সীতাপতি রায়

সীতাপতি রায়

আমার জনৈক বন্ধু একমনে আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ছিলেন দুনিয়ার কাজী খবর জানবার জন্যে; এবং মধ্যে মধ্যে আমাকে তা পড়ে শোনাচ্ছিলেন। আমি বললুম, বাংলায় কে কে গ্রেপ্তার হল, তাদের নামগুলো পড়ো তো? তিনি পড়তে শুরু করলেন। হঠাৎ একটা নাম শুনে আমি বললুম, সীতাপতি রায় যে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাতে আমি আশ্চর্য হই নি।

সীতাপতি রায়কে তুমি চেন?

এককালে তাঁকে খুব ভালোই জানতুম, তবে বহুকাল তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই।

তিনি কে?

অজ্ঞাতকুলশী। তাঁর বাড়ি কোথায়, আর তিনি কি জাত, তা জানি নে।

তাঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় হল কোথায়?

গোলদিঘিতে। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন তিনি পটোল বিশ্বাসের সঙ্গে প্রায় রোজই সন্ধ্যাবেলা গোলদিঘিতে বেড়াতে আসতেন।

পটোল বিশ্বাসটি কে?

পাটের দালাল অটল বিশ্বাসের একমাত্র সন্তান। শুনেছি অটল বিশ্বাস মস্ত ধনী। আর সীতাপতি ছিলেন পটোলের friend, phiolosopher and guide। তিনি থাকতেন পটোলদের বাড়িতেই এবং পুলিসকোর্টে ওকালতি করতেন। তিনি ছিলেন পটোলের সহপাঠী। আর শেষটা হয়েছিলেন তার private tutor। পটোল বি. এ. পাস করতে পারে নি, সীতাপতি খুব ভালো পাস করেছিলেন। অটল বিশ্বাসের বাড়িতে লেখাপড়ার চর্চা ছিল না, কিন্তু ছেলে যাতে বি. এ পাস করে সে বিষয়ে তার খুব ঝোঁক ছিল। পটোল বাপকে বললে, “আমি একজনকে জানি, তাঁকে আমার private tutor নিযুক্ত করলে তিনি নিশ্চয় আমাকে বি. এ. পাস করাবেন।” অটল বিশ্বাস ছিলেন যেমন ধনী তেমনি কৃপণ। বাপে-ছেলেয় অনেক বকাবকির পর শেষটা স্থির হল, সীতাপতি রায় পটোলের private tutor হবেন, তাদের বাড়িতে থাকবেন এবং মাসিক ত্রিশ টাকা মাইনে পাবেন।

আমি লক্ষ্য করেছিলুম যে, সীতাপতি অতি সুপুরুষ, ইংরিজি খুব ভালো জানে এবং গাইতে পারে চমৎকার।

পূর্বেই বলেছি সীতাপতি ছিলেন অজ্ঞাতকুলশীল। অনেকে সন্দেহ করত তিনি কোনো হিন্দুস্থানী বাইজির ছেলে। এ সন্দেহের অনেক কারণও ছিল। সীতাপতি নামটি বাঙালির ভিতর অতি দুর্লভ। আর তাঁর চেহারা ছিল কতকটা হিন্দুস্থানী ধরনের; নাক যেমন তোলা, চোখ তেমন বড়ো নয়। আর তিনি গান গাইতেন পেশাদার গায়কদের তুল্য। আর হিন্দি বলতেন মাতৃভাষার মতো। এককালে তাঁর অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল, আর তিনি থাকতেন বড়োবাজারের কোনো গলিতে। হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে পড়লেন।

সে যাই হোক, তিনি ছিলেন অতি বেপরোয়া লোক। আমি প্রথম থেকেই বুঝেছিলুম যে, সামাজিক জীবনের সঙ্গে তিনি খাপ খাওয়াতে পারবেন না। কিন্তু যখন যে অবস্থায় পড়বেন তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন।

অটল বিশ্বাসের পরিবারে সীতাপতি দিব্যি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। এমন কি, স্বয়ং বিশ্বাস মহাশয়ের অতি প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। ইতিমধ্যে এক বিপদ ঘটল। অটল বিশ্বাস ছেলের জন্য একটি মেয়ে দেখতে গিয়ে সেই সুরূপা ও কিঞ্চিৎ শিক্ষিতা মেয়েকে নিজে বিয়ে ক’রে নিয়ে চলে এলেন। তাঁর ছেলে তাতে মহা অসন্তুষ্ট হল। ফলে বাপে-ছেলেতে ছাড়াছাড়ি হবার উপক্রম। পটোল বিশ্বাস নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে চলে যেত, যদি সীতাপতির পরামর্শে সে নীরব থেকে বিমাতাকে ওষুধ গেলার মতো গ্রাহ্য করে না নিত। পটোলের কথা ছিল এই যে, এই বয়সে বাবা আবার চতুর্থ পক্ষ করলেন! তার উত্তরে সীতাপতি বললেন, “এই চতুর্থ পক্ষই সেজন্য তোমার বাবাকে যথেষ্ট শাস্তি দেবে।”

বৃদ্ধের এই তরুণী ভার্যাটি প্রথম থেকেই তার স্বামীকে বললে, “আমি কোনো ঘরকন্নার কাজ করব না। আমি এ বাড়িতে দাসীগিরি করতে আসি নি।

“তবে দিন কাটাবে কি করে?”

“নভেল পড়ে ও গান গেয়ে।”

অটল বিশ্বাস এ জবাব শুনে খুশি হলেন না। কিন্তু তাঁর চতুর্থ পক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে সাহস করলেন না।

মাসখানেক যেতে-না-যেতেই তাঁর চতুর্থ পক্ষ বললে, “আমি ভালো করে লেখাপড়া শিখতে চাই এবং সংগীতবিদ্যা আয়ত্ত করতে চাই। আমার জন্য একটি ইংরেজি শিক্ষক এবং একটি সংগীতশিক্ষক নিযুক্ত করো।”

অটল বিশ্বাস তাঁর ছেলেকে গিয়ে বললেন, “সীতাপতি কি ওঁর ইংরিজি শিক্ষক হতে পারে না? কিন্তু সংগীতশিক্ষক পাই কোত্থেকে?”

পটোল বললে, “মাস্টারমশায় চমৎকার গাইয়ে। তিনি একাই এই দুই শিক্ষা দিতে পারেন। আমি একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।”

তার পরদিন পটোল বললে, “মাস্টারমশায় রাজি আছেন যদি তাঁকে এই নতুন শিক্ষকতার জন্যে মাসে উপরি একশো টাকা ক’রে মাইনে দেওয়া হয়।”

অটল বিশ্বাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তাতেই রাজি হলেন, এবং সীতাপতি তার পরদিন থেকে গৃহিণীরও গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন।

পটোলের বিমাতার নাম ছিল কিশোরী। অল্পদিনের মধ্যেই সে মাস্টার-মশায়ের অনুরক্ত ভক্ত হয়ে পড়ল। আর সীতাপতিরও প্রিয়শিষ্য হয়ে উঠল। গানই তাঁদের পরস্পরকে মুগ্ধ করেছিল। মাসখানেক পরে উভয়ে একসঙ্গে অন্তর্ধান হলেন। লোকে সন্দেহ করে এ পলায়নের সহায় ছিল পটোল বিশ্বাস।

দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের পর সীতাপতি কলকাতায় ফিরে এলেন। এবং পটোল বিশ্বাসের বাড়িতে অধিষ্ঠান হলেন। ইতিমধ্যে অটল বিশ্বাস গত হয়েছিলেন, আর পটোল পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিল এবং বিয়েও করেছিল। তার পৈতৃক ছোটোবাড়ির পাশে পটোল একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল আর বাপের দালালি ব্যবসা ভালোরকমই চালাতে শিখেছিল।

সীতাপতির ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি নিজেই আমাকে বললেন। সেই কথাই এখন তোমাকে বলছি।

সীতাপতি ও কিশোরী প্রথমে পশ্চিমের একটি নামজাদা শহরে গিয়ে বছর দু-তিন বাস করেন। সেখানে নাকি একটি প্রসিদ্ধ ওস্তাদ ছিলেন, তাঁরই কাছে কিশোরীকে আরো ভালো করে গান শেখাবার জন্য। সে শহরে তাঁরা গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন। সীতাপতি নিজে সেখানে একটি মিশনারি ইস্কুলে ইংরিজি পড়াবার চাকরি নেন; এবং বছরখানেকের মধ্যেই সেই ইস্কুলের হেডমাস্টার হন।

সীতাপতি অবশ্য পশ্চিমে গিয়ে নাম বদলে নিয়েছিলেন। সে দেশে তাঁর নাম হল রামচন্দ্র রাও। এবং বেশও হল হিন্দুস্থানীদের বেশ। কিশোরী হয়ে উঠল অপূর্ব ঠুংরি গাইয়ে। তার গলা ছিল যেমন মিষ্টি, তেমনি স্থিতিস্থাপক।

সীতাপতি মিশনারি সাহেবের উপর চটে গিয়েছিলেন। কারণ, সাহেব কালা আদমীদের বিশেষ অবজ্ঞার চক্ষে দেখতেন। তিনি I. C. S. হলে দুর্দান্ত হাকিম হতেন।

তার উপর সীতাপতি শুনলেন যে, রামচন্দ্র রাওয়ের সঙ্গে যে স্ত্রীলোকটি থাকে সেটি তাঁর স্ত্রী কি না মিশনারি সাহেব সে খোঁজ করছেন। সন্দেহের কারণ, কিশোরী বাই পেশাদার বাইজির মতো গান করেন।

এই-সব কারণে তিনি ইস্কুলের চাকরি ত্যাগ করতে মনস্থ করলেন। এমন সময় পটোলের কাছ থেকে এক চিঠি পেলেন যে, অটল বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে। পটোল একমাত্র লোক, যে সীতাপতির নতুন নাম-ঠিকানা জানত।

এ সংবাদ শুনে কিশোরী বললে যে, সে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে বৃন্দাবনে যাবে। তার মজলিশী গান শেখা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন সে বৃন্দাবনে গিয়ে কীর্তন শিখবে। আসল কথা, সে অসামাজিক জীবন আর যাপন করবে না। এবং সেই জীবন অবলম্বন করবে, যাতে তার পূর্বজীবনের কালিমা ভক্তিরসে ধুয়ে মুছে যায়।

সীতাপতি কিশোরীকে কোনো বাধা দিলেন না। যদিচ কোনো ধর্মে তাঁর বিন্দুমাত্রও ভক্তি ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইস্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিলেন।

এর পর তাঁর জীবনের নতুন পর্যায় আরম্ভ হয়। যদিচ সীতাপতি কিশোরীকে কখনো ভুলতে পারেন নি; এবং কিশোরীও সীতাপতিকে কখনো ভুলতে পারে নি ।

সীতাপতি কিশোরীর কথাবার্তায় বুঝেছিলেন যে, তার নূতন সংকল্প থেকে তাকে নিরস্ত করা অসম্ভব। অটল বিশ্বাসের মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত কিশোরী সীতাপতির অনুরক্ত ভক্ত ছিল। যার সে কস্মিনকালেও স্ত্রী ছিল না, তার মৃত্যুতে কিশোরীর মন যে কি করে এমন বিপর্যস্ত হয়ে গেল তা সীতাপতিও বুঝতে পারলেন না। যে-সব মনস্তত্ত্ববিৎত্রা মগ্নচৈতন্যের খোঁজখবর রাখেন তাঁরা হয়তো বলবেন যে, নানারূপ সামাজিক অন্ধসংস্কার, যা কিশোরীর মনে প্রচ্ছন্নভাবে ছিল, এই মৃত্যুসংবাদের ধাক্কায় সে-সব জেগে উঠল। হিন্দু সধবার আচার সে অনায়াসে অগ্রাহ্য করেছিল, কিন্তু হিন্দু বিধবার আচার অবলম্বন করতে তার মন তাকে বাধ্য করলে। যাই হোক, আমার কাছে ব্যাপারটা একটা mystery থেকে গেল।

সীতাপতি কিশোরীকে বৃন্দাবন নিয়ে গিয়ে গৌরদাস বাবাজির কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করে দিলেন। এবং তাঁকে বললেন, “এ মেয়েটি চমৎকার গাইয়ে, একে যেন কীর্তন শেখবার সুযোগ দেওয়া হয়।”

বাবাজি বললেন, “তার জন্য ভাবনা কি? এখানে উঁচুদরের কীর্তনওয়ালী আছে যারা প্রথম জীবনে কীর্তন গেয়ে বাঙালিকে মুগ্ধ করেছিল। আমি এঁকে সেইরকম একজনের হাতে সমর্পণ করে দেব।”

সীতাপতি চলে আসবার পূর্বে কিশোরী তাঁকে বললে, “এর পর তুমি কোথায় থাকবে, তার ঠিকানা আমাকে দিয়ে যেয়ো।”

সীতাপতি বললেন, “সেটা অনিশ্চিত। তুমি পটোল বিশ্বাসকে লিখলেই আমার ঠিকানা জানতে পবে। সে চিরদিনই আমার অত্যন্ত অনুগত বন্ধু। আমি যখন যেখানে থাকি, তাকে জানাই।”

কিশোরী বললে, “ভয় নেই, আমি তোমাকে চিঠি লিখে উৎপাত করব না। যদি কখনো মরণাপন্ন পীড়িত হই, তবেই তোমাকে আসতে লিখব। মৃত্যুর পূর্বে তোমাকে একবার শুধু দেখতে চাই।”—এই কথা বলে তাঁর চোখ জলে ভরে উঠল।

তখন সীতাপতি বুঝলেন যে, তাঁর প্রতি কিশোরীর ভক্তি হচ্ছে শাস্ত্রে যাকে বলে পরাপ্রীতি যা অহৈতুকী এবং আমরণস্থায়ী।

সীতাপতি বললেন, “আমি প্রথমে কাশী যাব। এক তীর্থে তোমাকে বিসর্জন দিলুম, আর-এক তীর্থে মাকে বিসর্জন দিয়েছিলুম। এ দুজনের স্মৃতি আমার জীবন পূর্ণ করে থাকবে।”

এর পর তিনি কাশী চলে গেলেন।

সীতাপতির প্রকৃতি অত্যন্ত অসামাজিক, তা পূর্বেই বলেছি; কিন্তু তিনি ছিলেন অতিশয় সহৃদয়। এবং কিশোরী ও তাঁর নিজের মা, এই দুটি স্ত্রীলোক তাঁর হৃদয়ে শিকড় গেড়েছিল।

সীতাপতি যখন কাশী গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর কাছে টাকাকড়ি কিছু ছিল না বললেই হয়। কিশোরীর গহনাবিক্রির টাকা সে তাঁকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সীতাপতি কিছুতেই সে দান গ্রহণে সম্মত হন নি। তিনি বলেছিলেন, “অটল বিশ্বাসের স্ত্রীকে হস্তান্তর করতে পারি, কিন্তু তাঁর টাকা-পয়সা নয়। সে টাকা আমি পটোল বিশ্বাসকে দেব। তোমার যদি কখনো টাকার দরকার হয়, পটোলকে টেলিগ্রাফ করলে সে তোমাকে তা পাঠিয়ে দেবে।”

কাশী সীতাপতির পূর্বপরিচিত স্থান। সেখানে বহুলোকের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল, গাইয়ে-বাজিয়ে পুরুত-পাণ্ডা প্রভৃতি। তিনি একটি পরিচিত পাণ্ডার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। এবং নূতন কোনো চাকরিতে ভর্তি হবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এইভাবে মাসখানেক কেটে গেল। অবসর সময়ে সীতাপতি একমনে শ্ৰীমদ্‌ভাগবত অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন; বৈষ্ণবধর্ম ব্যাপারটা কি তাই জানবার জন্যে। পটোল বিশ্বাসকে তিনি অবশ্য তাঁর নতুন ঠিকানা জানিয়েছিলেন। পটোল গয়াতে তার বাবার পিণ্ডদান করে কাশীতে এসে উপস্থিত হল। সীতাপতি পটোলকে কিশোরীর সব টাকা বুঝিয়ে দিলেন। এবং এখন যে তিনি নিঃস্ব, তাও জানালেন। কিন্তু পটোলের কাছ থেকে কোনো অর্থসাহায্য নিতে রাজি হলেন না।

তার পর তিনি কাশীবাসী কোনো ধনী কায়স্থ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে পটোলের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করলেন। উক্ত পরিবারের কি একটা কলঙ্ক ছিল, যার জন্য তাঁরা দেশত্যাগী হয়ে কাশীবাস করছিলেন। ফলে সে ঘরের মেয়ের বিয়ে দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পটোল ছিল সীতাপতির শিষ্য। সে বিনা আপত্তিতে তার মাস্টারমশায়ের প্রস্তাবে সম্মত হল, বিশেষত মেয়েটি সুন্দরী ও শিক্ষিতা বলে। উপরন্তু অটলরা যে কি জাত, তা কেউ জানত না।

বিবাহের ৩/৪ দিন পরে পটোল তাঁর মাস্টারমশায়কে বললে, “যদি চাও তো তোমাকে ১০০/১৫০ টাকা মাইনের একটি চাকরি করে দিতে পারি। এখানকার পুলিসের এক সাহেবের সঙ্গে আমাদের খুব বাধ্যবাধকতা আছে। তিনি জাতে ফিরিঙ্গি, কিন্তু চলেন পুরোদস্তুর ইংরেজের কায়দায়। তাঁর মাইনে খুব বেশি নয়, কিন্তু টাকার দরকার বেশি। সে টাকা তাঁকে যে-কোনো উপায়ে হোক সংগ্রহ করতে হয়। একবার তিনি পাঁচ হাজার টাকার জন্যে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সে টাকা বাবা তাঁকে ধার দেন; কারণ বাবাও সে সময় একটি ফৌজদারী মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই পাঁচ হাজার টাকায় পুলিস সাহেব বেঁচে গেলেন, বাবাকেও বাঁচিয়ে দিলেন। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করবেন। তুমি পুলিসের চাকরি করতে রাজি?”

“হ্যাঁ, রাজি। এ চাকরিতে আমি নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করব।”

“কি অভিজ্ঞতা অর্জন করবে? পুলিসের কারবার তো শুধু চোর আর জুয়োচ্চোর নিয়ে।”

“তাতে আপত্তি কি? সব ব্যবসারই তো ভিতরকার কথা ঐ চুরি আর জুয়োচ্চুরি। পৃথিবীতে যতদিন দরিদ্র আর ধনী থাকবে, ততদিন আইন-কানুন সবই থাকবে। এবং আইন-কানুনের রক্ষক পুলিসও থাকবে। সমাজ তো দরিদ্রকে দরিদ্রই রাখতে চায়, আর ধনীকে ধনী। এই দুয়ের পার্থক্য বজায় রাখাই তো সকল আইন-কানুনের উদ্দেশ্য।”

“কেন, লোকের সম্পত্তি রক্ষা করা ছাড়া কি আইনের আর- কোনো উদ্দেশ্য নেই?”

“তা ছাড়া আর কি আছে?”

“কাঞ্চনের সঙ্গে কামিনীকেও রক্ষা করা আইনের অন্যতম বিধি। যা অমান্য করবার নাম offences against marriage।”

“সে ক্ষেত্রে স্ত্রীকেও property হিসেবে গণ্য করা হয়।”

“তা হলে offences against marriage বলে কিছু নেই?”

“অবশ্য আছে। যথা ধনী বৃদ্ধের পক্ষে তরুণী চতুর্থ পক্ষ করা।”

এ কথা শোনবার পর পটোল সীতাপতিকে সেই পুলিসের চাকরি করিয়ে দিলে।

সীতাপতি অল্পদিনেই বাড়োসাহেবের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। রিপোর্ট লেখা এবং তদন্ত করাই ছিল তাঁর কাজ। তাঁর লিখিত রিপোর্টের গুণে বড়োসাহেবের মাইনে বেড়ে গেল। তাঁর তদন্তের বিষয় ছিল পশ্চিম অঞ্চলের সব দেশে ছোকরাদের খুঁজে বার করা। তিনি অবশ্য সকলেরই খোঁজ পেয়েছিলেন, কিন্তু কাউকেই ধরিয়ে দেন নি। হয়তো অনেকের সম্বন্ধে সন্দেহের কারণ আছে, কিন্তু স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি অর্থলোভী ছিলেন না। সুতরাং অবৈধ উপায়ে টাকা সংগ্রহ করতেন না। কিন্তু তাঁরও মাইনে বেড়েই চলল। ফলে বড়োসাহেবের তিনি প্রিয়পাত্রই রয়ে গেলেন কিন্তু নিম্ন পুলিস কর্মচারীদের অত্যন্ত বিরাগভাজন হলেন। তাঁকে কি করে জব্দ করা যায়, তারা তার উপায় খুঁজতে লাগল।

বছর-তিনেক পুলিসের চাকরি করবার পর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা তাঁকে একদিন গ্রেপ্তার করলে। রামচন্দ্র রাও বলে একটি ঘোর anarchist নাকি ফেরার হয়েছিল। কোথায়ও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। গোয়েন্দা বিভাগ আবিষ্কার করলে যে, সীতাপতি রায়ই সেই রামচন্দ্র রাও। আর সে পুলিসের চাকরি নিয়েছে নিজের দলবলকে যতদূর সাধ্য সতর্ক করবার জন্যে।

রামচন্দ্র রাওই সে সীতাপতি রায় সেজেছেন, তা প্রমাণ করলেন সেই মিশনারী ইস্কুলের সাহেব। আর তিনি সেইসঙ্গে বললেন, “রামচন্দ্র ওরফে সীতাপতি রায় ইংরেজি খুব ভালো লেখেন এবং বাংলা ও হিন্দি এমন চমৎকার বলেন যে, তিনি বাঙালি কি হিন্দুস্থানী বোঝা অসম্ভব।”

তাঁর গ্রেপ্তারে আপত্তি করলেন শুধু কাশীর পুলিসের সাহেব। কারণ সীতাপতিকে জেলে দিলে তাঁর ডান হাত কাটা যায়। সে যাই হোক, তিনি হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে আটক থাকলেন, এক-আধ মাসের জন্য নয়, তিন বৎসরের জন্য।

এ তিন বৎসর তাঁর বিষয় তদন্ত চলতে লাগল। সরকারের লাল ফিতে ভয়ংকর দীর্ঘসূত্র।

সীতাপতির মুরুব্বি পুলিস সাহেব জেলে তাঁর থাকবার ভালো বন্দোবস্ত করেছিলেন। তিনি হকিম মেহেরালির সঙ্গে এক কামরায় আটক রইলেন। সেখানে অন্য কোনো আসামী ছিল না। ফলে দুজনের ঘোর বন্ধুত্ব হল। হকিমসাহেব বললেন, তিনি নির্দোষী, তাঁকে ভুল করে গ্রেপ্তার করেছে। সীতাপতি বললেন, তিনিও নির্দোষী, এবং তাঁকেও ভুল করে ধরেছে। তাঁরা দোষী কি না, তারই তদন্ত হচ্ছে। আর যতদিন সে তদন্ত শেষ না হয় ততদিন তাঁরা এখানে আটক থাকবেন। সে তিন মাসও হতে পারে, তিন বৎসরও হতে পারে।

হকিম সাহেব বললেন, “এই জেলে কাজ নেই, কর্ম নেই, এতদিন বসে বসে কি করা যায়?”

“আপনি নামাজ পড়ুন, আর আমি গায়ত্রী জপি।”

“নামাজ তো পাঁচ বখ্ত করতে হয়।”

“আর গায়ত্রী ত্রিসন্ধ্যা জপতে হয়।”

বাদ বাকি সময় নিয়ে কি করা যায়, সেই হল সমস্যা। শেষটা অনেক তর্কবিতর্কের পর স্থির হল, সতীপতি হকিমসাহেবর কাছে হকিমিবিদ্যা শিখবেন, আর হকি সাহেবকে কবিরাজীর টোটকা শাস্ত্র শেখাবেন।

তিন বৎসর কাল পরস্পরের এই অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় কেটে গেল, তার পর তাঁরা মুক্তি পেলেন। হকিমসাহেব চলে গেলেন মক্কায়, আর সীতাপতি কাশীতে। কিছুদিন পরে তিনি ত্রিহুতে গেলেন ডাক্তারি করতে। সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে হকিমি ব্যবসা সে দেশে চলবে না। কারণ মুসলমানরা হিন্দুর হাতে ওষুধ খাবে না, আর হিন্দুরা আমালতোষ জামালগোটা ফিখিস প্রভৃতি ওষুধের ম্লেচ্ছনাম শুনেই ভড়কে যায়। তা খেলে নাকি তাদের জাত যাবে। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা তিনি শেখেন নি; কিন্তু এটুকু জানতেন যে, অ্যালোপ্যাথির অস্ত্রোপচারই প্রধান অঙ্গ, আর তার ওষুধ-মাত্রা ভুল হলে মারাত্মক হতে পারে। তিনি জেলে বসে বসে ইংরিজি বাংলা হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসার বই পড়েছিলেন। তার থেকে তাঁর ধারণা জন্মেছিল যে, হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসা নির্ভয়ে করা যায়। ও চিকিৎসায় উপকার থাক্ বা না থাক্, অপকার নেই। হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার চিকিৎসক না হতে পারেন, কিন্তু জল্লাদ নন। তাই তিনি হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তারের ব্যবসা ধরলেন। আর ক্রমে দেদার পয়সা রোজকার করতে লাগলেন।

তারপর সীতাপতি কলকাতায় এসে একজন নামজাদা হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসক হয়ে উঠলেন। তিনি আস্তানা গেড়েছিলেন পটোল বিশ্বাসের পৈতৃক ছোটো বাড়িতে। সেইখানেই তাঁর সঙ্গে আমার মধ্যে মধ্যে দেখা হত। এবং অজ্ঞাতবাসের ইতিহাস সেইখানেই তাঁর মুখে শুনি। দেখলুম, তাঁর চেহারা সমানই আছে; আর তিনি আগের চাইতে ঢের বেশি চালাক-চতুর হয়েছেন। উপরন্তু শ্রীমদ্‌ভাগবত পড়ে পড়ে সংস্কৃত ভাষা খুব ভালো শিখেছেন। কিশোরীকে সীতাপতি একদিনের জন্যেও ভুলতে পারেন নি। তাই কিশোরী যে ধর্ম অবলম্বন করেছিল, সে ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ অধ্যয়ন করা তাঁর নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছিল। তিনি মতামতে আরো বেশি অসামাজিক হয়ে পড়েছিলেন।

একদিন সীতাপতির ডাক্তারখানায় গিয়ে শুনি যে, পটোল বিশ্বাসের কোনো আত্মীয়া ভারী ব্যারামে পড়েছেন। এবং পটোল বিশ্বাস ডাক্তার-বাবুকে সঙ্গে নিয়ে কাশী চলে গেছেন। আর বলে গেছেন দিন-সাতেকের মধ্যে তাঁরা ফিরে আসবেন। তিনি কোথায় এবং কাকে দেখতে গেছেন, সে বিষয় আমার সন্দেহ ছিল। সাত দিন পর আবার গিয়ে শুনলুম পটোল ফিরে এসেছে, কিন্তু ডাক্তারবাবু ফেরেন নি। আমি পটোলের সঙ্গে দেখা করে জানলুম যে, পটোল ও ডাক্তারবাবু বৃন্দাবন গিয়েছিলেন মরণাপন্ন কিশোরীকে দেখতে। কিশোরী একটি অসাধ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু তার মনের কোনো বিকার ঘটে নি। তাঁদের দুজনের কি কথাবার্তা হল তা পটোল শোনে নি, জানেও না। সেই দিনই সীতাপতি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হলেন। তারপর দিন কিশোরী মারা গেল। কিশোরীর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তিনি তাকে বললেন, “আমি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছি।” কিশোরী শেষ কথা বললে, “তুমি শ্রীকৃষ্ণের অবতার।”

তারপর সীতাপতি বৈরাগী হয়ে কোথায় যে চলে গেলেন, তা আমি জানি নে। কিন্তু খবরের কাগজে যার নাম পড়লে, সে নিশ্চিত এই সীতাপতি রায়।

বন্ধুবর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “এরকম লক্ষ্মীছাড়া ভবঘুরে লোকের জেলে থাকাই কর্তব্য।”

“তোমার এ শুভকামনা শুনলে সীতাপতি বলতেন সে কথা ঠিক। আমরা সকলে বর্তমান সভ্যতার বিরাট জেলের মধ্যেই বাস করছি।”

“তার অর্থ কি?”

“সে বিষয় কি আজও তোমার চোখ খোলে নি? বর্তমান সভ্যতার চরম রূপ কি দেখতে পাচ্ছ না? সীতাপতি এই বড়ো জেল থেকে মুক্তির উপায় চিরদিনই খুঁজেছেন। সে মুক্তি হচ্ছে মনের মুক্তি।”

“তিনি কি সে মুক্তির সন্ধান পেয়েছেন?”

“পান আর না পান, আজীবন খুঁজেছেন।”

“বোধ হয় সেকেলে ধর্মে পেয়েছেন?”

“একেলে অধর্মে তো নয়ই।”

পৌষ ১৩৪৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *