অ্যাডভেঞ্চার : জলে

অ্যাডভেঞ্চার : জলে

আমার জনৈক বন্ধু একটি খাসা ভূতের গল্প লিখেছেন যা পড়ে মনে ভয় হয় না, হয় স্ফূর্তি। আর শেষে বলেছেন—এটি গল্প নয়, সত্য ঘটনা।

গল্পের সঙ্গে সত্য ঘটনার সম্পর্ক কি, এ নিয়ে অবশ্য মহা তর্ক আছে। কেউ বলেন, আর্ট সত্য ঘটনাকে অনুসরণ করে; আবার কেউ বলেন, সত্য ঘটনা আর্টকে অনুসরণ করে। এর থেকে বোঝা যায়, আর্ট যে সত্যের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত নয়, এ জ্ঞান সকলেরই আছে। অপরপক্ষে, সত্য কথা ও আর্ট যে এক জিনিস নয়, এ কথাও লোকে মানতে বাধ্য।

আমি এখন একটি সত্য ঘটনার কথা বলব। লোকে তাকে সত্য বলে গ্রাহ্য করে কি না, তাতে কিছু আসে যায় না; সেটি গল্প বলে পাঠকদের কাছে গ্রাহ্য হয় কি না, সেইটেই হচ্ছে বড়ো কথা। ঘটনা সত্য কি কল্পিত, সে বিচার গল্পখোররা করে না।

এ গল্প ভয়ের গল্প। ভয় আমরা সকলেই পাই— কেউ কম কেউ বেশি, এই যা তফাত। যেমন, অপরকে আমরা কখনো কখনো ভালোবাসি, বিশেষত সে অপর যদি পুরুষ না হয়ে মেয়ে হয়—তবে, কেউ কম আর কেউ বেশি। এখানে আমি স্বজাতিরই পরিচয় দিলুম; কারণ স্ত্রীজাতির কাউকে ভালোবাসার গরজ আছে কি না, তা তাঁরাই বলতে পারেন।

প্রেম করাটা আমাদের পক্ষে যেমন স্বাভাবিক, ভয় পাওয়াটা তার চেয়ে বেশি স্বাভাবিক। কারণ ভয় জিনিসটে বারোমেসে; অপর পক্ষে প্রেমের ফুল মরসুমে ফোটে। তাই গল্প প্রেমেরও হয়, ভয়েরও হয়। আর প্রেমের গল্পও জমিয়ে বলা যায়, ভয়ের গল্পও।

যে ভয়ের কাহিনী আজ বলব সংকল্প করেছি, আমি তার মুখ্য অধিকারী নই, উত্তরাধিকারী মাত্র। ভয় অবশ্য প্রথমে একজন পান, তার পর তার ছোঁয়াচ আর-পাঁচ জনের লেগেছিল। ভয় জিনিসটে সাহসের মতো কেবল ব্যক্তিগত নয়। দলে পড়ে ও- জিনিস বাড়ে কিম্বা কমে। যোদ্ধামাত্রেই কি নির্ভীক? না দলে পড়ে লোকে বীরপুরুষ হয়?

আমরা জনকয়েক বন্ধুতে মিলে একবার নিরুদ্দেশ জলযাত্রা করেছিলুম; অর্থাৎ সকলে একসঙ্গে স্টিমারে ভেসে পড়ি, কোনো বিশেষ স্থানে যাবার জন্য নয়—জলপথে পূর্ববঙ্গ প্রদক্ষিণ করবার জন্য, এবং সে অঞ্চলের বড়ো বড়ো নদনদীর চাক্ষুষ পরিচয় লাভ করবার জন্য। অবশ্য গভীর ও বিপুল জলরাশি দেখবার লোভ আমাদের অনেকেরই ছিল না, কারণ, এ দলের লিডারকে বাদ দিয়ে বাকি সকলেই সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারাপার করেছেন; পৃথিবীর তিন ভাগ যে জল আর এক ভাগ স্থল, সে জ্ঞান জিয়োগ্রাফি পড়ে নয়, চোখে দেখে লাভ করেছেন; আর কালাপানির রঙ যে হীরেকষের মতো নীল নয়, তুঁতের মতো সবুজ, তাও লক্ষ্য করেছেন। উনপঞ্চাশ বায়ুর ভীষণ আক্রমণে মহাসমুদ্রের বিরাট আস্ফালন আর বিকট কোলাহলের সঙ্গেও তাঁরা পূর্ব থেকেই পরিচিত।

আমাদের সঙ্গে ছিলেন দুইজন জাপানি আর্টিস্ট, যাঁদের দেশে হয় অবিশ্রান্ত ভূমিকম্প, আর সমুদ্রে হয় তুমুল তুফান; যে তুফানের ভিতর তাঁদের প্রতিবাসী চীনেরা নৌকো ভাসায় বোম্বেটেগিরি করবার জন্য। এঁরা অবশ্য এই তুফানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে ভারতবর্ষে এসে পৌঁচেছিলেন।

জীবনে কখনো জলযাত্রা করেন নি শুধু আমাদের লিডারটি। বলা বাহুল্য যে, পাঁচজনে দল বাঁধলেই একজন তার দলপতি হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অতি সুপুরুষ, অতি বলিষ্ঠ, অতি ভদ্র আর অতি বুদ্ধিমান; উপরন্তু তিনি ছিলেন অতি ধনী এবং অতি অমিতব্যয়ী। যেখানে আয় কমে সেখানেই ব্যয়ের হিসেব, আয় যেখানে বেশি সেইখানেই বেহিসেব।

আমরা জাহাজে উঠেই আবিষ্কার করলুম, তিনি আমাদের রসদের এমনি সুব্যবস্থা করেছেন যে, তার প্রসাদে ভূ-প্রদক্ষিণ করা যায়। দেশি বিলেতি চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য- পেয়—কিছুই বাদ ছিল না। উপরন্তু তাঁর সঙ্গে জনৈক ডাক্তার ছিলেন, যিনি উক্ত জাহাজে একটি বটকৃষ্ণ পালের শাখা ডাক্তারখানা খুলেছিলেন। তার উপর তাম্বু, ক্যাম্পখাট প্রভৃতিও সংগ্রহ করতে তিনি ভোলেন নি। আমাদের ধনী বন্ধুটি Robinson Crusoe পড়েছিলেন। সুতরাং মাঝদরিয়ায় জাহাজডুবি হলে পদ্মার চড়ায় উঠে কি কি জিনিসের প্রয়োজন হবে, তার ফর্দ করে সে-সব জিনিস সংগ্রহ করেছিলেন। এই সতর্কতার ইংরেজি নাম কি hydrophobia?

আমি লিখতে বসেছি একটি গল্প—পূর্ববঙ্গের ভ্রমণকাহিনী নয়। তার কারণ, পূর্ববঙ্গের বর্ণনার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা পূর্ববঙ্গে যাই আর না যাই, পূর্ববঙ্গ এখন কলকাতায় এসেছে। দক্ষিণ কলকাতাও পূর্ববঙ্গের উপনিবেশ হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলে অবশ্য নদী নেই, কিন্তু লেক আছে। সুতরাং গল্পের ভূমিকা স্বরূপ যে দুটি- একটি কথা বলা আবশ্যক, শুধু তাই বলব।

আমরা কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ গিয়েছিলুম রেলে, গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টিমারে, আর সেই স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, তার পর চাঁদপুর থেকে বরিশাল; আর বরিশাল থেকে সুন্দরবন ঘুরে, বারাতলার মোহানা উৎরে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসি। এ যাত্রায় আমরা মাটির চেয়ে জল ঢের বেশি দেখেছি। এর কারণ, আমরা কিছু দেখতে বেরোই নি, বেরিয়েছিলুম স্ফূর্তি করতে—অর্থাৎ অনর্গল গল্প করতে ও হাসতে, যে গল্প ও যে হাসির মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু নদী কোথাও এত চওড়া নয় যে, একসঙ্গে তার দুকূল দেখা যায় না। শুধু মেঘনার মোহানা পাড়ি দেবার সময় আমাদের দলপতির মন একটু দমে গিয়েছিল ও মুখ একটু বিবর্ণ হয়েছিল সুমুখে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে জল থৈ থৈ করছে দেখে। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, একখানি ছোটো দেশি নৌকাও এ অগাধ জলরাশি বুকে ঠেলে অবাধে নদী পার হচ্ছে, তখন তাঁর মুখে রক্ত ফিরে এল।

সেদিন সন্ধ্যার সময় আমরা বরিশাল গিয়ে পৌঁছলুম। বরিশালের নীচে নদী আমার চোখে বড়ো সুন্দর লেগেছিল। আর মনে হচ্ছিল যে আমি যদি বরিশালবাসী হতুম, আর আমার পকেটে যদি জলে ফেলে দেবার পয়সা থাকত, তা হলে আমি নিশ্চয়ই একটি Boat Club করতুম, আর বিলেত থেকে সেই জাতের বোট আনাতুম যার নাম Eights— যে বোটে চড়ে অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের বিদ্যার্থীরা বাচ খেলে। যদিচ কেম্ব্রিজের নদীকে নালা বলাই সংগত, কারণ Cam টলির নালার চেয়ে প্রশস্ত নয়। রাত দশটা- এগারোটায় বরিশাল ছাড়লুম, কিন্তু সে রাত্তিরে ঘুম হয় নি। থেকে থেকে ঝালকাঠি প্রভৃতি বন্দরে জাহাজ থামে, আর মহা হৈ হৈ আরম্ভ হয়। সে গোলমালে কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভেঙে যেত— আমাদের যে যাবে, সে তো ধরা কথা। অবশ্য আমার সহযাত্রীরা এ কদিন ঘুমের কাছেও ছুটি নিয়েছিলেন।

পরদিন একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো নদীতে গিয়ে পৌঁছলুম, যার জল গঙ্গার মতো ঘোলা নয়, যমুনার মতো কালো। আর দেখলুম যে দেদার স্ত্রী-পুরুষ সেখানে ইংরেজিতে যাকে বলে mixed bathing, তাই করছে। আমি ছাড়া আমার বাদবাকি সহযাত্রীরা সেই নদীতে অবগাহন স্নান করলেন। যদিচ তাঁদের মধ্যে অনেকেই সাঁতার জানতেন না, এবং ইতিপূর্বে কখনো জলে নামেন নি। ঘণ্টাখানেক ধরে তাঁরা বুকজলে ঝাঁপাই ঝুরলেন— বোধ হয় পল্লীসুন্দরীদের ব্যক্তরূপ দেখতে, অথবা নিজেদের নাগরিক রূপ দেখাতে। যখন তাঁরা ডাঙায় উঠলেন, তখন দেখি যে ওঁদের চক্ষু সব জবাফুল, আর হাত-পা মড়ার মতো ফ্যাকাশে। ভূচর জন্তু হঠাৎ জলচর হলে, তাদের বুকের রক্ত সব মাথায় চড়ে যায়। ডাক্তারবাবু Vinum Gallicii নামক তান্ত্রিক ঔষধের সাহায্যে তাদের দেহে আবার রক্তচলাচল ফিরিয়ে আনলেন। সে যাই হোক, সমস্ত দিনটা ছোটো বড়ো মাঝারি নানা আকারের নানা নদী পেরিয়ে, সন্ধ্যার সময় সুন্দরবনের খালে ঢুকলুম। ট্রেন সুড়ঙ্গে ঢুকলে যেমন দেহমনের একটি অসোয়াস্তি ঘটে, আমার অবস্থাও হল তাই। খালের দু পাশে ঘোর বন নয়, ঘন জঙ্গল। অর্থাৎ গাছ নেই, আছে শুধু আগাছা। আর সে আগাছা বেজায় মাথাঝাড়া দিয়ে উঠেছে, দেখতে প্রায় গাছের মতোই উঁচু। জলজ উদ্ভিদ যেন ডাঙায় চড়ে হঠাৎ নবাব হয়ে উঠেছে। দু পাশের গাছ সব সুপুরি গাছের মতো সরু সরু, কিন্তু তার কাণ্ডগুলি সুপুরির মতো মজবুত নয় সজনে গাছের মতো জলভরা আর পত্রবহুল। আর সে-সব নলের মতো এমন ঘনবিন্যস্ত যে, তাদের ফাঁক দিয়ে আলো-বাতাস আসবার জো নেই। এ-সব খালে ঢুকে আমার দম আটকে আসতে লাগল। চলতি স্টিমারের গুণে একটু-আধটু হাওয়া পাওয়া যাচ্ছিল, তাই রক্ষে। মনে হচ্ছিল স্টিমার থামলেই হাঁপিয়ে মরব। জাহাজের searchlightএর পিচকারি জলপথের এই-সব চোরা অন্ধকারের গায়ে আলো ছিটিয়ে দিচ্ছিল আর বিদ্যুতের মতো চোখ ঝলসে দিচ্ছিল। আমি অন্ধকারের জীব নই, আর বাতাস আমার প্রাণ। এ-সব tunnel থেকে কখন বেরোব জিজ্ঞেস করায়, সারেঙ বললেন, “খানিকক্ষণ পরেই বড়ো নদীতে গিয়ে পড়ব, আর বারদরিয়ার কোল ঘেঁষে যাব। তখন আর হাওয়ার জন্য ভাবতে হবে না। তখন বলবেন, এ হাওয়া থামলেই রক্ষে পাই।”

খালের এই অসহ্য গুমট, উপরন্তু আমার সহযাত্রীদের অফুরন্ত গল্পগুজবে আমি নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলুম; তাই তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্যাবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। তখন রাত প্রায় বারোটা। কিন্তু ঘুম হল না। ঘণ্টা-দুয়েক আধঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে থাকবার পর আমার জনৈক সহযাত্রী এসে বললেন, “ওঠো, বাইরে চলো।” আমি জিজ্ঞেস করলুম, “কেন?” তিনি উত্তর করলেন, “জাহাজ ডুবছে।” আমি বললুম, “আমি বিছানা ছেড়ে উঠছি নে, জাহাজ যদি ডোবে তো ডেকে বসেও ডুবব, আর ক্যাবিনে শুয়েও ডুবব। জাহাজ ডোবা তো আর ভূমিকম্প নয় যে, ঘর ছেড়ে বাইরে গেলে রক্ষে পাব।” আসল কথা, তাঁর কথা আমি বিশ্বাস করি নি।

এ কথা শুনে, তিনি আর কিছু না বলে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট- পাঁচেক পরে আর-একটি ছোকরা এসে অতি গম্ভীর স্বরে আদেশ করলেন, “উঠে বাইরে এসো।” আমি, এঁকেও প্রশ্ন করলুম, “কেন?” তিনি বললেন, “বাইরে এসে নিজেই বুঝতে পারবে কেন।”

আমি জানতুম এ ছোকরাটি বাজে ভয় পাবার ছেলে নয়, রজ্জুতে সর্প ভ্রম করা তার ধাতে নেই। তাই আমি আর কোনো আপত্তি না করে তার সঙ্গে বাইরে এলুম।

বাইরে এসে দেখি, টুকরো টুকরো কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। আর তাদের ফাঁক দিয়ে তারার মিটমিটে আলো আকাশের বুকে ধুক্ ধুক্ করছে। এই ছিটেফোঁটা আলোর মিশ্রণে নৈশপ্রকৃতি একটি করাল মূর্তি ধারণ করেছে। বাঁ পাশে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, আর সেখান থেকে জোর হাওয়া এসে নদীর জলকে ওলটপালট করছে ও জাহাজ বেজায় roll করছে। সারেঙ বলেছিল এ-সব জাহাজের দোষই এই যে, এরা সব মাথাভারী—এরকম জাহাজ ডোবে না, উল্টে পড়ে। আকাশ বাতাস ও জলের অবস্থা দেখে বুঝলুম আমার সহযাত্রীরা কি কারণে ভয় পেয়েছেন। এ ভয় প্রকৃতির শক্তি দেখে ভয় নয়, রূপ দেখে ভয়।

ডেকের সুমুখে এসে দেখি, আমার সহযাত্রী সব সারবন্দী হয়ে বসে আছেন। সকলেরই গা খোলা, আর অনেকের হাতে পৈতে। আমরা অনেকেই ছিলুম জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু সকলের গলায় পৈতে ছিল না। আমাদের দলপতির আদেশে সকলেই গায়ত্রী জপতে বসে গিয়েছেন। আর যে দু-একজনের গায়ত্রীমন্ত্রে জন্মসুলভ অধিকার নেই তাঁরা সব দুর্গানাম জপ করছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হবামাত্রই আমার গায়ের জামা খুলতে হল, আর একশো আটবার গায়ত্রী জপ করবার হুকুম হল। আমি তাই করতে শুরু করলুম। জাপানি বন্ধু দুটি দেখি একটি ছোট্ট টেবিলের সুমুখে দু গেলাস হুইস্কি নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন, আর থেকে থেকেই অম্লানবদনে হুইস্কির সঙ্গে লঙ্কার গুঁড়ো ও মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে নীরবে গলাধঃকরণ করছেন।

সারেঙ বেচারা হতভম্ব হয়ে সুমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জাহাজের বিপদ দেখে, না, যাত্রীদের ভয় দেখে? আর সুখানি একমনে হালের চাকা ঘোরাচ্ছে। আর-একজন খালাসী আমাদের লিডারের হুকুমে ওলন ফেলে বৃথা জল মাপছে ও মধ্যে মধ্যে চিৎকার করে বলছে, “বাম মিলা নেই।”

আকাশের এই অদ্ভুত চেহারা দেখে আমারও মনে সোয়াস্তি ছিল না, তার পর আমার সহযাত্রীদের মুখে ও চোখে ভয়ের চেহারা দেখে আমার সে অসোয়াস্তি ভীষণ ভয়ে পরিণত হল। হৃদয়ের রক্তচলাচল slow হল কি fast হল বলতে পারি নে, কিন্তু তার মামুলি চাল ছিল না। তবে তাঁদের মন্ত্রপাঠ শুনে সেইসঙ্গে হাসিও পাচ্ছিল। পরে শুনেছি আমাদের দলপতি সারেঙ, সুখানি আর খালাসীদেরও নামাজ পড়তে আদেশ করেছিলেন। তাতে তারা রাজি হয় নি, বে-বখত বলে। ভাগ্যিস তারা রাজি হয় নি; যদি হত তা হলে আরবি ও সংস্কৃত মন্ত্রের খিচুড়ি ভগবানের কাছে গ্রাহ্য হত কি না জানি নে, কিন্তু আমার কানে তো সহ্য হত না। আর আমি তা হলে জাপানি বন্ধুদের দলে গিয়ে ভর্তি হতুম ও লঙ্কামরিচসনাথ হুইস্কি পান করতে শুরু করতুম, পৈতে হাতে করে বিলেতি মদকে গায়ত্রীমন্ত্রের সাহায্যে শোধন করে নিয়ে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা মাতলার মোহানা পার হলুম, আর বারদরিয়া অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর আমাদের চোখের সুমুখ থেকে অন্তর্ধান হল। অমনি সকলে বিপদ কেটে গেল বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বিপদ যে কিসের কেটে গেল তা আমি বুঝতে পারলুম না, কারণ, মাথাভারী জাহাজ যদি কচ্ছপের মতো উল্টে পড়ত, তা হলে তা নদীতেই ডিগবাজি খেত, সমুদ্রে নয়। সে যাই হোক, আমাদের দলপতি ডাক্তারবাবুকে কানে কানে কি উপদেশ দিলেন, তিনি অমনি জাহাজের নীচের তলায় চলে গেলেন, আজ মিনিট-পাঁচেক পরে ফিরে এলেন। তখন তাঁর হাতে আর hypodermic syringe নেই; আছে শুধু এক তাড়া নোট। আমাদের দলপতি আমাকে বললেন, “ঐ টাকা-কটি সারেঙকে বকশিস্ দাও।” আমি গুণে দেখি পাঁচখানি দশ টাকার নোট আছে। সারেঙকে বললুম, “হুজুর তোমাকে এই বকশিস্ দিয়েছেন, কারণ, তুমি প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বোটং।”

এ কথা শুনে সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল। শুধু সুখানি বেচারা মুখ হাঁড়ি করে রইল, প্রাণপণ চাকা ঘুরিয়েও বকশিস্ পায় নি বলে। বিপদ আমাদের কিছু ঘটে নি, ঘটলে এ গল্প আমি তোমাদের কাছে বলতে পারতুম না। কারণ গ্রীক পণ্ডিতরা বহুকাল পূর্বে আবিষ্কার করেছেন যে, জলমগ্ন লোক tell no tales। বোধ হয় এই সত্য আবিষ্কার করবার ফলে অ্যারিস্টটেল আদি বৈজ্ঞানিক বলে গণ্য।

তোমরা মনে ভাবতে পার যে, এ গল্প ভয়ানক রসের নয়, হাস্য-রসের। কিন্তু মনে রেখো যে, ভয় কেটে গেলেই মানুষের মুখে হাসি বেরোয়। আর ভয় জিনিসটে অনেক সময় অকারণ ঘটে। আমরা যাকে প্রেম বলি, তা ভয়েরই স্বজাত। আর এই দুই মনোভাবই কেটে গেলে comic হয়ে উঠে। যদি কেউ বলেন এ গল্পের ভিতর গল্প নেই; তা হলে বলি, গল্প না থাক্ তার চাইতে বড়ো জিনিস moral আছে। আর সে moral হচ্ছে, মাঝে মাঝে ভয় পেয়ো, নইলে তোমাদের মনে ধর্মভাব জেগে উঠবে না।

[আশ্বিন] ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *