়ে প্যাসেঞ্জার ধরবার একটু কারণ ছিল। একে ডিসেম্বর মাস, তার উপর আমার শরীর ছিল অসুস্থ, তাই এক পাল অপরিচিত লোকের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে অতটা পথ যাবার প্রবৃত্তি হল না। জানতুম যে, প্যাসেঞ্জারে গেলে সম্ভবত একটা পুরো সেকেণ্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্ট আমার একার ভোগেই আসবে। আর তাও যদি না হয় তো গাড়িতে যে লম্বা হয়ে শুতে পারব, আর কোনো গার্ড-ড্রাইভার গোছের ইংরেজের সঙ্গে একত্র যে যেতে হবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলুম। এর একটা আশা ফলেছিল, আর একটা ফলে নি। আমি লম্বা হয়ে শুতে পেরেছিলুম, কিন্তু ঘুমোতে পাই নি। গাড়িতে একটা বুড়ো সাহেব ছিল, সে রাত চারটে পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ হুঁশ ছিল ততক্ষণ শুধু মদ চালালে। তার দেহের গড়নটা নিতান্ত অদ্ভুত, কোমর থেকে গলা পর্যন্ত ঠিক বোতলের মতো। মদ খেয়েই তার শরীরটা বোতলের মতো হয়েছে, কিম্বা তার শরীরটা বোতলের মতো বলে সে মদ খায়, এ সমস্যার মীমাংসা আমি করতে পারলুম না। যারা দেহের গঠন ও ক্রিয়ার সম্বন্ধ নির্ণয় করে, এ problemটা তাদের জন্য, অর্থাৎ ফিজিওলজিস্টদের জন্য রেখে দিলুম। যাক এ-সব কথা। আমার সঙ্গে বৃদ্ধটি কোনোরূপ অভদ্রতা করে নি, বরং দেখবামাত্রই আমার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে সে ভদ্রলোক এতটা মাখামাখি করবার চেষ্টা করেছিল যে আমি জেগে থেকেও ঘুমিয়ে পড়বার ভান করলুম। মাতাল আমি পূর্বে কখনো এত হাতের গোড়ায়, আর এতক্ষণ ধরে দেখি নি, সুতরাং এই তার খাঁটি নমুনা কি না বলতে পারি নে। সে ভদ্রলোক পালায় পালায় হাসছিল ও কাঁদছিল; হাসছিল—বিড় বিড় করে কি বকে, আর কাঁদছিল—পরলোকগতা সহধর্মিণীর গুণকীর্তন করে। সে-যাত্রা গাড়িতে প্রথমেই মানবজীবনের এই ট্রাজি-কমেডির পরিচয় লাভ করলুম। আমার পক্ষে এই মাতলামোর অভিনয়টা কিন্তু ঠিক কমেডি বলে বোধ হয় নি। দুর্বল শরীরে শীতের রাত্তিরে রাত্রি- জাগরণটা ঠাট্টার কথা নয়, বিশেষত সে জাগরণের অংশীদার যখন এমন লোক, যার সর্বাঙ্গ দিয়ে মদের গন্ধ অবিরাম ছুটছে। মানুষ যখন ব্যারাম থেকে সবে সেরে ওঠে তখন তার সকল ইন্দ্ৰিয় তীক্ষ্ণ হয়, বিশেষত ঘ্রাণেন্দ্রিয়। আমারও তাই হয়েছিল। ফলে জ্বর আসবাব মুখে যেরকম গা পাক দেয়, মাথা ঘোরে, আমার ঠিক সেই রকম হচ্ছিল। ঘ্রাণে যে অর্ধ ভোজনের ফল হয়, এ সত্যের সে রাত্তিরে আমি নাকে-মুখে প্রমাণ পাই।

পরদিন ভোরের বেলায় শীতে হি হি করতে করতে স্টিমারে পদ্মা পার হলুম। সারায় গিয়ে এবার যে গাড়িতে চড়লুম তাতে জনপ্রাণী ছিল না। আগের রাত্তিরের পাপ সেইখানেই বিদেয় হল। মনে মনে বললুম, ‘বাঁচলুম।’ যদিচ বিনা নেশায় মানুষটা কিরকম তা দেখবার ঈষৎ কৌতূহল ছিল। সাদা চোখে হয়তো সে আমার দিকে কটমটিয়ে চাইত। শুনেছি, নেশার অনুরাগ খোঁয়ারিতে রাগে দাঁড়ায়। সে যাই হোক, গাড়ি চলতে লাগল, কিন্তু সে এমনি ভাবে যে, গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার জন্য যেন তার কোনো তাড়া নেই। ট্রেন প্রতি স্টেশনে থেমে জিরিয়ে, একপেট জল খেয়ে, দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ধীরে সুস্থে ঘটর-ঘটর করে অগ্রসর হতে লাগল। আমি সাহিত্যিক হলে এই ফাঁকে উত্তরবঙ্গের মাঠঘাট জলবায়ু গাছপালার একটা লম্বা বর্ণনা লিখতে পারতুম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে আমার চোখে এ-সব কিছুই পড়ে নি; আর যদি পড়ে থাকে তো মনে কিছুই ঢোকে নি, কেননা কি যে দেখেছিলুম তার বিন্দুবিসর্গ কিছুই মনে নেই। মনে এই মাত্র আছে যে, আমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। একটা গোলমাল শুনে জেগে উঠে দেখি, গাড়ি হিলি স্টেশনে পৌঁচেছে—আর বেলা তখন একটা।

তাকিয়ে দেখি, একদল মুটে হুড়মুড় করে এসে গাড়ির ভিতর ঢুকে এক রাশ বাক্স ও তোরঙ্গে ঘর ছেয়ে ফেললে। সেই-সব বাক্স ও তোরঙ্গের উপর বড়ো বড়ো কালির অক্ষরে লেখা ছিল Mr. A. Day। দেখে আমার প্রাণে ভয় ঢুকে গেল এই মনে করে যে, রাতরে তো একটা সাহেবে জ্বালিয়েছে, দিনটা হয়তো আর-একটা সাহেবে জ্বালাবে, সম্ভবত বেশিই জ্বালাবে, কেননা আগন্তুক যে সরকারী সাহেব তার সাক্ষী—তাঁর চাপরাশধারী পেয়াদা সুমুখেই হাজির ছিল। আমি ভয়ে ভয়ে বেঞ্চির এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসলুম। স্বীকার করছি, আমি বীরপুরুষ নই।

অতঃপর যিনি কামরায় প্রবেশ করলেন তাঁকে দেখে আমি ভীত না হই, চকিত হয়ে গেলুম। তাঁর নাম মিস্টার Day না হয়ে মিস্টার Night হলেই ঠিক হত। আমরা বাঙালিরা, শুনতে পাই, মোঙ্গল-দ্রাবিড় জাত। কথাটা সম্ভবত ঠিক, কেননা আমাদের অধিকাংশ লোকের চেহারায় মঙ্গোলিয়ানের রঙের বেশ-একটু আমেজ আছে। কিন্তু পাকা মাদ্রাজি রঙ শুধু দু-চার জনের মধ্যেই পাওয়া যায়। Mr. Day সেই দু-চার জনের এক জন। আমি কিন্তু তাঁর রঙ দেখে অবাক হই নি, চেহারা দেখে চমকে গিয়েছিলুম। এ দেশে ঢের শ্যামবর্ণ লোক আছে যারা অতি সুপুরুষ, কিন্তু এই হ্যাটকোটধারী যে কোন্ জাতীয় জীব তা বলা কঠিন। মানুষের সঙ্গে ভাঁটার যে কতটা সাদৃশ্য থাকতে পারে ইতিপূর্বে তার চাক্ষুষ পরিচয় কখনোই পাই নি। সেই দৈর্ঘ্য প্রস্থে প্রায় সমান লোকটির গা হাত পা মাথা চোখ গাল সবই ছিল গোলাকার। তার পর তাঁর সর্বাঙ্গ তাঁর কোট-পেণ্টালুনের ভিতর দিয়ে ফেটে বেরুচ্ছিল। কোট-পেন্টালুন তো কাপড়ের—তাঁর দেহ যে তাঁর চামড়া কেটে বেরোয় নি, এই আশ্চর্য! তাঁকে দেখে আমার শুধু কোলাব্যাঙের কথা মনে পড়তে লাগল, আর আমি হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলুম। যা অসামান্য তাই মানুষের চোখকে টানে, তা সে সুরূপই হোক আর কুরূপই হোক। একটু পরে আমার হুঁশ হল যে ব্যবহারটা আমার পক্ষে অভদ্রতা হচ্ছে। অমনি আমি তার সুগোল নিটোল বপু থেকে চোখ তুলে নিয়ে অন্য দিকে চাইলুম। অন্ধকারের পর আলো দেখলে লোকের মন যেমন এক নিমেষে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, আমারও তাই হল। এবার যা চোখে পড়ল তা সত্য সত্যই আলো— সে রূপ আলোর মতোই উজ্জ্বল, আলোর মতোই প্রসন্ন। Mr. Dayর সঙ্গে দুটি কিশোরীও যে গাড়িতে উঠেছিলেন, প্রথমে তা লক্ষ্য করি নি। এখন দেখলুম, তার একটি Mr. Dayর ঈষৎ-সংক্ষিপ্ত শাড়ি- বাঁধাই সংস্করণ। এর বেশি আর কিছু বলতে চাই নে। Weismann যাই বলুন, বাপের রূপ সন্তানে বর্তায়, তা সে-রূপ স্বোপার্জিতই হোক আর অন্বয়াগতই হোক। অপরটির রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসাধ্য; কেননা আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমার চোখে ও মনে সেই মুহূর্তে যা চিরদিনের মতো ছেপে গেল, সে হচ্ছে একটা আলোর অনুভূতি। এর বেশি আর কিছু বলতে পারি নে। আমি যদি চিরজীবন আঁক না কষে কবিতা লিখতুম, তা হলে হয়তো তার চেহারা কথায় এঁকে তোমাদের চোখের সুমুখে ধরে দিতে পারতুম। আমার মনে হল সে আপাদমস্তক বিদ্যুৎ দিয়ে গড়া, তার চোখের কোণ থেকে তার আঙুলের ডগা দিয়ে অবিশ্রান্ত বিদ্যুৎ ঠিকরে বেরুচ্ছিল। Leyden Jarএর সঙ্গে স্ত্রীলোকের তুলনা দেওয়াটা যদি সাহিত্যে চলত তা হলে ঐ এক কথাতেই আমি সব বুঝিয়ে দিতুম। সাদা কথায় বলতে গেলে প্রাণের চেহারা তার চোখ-মুখ, তার অঙ্গ- ভঙ্গি, তার বেশ-ভূষা, সকলের ভিতর দিয়ে অবাধে ফুটে বেরোচ্ছিল। সেই একদিনের জন্য আমি বিশ্বাস করেছিলুম যে, অধ্যাপক জে. সি. বোসের কথা সত্য—প্রাণ আর বিদ্যুৎ একই পদার্থ।

এই উচ্ছ্বাস থেকে তোমরা অনুমান করছ যে, আমি প্রথম-দর্শনেই তার ভালোবাসায় পড়ে গেলুম। ভালোবাসা কাকে বলে তা জানি নে, তবে এই পর্যন্ত বলতে পারি যে, সেই মুহূর্তে আমার বুকের ভিতর একটি নূতন জানালা খুলে গেল, আর সেই দ্বার দিয়ে আমি একটা নূতন জগৎ আবিষ্কার করলুম— যে জগতের আলোয় মোহ আছে, বাতাসে মদ আছে। এই থেকেই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারবে। আমার বিশ্বাস, আমি যদি কবি হতুম তা হলে তোমরা যাকে ভালোবাসা বল তা আমার মনে অত শিগগির জন্মাত না। যারা ছেলেবেলা থেকে কাব্যচর্চা করে তারা ও জিনিসের টীকে নেয়। আমাদের মতো চিরজীবন আঁক-কষা লোকদেরই ও রোগ চট্ করে পেয়ে বসে। মাপ করো, একটা বক্তৃতা করে ফেললুম, তোমাদের কাছে সাফাই হবার জন্য। এখন শোন তার পর কি হল।

Mr. Day আমার সঙ্গে কথোপকথন শুরু করে দিলেন এবং সেই ছলে আমার আদ্যোপান্ত পরিচয় নিলেন। মেয়ে-দুটি আমাদের কথাবার্তা অবশ্য শুনছিল, স্থূলাঙ্গীটি মনোযোগ সহকারে, আর অপরটি আপাতদৃষ্টিতে— অন্যমনস্ক ভাবে। আমি আপাতদৃষ্টিতে বলছি এই কারণে যে, আমার এক-একটা কথায় তার চোখের হাসি সাড়া দিচ্ছিল। আমার নাম কিশোরীরঞ্জন এ কথা শুনে বিদ্যুৎ তার চোখের কোণে চিক্‌মিক্ করতে লাগল, তার ঠোঁটের উপর লুকোচুরি খেলতে লাগল। স্থূলাঙ্গীটি কিন্তু আসল কাজের কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল। আমার বাবা যে পাটের কারবার করেন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কামারা ছেলে, তার পর অবিবাহিত, তার পর জাতিতে কায়স্থ, এ খবরগুলো বুঝলুম সে তার বুকের নোটবুকে টুকে নিচ্ছে। আমাদের সাংসারিক অবস্থা যে কি রকম, সে কথা জিজ্ঞাসা করবার বোধ হয় Mr. Day প্রয়োজন হয় নি। তিনি আমার বাবাকে হয়তো নামে জানতেন, নয়তো তিনি আমার বেশভূষার পরিপাট্য, আসবাবপত্রের আভিজাত্য থেকে অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, আমাদের সংসারে আর যে বস্তুরই অভাব থাক্—অন্নবস্ত্রের অভাব নেই। সুতরাং আমি বাবার এক ছেলে ও ফার্স্ট ডিভিসনে বি. এস্-সি পাস করেছি, এ সংবাদ পেয়ে তিনি আমার প্রতি হঠাৎ অতিশয় অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। আগের রাত্তিরে বুড়ো সাহেবটি যে পরিমাণ হয়েছিলেন, তার চাইতে এক চুল কম নয়। মদ যে এ দুনিয়ায় কত রকমের আছে, এ যাত্রায় তার জ্ঞান আমার ক্রমে বেড়ে যেতে লাগল।

এর পর তাঁর পরিচয় তিনি নিজে হতেই দিলেন। যে পরিচয় তিনি খুব লম্বা করে দিয়েছিলেন, আমি তা দু কথায় বলছি। তিনিও কায়স্থ, তিনিও বি. এ. পাস; এখন তিনি গভর্নমেন্টের একজন বড়ো চাকুরে-সেটেলমেণ্ট-অফিসার। কিন্তু যে কথা তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার করে বলছিলেন, সে হচ্ছে এই যে, তিনি বিলেতফেরত নন, ব্রাহ্মও নন, পাকা হিন্দু; তবে তিনি শিক্ষিত লোক বলে স্ত্রী-শিক্ষায় বিশ্বাস করেন, এবং বাল্যবিবাহ বিশ্বাস করেন না; সংক্ষেপে তিনি reformer নন—reformed Hindu। মেয়েকে লেখাপড়া, জুতো-মোজা পরতে শিখিয়েছেন, এবং এই-সব শিক্ষা দেবার জন্য বড়ো করে রেখেছেন, এতদিনও বিবাহ দেন নি; তবে পয়লা নম্বরের পাস করা ছেলে পেলে এখন মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি আছেন। এ কথা শুনে আমি তার দিকে চাইলুম, কার দিকে অবশ্য বলবার দরকার নেই। অমনি তার মুখে আলো ফুটে উঠল; কিন্তু তার ভিতর কি যেন একটা মানে ছিল যা আমি ধরতে পারলুম না। আমার মনে হল, সে আলোর অন্তরে ছিল অপার রহস্য আর অগাধ মায়া। এক কথায়, আরতির আলোতে প্রতিমার চেহারা যেরকম দেখায়— সেই হাসির আলোতে তার চেহারা ঠিক তেমনি দেখাচ্ছিল। শরীর যার রুগ্ণ সে পরের মায়া চায় এবং একটুতেই মনে করে অনেকখানি পায়। এই সূত্রে আমি একটা মস্তবড় সত্য আবিষ্কার করে ফেললুম, সে হচ্ছে এই যে, স্ত্রীলোকে বলকে ভক্তি করে, কিন্তু ভালোবাসে দুর্বলকে।

সে যাই হোক, আমি মনে মনে তার গলায় মালা দিলুম, আর তার আকার-ইঙ্গিতে বুঝলুম, সেও তার প্রতিদান করলে। এই মানসিক গান্ধর্ব-বিবাহকে সামাজিক ব্রাহ্ম- বিবাহে পরিণত করতে যে বৃথায় কালক্ষেপ করব না, সে বিষয়েও কৃতসংকল্প হলুম। দুটির মধ্যে সুন্দরীটিই যে বয়োজ্যেষ্ঠা সে বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। যদি জিজ্ঞাসা কর যে, দুই বোনের ভিতর চেহারার প্রভেদ এত বেশি কেন? তার উত্তর—একটি হয়েছে মায়ের মতো, আর-একটি বাপের মতো। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অবশ্য আমাকে differential calculusএর আঁক কষতে হয় নি।

আমি ও মিস্টার দে দুজনেই হলদিবাড়ি নামলুম। দে-সাহেবের ঐ ছিল কর্মস্থল, এবং বাবাও তাঁর ব্যবসার কি তদ্‌বিরের জন্য সে সময়ে ঐখানেই উপস্থিত ছিলেন। স্টেশনে যখন আমি দে-সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি—তখন সেই সুন্দরীর দিকে চেয়ে দেখি, সে মুখে হাসির রেখা পর্যন্ত নেই। যে চোখ এতক্ষণ বিদ্যুতের মতো চঞ্চল ছিল, সে চোখ এখন তারার মতো স্থির হয়ে রয়েছে, আর তার ভিতরে কি একটা বিষাদ, একটা নৈরাশ্যের কালো ছায়া পড়েছে। সে দৃষ্টি যখন আমার চোখের উপর পড়ল, তখন আমার মনে হল তা যেন স্পষ্টাক্ষরে বললে, ‘আমি এ জীবনে তোমাকে আর ভুলতে পারব না; আশা করি তুমিও আমাকে মনে রাখবে।’ মানুষের চোখ যে কথা কয় এ কথা আমি আগে জানতুম না। অতঃপর আমি চোখ নিচু করে সেখান থেকে চলে এলুম।

তার পর যা হল শোনো। আমি এ বিয়েতে বাবার মত করালুম। আমি তাঁর একমাত্র ছেলে, তার উপর আবার ভালো ছেলে; সুতরাং বাবা আমার ইচ্ছা পূর্ণ করতে দ্বিধা করলেন না। প্রস্তাবটা অবশ্য বরের পক্ষ থেকেই উত্থাপন করা হল। উভয়পক্ষের ভিতর মামুলি কথাবার্তা চলল। তার পর আমরা একদিন সেজেগুজে মেয়ে দেখতে গেলুম। মেয়ে আমি আগে দেখলেও বাবা তো দেখেন নি। তা ছাড়া রীতরক্ষে বলেও তো একটা জিনিস আছে।

দে-সাহেবের বাড়িতে আমরা উপস্থিত হবার পর, খানিকক্ষণ বাদেই একটি মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে আমাদের সুমুখে এনে হাজির করা হল। সে এসে দাঁড়াবামাত্র আমার চোখে বিদ্যুতের আলো নয়, বুকে বিদ্যুতের ধাক্কা লাগল। এ সে নয়—অন্যটি। সাজগোজের ভিতর তার কদর্যতা জোর করে ঠেলে বেরিয়েছিল। আমি যদি তার সেদিনকার মূর্তির বর্ণনা করি, তা হলে নিষ্ঠুর কথা বলব। তার কথা তাই থাক্। আমি এ ধাক্কায় এতটা স্তম্ভিত হয়ে গেলুম যে, কাঠের পুতুলের মতো অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। পর্দার আড়াল থেকে পাশের ঘরে একটি মেয়ে বোধ হয় আমার ঐ অবস্থা দেখে খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে উঠল। আমার বুঝতে বাকি রইল না— সে হাসি কার। আমি যদি কবি হতুম, তা হলে সে মুহূর্তে বলতুম, “ধরণী, দ্বিধা হও, আমি তোমার মধ্যে প্রবেশ করি।”

ব্যাপার কি হয়েছিল জান? যে মেয়েটিকে আমাকে দেখানো হয়েছিল, সে হচ্ছে দে-সাহেবের অবিবাহিতা কন্যা; আর যাকে পর্দার আড়ালে রাখা হয়েছিল সে হচ্ছে দে-বাহাদুরের বিবাহিতা স্ত্রী, অবশ্য দ্বিতীয় পক্ষের। বলা বাহুল্য, আমি বিবাহ করতে কিছুতেই রাজি হলুম না, যদিচ বাবা বিরক্ত হলেন, দে-সাহেব রাগ করলেন, আর দেশসুদ্ধ লোক আমার নিন্দা করতে লাগল।

এ ঘটনার হপ্তা-খানেক বাদে ডাকে একখানি চিঠি পেলুম। লেখা স্ত্রী-হস্তের। সে চিঠি এই—

“যদি আমার প্রতি তোমার কোনোরূপ মায়া থাকে তা হলে তুমি ঐ বিবাহ করো নচেৎ এ পরিবারে আমার তিষ্ঠানো ভার হবে।

কিশোরী”

এ চিঠি পেয়ে আমার সংকল্প ক্ষণিকের জন্য টলেছিল; কিন্তু ভেবে দেখলুম, ও কাজ করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কেননা দুজনেই এক ঘরের লোক, এবং দুজনের সঙ্গেই আমার সম্বন্ধ রাখতে হবে, এবং সে দুই মিথ্যাভাবে। নিজের মন যাচিয়ে বুঝলুম, চিরজীবন এ অভিনয় করা আমার পক্ষে অসাধ্য।

এই হচ্ছে আমার গল্প। এখন তোমরা স্থির করো যে এ ট্রাজেডি, কি কমেডি, কিংবা এক সঙ্গে দুইই।

প্রফেসর এই বলে থামলে অনুকূল হেসে বলল, “অবশ্য কমেডি। ইংরেজিতে যাকে বলে Comedy of Errors।”

প্রশান্ত গম্ভীরভাবে বললেন, “মোটেই নয়। এ শুধু ট্রাজেডি নয়, একেবারে চতুরঙ্গ ট্রাজেডি।”

ঐ চতুরঙ্গ বিশেষণের সার্থকতা কি, প্রশ্ন করাতে তিনি উত্তর করলেন— “স্ত্রী কিশোরী আর প্রোফেসার কিশোরী, এই দুই কিশোরীর পক্ষে ব্যাপারটা যে কি ট্রাজিক তা তো সকলেই বুঝতে পারছ। আর এটা বোঝাও শক্ত নয় যে, দে-সাহেবের মনের শান্তিও চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে গেল, আর তাঁর মেয়ের হয় আর বিয়ে হল না, নয় কোনো বাঁদরের সঙ্গে হল।”

প্রফেসর এর জবাবে বললেন, “শ্রীমতীর জন্য দুঃখ করবার কিছুই নেই, তার আমার চাইতে ঢের ভালো বরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী এখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, আর সে আমার দ্বিগুণ মাইনে পায়। কথাটা হয়তো তোমরা বিশ্বাস করছ না, কিন্তু ঘটনা তাই। দে-বাহাদুর দশ হাজার টাকা পণ দিয়ে একটি এম. এ.র সঙ্গে তার বিবাহ দেন, তার পরে সাহেব-সুবোকে ধরে তাকে ডেপুটি করে দেন। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে তাকে খালি-পায়ে বেড়াতে হত, এখন সে দুবেলা জুতো-মোজা পরছে। তার পর বলা বাহুল্য যে, দে-বাহাদুরের যেরকম আকৃতি-প্রকৃতি, তাতে করে তিনি ট্রাজেডি দূরে থাক্ কোনো কমেডিরও নায়ক হতে পারেন না, তাঁর যথার্থ স্থান হচ্ছে প্রহসনের মধ্যে।”

“আচ্ছা, তা হলে তোমাদের দুজনের পক্ষে তো ঘটনাটা ট্রাজিক?”

“কি করে জানলে? অপর কিশোরীর বিষয় তো তুমি কিছুই জান না, আর আমার মনের খবরই বা তুমি কি রাখ?”

“আচ্ছা, ধরে নিচ্ছি যে অপরটির পক্ষে ব্যাপারটা হয়েছে কমেডি, খুব সম্ভবত তাই— কেননা তা নইলে তোমার দুর্দশা দেখে সে খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে উঠবে কেন? কিন্তু তোমার পক্ষে যে এটা ট্রাজেডি, তার প্রমাণ, তুমি অদ্যাবধি বিবাহ কর নি।”

“বিবাহ করা আর না করা, এ দুটোর মধ্যে কোটা বড়ো ট্রাজেডি তা যখন জানি নে, তখন ধরে নেওয়া যাক— করাটাই হচ্ছে কমেডি, যদিচ বিবাহটা কমেডির শেষ অঙ্ক বলেই নাটকে প্রসিদ্ধ। সে যাই হোক, আমি যে বিয়ে করি নি তার কারণ—টাকার অভাব!”

“বটে! তুমি যে মাইনে পাও তাতে আর-দশজন ছেলে-পিলে নিয়ে তো দিব্যি ঘর- সংসার করছে!”

“তা ঠিক। আমার পক্ষে তা করা কেন সম্ভব নয়, তা বলছি। বছর-কয়েক আগে বোধ হয় জান যে, পাটের কারবারে একটা বড়ো গোছের মার খেয়ে বাবার ধন ও প্রাণ দুইই এক সঙ্গে যায়। ফলে আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ি। তার পর এই চাকরিতে ঢুকে মার অনুরোধে বিয়ে করতে রাজি হলুম। ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে এসেছিল; আমি অবশ্য মেয়ে দেখি নি, কিন্তু পাকাদেখাও হয়ে গিয়েছিল। এমন সময়ে আবার একখানি চিঠি পেলুম, লেখা সেই স্ত্রী-হস্তের। সে চিঠির মোদ্দা কথা এই যে, লেখিকা বিধবা হয়েছেন এবং সেই সঙ্গে কপর্দকশূন্য। দে-সাহেব তাঁর উইলে তাঁর স্ত্রীকে এক কড়াও দিয়ে যান নি। তাঁর চিরজীবনের সঞ্চিত ঘুষের টাকা তিনি তাঁর কন্যারত্নকে দিয়ে গিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে খোরপোষের মামলা করা কর্তব্য কি না, সে বিষয়ে তিনি আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি প্রত্যুত্তরে মামলা করা থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করে তাঁর সংসারের ভার নিজের ঘাড়ে নিয়েছি। ভেবে দেখো দেখি, যে গল্পটা তোমাদের বললুম, সেটা আদালতে কি বিশ্রী আকারে দেখা দিত। বলা বাহুল্য, এর পর আমার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিলুম, মা বিরক্ত হলেন, কন্যাপক্ষ রাগ করলেন, দেশসুদ্ধ লোক নিন্দে করতে লাগল, কিন্তু আমি তাতে টললুম না। কেননা, দু-সংসার চালাবার মতো রোজগার আমার নেই।”

“দেখো, তুমি অদ্ভুত কথা বলছ, একটি হিন্দু বিধবার আর কি লাগে, মাসে দশ টাকা হলেই তো চলে যায়, তা আর তুমি দিতে পার না?”

“যদি দশ টাকায় হত, তা হলে আমি পাকা দেখার পর বিয়ে ভেঙে দিয়ে সমাজে দুর্নামের ভাগী হতুম না। সে একা নয়, তার বাপ-মা আছে, তারা যে হতদরিদ্র তা বোধ হয় তাদের দে-সাহেবকে কন্যাদান থেকেই বুঝতে পার। তার পর আমি যে- ঘটনার উল্লেখ করেছি তার সাত মাস পরে তার যে কন্যাসন্তান হয়, সে এখন বড়ো হয়ে উঠছে। এই সব-কটির অন্নবস্ত্রের সংস্থান আমাকেই করতে হয়, আর তা অবশ্য দশ টাকায় হয় না।”

অনুকূল জিজ্ঞাসা করলে, “তাঁর রূপ আজও কি আলোর মতো জ্বলছে?”

“বলতে পারি নে, কেননা তাঁর সঙ্গে সেই ট্রেনে ছাড়া আমার আর সাক্ষাৎ হয় নি।”

“কি বলছ, তুমি তার গোনাগুষ্ঠি খাইয়ে পরিয়ে রাখছ, আর সে তোমার সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ করে নি!”

“একবার কেন, বহুবার সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল কিন্তু আমি করি নি।”

অনুকূল হেসে বলল, “পাছে ‘নেশার অনুরাগ খোঁয়ারির রাগে পরিণত হয়’ এই ভয়ে বুঝি?”

“না, তার কন্যাটি পাছে তার দিদির মতো দেখতে হয় এই ভয়ে!”

শেষে আমি বললুম, “প্রফেসার, তোমার গল্প উৎরেছে। তুমি করতে চাইলে বিয়ে, তা হল না, কিন্তু বিয়ের দায়টা পড়ল তোমার ঘাড়ে। এ ব্যাপার যদি ট্রাজি-কমেডি না হয় তো ট্রাজি-কমেডি কাকে বলে তা আমি জানি নে।”

সুপ্রসন্ন বললে, “তা হতে পারে, কিন্তু এ গল্প ছোটো হয় নি, কেননা, এতক্ষণে ষোলো পেজ পেরিয়ে গেল।”

প্রশান্ত অমনি বলে উঠল যে, “তা যদি হয়ে থাকে তো সে প্রফেসারের গল্প বলার দোষে নয়— তোমাদের জেরা আর সওয়াল-জবাবের গুণে।”

প্রফেসার হেসে বললেন, “প্রশান্ত যা বলছে তা ঠিক, শুধু ‘তোমাদের’ বললে ‘আমাদের’ ব্যবহার করলে তার বক্তব্যটা ব্যাকরণশুদ্ধ হত।”

শ্রাবণ ১৩২৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *