ঝাঁপান খেলা

ঝাঁপান খেলা

এ গল্প আমার একটি বন্ধুর মুখে শোনা।

বন্ধুবর আসলে ছিলেন মুন্সেফ, কিন্তু তাঁর হওয়া উচিত ছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথমত তাঁর ছিল পুরো হাকিমি মেজাজ; আর সেই কারণে তিনি পরতেন ইংরাজি পোশাক, খেতেন ইংরাজি খানা, ফুঁকতেন আধ হাত লম্বা বর্মা চুরুট। উপরন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, তিনি লেখেন নির্ভুল ইংরাজি, আর বলেন ইংরাজের মুখের ইংরাজি। কিন্তু মুন্সেফি আদালতে এই দুই বিদ্যের পরিচয় দেবার তেমন সুযোগ নেই—এই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান দুঃখ। রায় অবশ্য তাঁকে ইংরাজিতেই লিখতে হয়, কিন্তু বাকি খাজনার মামলার রায়ে তো আর শেক্সপীয়র মিলটন কোট করা চলে না।

কাজেই তিনি বাধ্য হয়ে আমাদের পাঁচজনের কাছে সাহিত্য আলোচনাচ্ছলে তাঁর বিদ্যের দৌড় দেখাতেন। আমরা কিন্তু তাঁর কথাবার্তা শুনতে খুবই ভালোবাসতুম। তিনি গল্প করতে যে পটু ছিলেন, শুধু তাই নয়, গল্প বলতেনও চমৎকার। চমৎকার বলছি এই জন্যে যে, সে-সব গল্পের বিষয়ও নতুন, বলবার কায়দাও অ-কেতাবী। সে গল্পগুলি ইংরাজি সাহিত্য থেকে চোরাই মাল নয়। তিনি মুন্সেফ না হয়ে ডেপুটি হলে যে একজন ছোটোখাটো বঙ্কিম হতেন, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই—অবশ্য যদি তাঁর বাঙলা ভাষা সংস্কৃত-বাপ-কি-বেটা—বন্ধুবরের কথা শুনে বোঝা যেত যে,বাঙলা ছত্রিশ জাতের ভাষা। তার ভিতর মধ্যে মধ্যে এমন-সব কথা থাকত—যাদের কোনো অভিধানে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না, এমন-কি, শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের সদ্যপ্রকাশিত ‘চলন্তিকা’তেও নয়। এ হেন পৈতে-ফেলা ভাষা ভদ্রসমাজে নিত্য শোনা যায় না।

বন্ধুবরের নাম করছি নে এই ভয়ে যে, পাছে তাঁর literary ক্ষমতা আছে জানলে তাঁর প্রমোশন বন্ধ হয়। কে না জানে যে সাহিত্যের মতো বে-আইনি জিনিস আর নেই? তা ছাড়া তিনি যখন লেখক নন, তখন তাঁর নামের কোনো মূল্য নেই। মুন্সেফবাবু ও ডেপুটি বাবুদের নাম আর কে মনে করে রাখে?

তিনি একদিন আমাকে সম্বোধন করে বললেন যে, ‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন তো আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলি।”

আমি বললুম, “আপনি আপনার ছেলেবেলার গল্প বলবেন, তাতে আমি ক্ষুণ্ণ হব কেন?”

“তাতে একটা জিনিস আছে, যা আপনার কানে ভালো না লাগতে পারে। সে জিনিসটে হচ্ছে গল্পের নায়কের নাম। আর লেখকমাত্রেই নামের বিষয়ে বড়ো sensitive। আপনি মনে করতে পারেন যে, ও নামটি আমি ইচ্ছে করেই রেখেছি—একটু রসিকতা করবার জন্য। কিন্তু আমার ওরকম কোনো কু-মতলব নেই। গল্প যারা বানিয়ে বলে, অর্থাৎ লেখকরা, তাদের অবশ্য নায়ক-নায়িকার নামকরণের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আমার মতো যারা সত্য ঘটনা বর্ণনা করে, তাঁদের যার যে নাম, তা বলা ছাড়া আর উপায় নেই।”

এ কথা শুনে আমি তাঁকে ভরসা দিলুম যে, “নায়কের নাম যাই হোক-না-কেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না। একাধিক লেখকের এক নাম হলেই মুশকিল, কেননা তা হলে পাঠকরা অন্যের লেখার জন্য আমাদের দায়ী করবে, অথবা আমাদের লেখার দায় অপরের ঘাড়ে চাপাবে। কিন্তু লেখক আর নায়ক তো এক চিজ নয়। সুতরাং আপনি নির্ভয়ে বলে যান। আপনার গল্পের নায়ক যদি গুণ্ডাও হয়, আর আমার যা নাম তার নামও যদি হয়, তা হলেও Goonda Act এ আমি গ্রেপ্তার হব না। আমার মতো নিরীহ লেখক বাঙলায় যে দ্বিতীয় নেই, তা কে না জানে?”

বন্ধুবর হেসে বললেন, “তবে বলি, শ্রবণ করুন।”

বাবার জীবনের প্রধান শখ ছিল শিকার। তাই তিনি বারোমাস বন্দুক ঘোড়া ও কুকুর নিয়েই মত্ত থাকতেন। আমরাও তাই জন্মাবধি বারুদ কুকুর ও ঘোড়ার গন্ধ শুঁকে শুঁকেই বড়ো হয়েছি। কুকুর যে চোখে দেখে না, গন্ধ শুঁকেই জানোয়ার চেনে, এ কথা তো আপনারা সবাই জানেন; কিন্তু নানা জাতীয় কুকুরের গায়ে যে নানারকমের রঙের মতো নানারকমের গন্ধ আছে, তা বোধ হয় আপনারা লক্ষ্য করেন নি। ওদের আভিজাত্যের পরিচয় ওদের গন্ধেই পাওয়া যায়। ফুলেরও যেমন, কুকুরের তেমনি, রূপের সঙ্গে গন্ধের একটা নিত্য সম্বন্ধ আছে। যাক ও-সব কথা।

আমার বয়স যখন ছয় ও সাতের মাঝামাঝি বাবা একটি নীলকুঠেল সাহেবের কাছ থেকে গুটিকয়েক শিকারী কুকুর কিনে নিয়ে এলেন। একটি বুলডগ, দুটি গ্রে- হাউণ্ড, দুটি ফক্স আর একটি বুল-টেরিয়র। গ্রে-হাউগু দুটি বাঙলায় যাকে বলে ‘ডালকুত্তা’—দেখতে ঠিক হরিণের মতো। সেই রঙ, সেই চোখ, মাথায় শুধু শিং নেই, আর ছুটতেও তদ্রূপ। বুলডগটির রূপের কথা আর বলে কাজ নেই। তার মুখ নাক বলে কোনো জিনিস ছিল না, চোখ দুটি একদম গোল। তার মুখে থাকবার ভিতর ছিল শুধু দুপাটি দাঁত। সে কাউকে কামড়াবামাত্র তার চোয়াল আটকে যেত, আর তখন তার মুখের ভিতর লোহার শিক পুরে দিয়ে মোক্ষম চাড় দিয়ে তার মুখ খোলা যেত।

নীলকুঠেল সাহেবের কৃষ্ণপক্ষের মেম, কুঠির হেড বরকন্দাজ উমেশ সর্দারের মেয়ে টগর বিবি, তার দাম চড়াবার জন্য বাবাকে বলেছিল যে, “পেলাগ্ ধরবেক তো ছাড়বেক না।” ‘পেলাগ্’ হচ্ছে অবশ্য ইংরাজি pluck শব্দের বুনো অপভ্রংশ। এ কথা যে সত্য তার প্রমাণ আমরা দুদিন না যেতেই পেলুম। পাড়ার বাগ্দিদের একটি মস্ত কুকুর ছিল। সে আসলে দেশি হলেও বিলেতির বেনামিতে চলে যেত। যেমন দেশি খৃস্টানদেরও কখনো কখনো বিলেতি নাম থাকে, তেমনই তারও নাম ছিল রিচার্ড। সে যে পুরো বিলোতি না হোক, উঁচুদরের দো-আঁশলা, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। রিচার্ড একদিন পেলাগের সঙ্গে দোস্তি করতে এসেছিল। ফলে পেলাগ্‌ না-বলা-কওয়া তার গায়ে এমনি দাঁত বসিয়ে দিলে যে, পাঁচজনে পড়ে যখন তার দাঁত ছাড়ালে, তখন দেখা গেল যে, রিচার্ডের হাড়গোড় সব থেঁতলে পিষে গিয়েছে। বাবাকে তার জন্য রিচার্ডের মালিককে ড্যামেজ দিতে হয়েছিল নগদ দশ টাকা। এতে আমার ভারি রাগ হয়েছিল। কারণ, এ কটা টাকা পেলে আমরা মনের সুখে ঘুড়ি উড়িয়ে বাঁচতুম, আর আমার স্কুল-ফ্রেণ্ড ভজহরি কুণ্ডুর পরামর্শমত মার বাক্স থেকে এক টাকা চুরি করতে হত না।

বাবা এই-সব শিকারী কুকুর নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে বাড়িসুদ্ধ লোককে, বিশেষত মাকে, বেজায় ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। তাদের ঠিকমত নাওয়ানো হচ্ছে না, খাওয়ানো হচ্ছে না, বলে দিবারাত্র চাকরদের উপর কাবকি শুরু করলেন। বামন ঠাকুর পেলাগের জন্য একদিন মোগলাই-দস্তুর কোর্মা রেঁধেছিল, তাতে গরম মসলা ও নুনের কমতি ছিল না, উপরন্তু ছিল পোয়াখানেক ঘি। বাবা শুনে মহাক্ষিপ্ত হয়ে মাকে গিয়ে বললেন যে, “বামন ঠাকুর দেখছি কুকুরটাকে দুদিনেই মেরে ফেলবে। ঘি খেলে যে কুকুরের রোঁয়া উঠে যায়, আর নুন খেলে যে সর্বাঙ্গে ঘা হয়—একথাটাও কি ঠাকুর জানে না?” মা বিরক্ত হয়ে বললেন যে, “জানবে কি করে? ঠাকুর তো এর আগে কখনো কুকুরের ভোগ রাঁধে নি। ওর রান্না কুকুর-বাবুদের যদি পছন্দ না হয় তো খুঁজে পেতে একজন কুকুরের বামন নিয়ে এসো।”

অনেক তল্লাসের পর একটি ১লা নভেম্বরে কুকুরের বামন পাওয়া গেল। জনরব, সে আগে লাটসাহেবের কুকুরদের খিমার ছিল। সে জাতে লালবেগী। লালবেগীরা যে কারা আর তাদের জাতব্যবসা যে কি, তা যিনিই বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা শুনেছেন, তিনিই জানেন। এ লোকটি একাধারে কুকুরের নর্স এবং ডাক্তার। কুকুরজাতির ঔষধ- পথ্য সব তার নখাগ্রে। কুকুরের খানাকে যে রাতিব বলে, আর তা যে রাঁধতে হয় বিনা নুন-ঝালে আর শুধু হলুদ দিয়ে—এ কথা আমরা প্রথম শুনলুম তার মুখে। কুকুরের জন্য খানা পাকাবার হিসেব এই যে, তাকে কাঁচা মাংসের রূপ-গুণ সব বজায় থাকবে। আমাদের যেমন কুইনিন ও রেড়ির তৈল, কুকুরদেরও নাকি হিং রশুন তেমনি সর্বরোগের মহৌষধ।

বাবা তার পশ্বায়ুর্বেদে পাণ্ডিত্য দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলেন, আর আমরাও ভারি খুশি হলুম, কিন্তু সে অন্য কারণে। সে কারণ যে কি, তা পরে বলছি। আর ভাইদের মধ্যে আমি হয়ে পড়লুম তার মহাভক্ত, যদিচ কুকুর জানোয়ারটির সঙ্গে আমার কোনরূপ ঘনিষ্ঠতা ছিল না; এবং তাদের ধর্মকর্ম সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলুম। দাদা বলতেন, তিনি কুকুরের হাড়হদ্দ জানেন; তাই দাদার মুখে শুনে শিখেছিলুম যে, যে কুকুরের বিশটি নখ থাকে তার নখে বিষ থাকে। কুকুর সম্বন্ধে আমার এইটুকুমাত্র জ্ঞান ছিল। এখন বুঝি, দাদার এ জ্ঞান তাঁর যত্বণত্ব-জ্ঞানের অভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সে যাই হোক, কুকুরের প্রতি আমার যে পরিমাণ অপ্রীতি ছিল, তার রক্ষকের প্রতি আমার সেই পরিমাণ প্রীতি জন্মাল।

এ লোকটির নাম ছিল বীরবল। বাবা ছিলেন সেকালে হিন্দু কলেজের ছেলে, ক্যাপ্টেন রিচার্ডসনের শিষ্য, অতএব মহা সাহিত্যভক্ত; তাই ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে বহু নামী লোকের সমাগম হত, কিন্তু এঁদের একজনেরও চেহারা আমার মনে নেই। মনে আছে একমাত্র বীরবলের। এর কারণ এঁরা অসামান্য ছিলেন গুণে, রূপে নয়। অপরপক্ষে বীরবল ছিল রূপে-গুণে অনুপম। অবশ্য সেই-সব গুণে, যে-সব গুণ ছোটো ছেলেরা বুঝতে পারে। সে ছিল যেমন বলিষ্ঠ, তেমনই নির্ভীক। ঘোড়ার বাগডোর সে একটানে ছিঁড়ে ফেলত। বড়ো বড়ো প্রাচীর সে অবলীলাক্রমে লাফিয়ে ডিঙিয়ে যেত। তার উপর সে ছিল আশ্চর্য ঘোড়সোয়ার। ঘোড়া—সে যতই বড়ো হোক-না, যতই দুরন্ত হোক না—বীরবল তাকে এক বোতল বিয়ার খাইয়ে একলাফে তার পিঠে চড়ে বসত, আর ঘাড়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে তার কানে বসে ফুঁ দিত; আর তখন সে ঘোড়া মরি-বাঁচি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটত, কিন্তু বীরবলকে ফেলতে পারত না।

আর তার রূপ! অমন সুপুরুষ আমি জীবনে কখনো দেখি নি। সে ছিল কালোপাথরের জীবন্ত এপোলো। সে যখন প্রথমে এল, পরনে হলুদে-ছোপানো ধুতি, মাথায় একই রঙের পাগড়ি, তার নীচে একমাথা কালো কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, ঠোঁটে হাসি ও বগলে লালটুকটুকে একখানি হাত-আড়াই বাঁশের লক্‌ড়ি, তখন বাড়িসুদ্ধ লোক তার রূপ দেখে চমকে উঠলেন। মা আস্তে বললেন, “স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ!” বাবা কিছু বলেন নি, কিন্তু বীরবলের রূপ যে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, তার প্রমাণ, মাস-দুই পরে ঝগড়ু মেথর যখন বাবার কাছে এসে নালিশ করলে যে, বীরবল তার বউকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে, তখন বাবা ‘আচ্ছা’ বলে তাকে বিদেয় করলেন। মার মনে হল এটা অবিচার, এবং বাবাকে সে কথা বলাতে তিনি বললেন, “তুমিও যেমন, ওদের বিয়েই নেই, তো কে কার বউ। আর তা ছাড়া ঝগড়ুকে তো দেখেছ, বেটা বাঁদরের বাচ্ছা। আর লখিয়াকেও তো দেখেছ? কী সুন্দরী! সে যে ঝগডুকে ছেড়ে বীরবলের কাছে চলে যাবে, এ তো নিতান্ত স্বাভাবিক। রাধাকে কেউ ঘরে রাখতে পারবে না—সে কৃষ্ণের কাছে যাবেই যাবে। এই হচ্ছে ভগবানের নিয়ম।” এ কথা শুনে মা চুপ করে রইলেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, বাবার রূপজ্ঞান তাঁর ধর্মজ্ঞানকে চাপা দিয়েছিল। বীরবলের রূপ ছিল যে অসাধারণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, বাবার প্রচণ্ড ধর্মজ্ঞানও সে রূপের আওতায় পড়ে গিয়েছিল; কারণ, বাবা ছিলেন সেকালের একদম ইংরাজি-পড়া ঘোর moralist.

বীরবলের রূপ আমি বর্ণনা করতে পারি, কিন্তু করছি নে এই ভয়ে যে, পাছে তা কেতাবী হয়ে পড়ে। তাকে দেখেছিলুম ছেলেবেলায়, সুতরাং তার যে-ছবি আজ আমার চোখের সমুখে খাড়া আছে, তার ভিতর স্মৃতির ভাগ কতটা আর কল্পনার ভাগই-বা কতটা, তা বলতে পারি নে। তবে এ কথা সত্য, সে যার সম্পর্কে এসেছিল, তাকেই জাদু করেছিল—এমন-কি, কুকুর কটাকেও। তাকে দেখামাত্রই কুকুরগুলো লেজ নাড়তে শুরু করত, আর Pluck তো একেবারে চিৎ হয়ে আহ্লাদে চার পা আকাশে তুলে দিত, অথচ দরকার হলে সে Pluck কে কড়া শাসন করতে কসুর করত না। সে তার পিঠে হাতও বোলাত, চাবুকও লাগাত।

তার চলাফেরা বলা-কওয়ার ভিতর একটা খাতির-নদারত ভাব ছিল, যেটা আসলে তার প্রাণের স্ফূর্তির বাহ্যরূপমাত্র। সে ছিল সদানন্দ। আর প্রদীপ যেমন তার আলো চার দিকে ছড়িয়ে দেয়, সেও তার মনের সহজ আনন্দ চার পাশে ছড়িয়ে দিত। এটা অবশ্য সকলেই লক্ষ্য করেছেন যে, পৃথিবীতে এমন লোকও আছে, যার মুখ দেখলেই মনটা দমে যায়। তার প্রকৃতি ছিল এ জাতের লোকের ঠিক উল্টো।

তার উপর ছোটো ছেলেদের বশ করবার নানা বিদ্যে তার জানা ছিল। সে ঘুড়ি তৈরি করত চমৎকার। তার হাতের ঘুড়ি কি ডাইনে কি বাঁয়ে কখনো কান্নি মারত না। সুতো ছেড়ে দিলেই বেলুনের মতো সোজা উপরে উঠে যেত। তাসের সুতোর জন্য যে চাই শীলত মাঞ্জা, আর লকের সুতোর জন্য খর, তা অবশ্য আমরা সবাই জানতুম। কিন্তু শীতল মাঞ্জার মাড় কতটা ঘন করলে আর খর মাঞ্জায় বোতলচুর কতটা মেশালে সুতো অকাট্য হয়, তার হিসেব জানত একা বীরবল। এমন-কি, বাণ্ডিলের সুতো হলুদে ছুপিয়ে খর মাঞ্জার যোগে যে লকের সুতোকেও কেটে দিতে পারে তার হাতে-কলমে প্রমাণ দিত বীরবল। তা ছাড়া চীনে-ঘুড়ির সে যে বর্ণনা করত, তা শুনে আমাদের মনে হত, এবার মরে চীন দেশে জন্মাব। এ-সব দিনের কথা এখন মনে করতে হাসি পায়। কিন্তু আমার পৃথিবীর সঙ্গে তখন প্রথম পরিচয়, যা দেখতুম আর যা শুনতুম, সবই অপূৰ্ব ঠেকত।

আমি ছিলুম তার favourite। বীরবল বলত, সে আমাকে তার সব বিদ্যে শেখাবে—অবশ্য বড়ো হলে। আমার অবশ্য তার কোনো বিদ্যেই শেখবার লোভ ছিল না, লোভ ছিল শুধু সব দেখবার।

তাই সে আমাকে একদিন বলেছিল যে, সে আর তার ভাই-ব্রাদারিতে মিলে রাত্রিতে ঝাঁপান ফেলবে। আমি যদি দেখতে চাই তো রাত-দুপুরে একা তার বাড়ি গেলেই সব দেখতে পাব। অবশ্য বাবা মা আমাকে অত রাত্তিরে বীরবলের বাড়ি একা যেতে দেবেন না, তা আমি জানতুম, তাই যদিও ঝাঁপান খেলা দেখবার আমার অত্যন্ত লোভ ছিল, তবুও বীরবলের প্রস্তাবে রাজি হতে পারলুম না।

ঝাঁপান খেলা ব্যাপারটি কি জানেন? আমাদের দেশে কেওড়া মেথর হাড়ি ডোমরা বছরে একদিন সাপ খেলে-সাপের বিষদাঁত না ভেঙে। সেই দিনই কে কেমন সাপুড়ে তার পরীক্ষা হয়, আর সঙ্গে সঙ্গে রোজাদের। ঝাঁপান যেখানে খেলা হয়, সেখানেই এক-আধজন মারা যায়। হাজার ওস্তাদ হোক্, আস্ত জাত-সাপ নিয়ে খেলা তো ছেলেখেলা নয়। ঐ বিষদাঁত ছুঁলেই মরণ, যদি না রোজা ঝেড়ে সে বিষ নামাতে পারে। পুলিস এ খেলা খেলতে দেয় না, তাই গুণীর দল রাত দুপুরে ঘরে দুয়োর দিয়ে এ খেলা খেলে। যেদিন বেহুলা ইন্দ্রের সভায় নেচে লখিন্দরকে বাঁচিয়েছিল, সেইদিনই এ খেলা খেলতে হয়। বীরবল অবশ্য ব্যবসাদার সাপুড়ে ছিল না। কিন্তু যে কার্যে বিপদ আছে, বীরবল হাসিমুকে গিয়ে তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আর শুনেছি সে সাপ খেলাতেও চমৎকার। সাপ যে দিক থেকে যে ভাবেই ছোবল মারুক-না কেন, বীরবলের অঙ্গ কখনো ছুঁতে পারে নি।

বীরবল সে রাত্তিরে একটা প্রকাণ্ড খয়ে-গোখরো নিয়ে তার হাতসাফাই দেখাবে, তাই সে আমাকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিল।

তার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি যে, বীরবলকে রাত্তিরে সাপে কামড়েছে, সে এখন মরমর। এ সংবাদ নিয়ে এলেন ঝগডু; তিনিও নাকি ঐ দলে ছিলেন—তুবড়ি বাজাবার ওস্তাদ হিসেবে। অতি মাত্রায় মদ্যপানের ফলে ঝগডু সাপের সঙ্গে ইয়ারকি করতে গিয়েছিল, আর তাকে বাঁচাতে গিয়েই নাকি সাপের ছোবল বীরবলের হাতে পড়েছে। এ সংবাদ পেয়েই বাবা আমাদের এবং কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে বীরবলের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন। আমরা গিয়ে দেখি, তার ভাই-ব্রাদারিতে মিলে তাকে উঠোনে নামিয়েছে, আর মঙ্গলা খৃস্টান বিড় বিড় করে কী মন্ত্র পড়ছে ও বীরবলের গায়ে জলের ছিটে দিচ্ছে; আর লখিয়া সজোরে তার গা টিপছে—সাপের বিষ ডলে নামাবার জন্য। বীরবলের ভাই-ব্রাদারি থেকে থেকে বেহুলার যাত্রার ধুয়ো ধরেছে—”ও সে বাঁচবে না।” মঙ্গলা খৃস্টান ওদিগের মধ্যে সবচাইতে নামী রোজা। সে বাবাকে সম্বোধন করে বললে, “হুজুর, বোধ হয় রোগীকে আর বাঁচাতে পারলুম না—যেমনি কামড়েছে তেমনি যদি আমাকে ডাকত তা হলে বিষ ঝেড়ে ঠিক নামিয়ে দিতুম। কিন্তু অন্য রোজারা তিন ঘণ্টা ধরে ঝাড়ফুঁক করে যখন হাল ছেড়ে পালিয়ে গেল, তখন আমাকে খবর দিলে। এখন আর কোনো মন্তরই লাগছে না, না চণ্ডীর না মেরির।

বীরবলের দেখলুম সর্বাঙ্গ একেবারে নীল হয়ে গিয়েছে, আর হাত-পা আড়ষ্ট। সে চোখ বুজে শুয়ে আছে আর তার নাক দিয়ে একটু একটু নিশ্বাস পড়ছে। হঠাৎ বীরবল চোখ খুললে, আর আমার দিকে চেয়ে বললে, “বাবা, হাম চলতা, কুচ ডর নেই।” এই কটি কথা বলে সে আবার চোখ বুজলে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেল। তখন দেখলুম সেই দেহ, সেই রূপ, সবই রয়েছে—চলে গিয়েছে শুধু বীরবল।

পেলাগ্ ছুটে গিয়ে তার মৃতদেহ একবার শুঁকলে, তার পরে চলে এল। দেখলুম তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমার শুধু মনে হল যে, দিনের আলো নিভে গেল।

এখন আমি ভাবি, আমিও কি একদিন এই শেষ কথাটি বলে যেতে পারব—”হাম চলতা, কুচ ডর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *