বীরপুরুষের লাঞ্ছনা

বীরপুরুষের লাঞ্ছনা

স্ত্রীজাতিকে আমরা অবলা বলি, কারণ আমাদের দৃঢ় ধারণা যে বল জিনিসটে পুরুষদের একচেটে। কিন্তু এই অবলাদের হাতে পুরুষজাতিকে কত অবস্থায় কত রকমে লাঞ্ছিত হতে হয় তা আমরা সকলেই জানি—নিজের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে নয়, কিন্তু নাটক-নভেল পড়ার ফলে। আমরা যাকে উঁচুদরের কাব্য বলি তার ভিতরকার কথা হচ্ছে নারী। নারী বাদ দিয়ে ট্রাজেডিও হয় না কমেডিও হয় না।

স্ত্রী-কর্তৃক পুরুষনিগ্রহের অনেক মর্মভেদী কথা সংস্কৃত কবিদের মুখেও শুনেছি, Strindberg এর বইয়েও পড়েছি; কিন্তু আমি স্বচক্ষে যে বুকভাঙা ব্যাপার দেখেছি তার তুল্য স্ত্রী-কর্তৃক পুরুষনিগ্রহের বিবরণ বিশ্বসাহিত্যে নেই।

এ ব্যাপার ঘটেছিল বিলেতে, আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে। আমি সে দেশে থাকাকালীন এ দেশ থেকে একটি যুবক ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য ইংলণ্ডে গিয়ে উপস্থিত হলেন। অত বলিষ্ঠ অত সুপুরুষ যুবক আমাদের মধ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না। আমরা আর-পাঁচজন ছিলুম এগ্‌জামিন পাস-করা বঙ্গযুবক, অতএব বলা বাহুল্য কেউ আমাদের দেখে রাজপুত্র বলে ভুল করত না। অপর পক্ষে এই নব আগন্তুকটিকে সকলেই রাজপুত্র বলে ভুল করত। তাঁর শরীর ছিল যেমন সুঠাম তেমনি বলিষ্ঠ, আর তাঁর মুখটি ছিল কুঁদে কাটা। টেনিস খেলতে, ঘোড়ায় চড়তে, দাঁড় টানতে তাঁর জুড়ি বিলাতপ্রবাসী ভারত,বাসীদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না। তিনি বাঙালি হলেও, কোনো পাঞ্জাবি কি কাশ্মীরি যুবক রূপে-বলে তাঁর সমকক্ষ ছিল না। যাঁরা তাঁর চাইতে বলিষ্ঠ ছিলেন তাঁরা কদাকার, আর যাঁরা তাঁর চাইতে সুন্দর ছিলেন তাঁরা নেহাত মেয়েলি। একমাত্র তাঁর শরীরেই বল ও রূপের রাসায়নিক যোগ হয়েছিল।

আমি চিরকালই রূপ ও শক্তির বিশেষ ভক্ত। কাজেই আমি দুদিনেই তাঁর একটি ভক্ত বন্ধু হয়ে উঠলুম। সত্য কথা বলতে গেলে আমার চেয়ে তাঁর বড়ো বন্ধু বিলেতে আর কেউ ছিল না। তাঁর আর-একটি মহা গুণ ছিল। তিনি যে কত সুপুরুষ আর কত বীরপুরুষ সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞান ছিলেন। তিনি জীবনে কখনো এক ফোঁটা মদ খান নি, এক টান সিগারেট টানেন নি। কারণ ডাক্তারদের মুখে শুনেছিলেন যে মদ ও তামাক শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।

এ জাতীয় পুরুষদের পক্ষে স্ত্রীজাতির হৃদয় জয় করবার ইচ্ছা অতি স্বাভাবিক। তিনিও তাই মনে ভাবতেন যে, তিনিও বিলাতে এসেছেন শুধু সে ভূ-ভাগের স্ত্রীরাজ্য জয় করতে। তাঁর কথা শুনে মনে হত যে তিনি এ বিষয়ে একজন দ্বিতীয় জুলিয়াস সিজার। অর্থাৎ স্ত্রীহৃদয় জয় করতে তাঁকে কোনোরূপ চেষ্টা করতে হত না, কোনোরূপ আয়াস পেতে হত না— আগাগোড়া ছিল Veni Vedi Veciর ব্যাপার। অর্থাৎ যে স্ত্রীলোকের প্রতি তিনি একবার দৃষ্টিপাত করতেন, তার গলাতেই তিনি শিকল গছাতেন।

বন্ধুবরের ইংলণ্ডের নারীরাজ্য জয়ের কাহিনী কতদূর সত্য তা বলা অসম্ভব। সম্ভবত সে বিবরণের অনেক অংশ কাল্পনিক। বীরপুরুষের আত্ম কথা প্রায়ই অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে। আলেকজাণ্ডার দুঃখ করে বলেছিলেন যে, পৃথিবীতে জয় করবার মতো দেশ আর অবশিষ্ট নেই। কথাটা যে অত্যুক্তি সে বিষয়ে তো আর সন্দেহ নেই। তাই বলে তিনি যে একজন বীরপুরুষ ছিলেন এবং নানাদেশ জয় করেছিলেন একথা তো কেউ অস্বীকার করে না। সুতরাং বন্ধুবর যে গণ্ডা গণ্ডা Duchess-Countess দের প্রণয় – ডোরে শৃঙ্খলিত করেছিলেন, সে কথা না মানলেও আমি মানতে বাধ্য যে বিলেতের দাসী-চাকরানীরা তাঁকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠত। এ ঘটনা আমার চোখে দেখা। ‘দাসী- চাকরানী’ শুনে নাক সিঁটকাবেন না। মনে রাখবেন, তারাও স্ত্রীলোক আর তাদের অন্তরে ও স্ত্রীলোকের হৃদয় আছে। আর তাদের হৃদয়ও এক নজরে কেড়ে নেওয়া কম কৃতিত্বের পরিচায়ক নয়। বন্ধুবর পদমর্যাদা দেখে প্রণয় করতেন না, স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তাঁর সর্বভূতে সমদৃষ্টি ছিল। এ কথাটা বলে রাখা দরকার নচেৎ বন্ধুবরের লাঞ্ছনার ইতিহাসটি শুনে আপনারা মনে করতে পারেন যে তাঁর রুচি ছিল ইতর।

এ দেশের মতো বিলেতেও মেলা হয়। বিলেতের কোনো এক পাড়াগেঁয়ে শহরে তাঁর সঙ্গে আমি একবার একটি মেলা দেখতে যাই। গিয়ে দেখি সেখানে একটিও ভদ্রসন্তান নেই, আছে শুধু ছোটোলোকের ছেলে-মেয়েরা। ব্যাপার দেখে আমি সেখান থেকে অবনতিবিলম্বে সরে পড়তে চেয়েছিলুম, কিন্তু বন্ধুবর তাতে কিছুতেই রাজি হলেন না। অত নারীসমাগম দেখে তাঁর বিজয়পিপাসা এতটা প্রবল হয়েছিল যে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা আমার শক্তিতে কুলোলা না।

মেলা এ দেশে যেমন হয়ে থাকে, দেখলুম, বিলেতেও প্রায় সেইরকমই হয়। দেদার ছোটোখোটো তাঁবু খাটিয়ে লোকে সব মণিহারীর দোকান পেতে বসে আছে; চার দিকে দেদার লোকের ভিড় ও ঠেলাঠেলি। ইতর শ্রেণী যুবকরা পরস্পর চীৎকার করছে, কখনো-বা রঙ্গ ক’রে শেয়াল-কুকুর ডাকছে ও সেই শ্রেণীর যুবতীরা খিল্‌ খিল্‌ করে হাসছে আর এ ওর গায়ে হেসে ঢলে পড়ছে। আমাদের মেলার সঙ্গে বিলেতি মেলার প্রভেদ এই যে, বিলেতে হাসাহাসি দৌড়াদৌড়ির মাত্রাটা একটু বেশি, কেননা সে দেশের লোকেরা আমাদের চাইতে একটু বেশি জীবন্ত। সে যাই হোক, অত ইতর লোকেরা সংঘর্ষটা আমার পক্ষে তেমন আরামজনক হয় নি। তাই আমি একটা নাগরদোলার কাছে এসে দাঁড়ালুম। অবশ্য সে দোলায় চড়বার আমার প্রবৃত্তি হয় নি, ইতর জাতের সঙ্গী-সঙ্গিনীদের সঙ্গে একযোগে উৎসব করার অভ্যাস আমার ছিল না বলে। খানিকক্ষণ পরে দেখি বন্ধুবর লাফিয়ে গিয়ে নাগরদোলার এক চেয়ারে চড়ে বসলেন। তার পর লক্ষ্য করি তার পাশের চেয়ারে একটি যুবতী বসে আছেন, আর তার মাথায় একটা রুমাল বাঁধা, আর হাতে একগাছি চাবুক। এ যে কোন্ শ্রেণীর স্ত্রীলোক তা আমি ঠাওর করতে পারলুম না। মেয়েটি দেখতে ভদ্রমহিলার মতো, কিন্তু বিলেতের কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষে মাথায় রেশমের ফ্যাটা বেঁধে হাতে ঘোড়ার চাবুক নিয়ে এরকম জায়গায় উপস্থিত হওয়া অসম্ভব। মনে করলুম, হয়তো কোনো ভদ্রমহিলা এই অদ্ভুত বেশ ধারণ করে গোপনে মেলা দেখতে এসেছেন এইজন্য যে কেউ তাকে চিনতে না পারে।

বন্ধুবরের দু মিনিটের মধ্যে উক্ত মহিলাটির সঙ্গে গলাগলি ভাব হয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তিনি ও তাঁর সঙ্গিনী নাগরদোলায় দুললেন। আর এই আধঘণ্টা ধরে দুজনে শুধু ফিস্ফিস করে কথা বলছিলেন আর মৃদুমন্দ হাস্য করছিলেন। নাগরদোলা থেকে নেমে তাঁরা দুজন সটান একটি খাবার দোকানে গিয়ে ঢুকলেন এবং তার পর সেখান থেকে ভূরিভোজন করে বেরিয়ে এলেন। অবশ্য খরচ সব বন্ধুবরের। ইতিমধ্যে দেখি তাঁদের বন্ধুত্ব খুব জমে গিয়েছে। কারণ এবার তাঁরা দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মতো হাত-ধরাধরি করে বেড়াচ্ছেন। আমি অবশ্য দূর থেকেই তাঁদের love-making দেখছিলুম। হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়ল। দেখি, বন্ধুবর শূন্য মার্গে দুবার ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে চিৎ হয়ে পড়লেন। অমনি তাঁর চারপাশে দেদার লোক জমে গেল। আমি ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি যে বন্ধুবর তখনো ভূমি-শয্যায় পড়ে রয়েছেন। আর উক্ত মহিলাটি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বন্ধুবরকে তুলতে যাচ্ছি দেখে ইংরাজ যুবতী আমাকে বললেন যে তুমি পারবে না, তোমার বন্ধু বেজায় ভারী, আমি একে তুলছি। এই বলে তিনি বন্ধুবরকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালেন, তারপর তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। সেই আলিঙ্গনের অব্যবহিত পরে দেখি বন্ধুবর আবার শূন্য মার্গে উড্ডীন হয়েছেন। তার এক মুহূর্ত পরে বন্ধুবর আবার ডিগবাজি খেয়ে মাটির উপড় পড়লেন; এবার মুখ থুবড়ে। আর রমণীটি এক লম্ফে গিয়ে তাঁর পিঠে আসোয়ার হয়ে তাঁকে চাবুক দিয়ে বেদম পিটতে লাগলেন। আমি ছুটে গিয়ে রমণীটিকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করলুম। সে উত্তরে বললে যে, তোমার বন্ধুটি আমাকে ঘোড়ায় চড়তে শেখাতে চেয়েছে, তাই আমি প্রথমে তার পিঠে চড়েই ঘোড়ায় চড়তে শিখছি। আর ঘোড়া চলছে না বলেই তার উপর চাবুক চালাচ্ছি।

অনেক কাকুতি-মিনতি ক’রে বন্ধুবরের পিঠ থেকে সোয়ার নামালুম। আর, পাঁচজন ধরাধরি করে তাঁকে খাড়া করলুম। দেখলুম, বন্ধুবরের হাত-পা কিছুই ভাঙে নি, শুধু পড়ার shock এ তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন।

তাঁর এই অবস্থা দেখে রমণীটি আমাকে অতি ভদ্রভাবে বললে যে, “যদি তোমার বন্ধুটি আমাকে না বলতেন যে তাঁর মতো কুস্তিগীর ও তাঁর মতো ঘোড়সোয়ার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই তা হলে তাঁকে আর এই প্রকাশ্য লাঞ্ছনা সহ্য করতে হত না। তিনি যে কত বড়ো কুস্তিগীর তার পরিচয় তো তোমরা পেয়েছ। আমার সঙ্গে বাঁও কসতে গিয়েই তিনি দুবার দুবার শূন্যে ডিগবাজি খেয়েছেন। আর ঘোড়ায় চড়া কাকে বলে তা তোমাদের দেখাচ্ছি।

এই বলে তিনি গিয়ে ঘোড়ার দোলার একটি কাঠের ঘোড়ার পিঠে গিয়ে চড়ে বসলেন। তারপর সে দোলা যখন বোঁ বোঁ শব্দে ঘুরতে লাগল তখন দেখি তিনি তার উপর সোজা দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর তিনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার উপর নৃত্য করতে লাগলেন, তার পর আকাশে লাফিয়ে উঠে জোড়া ডিগবাজি খেয়ে সেই ভ্রাম্যমান কাঠের অশ্বপৃষ্ঠে এসে দাঁড়ালেন। দর্শকবৃন্দ আনন্দে চীৎকার করতে ও সজোরে করতালি দিতে লাগল।

বন্ধুবর অবাক হয়ে হাঁ করে এই ব্যাপার দেখতে লাগলেন। ব্যাপার তিনি কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। এমন সময়ে পাশের একটি লোক বন্ধুবরকে বললেন, মেয়েটিকে চেনেন না? ও যে বিলেতের একটি প্রসিদ্ধ circus girl!

স্ত্রীলোক-কর্তৃক পুরুষনিগ্রহের এর চাইতে বড়ো ট্রাজেডি কেউ কখনো দেখেছেন না শুনেছেন?

কার্তিক ১৩৩১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *