মন্ত্রশক্তি
মন্ত্রশক্তিতে তোমরা বিশ্বাস কর না, কারণ আজকাল কেউ করে না, কিন্তু আমি করি। এ বিশ্বাস আমার জন্মেছে, শাস্ত্র পড়ে নয়— মন্ত্রের শক্তি চোখে দেখে।
চোখে কি দেখেছি, বলছি।
দাঁড়িয়ে ছিলুম চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দায়। জন দশ-বারো লেঠেল জমায়েত হয়েছিল পুব দিকে, ভোগের দালানের ভগ্নাবশেষের সুমুখে। পশ্চিমে শিবের মন্দির, যার পাশে বেলগাছে একটি ব্রহ্মদৈত্য বাস করতেন, যাঁর সাক্ষাৎ বাড়ির দাসী-চাকরানীরা কখনো কখনো রাত-দুপুরে পেতেন— ধোঁয়ার মতো যাঁর ধড় আর কুয়াশার মতো যাঁর জটা। আর দক্ষিণে পুজোর আঙিনা— যে আঙিনায় লক্ষ বলি হয়েছিল বলে একটি কবন্ধ জন্মেছিল। এঁকে কেউ দেখেন নি, কিন্তু সকলেই ভয় করতেন।
লেঠেলদের খেলা দেখবার জন্য লোক জুটেছিল কম নয়। মনিরুদ্দি সর্দার, তার সৈন্য-সামন্ত কে কোথায় দাঁড়াবে, তারই ব্যবস্থা করছিল। কী চেহারা তার! গৌরবর্ণ, মাথায় ছ ফুটের উপর লম্বা, পাকা দাড়ি, গোঁফ-ছাঁটা। সে ছিল ওদিকের সব- সেরা লক্ড়িওয়ালা।
এমন সময় নায়েববাবু আমাকে কানে কানে বললেন, “ঈশ্বর পাটনীকে এক-হাত খেলা দেখাতে হুকুম করুন-না। ঈশ্বর লেঠেল নয়, কিন্তু শুনেছি কি লাঠি, কি লক্ড়ি, কি সড়কি— ও হাতে নিলে কোনো ঠেলেই ওর সুমুখে দাঁড়াতে পারে না। আপনি হুকুম করলে ও না বলতে পারবে না, কারণ ও আপনাদের বিশেষ অনুগত প্ৰজা।”
এর পর নায়েববাবু ঈশ্বরকে ডাকলেন। ভিড়ের ভিতর থেকে একটি লম্বা ছিপছিপে লোক বেরিয়ে এল। তার শরীরে আছে শুধু হাড় আর মাংস—চর্বি এক বিন্দুও নেই। রঙ তার কালো, অথচ দেখতে সুপুরুষ।
আমি তাকে বললুম, “আজ তোমাকে এক-হাত খেলা দেখাতে হবে।”
লোকটা অতি ধীরভাবে উত্তর করলে, “হুজুর, লেঠেলি আমার জাত-ব্যবসা নয়। বাপ-ঠাকুরদার মতো আমিও খেয়ার নৌকো পারাপার করেই দু পয়সা কামাই। আমার কাজ লাঠি খেলা নয়, লগি ঠেলা। তাই বলছি হুজুর, এ আদেশ আমাকে করবেন না।”
আমি জিজ্ঞেস করলুম, “তা হলে তুমি লাঠি খেলতে জান না?”
২
সে উত্তর করলে, “হুজুর, জানতুম ছোকরা বয়েসে, তার পর আজ বিশ-পঁচিশ বছর লাঠিও ধরি নি, লক্ড়িও ধরি নি, সড়কিও ধরি নি; তা ছাড়া আর-একটা কথা আছে। এদের কাছে আমি ঠাকুরের সুমুখে দিব্যি করেছি যে আমি আর লাঠি-সড়কি ছোঁব না। সে কথা ভাঙি কি করে? হুজুরের হুকুম হলে আমি না বলতে পারি নে; কিন্তু হুজুর যদি আমার কথাটা শোনেন, তবে হুজুর আমাকে আর এ আদেশ করবেন না।”
আমি জিজ্ঞেস করলুম, “কেন এরকম দিব্যি করেছিলে?”
ঈশ্বর বললে, “ছেলেবেলায় এরা সব খেলা শিখত। আমিও খেলার লোভে এদের দলে জুটে গিয়েছিলুম। আমার বয়েস যখন বছর কুড়িক, তখন কি লাঠি, কি লক্ড়ি, কি সড়কিতে আমিই হয়ে উঠলুম সকলের সেরা। এরা ভাবলে যে আমি কোনো মন্তর-তন্ত র শিখেছি—তারই গুণে আমি সকলকে হঠিয়ে দিই। হুজুর, মন্তর-তন্তর কিছুই জানি নে; তবে আমার যা ছিল তা এদের কারো ছিল না। সে জিনিস হচ্ছে চোখ। আমি অন্যের চোখের ঘোরাফেরা দেখেই বুঝতুম যে তার হাতের লাঠি-সড়কির মার কোন্ দিক থেকে আসবে। কিন্তু আমার চোখ দেখে এরা কিছুই বুঝতে পারত না, আর শুধু মার খেত। শেষটায় এরা সকলে মিলে যুক্তি করলে যে আমাকে কালীবাড়ি নিয়ে গিয়ে হাড়কাঠে ফেলে বলি দেবে।
“তার পর একদিন এরা রাতদুপুরে আমার বাড়ি চড়াও হয়ে আমাকে বিছানা থেকে তুলে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে, কালীবাড়ি নিয়ে গিয়ে হাড়কাঠে ফেলে আমাকে বলি দেবার উদ্যোগ করলে। খাঁড়া ছিল ঐ গুলিখোর মিছু সর্দারের হাতে। আমি প্রাণভয়ে অনেক কান্নাকাটি করবার পর এরা বললে, ‘তুমি ঠাকুরের সুমুখে দিব্যি করো যে আর কখনো লাঠি ছোঁবে না, তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেব।’ হুজুর, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে এই দিব্যি করেছি; আর তার পর থেকে একদিনও লাঠি-সড়কি ছুঁই নি। কথা সত্যি কি মিথ্যে—ঐ গুলিখোর মিছুকে জিজ্ঞেস করলেই টের পাবেন।”
৩
মিছু আমাদের বাড়ির লেঠেলের সর্দার।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, “ঈশ্বরের কথা সত্যি না মিথ্যে?”
সে ‘হাঁ’ ‘না’ কিছুই উত্তর করলে না।
ঈশ্বর এর পর বলে উঠল, “হুজুর, আমি মিথ্যে কথা জীবনে বলি নি—আর, কখনো বলবও না।”
তার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, “মিছু যদি গুলিখোর হয় তো এমন পাকা লেঠেল হল কি করে? “
ঈশ্বর বললে, “হুজুর, নেশায় শরীরের শক্তি যায়, কিন্তু গুরুর কাছে শেখা বিদ্যে তো যায় না। বিদ্যে হচ্ছে আসল শক্তি। সেদিন দেখলেন না, ঠাকুরদাস কামার অত বড়ো মোষটার মাথা এক কোপে বেমালুম কাটলে; আর ঠাকুরদাস দিনে-দুপুরে গুলি খায়। আমি নেশা করি নে বটে, কিন্তু বয়সে আমার শরীরের জোর এখন কমে এসেছে— যেমন সকলেরই হয়। যদি এরা অনুমতি দেয় তা হলে দেখতে পাবেন যে বুড়ো হাড়েও বিদ্যে সমান আছে।”
এর পর আমি লেঠেলদের জিজ্ঞেস করলুম তারা ঈশ্বরকে খেলবার অনুমতি দেবে কি না। তারা পরস্পর পরামর্শ করে বললে, “আমরা ওকে হুজুরের কথায় আজকের দিনের মতো অনুমতি দিচ্ছি। দেখা যাক, ও কি ছেলেখেলা করে।”
লেঠেলদের অনুমতি পাবার পর, ঈশ্বর কোমরের কাপড় তুলে বুকে বাঁধলে, আর তার ঝাঁকড়া চুল একমুঠো ধুলো দিয়ে ঘষে ফুলিয়ে তুললে; তার পর মাটিতে জোড়াসন হয়ে বসে পাঁচ মিনিট ধরে বিড় বিড় করে কি বকতে লাগল। অমনি লেঠেলরা সব চীৎকার করে উঠল, “দেখছেন, বেটা মন্তর আওড়াচ্ছে, আমাদের নজরবন্দী করবার জন্যে।” ঈশ্বর এ-সব চেঁচামেচিতে কর্ণপাতও করলে না। তার পর যখন সে উঠে দাঁড়ালে, তখন দেখি সে আলাদা মানুষ। তার চোখে আগুন জ্বলছে, আর শরীরটে হয়েছে ইস্পাতের মতো।
৪
ঈশ্বর বললে, “প্রথম এক-হাত লক্ড়ি নিয়েই ছেলেখেলা করা যাক। এদের ভিতর কে বাপের বেটা আছে, লক্ড়ি ধরুক।”
মনিরুদ্দি সর্দার বললে, “আমার ছেলে কামালের সঙ্গেই এক-হাত খেলে, তাকে যদি হারাতে পার তা হলে আমি তোমাকে লক্ড়ি খেলা কাকে বলে তা দেখাব।” তার পরে একটি বছর-কুড়িকের ছোকরা এগিয়ে এল। সে তার বাপের মতোই সুপুরুষ, গৌরবর্ণ ও দীর্ঘাকৃতি বাঁ হাতে তার ছোট্ট একটি বেতের ঢাল, আর ডান হাতে পাকা বাঁশের লাল টুকটুকে একখানি লড়ি। খেলা শুরু হল। এক মিনিটের মধ্যেই দেখি—কামালের লক্ড়ি ঈশ্বরের বাঁ হাতে, আর কামাল নিরস্ত্র হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তখন ঈশ্বর বললে, “যে লড়ি হাতে ধরে রাখতে পারে না, সে আবার খেলবে কি?” এ কথা শুনে মনিরুদ্দি রেগে আগুন হয়ে লক্ড়ি-হাতে এগিয়ে এল। ঈশ্বর বললে, “তোমার হাতের লড়ি কেড়ে নেব না, কিন্তু তোমার গায়ে আমার লড়ির দাগ বসিয়ে দেব।”
এর পরে পাঁচ মিনিট ধরে দুজনের লক্ড়ি বিদ্যুৎবেগে চলাফেরা করতে লাগল। শেষটায় মনিরুদ্দির লক্ড়ি উড়ে শিবের মন্দিরের গায়ে গিয়ে পড়ল; আর দেখি, মনিরুদ্দির সর্বাঙ্গে লাল লাল দাগ, যেন কেউ সিঁদুর দিয়ে তার গায়ে ডোরা কেটে দিয়েছে।
মনিরুদ্দি মার খেয়েছে দেখে হেদাউল্লা লাফিয়ে উঠে বললে, “ধর্ বেটা সড়কি।” ঈশ্বর বললে, “ধরছি। কিন্তু সড়কি যেন আমার পেটে বসিয়ে দিয়ো না। জানি তুমি খুনে। কিন্তু এ তো কাজিয়া নয়—আপসে খেলা। আর এই কথা মনে রেখো, রক্ত যেমন আমার গায়ে আছে, তোমার গায়েও আছে।”
এর পর সড়কি খেলা শুরু হল। সড়কির সাপের জিভের মতো ছোটো ছোটো ইস্পাতের ফলাগুলো অতি ধীরে ধীরে একবার এগোয়, আবার পিছোয়। এ খেলা দেখতে গা কিরকম করে, কারণ সড়কির ফলা তো সাপের জিভ নয়, দাঁত। সে যাই হোক, হেদাউল্লা হঠাৎ ‘বাপ রে’ বলে চিৎকার করে উঠল।
৫
তখন তাকিয়ে দেখি তার কব্জি থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে, আর তার সড়কিখানি রয়েছে মাটিতে পড়ে।
ঈশ্বর বললে, “হুজুর, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ওর কব্জি জখম করেছি, নইলে ও আমার পেটের নাড়ীভুঁড়ি বার করে দিত। আমি যদি সড়কি ওর হাত থেকে খসিয়ে না দিতুম, তা হলে তা আমার পেটে ঠিক ঢুকে যেত। এ খেলার আইন-কানুন ও বেটা মানে না। ও চায়-হয় জখম করতে, নয় খুন করতে।”
হেদাউল্লার রক্ত দেখে লেঠেলদের মাথায় খুন চড়ে গেল, আর সমস্বরে ‘মার বেটাকে’ বলে চীৎকার করে তারা বড়ো বড়ো লাঠি নিয়ে ঈশ্বরকে আক্রমণ করলে। ঈশ্বর একখানা বড়ো লাঠি দু হাতে ধরে আত্মরক্ষা করতে লাগল। তখন আমি ও নায়েববাবু দুজনে গিয়ে লেঠেলদের থামাতে চেষ্টা করতে লাগলুম। হুজুরের হুকুমে তারা সব তাদের রাগ সামলে নিলে। তা ছাড়া লাঠির ঘায়ে অনেকেই কাবু হয়েছিল কারো মাথাও ফেটে গিয়েছিল। শুধু ঈশ্বর এদের মধ্যে থেকে অক্ষত শরীরে বেরিয়ে এসে আমাকে বললে, “আমি শুধু এদের মার ঠেকিয়েছি, কাউকেও এক ঘা মারি নি ওদের গায়ে মাথায় যে দাগ দেখছেন— সে-সব ওদেরই লাঠির দাগ। এলোমেলো লাঠি চালাতে গিয়ে এর লাঠি ওর মাথায় গিয়ে পড়েছে, ওরা লাঠি এর মাথায়। আমি যে এদের লাঠিবৃষ্টির মধ্যে থেকে মাথা বাঁচিয়ে এসেছি, সে শুধু হুজুরের— ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে।”
মিছু সর্দার বললে, “হুজুর, আগেই বলেছিলুম ও বেটা জাদু জানে। এখন তো দেখলেন যে আমাদের কথা ঠিক। মন্তরের সঙ্গে কে লড়তে পারবে?”
ঈশ্বর হাত জোড় করে বললে, “হুজুর, আমি মন্তর-তন্তর কিছুই জানি নে। তবে সড়কি-লাঠি ধরবামাত্র আমার শরীরে কি যেন ভর করে। শক্তি আমার কিছুই নেই; যিনি আমার উপর ভর করেন, সব শক্তি তাঁরই।”
আমি বুঝলুম লেঠেলদের কথা ঠিক। ঈশ্বরের গায়ে যিনি ভর করেন তাঁরই নাম মন্ত্রশক্তি অর্থাৎ দেবতা। শুধু লাঠি খেলাতে নয়, পৃথিবীর সব খেলাতেই—যথা সাহিত্যের খেলাতে, পলিটিক্সের খেলাতে তিনিই দিগ্বিজয়ী হন যাঁর শরীরে এই দৈবশক্তি ভর করে। এ শক্তি যে কি, যাঁদের শরীরে তা নেই, তাঁরা জানেন না। আর যাঁদের শরীরে আছে, তাঁরাও জানেন না।
আশ্বিন ১৩৪১