প্রসঙ্গকথা

প্রসঙ্গকথা

চার-ইয়ারি কথা প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী

আমি বিলেত থেকে এ দেশে ফিরে আসবার বছর-দশেক পরে ‘চার-ইয়ারি কথা’ বলে একখানা গল্পের বই লিখি। সে গল্প ক’টি পড়ে সেকালে যুবক-সম্প্রদায়ের চটক লাগে। এবং সমালোচক-দলের কাছে নতুন বলে গ্রাহ্য হয়। দু-চার জন সমালোচক লেখেন যে, গল্প ক’টি ফরাসি থেকে চুরি। যদিচ তাঁরা ফরাসি ভাষা ও ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। কেউ কেউ লেখেন যে, আনাটোল ফ্রান্সের গল্প থেকে চুরি। যদি আনাটোল ফ্রান্সের গল্পের সঙ্গে তাঁদের কিছুমাত্র পরিচয় থাকত তা হলে তাঁরা আমাকে এই চুরির দায়ে দোষী করতেন না। অনেকে মুখে আমাকে বলেছেন যে, এই গল্প-চারটির নায়িকাদের সঙ্গে বিলেতে আমার পরিচয় ছিল। প্রথম নায়িকা হচ্ছে পাগল, দ্বিতীয়টি চোর, তৃতীয়টি জুয়াচ্চোর, আর চতুর্থটি ভূত। বলা বাহুল্য, একরকম চারটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন চরিত্রের নায়িকার একটির পর একটির সঙ্গে পরিচয় হওয়া অসম্ভব। এই চারটিই আমার মনগড়া। তবে, এর ভিতর তৃতীয় গল্পের নায়িকার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, যাকে আমি রিণী নামে গড়ে তুলেছি।

এ গল্পের ঘটনা ও কথোপকথন সবই আমার স্বকপোলকল্পিত। কিন্তু আমি এমন- একটি যুবতীকে জানতুম, যাকে রিণীর রূপ দেওয়া যায়। তার যথার্থ নাম ছিল কাতি, ইংরেজি Katieর ফরাসি উচ্চারণ। এই নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, সে আধা-ফরাসি আধা-ইংরেজ। তার মুখে শুনেছি যে, সে অল্পবয়সে ব্রাসেসে থাকত, সেখানকার conservatorie -এ ভালো করে গানবাজনা শেখবার জন্যে। আমি তাকে কখনো গান গাইতে কিম্বা বাজাতে শুনি নি; কিন্তু সে যে ফরাসি বলতে পারত, তার পরিচয় আমি পেয়েছি। সে ছিল অভিজাতবংশীয়া। যদি তার কথা বিশ্বাস করতে হয়, তা হলে তার ঠাকুরদা ছিলেন ভারতবর্ষে একটি জেনারেল। তার বাবাও ছিলেন একটি মিলিটারি অফিসার। তার পর তিনি কোনো দুষ্কর্ম করায় দেশত্যাগী হয়েছিলেন। কাতির মা দিদি ও কাতিকে একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে তিনি পলাতক হন। এবং তখন পর্যন্ত তাঁর কোনো খবর পাওয়া যায় নি। এই সময়ে জেনারেল ফ্রেঞ্চ কাতিদের কিছু কিছু মাসহারা দিয়ে ভরণপোষণ করতেন। এবং সম্ভবত তিনিই তাদের ব্রাসেসে থাকতে পাঠান। আমি এই ব্রাসেসের কথা তাকে কখনো জিজ্ঞাসা করি নি। আমি কাতির মাকে কখনো দেখি নি। তার দিদিকে দেখেছিলুম; সে দেখতে মোটেই সুন্দরী নয়, এবং অত্যন্ত ভালোমানুষ। সে যে কাতির দিদি, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কাতি ছিল অতিশয় সুন্দরী এবং অতিশয় চালাক-চতুর। কাতির মুখ ছিল লম্বা ধরনের, নাক লম্বা, চোখও লম্বার দিকে বড়ো; এবং সমস্ত মুখ চোখে একটা তীক্ষ্ণ ভাব ছিল। আমার আর্টিস্ট বন্ধু রোলান্‌ড্ হল্ তার ফোটো দেখে চমকে ওঠেন, এবং তিনি বলেন যে, এই মেয়েটির চোখের তারার রঙ নীল নয়, ভায়লেট। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি ফোটো থেকে কি করে চোখের তারার রঙ বুঝলে?—তিনি উত্তরে বললেন যে, এর পরে তুমি লক্ষ্য করে দেখো তোমার এই বন্ধুটির চোখ ভায়লেট কি না। আমি পরে লক্ষ্য করে দেখি যে, রোলান্ড হল্ এর কথাই ঠিক।

আমি সম্প্রতি একখানি বই পড়ছি, যার নাম Bernard Shaw, His life and Personality। তাতে উইলিয়ম মরিস্ নামক একটি প্রসিদ্ধ আর্টিস্ট এবং সাহিত্যিকের কনিষ্ঠা কন্যা মে মরিস্ত্রে একখানি ছবি আছে। আমি ছবিখানি যখনই দেখি, তখনই আমার কাতির কথা মনে পড়ে। এমন-কি, সময়ে সময়ে ভুল হয় যে ওটা তারই ছবি। আমি এই একটি সত্যিকারের মেয়েকে ভেঙে ‘চার-ইয়ারি কথা’র চারটি নায়িকাকে তৈরি করেছি। আমি তার নাম-ধাম কিছুই জানতুম না, যা তার মুখে শুনেছি তা ছাড়া। এবং বেশি জানবার কোনো কৌতূহলও আমার ছিল না। প্রথম থেকেই আমার মনে হয়েছিল যে, সে একটি mystery girl। এবং তার জীবনরহস্য উদ্ঘাটন করবার চেষ্টা আমি সংগত মনে করতুম না, পাছে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। উপরন্তু তার ব্যবহার এত অব্যবস্থিতচিত্ততার পরিচয় দিত যে, তার থেকে আমার মনে হত তার ভিতর একটু পাগলামির ছিট আছে। দ্বিতীয় গল্পের নায়িকাকে আমি বইয়ের দোকানে প্রথম দেখি, কাতিকেও তাই। তারপর যা- সব লিখেছি, সে-সব হচ্ছে সীতেশকে ফোটাবার জন্যে। আর শেষটা সে নায়িকা যে সীতেশের পাঁচ পাউণ্ড চুরি করে নিয়ে গেল, এ ঘটনা আমার সম্পূর্ণ বানানো। কাতি ক্রিমিনালের মেয়ে, তার পরিবারের অবস্থা সচ্ছল ছিল না; তাই আমি তাকে শেষ কাণ্ডে চোর বানিয়েছি। এ কাতি কিন্তু যথার্থ কাতি ছিল না।

‘চার-ইয়ারি’র তৃতীয় গল্পে আমি যাকে রিণী বানিয়েছি, তার সঙ্গে যথার্থ কাতির কিছু সাদৃশ্য আছে। যখন “চার-ইয়ারি’ প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন আমাকে বহুলোক জিজ্ঞেস করেছিল যে, এ গল্পটি real কি না। উত্তরে আমি বলি, তা হলে গল্পটি উরেছে। কেননা, যা আগাগোড়া কল্পনার জিনিস, অনেক পাঠকের কাছে তা সত্য বলে মনে হয়েছে। কাতির সঙ্গে আমি ভালোবাসায় পড়ি আর না-পড়ি, সেকালে যুবক-পাঠকের দল অনেকে রিণীর প্রেমে পড়েছিল। আমার একটি ভক্ত বন্ধু কোনো মাসিক পত্রিকায় ‘চার-ইয়ারি’র দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন। তাতে তিনি মুখ ফুটে বলেন যে, রিণীর মতো মেয়ের হাতে পড়ে নাকানি-চোবানি খাওয়াতেও সুখ আছে। আমি তাঁকে বলি, এটা কি লক্ষ্য কর নি যে, রিণীর পিরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেক চাঁদ? আমার বন্ধু উত্তরে বলেন, রিণী যে ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট, রুষ্টতুষ্ট ক্ষণে ক্ষণে—এ কার চোখ এড়িয়ে যায়? কিন্তু সে জীবন্ত মানুষ, জড় পদার্থ নয়, এইখানেই তার বিশেষত্ব। কাতির সঙ্গে রিণীর প্রধান তফাত এই যে, আমি কাতিকে অনেক রঙ চড়িয়ে রিণী বানিয়েছি। রিণী ও তৃতীয় গল্পের নায়ক সোমনাথের কথাবার্তা প্রায় সবই আমার স্বকপোলকল্পিত। তবে লোকের কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্য তাদের রক্তমাংসের মানুষ তৈরি করতে চেষ্টা করেছি। ফলে, এটি গল্প হয়েছে, অথচ পাঠকের কাছে সত্য ঘটনা বলে ভ্রম হয়।

“চার-ইয়ারি কথা’র চতুর্থ গল্পের নায়িকা হচ্ছে প্রেতাত্মা। সে দেশি কি বিলেতি, এ প্রশ্ন যে কোনো পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

বৈশাখী’ ১৩৫২

প্রমথ চৌধুরীর গল্প সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ

মৌলিক গল্প রচনার পূর্বে প্রমথ চৌধুরী কোনো কোনো বিদেশী গল্প অনুবাদ করেছিলেন। সাধনা পত্রে ‘সাময়িক সাহিত্য সমালোচনায়’ [সাধনা, অগ্রহায়ণ ১২৯৮] রবীন্দ্রনাথ তার একটির প্রসঙ্গে অনুকূল মন্তব্য করেন নি; নিম্নে তা মুদ্রিত হল—

সাহিত্য। দ্বিতীয় ভাগ। আশ্বিন [১২৯৮]। এই সংখ্যায় “ফুলদানী” নামক একটি ছোট উপন্যাস ফরাসীস্ হইতে অনুবাদিত হইয়াছে। প্রসিদ্ধ লেখক প্রস্পর মেরিমে প্রণীত এই গল্পটি যদিও সুন্দর কিন্তু ইহা বাঙ্গলা অনুবাদের যোগ্য নহে। বর্ণিত ঘটনা এবং পাত্রগণ বড় বেশি য়ুরোপীয়—ইহতে বাঙ্গালী পাঠকদের রসাস্বাদনের বড়ই ব্যাঘাত করিবে। এমন কি সামাজিক প্রথার পার্থক্যহেতু মূল ঘটনাটি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ মন্দই বোধ হইতে পারে। বিশেষত: মূল গ্রন্থের ভাষামাধুর্য্য অনুবাদে কখনই রক্ষিত হইতে পারে না, সুতরাং রচনার আব্রুটুকু চলিয়া যায়।

প্রমথ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘আত্মকথা’য় (১৩৫৩) লিখেছেন—

সুরেশচন্দ্র সমাজপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় Prosper Merimeeর ‘Etruscan Vase’ নামক একটি গল্প তর্জ্জমা করে’ ‘ফুলদানি’ নাম দিয়ে প্রকাশ করি। সেটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’য় আমাকে আক্রমণ করেন। দুটি কারণে, প্রথমত, ‘ফুলদানি’র মত গল্প বঙ্গসাহিত্যের অন্তর্ভূত করা অনুচিত বলে; দ্বিতীয়ত, পাকা ফরাসী লেখকের লেখা কাঁচা বাঙ্গলা লেখকের অনুবাদে শ্রীভ্রষ্ট করা হয়েছে বলে’। আমি শেষোক্ত আপত্তি গ্রাহ্য করি। কিন্তু এ জাতীয় গল্প যে বঙ্গসাহিত্যে চলতে পারে না, সে কথা মানি নি। আমি অবশ্য সে সমালোচনা পড়ে’ একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলুম। কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এরকম সমালোচনা আশা করি নি। তার পরেই আমি মেরিমে’র ‘কার্মেন’ তর্জ্জমা করি। কিন্তু সেটি শেষ করতে পারি নি বলে প্রকাশ করি নি। কার্মেন অনুবাদ করবার কারণ, তার বিষয়বস্তু ‘ফুলদানি’র চেয়ে ঢের বেশি অসামাজিক।

প্রধানত, সবুজ পত্র প্রকাশ হবার পর থেকেই প্রমথ চৌধুরীর মৌলিক গল্প রচনার সূচনা। সবুজ পত্রের প্রথম গল্পটি [চার-ইয়ারির কথা] লিখিত হবার পর রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে লেখেন—তুমি যখন প্রথম গণ্ডী পেরিয়েছ তখন আর গল্প লেখায় তোমাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না—এখন থেকে তোমার এই এক বহু হবার পথে চল্ল। [ফেব্রুয়ারি ১৯১৬]

এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর জীবনে। অতঃপর জীবনের প্রত্যন্ত ভাগ পর্যন্ত তিনি গল্প রচনায় নিরত ছিলেন। সেগুলির কোনো-কোনোটি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে লিখিত চিঠিপত্রে যে মন্তব্য করেছেন নিম্নে তা সংকলিত হল।—

চার-ইয়ারি কথা

এখন মনে হচ্চে তোমার গল্পগুলো উল্টো দিক দিয়ে সুরু হলে ভালো হত। তোমার শেষ গল্পটা সব চেয়ে human। গল্পের প্রথম পরিচয়ে সেইটে সহজে লোকের হৃদয়কে টান্ত—তার পরে অন্য গল্পে মনস্তত্ত্ব এবং আর্টের বৈচিত্র্য তারা মেনে নিত। এবারকার দুটি নায়িকাই ফাঁকি—একটি পাগল, আর একটি চোর। কিন্তু নায়িকার প্রতি, অন্তত পুরুষ পাঠকের যে একটা স্বাভাবিক মনের টান আছে, সেটাকে এমনতর বিদ্রূপ করলে নিষ্ঠুরতা করা হয়। সব পাঠকের সঙ্গেই ত তোমার ঠাট্টার সম্পর্ক নয়—এই জন্যে তারা চটে ওঠে। তাদের পেট ভরাবার মত কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন দিলেও ইতরে জনাঃ খুসি থাকত। তুমি করালে কি না “ঘ্রাণেন অর্দ্ধভোজনং”–কিন্তু কথাটা একেবারেই সত্য নয়—বস্তুত, ঘ্রাণে দ্বিগুণ উপবাস। মানুষ যখন ঠকে তখন সহজে এ কথা বলতে পারে না যে, ঠকেচি বটে কিন্তু চমৎকার! [মার্চ ১৯১৬]

ছোটো গল্প

গল্পটি কিন্তু তুমি সম্পূর্ণ আমার জীবনবৃত্তান্ত থেকে চুরি করেচ—ঠিক গল্পটি নয় কিন্তু তার বৃত্তান্তটি। কিন্তু খুব উপাদেয় হয়েচে। এ’কে মারাত্মক গল্প বলা যেতে পারে কারণ, বুদ্ধকে মার যে-রকম প্রলুব্ধ করেছিল, তোমার গল্পের উপসংহারে সেই রকম একটি মারের প্রলোভন উদ্যত আছে—সুকুমারমতি পাঠকেরা নিশ্চয় নিঃশ্বাস ছেড়ে বলবে, আহা ঐ বিধবার সঙ্গে বিবাহ হলেই ত চুকে যায়—কিন্তু তাহলে গল্পের তপস্যা ঐখানেই মাটি। [১ ভাদ্র ১৩২৫]

রাম ও শ্যাম

তোমার শেষ গল্পটি সুতীক্ষ্ণ—ওটা দেশোচিত, কালোচিত এবং পুরুষোচিত। এরকম খরধার এবং সুগঠিত লেখা আর কারো হাত দিয়ে বের হবার জো নেই। [২১ ডিসেম্বর, ১৯১৮]

নীল-লোহিতের আদিপ্রেম গ্রন্থের গল্প

তোমার গল্পগুলি আর একবার পড়লুম। ইতিপূর্ব্বেও পড়েচি। ঠিক যেন তোমার সনেটেরই মত—পালিশ করা, ঝক্‌ঝকে, তীক্ষ্ণ। উজ্জ্বলতার বাতায়ন মগজের তিনতলা মহলে মধ্যাহ্নের আলো সেখানে অনাবৃত। রসাক্ত সুমিষ্টতা দোতলায়, সেখানে রসনার লোলুপতা। তোমার লেখনী সে পাড়া মাড়াতে চায় না। [২৫ আগস্ট, ১৯৩৪]

ঘোষালের হেঁয়ালি

আজকাল যেন আলো কমে এসেছে তাই পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিয়েছি, হঠাৎ বিচিত্রায় তোমার নাম দেখে তোমার লেখা গল্পটি পড়লেম। পড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে যাচ্ছিলুম। এ লেখায় তোমার সবুজপত্রী যুগের উজ্জ্বলতা দেখে খুব খুসি হয়েছি। আজকাল যে সব লেখা বেরোয় তার মাঝখানে এই আকস্মিক আগন্তুকটির চেহারা দেখে চমক লাগে, এর জাতই আলাদা। অনেকদিন চুপচাপ ছিলে, ভয় হয়েছিল তোমার আলো-ওয়ালা কলমের দীপ্তি পাছে কমে গিয়ে থাকে, দেখচি তার আশঙ্কা নেই। [১৩ ভাদ্র, ১৩৪২]

বীণাবাই

পেয়েছি ভারতবর্ষ। সাবাস্। খুব ভালো হয়েছে। অর্থাৎ তোমার শিলমোহরের ছাপ পড়েছে অতএব এর দাম কম নয়। এ ধরনের লেখা আর কারো কলমে ফুটতে পারে না। সাহিত্যে যারা জালিয়াতি করে দিন চালায় তারা হতাশ হবে। [৩ শ্রাবণ ১৩৪৪]

অণুকথা সপ্তক গ্রন্থের গল্প

তোমার ছোটো গল্প পড়ে চেকভের ছোট গল্প মনে পড়ল। যা মুখে এসেছে তাই বলে গেছ হাল্কা চালে। এতে আলবোলার ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া যায়। এ রকম কিছুই না লিখতে সাহসের দরকার করে। দেশের লোক সাহিত্যে ভুরিভোজন ভালোবাসে—তারা ভাববে ফাঁকি দিয়েছ—কিম্বা ভাববে ঠাট্টা। [১১ জুন, ১৯৩৯]

জুড়ি দৃশ্য

এবার পরিচয়ে তোমার গল্পটি পড়ে আশ্চর্য হয়ে গেছি, না লিখে থাকতে পারলুম না। বয়স হলে কলমকে বাতে ধরে, কিন্তু তোমার কলম এখনো যে রকম খাড়া চলতে পারে এমন তো আর কারো দেখিনি। এ একেবারে তোমার খাষ দখলের লেখা, আর কারো হাত দিয়ে বেরবার জো নেই।…খাঁটি জিনিস একটা আধটাই যথেষ্ট, সেই কথাটা আমাদের দেশের বদরসিকদের বোঝানো শক্ত,—কালকেতুর ব্যাধের মতো তাদের গ্রাস—মাসে মাসে মুঠো মুঠো অপথ্যর জোগান দিতে না পারলে তাদের বাহবা মিইয়ে আসবে। [৬ শ্রাবণ ১৩৪৭]

এই পত্রগুলি রবীন্দ্রনাথের ‘চিঠিপত্র’ পঞ্চম খণ্ডের অন্তর্গত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্রসঙ্গকথা

প্রসঙ্গকথা

অল্পকাল হইল বাংলাদেশের তৎসাময়িক শাসনকর্তা ম্যাকেঞ্জিসাহেবকে সভাপতির আসনে বসাইয়া মান্যবর শ্রীযুক্ত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় তাঁহার স্বপ্রতিষ্ঠিত সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের দুরবস্থা উপলক্ষে নিজের সম্বন্ধে করুণা, স্বদেশ সম্বন্ধে আক্ষেপ, এবং স্বদেশীয়দের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করিয়াছেন। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল।

তাঁহার সমস্ত বক্তৃতার মধ্যে একটা নালিশের সুর ছিল। বাদী ছিলেন তিনি, প্রতিবাদী ছিল তাঁহার অবশিষ্ট স্বজাতিবর্গ এবং জজ ও জুরি ছিল ম্যাকেঞ্জিপ্রমুখ রাজপুরুষগণ। এ বিচারে আমাদের নিরপরাধে খালাস পাইবার আশামাত্র ছিল না।

কবুল করিতেই হইবে, আমাদের অপরাধ অনেক আছে এবং সেজন্য আমরা লজ্জিত–অথবা সুগভীর অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য-বশত লজ্জাবোধও আমাদের নাই। কিন্তু সেই অপরাধখণ্ডনের ভার আমাদের দেশের বড়োলোকদের উপর। মানবসমাজের বিচারালয়ে বাঙালির নাম আসামীশ্রেণী হইতে খারিজ করিয়া লইবার জন্যই তাঁহারা জন্মিয়াছেন, সেই তাঁহাদের জীবনের সার্থকতা। নালিশ করিবার লোক ঢের আছে এবং বাঙালির নামে নালিশ শুনিবার লোকও রাজপুরুষদের মধ্যে যথেষ্ট মিলিবে।

প্রাণীদের মধ্যে মনুষ্যজাতিটা খুব শ্রেষ্ঠজাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ; তথাপি ইতিহাসের আরম্ভভাগ হইতেই দেখা যায় মনুষ্যের উপকার করা সহজ কাজ নহে। যাঁহারা ইহাকে বিপুল চেষ্টা ও সুদীর্ঘ সময়-সাধ্য বলিয়া না জানেন তাঁহারা যেন সাধারণের উপকার করার কাজটায় হঠাৎ হস্তক্ষেপ না করেন। যদি করেন তবে অবশেষে পাঁচ জনকে ডাকিয়া বিলাপ পরিতাপ ও সাধারণের প্রতি দোষারোপ করিয়া সান্ত্বনা পাইবার প্রয়াস পাইতে হইবে। তাহা দেখিতেও শোভন হয় না, তাহার ফলও নিরুৎসাহজনক, এবং তাহাতে গৌরবহানি ঘটে।

অবশ্য সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের প্রতি মহেন্দ্রবাবুর অকৃত্রিম অনুরাগ আছে এবং সেই অনুরাগের টানে তিনি অনেক করিয়াছেন। কিন্তু অনেক করিয়াছেন বলিয়া বিলাপ না করিয়া তাঁহাকে যে আরো অনেক করিতে হয় নাই সেজন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানপ্রচারের উৎসাহে কোনো মহাপুরুষ জেলে গিয়াছেন, কোনো মহাপুরুষকে অগ্নিতে দগ্ধ হইতে হইয়াছে। বড়োলোক হইয়া বড়ো কাজ করিতে গেলে এরূপ অসুবিধা ঘটিয়া থাকে।

মহেন্দ্রবাবুর অপেক্ষা অধিকতর চেষ্টা করিয়া তাঁহা অপেক্ষা অধিকতর নিষ্ফল অনেকে হইয়াছেন। ডাক্তার সরকারকে জিজ্ঞাসা করি, আজ পর্যন্ত সমস্ত বঙ্গদেশে এমন কয়টা অনুষ্ঠান আছে যে নিজের ঘর-দুয়ার ফাঁদিতে পারিয়াছে, বহুব্যয়সাধ্য আসবাব সংগ্রহ করিয়াছে, যাহার স্থায়ী অর্থের সংস্থান হইয়াছে, এবং যাহার সভাপতি দেশের ছোটোলাট বড়োলাট সাহেবকে সম্মুখে বসাইয়া নিজের মহৎ ত্যাগস্বীকার ঘোষণাপূর্বক অশ্রুপাত করিবার দুর্লভ ঐ অবসর পাইয়াছে। যতটা হইয়াছে বাঙালি তাহার জন্য ডাক্তার সরকারের নিকট কৃতজ্ঞ, কিন্তু সেজন্য তিনিও বাঙালির নিকট কতকটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে পারিতেন।

বড়োলোকেরা বড়ো কাজ করিয়া থাকেন কিন্তু তাঁহারা আলাদিনের প্রদীপ লইয়া জন্মগ্রহণ করেন না। কাজেই তাঁহারা রাতারাতি অসাধ্য সাধন করিতে পারেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের নাম ছোটোখাটো আলাদিনের প্রদীপবিশেষ। সেই প্রদীপের সাহায্যে এবং ডাক্তার সরকারের নিজের নাম ও চেষ্টার জোরে এই বিজ্ঞানচর্চাবিহীন বঙ্গদেশে অকস্মাৎ পাকা ভিত এবং যন্ত্রতন্ত্রসহ এক সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশেন উঠিয়া পড়িল। ইহাকে একপ্রকার ভেলকি বলা যাইতে পারে।

কিন্তু বাস্তবজগতে আরব্য উপন্যাস অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে না। ভেলকির জোরে জনসাধারণের মনে বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ সঞ্চার করা সম্ভব নহে। আজ প্রায় সিকি শতাব্দীকাল বাংলাদেশে বিজ্ঞানের জন্য একখানা পাকাবাড়ি, কতগুলি আসবাব এবং কিঞ্চিৎ অর্থ আছে বলিয়াই যে বিজ্ঞান আপনা-আপনি গোকুলে বাড়িয়া উঠিতে থাকিবে এমন কোনো কথা নাই। আরো আসবাব এবং আরো টাকা থাকিলেই যে বিজ্ঞান আরো ফুলিয়া উঠিবে এমনও কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম দেখা যায় না।

অবশ্য, দেশ কাল পাত্র সমস্তই ষোলো-আনা অনুকূল যদি হয় তবে তাহার মতো সুখের বিষয় আর কিছুই হইতে পারে না। কিন্তু সর্বত্রই প্রায় কোনো-না কোনোটার সম্বন্ধে টানাটানি থাকেই; আমাদের এ দরিদ্র দেশে তো আগাগোড়াই টানাটানি। অন্তত বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের যেমন দেশ, তেমনই কাল, তেমনই পাত্র! এখানে সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশন নামক একটা কল জুড়িয়া দিলেই যে বিজ্ঞান একদমে বাঁশি বাজাইয়া রেলগাড়ির মতো ছুটিতে থাকিবে, অত্যন্ত অন্ধ অনুরাগও এরূপ দুরাশা পোষণ করিতে পারে না। গাড়ি চলে না বলিয়া দেশাধিপতির নিকট দেশের নামে নালিশ রুজু না করিয়া আপাতত রাস্তা বানাইতে শুরু করা কর্তব্য।

রাস্তা বানাইতে গেলে নামিয়া আসিয়া একেবারে মাটিতে হাত লাগাইতে হয়। আমাদের দেশের বড়োলোকদের নিকটে সে-প্রস্তাব করিতে সংকোচ বোধ করি, কিন্তু অগত্যা না করিয়া থাকা যায় না। বিজ্ঞান যাহাতে দেশের সর্বসাধারণের নিকট সুগম হয় সে-উপায় অবলম্বন করিতে হইলে একেবারে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার গোড়াপত্তন করিয়া দিতে হয়। সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশন যদি গত পঁচিশ বৎসর এই কার্যে যত্নশীল হইতেন তবে যে-ফললাভ করিতেন তাহা রাজপুরুষবর্গের সমুচ্চ প্রাসাদবাতায়ন হইতে দৃষ্টিগোচর না হইলেও আমাদের এই বিজ্ঞানদীন দেশের পক্ষে অত্যন্ত মহার্ঘ হইত।

নালিশ এই যে, বিজ্ঞানসভা দেশের জনসাধারণের নিকট হইতে উপযুক্তমত খোরাকি এবং আদর পায় না। কেমন করিয়া পাইবে। যাহারা বিজ্ঞানের মর্যাদা বোঝে না তাহারা বিজ্ঞানের জন্য টাকা দিবে, এমন অলৌকিক সম্ভাবনার পথ চাহিয়া বসিয়া থাকা নিষ্ফল। আপাতত মাতৃভাষার সাহায্যে সমস্ত বাংলাদেশকে বিজ্ঞানচর্চায় দীক্ষিত করা আবশ্যক, তাহা হইলেই বিজ্ঞানসভা সার্থক হইবে এবং সফলতা মৃগতৃষ্ণিকার ন্যায় দিগন্তে বিলীন হইবে না।

পূর্বকালে ভারতবর্ষে কেবল ব্রাহ্মণদের জ্ঞানানুশীলনের অধিকার ছিল। ব্রহ্মণ্যের উচ্চ আদর্শ সেই কারণেই ক্রমে ম্লান এবং বিকৃত হইয়া যায়। ক্রমে কর্ম নিরর্থক, ধর্ম পুঁথিগত, এবং পুঁথিও মুখস্থবিদ্যায় পরিণত হইয়া আসিতেছিল। ইহার কারণ, নিম্নের মাধ্যাকর্ষণশক্তি অত্যন্ত প্রবল। যেখানে চতুর্দিক অনুন্নত সেখানে সংকীর্ণ উন্নতিকে দীর্ঘকাল রক্ষা করা দুঃসাধ্য। অদ্য ব্রাহ্মণ নামমাত্র ব্রাহ্মণ, তাহার তিন দিনের উপনয়ন ব্রহ্মচর্যের বিদ্রূপমাত্র, তাহার মন্ত্রার্থজ্ঞানহীন সংস্কার বর্বরতা। তাহার কারণ, অশিক্ষিত বিপুলবিস্তৃত শূদ্রসম্প্রদায় আপন দূরব্যাপী প্রকাণ্ড মূঢ়তার গুরুভারে ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মণ্যের উচ্চশিরকে ধূলিসাৎ করিয়া জয়ী হইয়াছে।

অদ্য ইংরেজিশিক্ষিতগণ কিয়ৎপরিমাণে সেই ব্রাহ্মণদের স্থান অধিকার করিয়াছেন। সাধারণের কাছে ইংরেজিভাষা বেদের মন্ত্র অপেক্ষা সরল নহে। এবং অধিকাংশ জ্ঞানবিজ্ঞান ইংরেজিভাষার কড়া পাহারার মধ্যে আবদ্ধ।

তাহার ফল এই, বিদ্যালয়ে আমরা যাহা লাভ করি সমাজে তাহার কোনো চর্চা নাই। সুতরাং আমাদের বিদ্যা আমাদের প্রাণের সহিত রক্তের সহিত মিশ্রিত হয় না। বিদ্যার প্রধান গৌরব দাঁড়াইয়াছে অর্থোপার্জনের উপায়রূপে।

সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশন সেই স্বল্পসংখ্যক আধুনিক ব্রাহ্মণস্থানীয়দের জন্য আপন শক্তি নিয়োগ করিয়াছে। যে-কয়জনা ইংরেজিতে বিজ্ঞান শেখে সভা তাহাদের নিকট ইংরেজিভাষায় বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে; বাকি সমস্ত বাঙালির সহিত তাহার কিছুমাত্র সংস্রব নাই। অথচ সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের জন্য বাঙালি বিশেষ উদ্যোগী হইতেছে না, এ আক্ষেপ তাহার উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে।

বিজ্ঞানচর্চার দ্বারা জিজ্ঞাসাবৃত্তির উদ্রেক, পরীক্ষণশক্তির সূক্ষ্মতা এবং চিন্তনক্রিয়ার যাথাতথ্য জন্মে এবং সেইসঙ্গে সর্বপ্রকার ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত ও অন্ধ সংস্কার সূর্যোদয়ে কুয়াশার মতো দেখিতে দেখিতে দূর হইয়া যায়। কিন্তু আমরা বারংবার দেখিয়াছি আমাদের দেশের ইংরেজিশিক্ষিত বিজ্ঞানঘেঁষা ছাত্রেরাও কালক্রমে তাঁহাদের সমস্ত বৈজ্ঞানিক কায়দা ঢিলা দিয়া অযৌক্তিক সংস্কারের হস্তে আত্মসমর্পণপূর্বক বিশ্রামলাভ করেন। যেমন পাথুরে জমির উপর আধহাতখানেক পুষ্করিণীর পাঁক তুলিয়া দিয়া তাহাতে বৃক্ষ রোপণ করিলে গাছটা প্রথম প্রথম খুব ঝাড়িয়া মাথা তুলিয়া ডালেপালায় গজাইয়া উঠে, অবশেষে শিকড় যেমনি নীচের কঠিন স্তরে গিয়া ঠেকে অমনি অকস্মাৎ মুষড়িয়া মরিয়া যায়– আমাদের দেশের বিজ্ঞানশিক্ষারও সেই অবস্থা।

ঘরে-বাইরে চারি দিকে বিজ্ঞানের আলোককে সাধারণভাবে পরিব্যাপ্ত করিয়া দিলে তবেই বিশেষভাবে বিজ্ঞানের চর্চা এ দেশে স্থায়ীরূপে বর্ধিত হইতে পারিবে। নতুবা আপাতত দুইদিনের উন্নতি দেখিয়া অত্যন্ত উৎফুল্ল হইবার কারণ নাই– কেননা, চারি দিকের দিগন্তপ্রসারিত মূঢ়তা দিনে নিশীথে অলক্ষ্যভাবে আকর্ষণ করিয়া সংকীর্ণমূল উচ্চতাকে আপনার সহিত সমভূম করিয়া আনিবে। ভারতবর্ষীয় প্রাচীন জ্ঞানবিজ্ঞানের অধোগতির প্রধান কারণ এই ভিত্তির সংকীর্ণতা, ব্যাপ্তির অভাব, একাংশের সহিত অপরাংশের গুরুতর অসাম্য।

অথচ বাংলাভাষায় ইংরেজি-অনভিজ্ঞদের কাছে বিজ্ঞানপ্রচারের কোনো উপায় এ দেশে নাই। ইহা ব্যয়সাধ্য, চেষ্টাসাধ্য, ইহাতে আশু ফললাভের আশাও নাই– কোনো ব্যক্তিবিশেষের একান্ত উৎসাহ রক্ষার উপযোগী কোনো উত্তেজনা ইহাতে দেখা যায় না। ইহাতে অর্থনাশ ছাড়া অর্থাগমেরও সম্ভাবনা অল্প। বাংলাভাষায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা রচনা করাও অনেক চিন্তা ও চেষ্টার কাজ– বিজ্ঞানের যাথাতথ্য রক্ষাপূর্বক তাহাকে জনসাধারণের বুদ্ধিগম্য করিয়া সরলভাষায় প্রকাশ করাও শক্ত।

অতএব যেমন করিয়াই দেখি সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের ন্যায় সামর্থ্যশালী বিশেষ সভার দ্বারাই এই কার্য সম্ভবপর বোধ হয়। ইংরেজিতে বিজ্ঞান শিখাইবার জন্য অনেক ইস্কুল কলেজ আছে, তাহার গ্রন্থ ও আচার্যের অভাব নাই। এমন-কি, যাঁহারা ইংরেজিতে বিজ্ঞানশিক্ষা সমাধা করিতে চান তাঁহারা বিলাতে গিয়াও কৃতিত্ব লাভ করিতে পারেন। ডাক্তার জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু নানা কারণে ইংরেজিশিক্ষায় বঞ্চিত আমাদের অধিকাংশ, আমাদের সর্বসাধারণ, আমাদের প্রকৃত দেশ সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের দ্বারাও উপেক্ষিত; অথচ এমনই দৈব বিড়ম্বনা, সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশন সেই দেশের নামে অবহেলার অভিযোগ আনিয়াছেন।

বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ বাংলার বৈজ্ঞানিক পরিভাষাসংকলনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের উদ্দেশ্য নানা শাখায় বিভক্ত হওয়ায় কার্য যথোচিতরূপে অগ্রসর হইতেছে না। এই কার্যে সাহিত্যপরিষদের সহিত সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের যোগ দেওয়া কর্তব্য। বাংলায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ প্রচার, সাময়িক পত্র প্রকাশ, স্থানে স্থানে যথানিয়মে বক্তৃতা দিবার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। নিজের উপযোগিতা উপকারিতা সর্বতোভাবে প্রমাণ করা আবশ্যক। তবেই দেশের সহিত সভার দান-প্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হইবে, কেবলমাত্র বিলাপের দ্বারা তাহা হইতে পারে না। এমন-কি, রাজপ্রতিনিধির মধ্যস্থতা দ্বারাও বেশিকিছু হইবে না। রাজা সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশনের অর্থাগমের সুযোগ করিয়া দিতে পারেন, কিন্তু তাহাকে সফল করিতে পারেন না।

যাহাই হোক, সায়ান্সঅ্যাসোসিয়েশন যদি যথার্থ পথে কাজ করিতে অগ্রসর হন তবে তাঁহার র্ভৎসনা সহিতে আমরা প্রস্তুত আছি; কিন্তু কাজও করিবেন না, চোখও রাঙাইবেন, দেশকে দূরে রাখিবেন অথচ সাহেবকে ডাকিয়া দেশের নামে নালিশ করিবেন, ইহার অপরূপ সৌন্দর্যটুকু আমরা দেখিতে পাই না।

বর্তমানসংখ্যক “ভারতী’তে “ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ’ নামক ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি যিনি লিখিয়াছেন, তিনি আধুনিক বাঙালি ইতিহাস-লেখকগণের শীর্ষস্থানীয়। তাঁহার প্রস্তাবটির প্রতি পাঠকগণ মনোযোগ করিবেন।

ইতিহাসের সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা বড়ো কঠিন। কথা সজীব পদার্থের মতো বাড়িয়া চলে; মুখে মুখে কালে কালে তাহার পরিবর্তন ঘটিতে থাকে। সৃজনশক্তি মানুষের মনের স্বাভাবিক শক্তি– যে-কোনো ঘটনা, যে-কোনো কথা তাহার হস্তগত হয় তাহাকে সে অবিকৃত রাখিতে পারে না, কতকটা নিজের ছাঁচে ঢালিয়া তাহাকে গড়িয়া লয়। এইজন্য আমরা প্রত্যহই একটি ঘটনার নানা পাঠান্তর নানা লোকের নিকট পাইয়া থাকি।

কেহ কেহ এইরূপ প্রত্যহিক ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখাইয়া ইতিহাসের সত্যতা সম্বন্ধে আগাগোড়া সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু একটি কথা তাঁহারা ভুলিয়া যান, ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরণে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায়। তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে।

অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না, লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সেও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মানবমন মিশ্রিত হইয়া যে-পদার্থ উদ্ভূত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরণই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়।

এই বিচিত্র জনশ্রুতি এবং জীর্ণ-উপকরণমূলক ইতিহাসে এমন অনেকটা অংশই থাকে যাহার প্রমাণ অপ্রমাণ ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। দুই সাক্ষীর মধ্যে কোন্‌ সাক্ষীকে বিশ্বাস করিব তাহা অনেক সময়ে কেবলমাত্র বিচারকের স্বভাব ও পূর্বসংস্কারের দ্বারা স্থিরীকৃত হয়। ইংরেজ মিথ্যা বলে না, ইংরেজ জজ ইহা কতকটা স্বভাবত এবং কতকটা টানিয়াও বিশ্বাস করেন; এই প্রবৃত্তি ও বিশ্বাস-বশত তাঁহারা অন্যদেশীয়দের প্রতি অনেক সময়ে অবিচার করিয়া থাকেন, তাহা ইংরেজ ব্যতীত আর-সকলেই অনুভব করিতে পারেন।

ইতিহাসে এইপ্রকার ব্যক্তিগত সংস্কারের লীলা যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন এই কথা সহজেই মনে উদয় হয়, আমরা ক্রমাগত বিদেশীয় ঐতিহাসিকের বিজাতীয় সংস্কারের দ্বারা গঠিত ইতিহাসপাঠে পীড়ন কেন সহ্য করিব। আমরা যে-ইতিহাস সংকলন করিব, তাহাও যে বিশুদ্ধ সত্য হইবে এ আশা করি না; কিন্তু ইতিহাসের যে-অংশ প্রমাণ অপেক্ষা ঐতিহাসিকের মানসিক প্রকৃতির উপর বেশি নির্ভর করে, সে-অংশে আমাদের স্বজাতীয় প্রকৃতির সৃজনকর্তৃত্ব আমরা দেখিতে চাই।

তাহা ছাড়া ইতিহাস একতরফা না হইয়া দুইতরফা হইলে সত্যনির্ণয় সহজ হয়। বিদেশী ঐতিহাসিক এক ভাবে সাক্ষী সাজাইবেন এবং স্বদেশী ঐতিহাসিক অন্য ভাবে সাক্ষী সাজাইবেন, তাহাতে নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের কাজের সুবিধা হয়।

যাহা হউক, বিদেশীলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসকে বিনা প্রশ্নে বিচারে গ্রহণ ও মুখস্থ করিয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া আমাদের গৌরবের বিষয় হইতেছে না। কোনো ইতিহাসই কোনোকালে প্রশ্ন ও বিচারের অতীত হইতে পারে না। য়ুরোপীয় ইতিহাসেও ভুরি ভুরি চিরপ্রচলিত দৃঢ়নিবদ্ধ বিশ্বাস নব নব সমালোচনার দ্বারা তিরস্কৃত হইতেছে। আমাদের দেশীয় ইতিহাস হইতে মিথ্যা বাছিতে গেলে তাহার উজাড় হইবার সম্ভাবনা আশঙ্কা করি।

লেখকমহাশয় আমাদের দেশীয় ইতিহাস সমালোচন ও সংকলনের জন্য একটি ঐতিহাসিক সভা স্থাপনের প্রস্তাব করিয়াছেন।

আমাদের দেশে সভাস্থাপনের প্রতি আমাদের বড়ো-একটা বিশ্বাস নাই। লেখকমহাশয় তাঁহার প্রবন্ধে আমাদের দেশের মাটিতে শিব গড়িতে গিয়া কিরূপ লজ্জা পাইতে হয়, তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। সভা নামক বড়ো শিব গড়িতে গিয়া আরো কি বড়ো প্রহসনের সম্ভাবনা নাই।

যে দেশে কোনো-একটি বিশেষ বিষয়ে অনেকগুলি লেখকের সুদৃঢ় উৎসাহ আছে, সেই দেশে উৎসাহী লোকেরা একত্র হইয়া বৃহৎ কার্য সম্পন্ন করিতে পারেন। যে দেশে উৎসাহী লোক স্বল্প সে দেশে সভা করিতে গেলে ঠিক বিপরীত ফল ফলিবার সম্ভাবনা। কারণ, সে সভায় অধিকাংশ বাজে লোক জুটিয়া উৎসাহী লোকের উদ্যম খর্ব করিয়া দেয় মাত্র।

আমরা লেখকমহাশয় ও তাঁহার দুই-চারিজন সহযোগীর স্বতন্ত্র চেষ্টার প্রতিই লক্ষ করিয়া আছি। তাঁহারা নিজেদের উৎসাহের উদ্যমে ভুলিয়া যাইতেছেন যে, দেশের লোকের অধিকাংশের মনে এ-সকল বিষয়ে অকৃত্রিম অনুরাগ নাই। অতএব তাঁহারা প্রথমে নিজের রচনা ও দৃষ্টান্তদ্বারা দেশে ইতিহাসানুরাগ বিস্তার করিয়া দিলে যথাসময়ে সভাস্থাপনের সময় হইবে।

সমবেত চেষ্টার জন্য উৎসাহী অনুরাগী লোকমাত্রেরই মন কাঁদে। মানুষ কাজ করিবার যন্ত্র নহে– অন্য পাঁচজন মানুষের সহিত মিশিয়া পাঁচজনের সহানুভূতি, সমাদর ও উৎসাহ -দ্বারা বললাভ প্রাণলাভ করিতে হয়; জনহীন শূন্য সভায় একা দাঁড়াইয়া কেবলমাত্র কর্তব্য করিয়া যাওয়া বড়ো কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশে যাঁহারা কোনো মহৎ কার্যের ভার লইবেন, লোকসঙ্গ লোকসাহায্যের সুখ তাঁহাদের অদৃষ্টে নাই।

বিনা আড়ম্বরে বিনা ঘোষণায় “ঐতিহাসিক চিত্রাবলী’ নামক যে কয়েকটি মূল্যবান ইতিহাসগ্রন্থ বাংলায় বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে তাহাই আমাদের বিপুল আশার কারণ। যাঁহারা “সিরাজদৌল্লা” গ্রন্থখানি পাঠ করিয়াছেন তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন, সভার দ্বারা তেমন কাজ হয় না প্রতিভার দ্বারা যেমন হয়।

১৩০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *