সল্পগল্প
এ গল্প আমি আমার আকৈশোর বন্ধু কুমার-বাহাদুরের মুখে শুনেছি। যাঁকে আমি কুমার-বাহাদুর বলছি, তিনি রাজপুত্র ছিলেন না; ছিলেন শুধু একটি পাড়াগেঁয়ে মধ্যবিত্ত জমিদারের একমাত্র সন্তান। তাঁর নাম ছিল কুমারেশ্বর, তাই কলেজে তাঁর সহপাঠীরা মজা করে তাঁকে কুমার-বাহাদুর বলে ডাকতেন। এই নামটাই আমাদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল।
শুধু কুমার নামটা কেমন নেড়া নেড়া শোনায়—ওর পিছনে ‘বাহাদুর’ লেজুড়টা জুড়ে দিলে নামটাও যেমন ভরাট হয়, কানও তেমনি সহজে তা গ্রাহ্য করে; কেননা, কান তাতে অভ্যস্ত।
কুমার-বাহাদুরও এই ডাকনামে কোনো আপত্তি করেন নি। পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনা কে প্রত্যাখ্যান করে—বিশেষত যে জিনিস দাম দিয়ে কিনতে হয়, তা অমনি পেলে কে না খুশি হয়?
যদিও তিনি জানতেন যে, ও নামের ভিতর একটু প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে; যে খোঁচা—যাদের খেটে খেতে হবে তারা, যাদের তা করতে হবে না তাদের গায়ে বিঁধিয়ে সুখ পায়। ও একরকম কথার চিমটি কাটা
কুমার-বাহাদুরের sense of humour দিব্যি সজাগ ছিল, তাই তিনি ছোটোখাটো অনেক কথা ও ব্যবহার—ঈষৎ বিরক্তিকর হলেও ছোটো বলেই হেসে উড়িয়ে দিতেন; যেমন আমরা গায়ে মাছি বসলে, তাকে উড়িয়ে দিই। পরশ্রীকাতরতার উৎপাত মানুষমাত্রকেই উপেক্ষা করতে হয়, নইলে মানবসমাজ হয়ে উঠত একটা যুদ্ধক্ষেত্র। বলা বাহুল্য শ্রী মানে শুধু রূপ নয়, গুণও বটে; শুধু লক্ষ্মী নয়, সরস্বতীও বটে।
তিনি বি. এ. পাস করবার পরে, অর্থাৎ কলেজ ছাড়ার পর বেশির ভাগ সময় দেশেই বাস করতেন। পাড়াগাঁয়ে নাকি সময় দিব্যি কাটানো যায়—শিকার করে ও বিলেতি নভেল পড়ে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পয়লা নম্বরের বন্দুক ও নভেল শুধু বিলেতেই জন্মায়। সেই সঙ্গে জমিদারি তদারক করতেন। দেশে যখন ম্যালেরিয়া দেখা দিত, তখন তিনি তীর্থযাত্রা করতেন—ঠাকুর দেখবার জন্য নয়, ঠাকুরবাড়ি দেখবার জন্য। দেবদেবীর ভক্ত তিনি ছিলেন না; ছিলেন architecture-এর অনুরক্ত। এও একরকম বিলেতি শখ। তাঁর জমিদারির আয়ে এ-সব শখ সহজেই মেটাতে পারতেন। আর কলকাতায় যখন আসতেন, তখন আমার সঙ্গে দেখা করতেন। কেননা, ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছিলুম তাঁর friend, philosopher and guide ।
কিছুদিন পূর্বে কুমার-বাহাদুর হঠাৎ একদিন আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে সেদিন যা কথাবার্তা হল—তাই আজ বলছি। এই কথোপকথনকেই আমি পূর্বে বলেছি—গল্প। কিন্তু তিনি যে ঘটনার উল্লেখ করলেন, আর যার নায়ক স্বয়ং তিনি, সে ঘটনা এতই অকিঞ্চিৎকর যে, তা অবলম্বন করে একটি ছোটো গল্পও গড়ে তোলা যায় না। তবে তিনি তাঁর মনের গোপন কথা এত মন খুলে বলেছিলেন যে, আমার মনে সেটি গেঁথে গিয়েছে। কুমার-বাহাদুর তুচ্ছ জিনিসকে উপেক্ষা করতেন, কিন্তু সেদিন দেখলুম তিনি একটি তুচ্ছ ঘটনাকে খুব বড়ো করে দেখেছেন, বোধ হয় সেটি নিজের কীর্তি বলেই।
আমি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলুম, “কেমন আছ?”
“ঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। শরীর ভালো কিন্তু মন খারাপ।”
“মন খারাপ কিসে হল?”
“অর্থাভাবে।”
“তোমার অর্থাভাব!”
“হাঁ, ভাই। এখন থেকে আমাকে ভিক্ষে করে খেতে হবে—এই ভয়ে মনটা মুষড়ে গিয়েছে।”
“তোমাকে ভিক্ষে করতে হবে!”
“ভয় নেই! তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে আসি নি। তুমি সাহিত্যিক, দেবে কোত্থেকে?”
“রসিকতা করছ?”
“না, আমি সত্যসত্যই প্রায় নিঃস্ব হয়েছি। এখন বেঁচে থাকতে হলে, পরের অনুগ্রহের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হবে—যার শ্রুতিকটু নাম হচ্ছে ভিক্ষে করা। যদিচ অনেকেই তা করে। কেউ করে সরকারের কাছে মানভিক্ষা; কেউ করে রমণীর কাছে প্রেমভিক্ষা; আবার কেউ করে গুরুর কাছে জ্ঞানভিক্ষা। আমি মনে করেছি বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের কাছে এখন থেকে করব মুষ্টিভিক্ষা।”
“আচ্ছা, তা যেন হল, তোমার সম্পত্তি কি সব উড়িয়ে দিয়েছ?”
“না, গোরু এখনো গোয়ালে আছে, কিন্তু দুধ দেয় না। অর্থাৎ জমিদারির স্বত্ব আছে, কিন্তু উপস্বত্ব নেই।”
“কারণ?”
“Economic depression.”
“তা হলে তো কর্জ করতে পার।”
“কর্জ দেয় ধনীলোকে, আর নেয় ধনীলোকে। ও একরকম স্থাবর সম্পত্তি ও আস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে জুয়োখেলা। ভিক্ষে করে শুধু গরিব লোকে; আর আমি এখন গরিব হয়েছি। সুতরাং ও জুয়োখেলায় যোগ দেবার আমার আর অধিকার নেই। যে সম্পত্তি আজ আছে, তা হয়তো সদর খাজনার দায়ে কাল বিকিয়ে যাবে। এমন সম্পত্তি রেহান রেখে কে কর্জ দেবে? আর তা ছাড়া মহাজনদের অবস্থাও তথৈবচ।”
“তা হলে ধারও করতে পারবে না?”
“না। কর্জের পথ বন্ধ বলেই তো ভিক্ষের পথ ধরব মনে করেছি। ইংরেজিতে একটা মহাবাক্য আছে— Beg, borrow or steal।’
“তাই বুঝি beg করাটাই শ্রেয় মনে করেছ?”
“উপায়ান্তর নেই বলে। যদিচ জানি তাকে বিশেষ কোনো ফল হবে না। সামাজিক লোকের ভিতর fraternity নেই। Equality ও নেই, পরে হবে যখন তারা liberty তেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবে। Dictator মানুষকে লেশমাত্র liberty দেন না।”
“তা হলে borrow করতে পারবে না, beg করেও কোনো ফল হবে না। তবে করবে কি?”
“Steal আমি করব না। জন্মের মধ্যে কর্ম একবার করেছিলেম, তাতেই মনটা তিতো হয়ে রয়েছে।”
“চুরি করেছিলে তুমি!”
“হাঁ। এখন সেই চুরির মামলা শোনো।”
আমি সেকালে একবার দার্জিলিং যাচ্ছিলুম—পুজোর পর বোধ হয় অক্টোবর মাসের শেষ হপ্তায়। পাগ্লা ঝোরার কাছে এসে দেখি, সে যেন বাস্তবিকই ক্ষেপেছে— লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, গর্জাচ্ছে—আর আমাদের গায়ে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। শুনলুম ট্রেন আর বেশি দূর এগোতে পারবে না। রেলের রাস্তা নাকি অতিবৃষ্টিতে খানিকটা ধ্বসে পড়েছে। এ গাড়ি ছেড়ে খানিকটা হেঁটে মহানদীতে গিয়ে অন্য গাড়িতে উঠতে হবে। করতে হলও তাই। খানিক ক্ষণ বাদে নামতে হল, তার পর জলকাদার ভিতর দিয়ে আধ মাইল পথ পদব্রজে উত্তীর্ণ হয়ে মহানদীতে এসে আর-একটি খালি গাড়িতে চড়লুম। আমি একা নয়—সঙ্গে ছিল অনেক সাহেব মেম।
সে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি জনৈক পল্টনী সাহেব আগেভাগে সেখানে অধিষ্ঠান হয়েছেন। এতে অবশ্য আমি খুশি হলুম না। মেমেরা যেমন কালা আদমীদের সঙ্গে এক গাড়িতে উঠতে ভালোবাসেন না—আমরাও তেমনি সাহেবসুবোদের সঙ্গে এক গাড়িতে যেতে আসোয়াস্তি বোধ করি। রঙের তফাতে যে মানুষে মানুষে কত তফাত হয়, তা তো তুমি জান। কিন্তু অগত্যা সেই গাড়িতেই উঠে পড়লুম। সেটা ছিল ফার্স্ট ক্লাস, আর আমার পকেটেও ছিল ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। এক পা কাদা নিয়ে ঢুকতে ঈষৎ ইতস্তত করছিলুম। কিন্তু চোখে পড়ল যে সাহেবটির পদযুগলও তদবস্থ। তাঁর পা আমার চাইতে ঢের বড়ো, জুতোও সেই মাপের; সুতরা কর্দমাক্ত হয়েছে তদনুরূপ। ট্রেনে চড়ার পর মাঝপথে গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর পায়ে হেঁটে, আবার নতুন গাড়িতে চড়া কষ্টকর না হলেও বিরক্তিকর। আগের গাড়িতে মালপত্র যেমন সুব্যবস্থিত থাকে, পরের গাড়িতে ঠিক না থাকে না; সবই ভেস্তে যায়। যা ছিল চড়বার গাড়িতে, তা মালগাড়িতে চলে যায়; আর কোনো কোনো জিনিস মালগাড়ি থেকে বসবার গাড়িতে বদলি হয়। এতেই মন খিঁচড়ে যায়। ছোটোখাটো অসুবিধে আসলে মস্তবড়ো অসুবিধে। আমি মুখের ঘাম মুছতে হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে একটি রুমাল বার করতে গিয়ে দেখি সেটি অদৃশ্য হয়েছে। তাই কি করি—ভিজে মুখ ভার করে বসে থাকলুম। চারি পাশ কুয়াশার খদ্দরে ঢাকা; তাই পাহাড়ের দৃশ্য আমার চোখে পড়ল না। যদিচ এই পথটুকুর চেহারা অতি চমৎকার। রাস্তার দুধারে প্রকাণ্ড গাছ, যাদের একটিরও নাম জানি নে; অথচ দেখতে বড়ো ভালো লাগে। পৃথিবীতে অনেক জিনিসের নামই তাঁর রূপ দেখতে দেয় না। কার্সিয়ং পৌছবার কথা বেলা এগোরোটায়—কিন্তু বেলা একটা বেজে গেল, তখনো গাড়ি সে স্টেশনে পৌঁছল না। সেদিন ক্ষিধেও পেয়েছিল বেজায়। একে বেলা হয়েছে, তার উপর আধ মাইল কাদার মধ্যে পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়েছে। তাই কার্সিয় পৌঁছেই স্টেশনে রেস্তোরাঁতে খেতে গেলুম। এক পেট মাছমাংস খেয়ে যখন গাড়িতে ফিরে এলুম, তখন গাড়ি ছাড়বার বড়ো দেরি নেই। গাড়িতে ফিরে এসে দেখি আমার সিগারেট-কেসে একটিও সিগারেট নেই—ইতিমধ্যে সব ফুঁকে দিয়েছি। আর আমি রেস্তোরাঁ থেকেও সিগারেট কিনি নি, কারণ আমি জানতুম আমার হ্যাণ্ডব্যাগে একটি পুরো সিগারেটের টিন আছে। শুধু ভুলে গিয়েছিলুম যে—হ্যাণ্ডব্যাগটি হারিয়েছে। একটি সিগারেটের অভাবে আমার প্রাণ আই-ঢাই করতে লাগল। সিগারেটের নেশা গাঁজাগুলিচরসভাঙের মতো নয়, কিন্তু নেশা মানে যদি মৌতাত হয়—তা হলে এ মৌতাত ইয়াদী। যদি মনে হল যে সিগারেট যাব, তখন তা না পেলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। যাঁহা মুশকিল তাঁহা আসান। চোখে পড়ল সুমুখের বেঞ্চে সাহেবের একটি খোলা টিন আছে, আর সাহেব তখনো গাড়িতে এসে ঢোকেন নি, রেস্তোরাঁতে বসে হুইস্কি পান করেছেন। এই সুযোগে আমি অনেক ইস্তুত করে সাহেবের টিন থেকে একটি সিগারেট চুরি করলুম। আর গাঁজার কল্কেয় গেঁজেল যে ভাবে দম দেয়, সেই ভাবে কষে দম দিয়ে দু চার টানে সিগারেটটি ফুঁকে দিলুম। তার কারণ সাহেব এসে যদি দেখেন যে সিগারেট খাচ্ছি, তা হলে হয়তো আমার চুরি বমাল ধরা পড়বে। যদিচ ধোঁয়া দেখে অথবা শুঁকে কেউ বলতে পারে না সিগারেটটি কার। কিন্তু অন্যায় কাজ করলে এমনি অনর্থক ভয় হয়। তা যে হয়, তা সেকালের লোকরাও জানতেন। মৃচ্ছকটিতে শর্বিলক বসন্তসেনার গহনা চুরি করে এমনি অকারণ ভয় পেয়েছিল; তার স্বগতোক্তি এই—স্বৈর্দোষৈভবতি হি শঙ্কিতো মনুষ্যঃ। লোকে বলে চুরি বিদ্যে বড়ো বিদ্যে, যদি না পড়ে ধরা। কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। ধরা পড়বার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও—চুরি করলে ভদ্রলোকের মনের শান্তিভঙ্গ হয়। সে যাই হোক, আমি ধোঁয়ার শেষ ঢোক গিলেছি, এমন সময় সাহেবটি এসে তাঁর স্থান অধিকার করলেন। যখন তিনি খানাপিনা করে ফিরে এলেন, তখন দেখি তাঁর যে মুখ ছিল সাদা তা হয়েছে লাল—ক্রোধে নয়, মদে। তিনি ফিরে এসেই তাঁর টিন থেকে একটি সিগারেট বার করে ধরালেন এবং আমাকে সম্বোধন করে বললেন, “try one of mine; you may like it.”
“আমি তাঁকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললুম যে, “আমি নিজে থেকেই চা’ব মনে করেছিলুম।”
“কেন?”
“আমার সিগারেটের টিন হারিয়ে গেছে—আর আমি বসে বসে আঙুল চুষছি।”
“কি সর্বনাশ! দেও তোমার কেস-আমি সেটি ভরে দিচ্ছি।”
আমি আর দ্বিরুক্তি না করে তাঁর দান প্রসন্নমনে গ্রহণ করলুম।
গাড়ি দার্জিলিঙের অভিমুখে রওনা হলে পর তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ হল—প্রধানত দার্জিলিঙের আবহাওয়ার বিষয়। কথায় কথায় শিকারের কথা এসে পড়ল। আমিও অকারণ পশুপক্ষী গুলি করে মারি শুনে, তিনি আমাকে তাঁর জাতভাই মনে করে মহা খাতির করতে লাগলেন। আর বললেন, “তোমরা যদি সব শিকারী হয়ে ওঠ, তা হলে বাঙালিরা আমাদের কাছে অত নগণ্য হয়ে থাকবে না।” আমি বললুম, “তার আর সন্দেহ কি?”
যদিচ মনে মনে তাঁর কথায় সায় দিলুম না।
আর-একটু এগিয়ে দেখি যে, টুং ও সোনাদার মধ্যে রাস্তা এক জায়গায় ভেঙে গিয়েছিল, আর সদ্য মেরামত হয়েছে। তাই ট্রেন পা টিপে টিপে চলতে আরম্ভ করলে। আগে ছুটেছিল ঘোড়ার মতো এখন তার হল গজেন্দ্রগমন। পাহাড়ী মেয়েরা দশবারো মণ ওজনের পাথর সব পিঠে ঝুলিয়ে অবলীলাক্রমে নিয়ে আসছে ও পথের ধারে জড় করছে—আর সেই সঙ্গে মহা ফুর্তি করে গান গাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে এদের এই ব্যবহার দেখছি দেখে সাহেব বললেন, “এরা সব সিপাহীদের মা, বোন ও স্ত্রী। এদের হাড় এত মজবুত না হলে কি বেঁটেখাটো গুর্খারা এমন মজবুত সিপাহী হতে পারত?”
তারপর একটি সতেরো-আঠারো বৎসরের পাহাড়ী মেয়ে গাড়ির কাছে এসে বললে, “সাহাব, একঠো সিগারেট মাঙতা।” সাহেব তিলমাত্র দ্বিধা না করে তাকে একটি সিগারেট দিলেন। মেয়েটি অমনি আহ্লাদে হেসেই অস্থির।
তার পর সাহেব বললেন, “পাহাড়িদের আর-একটা মস্ত গুণ এই যে, এরা ছিঁচকে চোর নয়। আমি কার্সিয়ঙে গাড়িতে একটা খোলা টিন রেখে গিয়েছিলুম এই ভরসায় যে, এরা তার একটিও ছোঁবে না। ছিঁচকে চুরিতে ওস্তাদ হচ্ছে উড়েরা-coward-এর জাত কিনা।”
কথাটা আমার মনে কাঁটার মতো বিঁধল, কিন্তু আমি কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারলুম না যে, আমিও তো তাই করেছি। বাধল আমার self-respect এ, কিন্তু মনে মনে নিজের উপর ঘোর অভক্তি হয়ে গেল।
তার পর থেকেই মনস্থির করেছি যে, যদি beg করতে হয় তাও স্বীকার; কিন্তু steal আর প্রাণ থাকতে করব না। চুরির সুবিধে এই যে, তা গোপনে করা যায়, আর beg করতে হয় প্রকাশ্যেই। শাস্ত্রে বলে, ‘ন গুপ্তিরঘৃতং বিনা’; এই তো মুশকিল। একবার চুরি করলে হাজারটা মিথ্যে কথা বলে তা গোপন রাখতে হয়। মিথ্যে কথা বলবার প্রবৃত্তি আমার ধাতে নেই—এক মজা করে ছাড়া। তাই এখন থেকে ভিক্ষে জিনিসটে এস্তমাল করব।
এই বলে তিনি একটু হেসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে প্রার্থনা করলেন, “সাহাব, একঠো সিগরেট মাঙতা।”
আমিও একটু হেসে তাঁকে একটি সিগারেট দান করলুম।
তিনি তার নাম পড়ে বললেন, “না থাক্। যে সিগারেট একবার চুরি করে খেয়েছি, সেই সিগারেট আবার ভিক্ষে করে খাব না।”
এরপর তিনি নিজের পকেট থেকে সোনার উপর নীল মিনে-করা একটি জমকালো কেস বার করে একটি সিগারেট নিজে নিলেন, অপরটি আমাকে দিলেন এই বলে- “Take one of mine; you may like it.”
আমি সেটি নিয়ে তাঁর কেসটার উপর নজর দিচ্ছি লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “এটি আমি বেচব না, জমিদারি বিকিয়ে গেলেও যোগ্যপাত্রে দান করব—অর্থাৎ সেই লোককে, যে ওটি ব্যবহার করবে না, শুধু বাক্সে বন্ধ করে রাখবে।”
এই কথার পর তিনি নিজের সিগারেটটি ধরিয়ে গাত্রোত্থান করলেন।
আমি বুঝতে পারলুম না তাঁর গল্প সত্য, না বানানো। শুধু এইটুকু বুঝলুম যে, কুমার-বাহাদুর যদি ফকিরও হন, ভিখারি তিনি কখনো হতে পারবেন না অমন দুগ্ধপোষ্য মন নিয়ে।
আষাঢ় ১৩৪৫