নীল-লোহিতের স্বয়ম্বর

নীল-লোহিতের স্বয়ম্বর

আদিপর্ব

সেদিন রূপেন্দ্র আমাদের নবতর-জীবন সমিতিতে মহা বক্তৃতা করছিলেন—এই কথা সকলকে বোঝাবার জন্য যে, আমাদের দেশের মামুলি বিবাহপ্রথার বদলে স্বয়ম্বরপ্রথা না চালালে আমরা জাতিগঠন কিছুতেই করতে পারব না।

রূপেন্দ্রের এ বিষয়ে এত উৎসাহ হবার কারণ—প্রথমত তাঁর বাপ-মা তাঁর জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন, দ্বিতীয়ত তিনি দুদিন আগে রঘুবংশের ষষ্ঠ সর্গ পড়েছিলেন, আর তৃতীয়ত তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যথার্থই রূপেন্দ্র, অর্থাৎ অসাধারণ সুপুরুষ। আর আমরা যে ঘণ্টাখানেক ধরে তার বক্তৃতা একমনে শুনছিলুম, তার কারণ, আমরা সকলেই ছিলুম অবিবাহিত অথচ বিবাহযোগ্য। কাজেই এ আলোচনায় আমরা সকলেই মনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলুম, চুপ করেছিলেন শুধু নীল-লোহিত। তাই রসিকলাল তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হে, তুমি কোনো কথা কইছ না কেন? রূপেন্দ্রের প্রস্তাবে তোমার মৌন কি সম্মতির লক্ষণ নাকি?” নীল-লোহিত কিঞ্চিৎ বিরক্তির স্বরে বলেন, “যা হয় তা হওয়া উচিত, এরকম nonsensical কথার উপর আর কি বলব?” এ কথা শুনে আমরা সকলেই কান খাড়া করলুম, কেননা বুঝলুম এইবার নীল-লোহিতের কেচ্ছা শুরু হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “বাঙলার মেয়েরা আজও স্বয়ম্বরা হয় নাকি?” নীল- লোহিত বললেন, “আলবৎ।” আমি আবার প্রশ্ন করলুম, “তুমি কি করে জানলে?” নীল-লোহিত বললেন, “জানলুম কি করে? বই কি কাগজ পড়ে নয়, শুঁড়ির দোকান কিম্বা গুলির আড্ডায় পরের মুখে শুনেও নয়—নিজের চোখে দেখে।”

“চোখে দেখে!”

“হাঁ, চোখে দেখে। আমি একটি জাঁকালো স্বয়ম্বর-সভায় সশরীরে উপস্থিত ছিলুম, আর আমার চোখ বলে যে একটা জিনিস আছে, তা তো তোমরা সকলেই জান।”

ব্যাপারটা কি হয়েছিল শোনবার জন্য আমরা বিশেষ কৌতূহল প্রকাশ করাতে নীল-লোহিত তাঁর বর্ণনা শুরু করলেন-

আমি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই একখানি চিঠি পাই, অক্ষরের ছাঁদ দেখে মনে হল মেয়ের লেখা। তার প্রতি অক্ষরটি যেন ছাপার অক্ষর, আর সেগুলি সাজানো হয়েছে সব সরল রেখায়। লেখা দেখে মনে হল পূর্ব-পরিচিত, কিন্তু কোথায় এ লেখা দেখেছি, তা মনে করতে পারলুম না। শেষটায় চিঠিখানি খুলে যা পড়লুম, তাতে অবাক হয়ে গেলুম। চিঠিখানি এই—

“আপনি জানেন যে বাবা হচ্ছেন সেই জাতীয় লোক, আপনারা যাকে বলেন idealist। একটা idea তাঁর মাথায় ঢুকলে সেটিকে কার্যে পরিণত না করে তিনি থামেন না। আর অপর কেউ তাঁকে থামাতে পারে না, কারণ তাঁর পয়সা আছে, আর সে পয়সা তিনি অকাতরে অপব্যয় করেন। বড়ো-মানুষের খোশ-খেয়ালও তো একরকম idealist।

“বাবা যেদিন থেকে পৈতা নিয়ে ক্ষত্রিয় হয়েছেন, সেদিন থেকেই তিনি যথাসাধ্য শাস্ত্রানুমোদিত ক্ষাত্রধর্মের চর্চা করছেন। অতঃপর তিনি মনস্থির করেছেন যে, আমাকে এবার স্বয়ম্বরা হতে হবে। আমাদের বাড়িতে আগামী মাঘী পূর্ণিমায় স্বয়ম্বর-সভা বসবে। আপনি যদি সে সভায় উপস্থিত হন—অবশ্য নিমন্ত্রিত হিসেবে নয়, দর্শক হিসেবে-তো খুশি হই। এরকম অপূর্ব নাটক আপনি কলকাতায় কোনো থিয়েটারেও দেখতে পাবেন না। অবশ্য আপনাকে ছদ্মবেশে আসতে হবে। কি করে কি করতে হবে সে-সব মেজদা আপনাকে জানাবেন।

ইতি

মালা।”

.

চিঠি পড়েই বুঝলুম যে এ মালশ্রীর চিঠি।

আমাদের ভিতর কে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, “মহিলাটি কে, মাদ্রাজী না মারাঠী?” নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “চিঠি শুনে কি মনে হল যে, ও চিঠি কোনো কাছা-কোঁচা-দেওয়া মেয়ের হাত থেকে বেরোতে পারে? দুপাতা ইংরেজি পড়ে মাতৃভাষাও ভুলে গিয়েছ নাকি?”

“না, তা ভুলি নি। কিন্তু কোনো বাঙালি মেয়ের মালশ্রী নাম কখনো শুনি নি। এমন-কি, হাল-ফ্যাশানের নভেল-নাটকেও পড়ি নি।”

“সে নিজের নাম নিজে রাখে নি, রেখেছে তার বাপ-মা।”

“মেয়েটি কার মেয়ে?”

“রাজা ঋষভরঞ্জন রায়ের একমাত্র সন্তান।”

বাপের নাম শুনে আমরা অনেকেই হাসি আর রাখতে পারলুম না। আমাদের হাসি দেখে ও শুনে নীল-লোহিত মহা চটে বললেন, “বীরবলী ভাষা পড়ে পড়ে যদি সাধুভাষা ভুলে না যেতে, তা হলে আর অমন করে হাসতে না। এ ঋষভ সংগীতের ঋষভ, বাঙলায় যাকে বলে রেখাব। নূরনগরের রাজপরিবারের ছেলেমেয়েদের নামকরণ করা হয় সংগীতাচার্যদের উপদেশমত। মালশ্রীর পিসিদের নাম হচ্ছে জয়জয়ন্তী ও পটমঞ্জরী, আর তার পিসতুতো মেজদাদার নাম হচ্ছে নটনারায়ণ, আর বড়দাদার নাম ছিল দীপক। গান-বাজনার যদি ক খ জানতে তা হলে এগুলি যে সব বড়ো বড়ো রাগরাগিণীর নাম, তা আর আমাকে তোমাদের বলে দিতে হত না। বনেদী পরিবারের ছেলের নাম কি হবে পাঁচু, আর মেয়ের নাম পাঁচি?”

নীল-লোহিতের এ বক্তৃতা শুনে রসিকলাল জিজ্ঞাসা করলেন, “তা হলে এ পরিবারে সংগীতের যথেষ্ট চর্চা আছে?” নীল-লোহিত বললেন, “রাজা ঋষভরঞ্জন পয়লা নম্বরের ধ্রুপদী। তাঁর তুল্য বাজখাই গলা কোনো গাঁজাখোর ওস্তাদেরও নেই।” রসিকলাল উত্তর করলেন, “আমরা গান-বাজনার ক খ না জানি— এটা জানি যে ঋষভের গলা বাজখাঁই হয়ে থাকে।” এ কথা শুনে আমরা কোনোমত প্রকারে হাসি চেপে রাখলুম এই ভয়ে যে নীল-লোহিত আমাদের হাসি দ্বিতীয়বার আর সহ্য করতে পারবেন না। নীল-লোহিত বললেন, “কথায় কথায় যদি বস্তাপচা রসিকতা কর, তা হলে আমি আর কথা কইব না।”

অনেক সাধ্য-সাধনার পর নীল-লোহিত মালশ্রীর স্বয়ম্বরের গল্প বলতে রাজি হলেন, on condition আমরা টু শব্দ করব না। নীল-লোহিত আরম্ভ করলেন, “তোমাদের দেখছি আসল ঘটনার চাইতে তার সব উপসর্গ সম্বন্ধেই কৌতূহল বেশি। এ হচ্ছে বিলেতি নভেল পড়ার ফল। গল্প যাক চুলোয়, তার আশ-পাশের বর্ণনাই হল মূল। ছবি বাদ দিয়ে তার ফ্রেমের রূপই তোমরা দেখতে চাও। সে যাই হোক, এখন আমার গল্প শোনো।”

-মালশ্রীর মেজদাদা অর্থাৎ রাজাবাহাদুরের ভাগ্নে আমার একজন বাল্যবন্ধু। রূপেন্দ্রের বিশ্বাস তিনি বড়ো সুপুরুষ। একবার নটনারায়ণকে গিয়ে দেখে আসুন, চেহারা কাকে বলে; তার উপর সে আশ্চর্য গুণী। নাচে-গানে তার তুল্য গুণী amateurদের ভিতর আর দ্বিতীয় নেই। আর তার কথাবার্তা শুনলে রসিকলাল বুঝতেন যথার্থ সুরসিক কাকে বলে।

রাজাবাহাদুর যখন কলকাতায় ছিলেন, তখন নটনারায়ণের সুপারিশে আমি মালশ্রীর প্রাইভেট টিউটার হই। ইংরেজি সে আমার কাছেই শিখেছে। তেরো থেকে ষোলো এই তিন বৎসর সে আমার কাছে পড়ে যেরকম ইংরেজি শিখেছে সে ইংরেজি তোমরা কেউই জান না। আর তাকে এত যত্ন করে পড়িয়েছিলুম কেন জান? মেয়েটি সত্যিই ডানাকাটা পরী, তার উপর আশ্চর্য বুদ্ধিমতী। তার পর রাজাবাহাদুর আজ দু বৎসর হল দেশে চলে গিয়েছেন—আমলাদের অত্যাচারে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল বলে। ইতিমধ্যে তাঁদের আর-কোনো খবরই পাই নি, হঠাৎ ঐ চিঠি এসে উপস্থিত। সকালে চিঠি পেলুম, বিকেলেই মেজদার সঙ্গে দেখা করলুম। মালশ্রী নটনারায়ণকেও চিঠি লিখেছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, “মেজদা, ব্যাপার কি?”

“রাজামামার খেয়াল।”

“এ খেয়ালের ফল দাঁড়াবে কি?”

“প্রকাণ্ড তামাসা।”

“সে তামাসা আমিও দেখতে চাই।”

“সেখানে গেলেই দেখতে পাবে।”

“সেখানে যাই কি করে?”

“নামরূপ ভাঁড়িয়ে।”

“কি সেজে?”

“বর সেজে নয়।”

তার পর সে পরামর্শ দিলে যে, আমি দরওয়ান সেজে ও সভায় যেতে পারি। রাজাবাহাদুরের পুরোনো জমাদার রামটহল সিং জনকতক নতুন ভোজপুরি দরওয়া সংগ্রহ করবার জন্য কলকাতায় এসেছে; তাদের দলেই আমি ঢুকে যেতে পারি।

উদ্যোগপর্ব

তার পর দিন সকালে আমি মেজদার ওখানে হাজির হলুম। আমার নাম হল লীললাল সিং, আর নটনারায়ণ আমাকে এ দলের সেনাপতি-পদে নিযুক্ত করলে। সবরকম ভোজপুরি দেহাতি বুলি আমি বাঙলার চাইতেও অনর্গল বলতে পারি। আর ‘করলবড়া’র জায়গায় ভুলেও আমার মুখ থেকে ‘করলবাণী’ বেরোয় না; কাজেই রামদুলাল সিং, রামঅবতার সিং, রামখেলাওয়ন সিং, রামদিন সিং, রামযশ সিং, রামভূপ সিং, রামদৎ সিং, রামগোলাম সিং, রামগোপাল সিং প্রভৃতি ভোজপুরি ছত্রীর দল আমাকে আর বাঙালি বলে চিনতে পারলে না। আমি জমাদার হয়েই দু বেটা মূর্তিমান পাপকে শুধু বিদেয় করলুম। কারণ ওংকারনাথ ব্রাহ্মণ ও বৈজনাথ ব্রাহ্মণকে দেখেই বুঝলুম যে, দু বেটাই মৃজাপুরি গুণ্ডা, দু বেটাই খুনে। দু পয়সার লোভে কাকে কখন চোরা ছোরা মেরে দেবে তার ঠিক নেই। আর ফলে আমার বদনাম হবে।

এই রামসিংদের সঙ্গে আমার দু দণ্ডেই ভাব হয়ে গেল, আর তাদের এমন প্রিয়পাত্র হয়ে পড়লুম যে, সেই রাত্তিরে ট্রেনে রামগোলাম সিং ও রামগোপাল সিং তাদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের প্রস্তাব করলে। আমি দুজনকে কথা দিলুম যে, প্রথমে মুনিবের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাক— তার পর আমার বিয়ের কথা ঠিক করা যাবে। তারা বললে, “ই বাৎ ঠিক হ্যায়।” Loyalty কাকে বলে দেখতে চাও তো এদের দেখো। সেই একদিনের আলাপ, কিন্তু আজও যদি খবর দিই তো তারা সুতোপটি ময়দাপটি পাথুরেঘাটা দরমাহাটা— যে যেখানে আছে সে সেখান থেকে হাতের গোড়ায় যে হাতিয়ার পায় তাই নিয়ে ছুটে আসবে। আজও বড়োবাজারের গদিতে গদিতে ও পাথুরেঘাটার দেউড়িতে দেউড়িতে এ কথা প্রচার যে, বাঙলামে কোই মরদ হ্যায় তো হ্যায় লীললাল ব্রাহ্মণ। আমি যে ছত্রী নই, সে কথা তারা পরে জানতে পেরেছে, আর তার পর থেকেই আমার সঙ্গে দেখা হলেই তারা বলে, “গোড় লাগি মহারাজ।”

আমি সদলবলে বিকেলে ট্রেনে উঠলুম থার্ড ক্লাসে, আর ফার্স্ট ক্লাসে উঠলেন আর- একদল, কারা তা চিনি নে। ভোর হতে না হতেই পীরপুর স্টেশনে পৌঁছলুম। রাত্তিরে অবশ্য গাড়িতে ঘুম হয় নি। আমাদের মুখে যেমন সিগারেট, রামসিংদের মুখে তেমনি গাঁজার কলকে, মধ্যে মধ্যেই ধোঁয়া ছাড়ছে। তার উপর আবার গান। কেউ ধরছে খেয়াল, কেউ ভজন, কেউ মোবারকবাদী, কেউ-বা আবার লাউনি। ভজনই এরা গায় ভালো, কারণ ভজনে তান নেই, আছে শুধু টান। তাদের মুখে ভজনগুলোই আমার লাগছিল ভালো। ‘প্রভু অগুণে চিতে না ধরো’ ভজনটা শুনে আমার মন ভক্তিরসে তেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠে নি, যেমন হয়েছিল ‘সাহেব আল্লা করিম রহিম’ এই ইসলামী ভজন শুনে। হিন্দু-মুসলমানের মনের গর্ভ-মন্দিরে যে একই দেবতা বিরাজ করছেন, এই-সব গানের প্রসাদে সে সত্য আমরা আবিষ্কার করি। মোবারকবাদী কাকে বলে জান? শুভকর্মের শুভলগ্নে গান। ভক্তিরস অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, তাই ওদের মধ্যে সব চেয়ে ফুর্তিওয়ালা ছোকরা রামরঙ্গিলা সিং যখন এই বিয়ের গান ধরলে

‘হাস হাসকে ঘুঁঘট খোলে লালবনা
আম্মা মেরে টীকা দেখলে ভয়া লালবনা।।’

তখন ঘরসুদ্ধ হাসির গর্রা পড়ে গেল! ‘বর আমার ঘোমটা খুলে কপালে রুলির ফোটা দেখে নিয়েছে’—এ কথায় হাসবার যে কি আছে তা জানি নে, কিন্তু ঐ সূত্রে যে- সব দেহাতি রসিকতা শুনলুম তা তোমাদের না শোনাই ভালো। সে যাই হোক, ঘুম না হলেও রাতটা কেটেছিল ভালো। ব্যাপারটা হয়েছিল একদম musical soiree।

এতক্ষণ সকলে চুপ করে ছিল। অবশেষে আমাদের মধ্যে প্রধান গাইয়ে, বিশ্বনাথ ওস্তাদের সাগরেদ শ্রীকণ্ঠ বলে উঠলেন, “নীল-লোহিত, তুমি দেখছি গান-বাজনাতেও expert হয়ে উঠেছ। ভজনের সঙ্গে খেয়ালের তফাত কি, তাও তুমি জান।

তিনি উত্তর করলেন, “তিন বৎসর তো আর কানে তুলো দিয়ে মালাকে পড়াই নি। ও বাড়িতে যে দিবারাত্র ওস্তাদি গান হয়। গানের expert গলা সাধলে হয় না, তার জন্য চাই কান সাধা।”

“মানলুম তাই। আর দরওয়ানরাও সব ওস্তাদি গান গায়! অবাক করলে।”

“ভালো। দরওয়ানের সঙ্গে ওস্তাদের তফাতটা কি? দুজনেই ডালরুটি ও গাঁজা খায়, দুজনেই মুগুর ও সুর ভাজে। কেন, তুমি কখনো কোনো পালোয়ানকে মৃদঙ্গের সঙ্গে তাল ঠুকে কুস্তি করতে দেখ নি? ওরা সব আজ ওস্তাদ কাল দরওয়ান, আজ দরওয়ান কাল ওস্তাদ—যখন যার যেমন পরবস্তি হয়

তার পর তিনি আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “যা বললুম তার থেকে মনে ভেবো না যে, ওদের বিরুদ্ধে আমার কোনারূপ prejudice আছে কি ছিল। নিরক্ষর ও নিঃস্ব হলেও, মানুষের অন্তরে যে প্রেম ও ভক্তি আর দেহে জোর হিম্মত থাকতে পারে, এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকলে তোমরাও তা দেখতে পেতে। তোমরা তো হিস্টরি পড়েছ। সন সাঁতাওনকে গদড় কারা করেছিল? তোমাদের পূর্বপুরুষরা, না, এদের বাপ- ঠাকুরদারা? তোমরা এদের ছাতুখোর বলে অবজ্ঞা কর, তার কারণ তোমরা জান না ছাতুর ভিতর কি মাল আছে। কালিদাস কি খেয়ে মেঘদূত লিখেছিলেন, ভাত না ছাতু?”

“আমি বললুম, “হয়েছে, এখন গল্প বলো।”

নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “আমি তো তাই বলতে চাই, কিন্তু তোমরা বলতে দেও কই? গল্প শুনতে তোমরা শেখ নি, শিখবেও না, কারণ তোমরা চাও নিজের নিজের বিদ্যে দেখাতে—কেউ সংগীতের কেউ সাহিত্যের। এত সমালোচকের পাল্লায় পড়লে আমি তো আমি Shakespeareও তাঁর গল্প বলতে পারতেন না। কেউ-না-কেউ Calibanএর Anthropology নিয়ে ঘোর তর্ক শুরু করত। যদি সত্যিই শুনতে চাও তো এখন শোনো—বিদ্যে গোলদিঘিতে গিয়ে জাহির কোরো।”

পীরপুর স্টেশন থেকে নূরনগর দশ মাইল রাস্তা। আমি গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের দলবলকে একবার drill করালুম, এবং তার পর সকলকে shoulder arms করে quick march করতে হুকুম দিলুম। আর-একখানি লরিতে ভাবী জামাইবাবুরা রওনা হলেন; অর্থাৎ তাঁরা, যাঁরা ট্রেনে ফার্স্টক্লাসে এসেছিলেন। হাজার হাজার নাকে বেসর-পরা চাষার মেয়ে দুপাশে কাতার দিয়ে আমাদের শোভাযাত্রা দেখতে লাগল। তারা বলাবলি করতে আরম্ভ করলে—”এ কিরকম হল, বরের দল চলেছে হেঁটে—আর তাদের তল্পীদাররা চেপেছে মোটরগাড়িতে! বোধ হয় মালপত্র হেপাজ‍ করে নিয়ে যাবার জন্যে।” এ ভুল যে তাদের হয়েছিল, তার কারণ আমার দলবলরাই ছিল দেখতে রাজপুত্তুরের মতো—আর যারা লরিতে ছিল তারা দেখতে তোমরা যেমন।

আমরা দুদলই রাজবাড়িতে একসঙ্গে পৌঁছলুম। পাড়াগেঁয়ে কাঁচা রাস্তা, সে রাস্তায় আমাদের পায়ের সঙ্গে মোটর পাল্লা দিতে পারবে কেন? সেখানে গিয়েই জামাইবাবুরা রাজাবাহাদুরের guest houseএ চলে গেলেন, আর আমাদের বাসা হল দেউড়ির ডান পাশের ভোজপুরি ব্যারাকে।

বাঁ পাশের ঘরগুলোতে আস্তানা করেছিল বাঙালি লাঠিয়ালরা। গিয়ে দেখি তারা সব সিঙ্গার-পটার করছে। কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁতন করছে, কেউ বাবরি চুল আঁচড়াচ্ছে তো আঁচড়াচ্ছেই, কেউ আবার একমনে দাঁতে মিশি দিচ্ছে। সকলেরই পরনে মিহি শান্তিপুরে ধুতি, কোমরে গোট, বাজুতে দাওয়া আর দোয়া-ভরা কবচ ও মাদুলি, আর কাঁধে লাল ডুরেদার গামছা। বেটারা যেন সব নবাবপুত্তুর— কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এরা পৃথিবীতে এসেছে যেন পান-দোখতা খেতে, আর কাজিয়ার সময় লোকের পেটে সড়কি বসিয়ে দিতে; তার পরেই নিরুদ্দেশ। বেটাদের বাড়ি হচ্ছে হয় নটীবাড়ি নয় শ্রীঘর—আর যেখানেই তারা যায়, সেইখানেই তো এ দুই ঘরবাড়ি আছে। এই-সব লাল-খাঁ কালো-খাঁদের বাঁয়ে রেখে, আমরা নিজের আড্ডায় গিয়ে ঢুকলুম।

দিনটে কেটে গেল হাতিয়ার শানাতে। কারণ রাজবাড়ি থেকে যে-সব ঢাল- তলোয়ার আমাদের দেওয়া হয়েছিল, সে-সব দুশো বৎসরের মরচে-ধরা। তাদের মরচে ছাড়াতেই প্রায় দিন কাবার হয়ে গেল। সেদিন আমাদের আর রান্নাবাড়া হল না, যদিচ রাজবাড়ি থেকে প্রকাণ্ড সিধে এসেছিল। আমরা সকলে জলের ছিটে দিয়ে ছাতু তাল পাকিয়ে নিয়ে, গণ্ডা গণ্ডা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তা গলাধঃকরণ করলুম। সন্ধে হয়-হয়, এমন সময় আমাদের ডাক পড়ল —স্বয়ম্বরসভা পাহারা দেবার জন্য। ভোজপুরিদের সঙ্গে লাঠিয়ালদের তফাত এই যে, লেঠেলরা খেতে না পেলে ডাকাত হয়, আর ভোজপুরিরা পাহারাওয়ালা।

সভাপর্ব

বিয়ের সভা বসেছিল ঠাকুরবাড়িতে, কারণ তার নাটমন্দিরে শ-পাঁচেক লোক হেলায় বসতে পারে। ঠাকুরবাড়িতে ঢোকবার আগে বাইরের উঠানে দেখি লাঠিয়ালরা সব সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ এক নতুন মূর্তি। এবার তারা সব কাপড় পরেছে, উত্তরবঙ্গের চাষার মেয়েদের মতো বুক থেকে ঝুলিয়ে, আর সে কাপড়ের ঝুল হাঁটু পর্যন্ত। সকলেরই ডান হাতে পাঁচ হাত লম্বা লাঠি, কারো কারো হাতে আবার পুঁটিমাছ- ধরা ছিপের মতো সরু সরু লম্বা সড়কি, তার মুখে ইস্পাতের ফলাগুলো জিভের মতো বেরিয়ে আছে। সে তো মানুষের জিভ নয়, সাপের দাঁত। আর সকলেরই বাঁ হাতে থাবাপ্রমাণ বেতের ঢাল। প্রথমে এদের দেখে চিনতেই পারি নি। মাথার চুল এখন আর তাদের কাঁধের উপর ঝুলছে না, ছাতার মতো মাথা ঘিরে রয়েছে। শুনলুম, মাথার চুল দিনভর ময়দা দিয়ে ঘষে ঘষে ফুলিয়েছে। এই নাকি তাদের যুদ্ধের বেশ।

ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে দেখি নাটমন্দির লোকে লোকারণ্য। আর সুমুখের ঠাকুরদালান খালি, শুধু দুধারে দুসার চেয়ারে বরবাবুরা বসে আছেন। একধারে সাদা কাপড়ের উপর বড়ো বড়ো শালুর লাল অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কর্মবীর’, অন্যধারে একই ধাঁচে ‘জ্ঞানবীর’। ঘোর মূর্খের দলরা হচ্ছে সব কর্মবীর, ইংরাজিতে যাকে বলে sportsman; তাদের কারো হাতে রয়েছে ক্রিকেট-ব্যাট, কারো হাতে টেনিস-র‍্যাকেট, কারো হাতে boxing-gloves, কারো হাতে হকি-স্টিক, কারো হাতে ফুটবল। শুধু একজনের হাতে রয়েছে দেখলুম এক হাত লম্বা একটি খাগড়ার কলম, শুনলুম ইনি হচ্ছেন লিপিবীর। মধ্যে যেখানে চার ধাপ সিঁড়ি দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে উঠতে হয়, সেখানটা ফাঁক। তার পরে জ্ঞানবীরদের আসন। এরা সকলেই ডক্টর—শুধু কারো Dর পিছনে আছে L, কারো L, T, কারো S. C.। কে কোন্ দলের লোক তা তাদের মাথার উপরের placard না দেখলে বোঝা যায় না। দুদলেরই রূপ এক। ব্যাঙ আর ফড়িং এ দলেও ছিল, ও দলেও ছিল। অথচ উভয় দলই পরস্পরকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখছিলেন।

রাজাবাহাদুর-নাটমন্দিরে ঢুকতেই একটি উচ্চাসনে অর্থাৎ হাইকোর্টের জজের চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর এক পাশে ছিল নটনারায়ণ, আর-এক পাশে দেওয়ানজি। চণ্ডীমণ্ডপ ও নাটমন্দিরের মধ্যে যে গলিটা ছিল, আমি আমার দলবল নিয়ে সেইখানে গিয়ে দাঁড়ালুম। সকলেরই মাথায় লাল পাগড়ি, গায়ে সাদা চাপকান, কোমরে তলওয়ার, আর পায়ে নাগরা জুতো; শুধু আমার মাথায় পাগড়ি ছিল ডাইনে নীল বাঁয়ে লাল, আর একমাত্র আমার তলওয়ারে ছিল হাতির দাঁতের বাঁট। আমরা প্রথমে গিয়েই সব single fileএ দাঁড়িয়ে salute করলুম। তার পরে এই বলে অভিবাদন করলুম, “জিয়ে মহারাজ, জিয়ে মোতিওয়ালা, দোস্ত বাহাল, দুষ্মন পয়মাল।” শুনে রাজা খুব খুশি হলেন। তার পরে নটনারায়ণ হুকুম দিলেন—”জমাদার লীললাল সিং, পাহারাকো বন্দোবস্ত করো।” আমি “জো হুকুম” বলে, ঠাকুরবাড়ির উত্তর দুয়ারে ছ জন, দক্ষিণ দুয়ারে ছ জন, পশ্চিম দুয়ারে ছ জনকে মোতায়েন করে দিলুম। আর আমি দাঁড়ালুম চণ্ডীমণ্ডপের নীচে, যেখানে মাথার উপরে বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা ছিল ‘None but the brave deserve the fair’। আর রামরঙ্গিলা সিংকে রাজাবাহাদুরের সুমুখে খাড়া করে দিলুম। তার কারণ সে ছোকরা ছিল বহুৎ খপসুরৎ।

মিনিট-পাঁচেক পরে নটনারায়ণের হুকুমে একটা বাবরিচুলো ছোকরা—ভাণ্ডারী মহা শঙ্খধ্বনি করলে, আর তৎক্ষণাৎ অন্দরমহলের দুয়ার দিয়ে মালশ্রী চণ্ডীমণ্ডপে হাজির হলেন বিয়ের কনে সেজে। দেখলুম তার বিশেষ কিছু বদল হয় নি, শুধু লম্বায় একটু বেড়েছে, আর গায়ের রঙ আরো উজ্জ্বল হয়েছে। সঙ্গে আছেন একটি মহিলা, যেমন বেঁটে তেমনি রোগা, যেমন কালো তেমনি ফ্যাকাসে—এক কথায় শ্ৰীমতী মূর্তিমতী dyspepsia। তাঁর হাতে একখানা সোনার থালার উপরে একটি বেল ফুলের গোড়ে মালা। পরে শুনেছি ইনি হচ্ছেন মিস বিশ্বাস, জাত খৃস্টান, পাস এম. এ., মালার নতুন মাস্টারনী। মালা এসে প্রথমে এ নজরে সভাটি দেখে নিলে, তার পর মিস বিশ্বাসকে কি ইঙ্গিত করলে। আর মিস বিশ্বাস একমুখ হেসে অগ্রসর হতে শুরু করলেন।

প্রথমেই তিনি ব্যাটধারীর সুমুখে দাঁড়িয়ে মালশ্রীকে সম্বোধন করে বললেন, “এই বীরযুবকদের ‘কুলশীলের পরিচয় দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। রাজা-বাহাদুর যে সমান ঘর থেকে সমান বরের আমদানী করেছেন, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। এদের রূপ তুমি নিজের চোখ দিয়ে দেখো আর গুণ আমার মুখে শোনো। ইনি হচ্ছেন স্বনামধন্য বাসু বোস, ওরফে দ্বিতীয় রঞ্জি। ঐ যে হাতে ব্যাট দেখছ, ওর স্পর্শে বল অসীমে চলে যায়। তুমি যদি ওঁকে বরণ কর তো উনি তার পর দিনই নববধূ কোলে করে বিলেত চলে যাবেন Lord’s Cricket Groundএ ম্যাচ খেলতে। আর উনি যখন সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করবেন তখন স্বয়ং রাজা ওঁর handshake করবেন, রানী তোমার।’

এ-সব শুনে মালশ্রী বললে, “Advance”

মিস বিশ্বাস অমনি দ্বিতীয় বীরের সুমুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইনি হচ্ছেন নেড়া দত্ত। এঁর তুল্য গোল্‌-কীপার ভূ-ভারতে আর নেই। ইনি বল ঠেকান শুধু মাথা দিয়ে। তাই এঁর মাথায় একটি চুল নেই, সব বলের ধাক্কায় ঝরে পড়েছে। যখন গোরার পায়ের লাথি খেয়ে বল ঊর্ধ্বশ্বাসে মরি-বাঁচি করে ছোটে, তখন এঁর মাথার গুঁতোয় তা চৌচির হয়ে যায়—অন্যের হলে মাথা চৌচির হয়ে যেত। তুমি যদি এঁকে বরণ কর তো ইনি তোমাকে ঐ অপূর্ব ও অমূল্য মাথায় করে রাখবেন।

মালা আবার বললে, “Advance”

মিস বিশ্বাস তৃতীয় বীরের কাছে উপস্থিত হয়ে শুরু করলেন, “ইনি হচ্ছেন ঘুসি ঘোষ। ঐ যে ওঁর দু হাত জোড়া দুটো পাওরুটি রয়েছে, ও bread নয়— stone। ও- রুটি যার মুখে পড়ে, তার একসঙ্গে দাঁত ভাঙে আর দাঁতকপাটি লাগে। তুমি যদি এঁকে বরণ কর তা হলে ঐ রুটির অন্তরে যে রক্তমাংসের হাত আছে, সেই হাত দিয়ে তোমার পাণি গ্রহণ করবেন।”

আবার শোনা গেল – “Advance”

মিস বিশ্বাস চতুর্থ বীরের সুমুখে দাঁড়িয়ে বললেন, “উনি হচ্ছেন নগা নাগ, the world-hockey-champion—আর তার লক্ষণ সব ওঁর দেহেই রয়েছে। ওঁর শরীর যে কাঠ হয়ে গিয়েছে সে শুধু দৌড়ে দৌড়ে, আর ওঁর বর্ণ যে মলিন শ্যাম, সে কতকটা রোদে পুড়ে আর অনেকটা রাঁচির কোলজাতীয় হকি খেলোয়াড়দের ছোঁয়াচ লেগে। মহাবীরের রূপ এইরকমই হয়। তাদের দেহের গুণ রূপকে ছাপিয়ে ওঠে।’

জোর গলায় হুকুম এল—”Advance”

মিস বিশ্বাস পঞ্চম বীরের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, “এঁর নাম খঞ্জন মিত্তির। Tennis groundএ ইনি খঞ্জনের মতো লাফিয়ে বেড়ান বলে লোকে এঁর পিতৃদত্ত নাম রঞ্জন খণ্ডে খঞ্জন করেছে। এঁর চেহারাটা যে একটু মেয়েলিগোছের, তার কারণ টেনিস খেলায় ভীমের মতো বলের দরকার নেই, কৃষ্ণের মতো ছলই যথেষ্ট। এ খেলায় muscle চাই নে, চাই শুধু nerve।”

মালা বললে, “Advance”

অতঃপর মিস বিশ্বাস লিপিবীরের সুমুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইনি হচ্ছেন বীর নৃসিংহ ভঞ্জ, প্রসিদ্ধ ‘তেজপত্রে’র সম্পাদক। প্রথমে ইনি ছিলেন গত সবুজ পত্রের সহকারী সম্পাদক, সে কাগজে বীরবলের ব্যঙ্গের ভয়ে ইনি মন খুলে হাত ঝেড়ে লিখতে পারেন নি। তেজপত্র যে কতদূর তেজপূর্ণ, তা তো তুমি জান, কারণ তুমি তা পড়েছ। তার দু পত্র পড়লেই পাঠকের শিরায়-উপশিরায় ধমনীতে-উপধমনীতে রক্তের স্রোত উজান বইতে বইতে তার মাথায় চড়ে যায়। তখন পাঠকের অন্তরে আর ধৈর্য থাকে না, উথলে ওঠে শুধু বীর্য। The pen is mightier than the sword— এ কথা যে সত্য তা হাতে-কলমে প্রমাণ করেছে ওঁর হাতের ঐ কলমটি।”

মালা হুকুম করলে—” Forward”

মিস বিশ্বাস হাতে সোনার থালা ও ফুলের মালা নিয়ে শেষ কর্মবীর ও প্রথম জ্ঞানবীরের মধ্যে যে হাত-দশেক ব্যবধান ছিল, ধীরে ধীরে তা অতিক্রম করতে লাগলেন; এ দিকে মালশ্রী দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে নিজের গলার মুক্তোর হার খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিলে। তার পর আমার বাঁ পাশে এসে আমার বাঁ হাত ধরে দাঁড়ালে। আর আমি আমার অসি খাপমুক্ত করতে বাধ্য হলুম। এ ব্যাপার দেখে সভাসুদ্ধ লোক স্তম্ভিত হয়ে গেল। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। তার পর হঠাৎ রামরঙ্গিলা ছোকরা চীৎকার করে তার ভাই বদ্রীকে জানালে, “মালা হামলোককা মিল গিয়া, আর এইসা তেইসা মালা নেই—একদম মোতিকো মালা।” অমনি রাম সিংদের দল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল- “জয় লীললাল সিংকো জয়!’

রাজাবাহাদুর এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। আমার দলবলে এই ক্ষত্রিয়োচিত জয়জয়কার শুনে তিনি বললেন, “ই বাৎ হো নেই সেতা।”

রামরঙ্গিলা অমনি বললে, “অগর হো নেই সেতা তো হুয়া কৈসে?”

আমি তখন তার দিকে তাকিয়ে বললুম, “তোম চুপ রহো।” আর রাজাসাহেবকে সম্বোধন করে বললুম, “হুজুর, ইকো লেড়কপকা। চঞ্চলতা মাপ কিজিয়ে।” অমনি আবার সব চুপ হয়ে গেল।

তখন রাজাবাহাদুর বীরের দলকে সম্বোধন করে বললেন, “হে বীরগণ এখন তোমাদের কর্তব্য করো। দরওয়ান-বেটার হাত থেকে মালাকে ছিনিয়ে নেও।”

এ কথা শুনে কর্মবীররা চুপ করে রইলেন, কিন্তু জ্ঞানবীরদের মধ্যে একজন উঠে বললেন, “মহাশয়, এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনোই কর্তব্য নেই। আপনার মেয়ে তো আমাদের প্রত্যাখ্যান করে নি, করেছে কর্মবীরদের। ওঁরাই এখন যথাবিহিত করুন।”

কর্মবীররাও নড়বার চড়বার কোনো লক্ষণ দেখালেন না। শুধু লিপিবীর বাঁ হাত দিয়ে মিস বিশ্বাসের অঞ্চল ধরে পাশের বীরকে ঠেলতে লাগলেন। লিপিবীরের ঠেলাতে অস্থির হয়ে খঞ্জন মিত্তির উঠে বললেন, “রাজাবাহাদুর, এ তো playground নয়—battle-field। আমরা নিরস্ত্র, ওরা সশস্ত্র; আমাদের হাতে আছে শুধু ব্যাটবল, আর ওদের হাতে আছে তলওয়ার। এ অবস্থায় আমরা ‘যুদ্ধং দেহি’ বলতে পারি নে। এই দু মিনিট আগে শুনলুম— The pen is mightier than the sword; তা যদি হয় তো তেজপত্রের সম্পাদক কলম হাতে নিয়ে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।”

ঐ প্রস্তাবে লিপিবীর মিস বিশ্বাসের পিছনে আশ্রয় নিলে।

এই-সব ব্যাপার দেখে শুনে মালা আমার কানে কানে বললে, “দেখলে বাবার ফরমায়েসী বীরের দল?”

তার পর রাজাবাহাদুর বললেন, “দেখছি তোমাদের দ্বারা কিছু হবে না, আমার মেয়ে আমিই উদ্ধার করব।” এর পর তিনি নটনারায়ণের কানে কানে কি বললেন। সে অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর মিনিট-খানেকের মধ্যে লেঠেলের সর্দারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। রাজাবাহাদুর বললেন, “যাও সরিতুল্লা, যাও। তোমরা গিয়ে ডাক ছাড়ো, তার পর যেমন যেমন দরকার হবে তেমনি হুকুম দেব।” সরিতুল্লা “হুজুর মালিক” বলে রাজাবাহাদুরের পায়ের ধুলো জিভে ঠেকিয়ে চলে গেল। সে বেরিয়ে যাবামাত্র লেঠেলরা সকলে গলা মিলিয়ে “লা আল্লা ইল আল্লা মহম্মদ রসুল-উ-উ-উ-উ- ল” বলে ভীষণ জিগির ছাড়লে, যেন মনে হল এইবার সভায় ডাকাত পড়বে। আর তাই শুনে রামসিংয়ের দল “সীতাপতি রামচন্দ্রজিকো জয়” বলে হুংকার দিয়ে উঠল। মনে হল, এইবার দুইদলে যুদ্ধ বাধে।

জ্ঞানবীরদের মধ্যে একজন তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে রাজাবাহাদুরকে বললেন, “মহাশয় করছেন কি, একটা হিন্দু-মুসলমানের riot বাধাবেন নাকি? এমন জানলে তো এখানে কখনো আসতুম না, এখন বেরোতে পারলে বাঁচি। যা করতে হয় করুন, কিন্তু non-violent উপায়ে।” রাজাবাহাদুর উত্তর করলেন, “শান্ত উপায় অবলম্বন করতে আমি সদাই প্রস্তুত, অবশ্য তা যদি ক্ষাত্রধর্মের অবিরোধী হয়।”

আমি দেখলুম, আর বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা কিছু নয়। অমনি আমার দলবলকে হুকুম দিলুম বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে। যেই তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, অমনি আমি আমার মাথার পাগড়ি ও কোমরের বেল্ট খুলে ফেললুম। রাজাবাহাদুর আমার দিকে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “কে, নীল-লোহিত নাকি!” আমি বললুম, “আজ্ঞে আমি নীল-লোহিত শর্মা।” আমার পরিচয় পেয়েই বাসু বোস, ঘুসি ঘোষ, নেড়া দত্ত, নগা নাগ ও খঞ্জন মিত্র সমস্বরে চীৎকার করে উঠল— “Three cheers for the conquering hero”। তার পর হুরে হুরে শব্দে সভাগৃহ কেঁপে উঠল। দেখলুম এরা সত্যসত্যই sportsman বটে। এদের মধ্যে একমাত্র লিপিবীর ক্রোধকম্পান্বিত কলেবর হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, “এ মূর্খের দলে ঢোকাই আমার ভুল হয়েছিল। রাজাবাহাদুরের মতো বাঙালিদের আজও এ জ্ঞান হয় নি যে, গোঁয়ার ও বীর এক জিনিস নয়। যাই একবার কলকাতায় ফিরে, এ বিষয়ে একটি চুটিয়ে আর্টিকেল লিখব।” তিনি মনের আক্ষেপ এই কটি কথায় প্রকাশ করে দ্রুতপদে জ্ঞানবীরদের কাছে গিয়ে ফিস্ ফিস্ করে তাদের কানে কি মন্ত্র দিতে লাগলেন।

একটু পরে রাজাবাহাদুর অতি ধীর গম্ভীর বুনিয়াদী গলায় বললেন, “আমার মেয়ে যখন স্বেচ্ছায় স্বয়ং তোমাকে বরণ করেছে, তখন এ বিবাহে আমার কোনো ন্যায্য আপত্তি থাকতে পারে না। আমি শুধু ভাবছি, তুমি ব্রাহ্মণ-সন্তান আর মালশ্রী ক্ষত্রিয়- কন্যা; সুতরাং এ বিবাহ কি শাস্ত্ৰসংগত হবে?”

আমি বললুম—

“পণে জাতি কেবা চায়, পণে জাতি কেবা চায়।
প্রতিজ্ঞায় যেই জিনে সেই লয়ে যায়॥
দেখো পুরাণ প্রসঙ্গ, দেখো পুরাণ প্রসঙ্গ।
যথা যথা পণ, তথা তথা এই রঙ্গ॥”

এ কথা শুনে জ্ঞানবীরদের দলের একজন দোজবরে D. L. দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, এ বিয়ে দিতে চান দিন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এইটুকু শুধু জেনে রাখবেন যে তা সম্পূর্ণ illegal হবে। মনুর মতেও তাই, মিতাক্ষরা মতেও তাই। উদ্‌বাহতত্ত্ব সম্বন্ধে ভারতচন্দ্র authority নন, কারণ বিদ্যাসুন্দরকে কোনোমতেই ধর্মশাস্ত্র বলা যায় না। যদি এ বিষয়ে শেষ কথা আর সার কথা জানতে চান তো Sir Gurudasএর Marriage & stridhan পড়ুন। আর ও বই পড়া আপনার নিতান্ত দরকার, কারণ এ ক্ষেত্রে শুধু marriage নয়, স্ত্রীধনের কথাও রয়েছে।”

আমি জবাব দিলুম, “শাস্ত্রফাস্ত্র জানিও নে, মানিও নে। কারণ—

আমি যে হই সে হই, আমি যে হই সে হই।
জিনিয়াছি পণে মালা ছাড়িবার নই॥
মোর মালা মোরে দেহ, মোর মালা মোরে দেহ,
জাতি লয়ে থাকো তুমি, আমি যাই গেহ॥”

রাজাবাহাদুর আমার কথা শুনে থ হয়ে রইলেন। এর পর প্রমাণ পেলুম যে, পটলডাঙার পণ্ডিতেরা ঘোর পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু গড়ের মাঠের খেলোয়াড়রা ঘোর মূর্খ নয়। শাস্ত্রজ্ঞান উভয়েরই প্রায় তুল্যমূল্য, আর শাস্ত্রের প্যাঁচ কাটাতে জানে কর্মবীররা, আর জানে না জ্ঞানবীররা।

রাজাবাহাদুর উভয়সংকটে পড়েছেন দেখে খঞ্জন মিত্তির চেঁচিয়ে বললেন, “অনুলোম বিবাহ শাস্ত্রসংগত। সুতরাং এ বিবাহ দিলে আপনার পণও রক্ষা হবে, জাতও রক্ষা হবে।

রাজবাহাদুর এই সুসংবাদ শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। D.L.টি কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। তিনি আইনের আর-এক ফেঁড়া তুললেন। তিনি বললেন, “যদিচ ওরকম বিবাহ লোকাচারবিরুদ্ধ, তবুও তা শাস্ত্রসংগত হতে পারে, যদি ওঁর পূর্ববিবাহিত স্ত্রী ব্রাহ্মণী হন।”

রাজাবাহাদুর অমনি আমার দিকে চাইলেন। আমি বললুম, “আজ্ঞে আমার প্রথম স্ত্রী তো আমি স্বয়ম্বর-সভা থেকে সংগ্রহ করি নি। সে শুধু ব্রাহ্মণী নয়, উপরন্তু কুলীন- কন্যা, লক্ষ্মীপাশার মেয়ে, সুতরাং সপত্নীতে আর আপত্তি নেই।” যেই এ কথা বলা, অমনি মালশ্রী আমার হাত ছেড়ে বিদ্যুৎবেগে বাপের কাছে ছুটে গিয়ে বললে, “এ বিবাহ আমি কিছুতেই করব না, প্রাণ গেলেও নয়। স্বামী নিয়ে partnership business!”

আমি বললুম, “মালশ্রী, আমি বিপদে পড়ে মিথ্যে কথা বলেছি। আমি যে কার্তিক ছিলুম, সেই কার্তিকই আছি।”

মালশ্রী উত্তর করলে, “তা হলে সেই কার্তিকই থাকো। মিথ্যাবাদীকে আমি কিছুতেই বিবাহ করব না, প্রাণ গেলেও নয়।”

আমি বললুম, “তাই সই, আমি চিরকুমারই থাকব। যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর!”

মালশ্রী ইতিমধ্যে দেখি রণচণ্ডী হয়ে উঠেছে। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে চীৎকার করে বললে, “আমিও চিরকুমারী হয়ে থাকব। এর পর আমি পুরুষ-বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে নারী-আন্দোলনে যোগ দেব।”

এ কথা বলেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল।

এর পর আমি সটান স্টেশনে চলে গেলুম, একলা হেঁটে নয়, মোটরগাড়িতে নটনারায়ণের সঙ্গে।

.

রূপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, “মালার কি হল?”

নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “সে খোঁজ তুমি করো-গে। আমি ঘটক নই।”

এর পর রসিকলাল জিজ্ঞাসা করলেন, “আর মোতির মালাটা?”

নীল-লোহিত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “সেটি তোমার চাই নাকি? তুমি দেখছি রামরঙ্গিলার মাসতুতো ভাই। মালা গেল তাতে দুঃখ নেই, মোতির মালা হারালো এইটিই হচ্ছে জবর ট্রাজেডি! বাঙালি জাতটে হাড়ে ছিবলে। কোনো serious জিনিস তোমরা ভাবতেই পার না, বুঝতেও পার না। তোমাদের উপযুক্ত সাহিত্য হচ্ছে প্রহসন। যাও সকলে মিলে পড়ো গিয়ে ‘বিবাহ-বিভ্রাট”।”

এই শেষ কথা বলে নীল-লোহিত কপালে হাত দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, মাথার ঘাম কি চোখের জল মুছতে মুছতে, তা ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমরা সকলে হো হো করে হেসে উঠলুম। কারণ নীল-লোহিতের ধমক সত্ত্বেও ব্যাপারটাকে ট্রাজেডি বলে আমরা বুঝতে পারলুম না, আমাদের মনে হল, ওটি একটি roaring farcel

কার্তিক ১৩৩৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *