সত্যজিৎ এর ‘বড় বউ’
তখন বম্বেতে। সাদা খামে একটা চিঠি এলো। চিঠিটা পড়ে আমি তো থ বনে গেছি। অনেকক্ষণ মুখে কোন কথা নেই। অজিত পেছন থেকে সমানে খোঁচাচ্ছে- ”কি হল? কার চিঠি? খারাপ কিছু?”
-”সত্যজিৎ রায়”। দীর্ঘ পনেরো বছর পর আবার যোগাযোগ। উনি চিঠি লিখেছেন আমাকে। সেই কোন ছোট্ট বেলায় ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। অপুর সংসার-এ কাজ করা হয়নি। অল্প সময়ের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম মাত্র। এতদিন পরও যে উনি আমাকে মনে রেখেছেন, তাই বা কম কি! বাড়ি বদলের সময় কিভাবে যে চিঠিটা হারিয়ে ফেললাম, এ আপশোশ আমার কোনদিন যাবার নয়। তবে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাগুলো দাঁড়ি কমা সহ মনে আছে- ”তোমার ‘ফুলেশ্বরী’ দেখেছি। খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমি শংকরের উপন্যাস ‘জন অরণ্য’-কে চলচ্চিত্রায়িত করার কথা ভাবছি। উপন্যাসে দুজন বৌদি ছিল। আমি কেটেছেঁটে একটা করেছি। কমলা বৌদি। আমার ইচ্ছে তুমি এই চরিত্রটা কর। ওখানে তোমার কাজের চাপ কেমন? ফাঁকা হলে জানিও। সেই মত যোগাযোগ করা যাবে। – সত্যজিৎ রায়”। কোথাও কোন ঠিকানা লেখা নেই। চিঠির উত্তর দেবো কী করে! আমি পড়লাম মহা বিপদে। সেই কবে লেক টেম্পল রোডের বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন ঠিকানা পাই কোথায়! এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে বাসু ভট্টাচার্যের স্ত্রী রিঙ্কিকে ফোন করলাম। রিঙ্কি জানালো ওর মা’র কাছে আছে। ওর মা মানে বিমল রায়ের স্ত্রী। উনিই আমাকে ঠিকানা যোগাড় করে দিলেন। চিঠি লিখলাম সত্যজিৎ বাবুকে- ”এ সুযোগ বারবার আসেনা। আমি যে কোন মূল্যে আপনার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত”। ‘চুপকে চুপকে’-র শুটিং তখন শেষের পথে। ঋষিদাকে জানাতেই এক বাক্যে সায় দিলেন- ”এটা তোর লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স হবে লিলি। শিগগিরি যা”। কিছুদিনের মধ্যে ফ্লাইটের দুটো টিকিট চলে এলো। সোজা কলকাতা এসে পৌঁছোলাম। ফ্লাইটটা সেদিন একটু লেট ছিল। এসে শুনি ওঁর প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরী বার কয়েক ঘুরে গেছেন। কোনোমতে স্নান-টান সেরেই দে ছুট। তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না! আমি কী কোন স্বপ্নের মধ্যে আছি! দরজায় টোকা মারতেই বৌদি বেরিয়ে এলেন। অভ্যর্থনা সেরে ঘরে ঢোকালেন আমাকে। বললেন- তোমার সেই কোমর-ছাপানো একমাথা চুল গেল কই? উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে ভেসে এলো সেই ব্যারিটোন ভয়েস। নড়েচড়ে বসলাম আমি। ধীরে ধীরে আমার সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছেন সেই দীর্ঘদেহী সুপুরুষ। আমি তো এই মুহূর্তটারই প্রতীক্ষায় ছিলাম! বারবার চিমটি কেটে পরখ করে নিচ্ছিলাম নিজেকে। এই কী সেই বিশ্বনন্দিত পরিচালক! যার সঙ্গে কাজ করবার সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন লালন করেছি ভেতরে ভেতরে? তবে কী আরও একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে? এমন হাজারও প্রত্যাশা আর সম্ভাবনার আলোড়ন চলছিল ভেতরে ভেতরে। সেই আলোড়নের স্রোতে যেন জোয়ার এনে দিল সত্যজিৎবাবুর এক একটি সংলাপ। আমার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে বিজয়া রায়কে বললেন- ”কি যা-তা বলছ! আমি ওর ফুলেশ্বরী দেখেছি। বেশ ভালোই তো চুল ছিল”।
কথাটা শুনেই সেই গুরুগম্ভীর পরিবেশে ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। হেসেই মনে হল আমি এখনও কি চূড়ান্ত ছেলেমানুষ! কোথায় কি আচরণ করতে হয় এসব জ্ঞানগম্যি আমার আজও হল না। ভয়ে ভয়ে বললাম- ”ওটা তো আসল চুল নয়। উইগ ছিল”। বলেই মনে হল, ‘কাকে কী বলছি’! কোথায় চুপচাপ ওঁর কথা শুনবো, তা নয়, ফটফট করে বকে যাচ্ছি! এবার নির্ঘাত আমার কপালে বকুনি জুটবে। কিন্তু কিসের বকুনি! উলটে যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন সত্যজিৎ রায়। সেই প্রথম সমস্ত গাম্ভীর্য ভেঙে বেরিয়ে এলেন। নিজেও খানিকটা মুচকি হেসে বললেন- ”সে কী আমার চোখে ফাঁকি! এমন উইগ কে বানালো?” বললাম- ”এমন উইগ একজনই বানাতে পারে— পিয়ার আলি”। আমার মুখ থেকে যেন কথা কেড়ে নিলেন সত্যজিৎ রায়। ডেকে পাঠালেন অনিল চৌধুরীকে- ”অনিলবাবু, পিয়ার আলিকে এক্ষুণি খবর দিন। আমার জন অরণ্যের জন্য লিলির একটা উইগ চাই”।
এরপর এলো স্ক্রিপ্ট পাঠের দিন। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে স্ক্রিপ্ট পাঠের অভিজ্ঞতার গল্প যে কতজনের মুখে শুনেছি! আমার ভাবতেই বেশ ভালো লাগছিল। আমিও সেই অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে চলেছি। পড়তে শুরু করলেন তিনি। গোটা গোটা অক্ষরে সাজানো লেখা, আর ফাঁকে ফাঁকে ওর সেই অসামান্য স্কেচ। ছবিটা যেন সত্যজিৎ বাবুর মাথার মধ্যে খেলছে। একবারের জন্যও অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছেন না। কিন্তু স্ক্রিপ্ট পাঠের অসামান্য দক্ষতায় চোখের সামনে জলজ্যান্ত হয়ে উঠছে চরিত্রগুলো। এতেই একজন অভিনেতার নব্বই শতাংশ কাজ সহজ হয়ে যেত। মাত্র দশ শতাংশ নিজস্ব এফর্ট যোগ করলেই চলত।
শুটিং এর প্রথম দিনের কথা দিব্যি মনে আছে। তখন আমার মেকআপ হয়ে গিয়েছে। মেকআপ ম্যান অনন্তবাবু মাথায় উইগ পড়িয়ে দিয়েছেন। পিয়ার আলি এত অসাধারণ উইগটা বানিয়েছেন, বোঝা যাচ্ছে না এতটুকু। তবু সত্যজিৎ রায়ের মত পারফেকশনিস্ট এর কী আর সহজে পছন্দ হয়! বারবার মেক আপ রুমে আসছেন ব্ল্যাক পেন্সিলটা হাতে নিইয়ে উইগটা নাড়িয়ে চারিয়ে দেখছেন। কিছুতেই যেন মনঃপুত হচ্ছে না। চিরকাল অরিজিনালিটিতে বিশ্বাস করে এসেছেন। এতটুকু কৃত্রিমতা ছিল ওর না-পসন্দ। তাই উইগ নিয়ে অস্বস্তি যেন কিছুতেই কাটছিল না। অবশেষে শুটিং হল সেই উইগ নিয়েই। বেশ ভালোভাবেই উতরে গেল। কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না। যদিও মনের মধ্যে একটা হালকা খচখচানি রয়েই গেল সত্যজিৎ রায়ের।
কিভাবে যে জলের মত শুটিং এর এগারোটা দিন পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। এমন একজন মহান পরিচালকের সংস্পর্শ আমাকে অনেক কিছু শেখালো। ইউনিটের প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয়ে ওঁর নজর। সবার সঙ্গে সমান ভাবে মিশে যাচ্ছেন অনায়াসে। বড় পরিচালক মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। মেক আপ থেকে আলো, সেট, ক্যামেরা, লেন্স যাবতীয় বিষয়গুলো বারবার নিজের হাতে পরখ করে নেওয়া। এরই নাম সত্যজিৎ রায়। উনিই তো বিশ্ববন্দিত হবেন। কারণ উনিই পারেন সূক্ষতার গভীরে পৌঁছে যেতে। ভাবনার জাল বুনে তাকে বৃহৎ বিস্তার দিতে। ওর পক্ষেই তো সম্ভব বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া।
শুটিং সেরে বম্বে এলাম পুনরায়। কিছুদিন বাদের ফিল্ম ডেভেলপমেন্টের কাজে সত্যজিৎ রায়ও এলেন। আমার ভেতরে আবার উৎকন্ঠা আর উচ্ছ্বাসের আলোড়ন। অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ। সদলে জন অরণ্যের টিম এসে হাজির বম্বেতে। ইনডোর শুটিং এর সাউন্ড ডাব হওয়ার চল তখনও শুরু হয়নি। অরিজিনাল সাউন্ডই ব্যবহার করা হত। আমার পুরোটাই ছিল ইনডোর পার্ট। তাই ডাবিং এর বিশেষ প্রয়োজন হয়নি। প্রদীপ সেবার আমাদের বাড়িতেই ছিল। ওর সঙ্গে আমার ভারি জমতো। আমারই মত লাজুক, মিতভাষী, প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে। নীরবে একের পর এক ভালো ভালো কাজ করে গেছে। বিনিময়ে কোন চাহিদা ছিল না প্রদীপের। আর ছিল অসম্ভব ভোজন রসিক। মনে আছে সেবার রাজকমলে ফিল্ম ডেভেলপমেন্টের কাজ শেষে আমরা সবাই মিলে একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। আমি, সত্যজিৎ রায়, বৌদি, প্রদীপ- সব পেটুক একসঙ্গে। সত্যজিৎবাবুর যে রান্নার ব্যাপারেও এত জ্ঞানগম্যি, তা কী আর আগে থাকতে জানতাম! দেশি-বিদেশি হাজার একটা রেসিপি তার নখদর্পণে। খুব হুল্লোড় হয়েছিল সেবার। মুহূর্তগুলো আজও স্মৃতিতে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আছে।
সেদিনের পর আবার লম্বা এক বিরতি। দূরত্বের খরা যেন কাটতেই চায়না। কতদিন ভেবেছি, যাই একটু দেখা করে আসি। কিন্তু যাবো যাবো করে আর হয়ে ওঠেনি। সংকোচ, দ্বিধা, নিজেকে গুটিয়ে রাখার আজন্ম অভ্যেস আমাকে চিরকাল গুণীজনদের সঙ্গে নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকেও দূরে রেখেছে। কতজনকে দেখতাম, কাজ পাওয়ার জন্য সত্যজিৎবাবুর বাড়িতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন। পরিচালকদের সঙ্গে দেখা করাটা তাদের সাপ্তাহিক রুটিনের মধ্যে পড়ত। মাঝেমধ্যে আমার নিজের প্রতি রাগ হত। একা একা বলতাম- ”দেখো লিলি, চারপাশটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো। এখনও সময় আছে। তাড়াতাড়ি এসব শিখে নাও”। আমার সমস্ত সময় বোধহয় অপচয়েই গেল। যে মানুষের কাছাকাছি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকাও সৌভাগ্যের, ব্যক্তিগত দ্বিধা দ্বন্দ্ব আমাকে সেই পরম সৌভাগ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখলো। কিন্তু সবই যে ওপরওয়ালার ইচ্ছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে আবার একটা ফোন। ততদিনে পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে।
সেদিন খুব টায়ার্ড ছিলাম। নাটকের ডাবল শো থেকে সদ্য ফিরছি। ল্যান্ডলাইন ছিল দোতলার ঘরে। প্রথমবার রিং হলেও আমি আর সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ঘরে যাইনি। ভাবলাম এত রাতে কে আবার ফোন করবে! নির্ঘাত কোন উটকো ফোন। সবে সবে বাড়িতে ল্যান্ডলাইন ঢুকেছে। তখন ফোন মানে অনেকের কাছেই বিলাসিতা। অনেকের কাছে আবার অজানা আশ্চর্যের বিষয়। মাঝেমধ্যেই প্রচুর উটকো ফোন আসত। সেসব ভেবেই আর ওপরে উঠিনি। দ্বিতীয়বার আবার বাজল। এবার যেতেই হল। রিসিভ করতেই ওপার থেকে একজন বললেন ”নির্মাল্য আচার্য বলছি। সত্যজিৎ রায় আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান”। রিসিভারটা ধরে আছি, হাত কাঁপছে থরথর করে। মুহূর্তে ঝেঁপে এল স্মৃতিরা। ১৯৭৫ এ ‘জন অরণ্য’-র শুটিং। বছরখানেকের মধ্যে রিলিজ। প্রত্যেকটা দৃশ্য তখন আমার চোখের সামনে ঘুরছে। দেখতে দেখতে স্রোতের মত গড়িয়ে গেছে পনেরোটা বছর। মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই, একটু একটু করে বয়সের ছাপ পড়েছে আমার মুখে। কত নতুন নায়িকারা চলে এসেছে! অন্যদিকে তিনি আরও ক্ষুরধার, আরও উজ্জ্বল। ভারতীয় চলচ্চিত্রের নক্ষত্রালোকে প্রধানতম জ্যোতিষ্ক। বানিয়ে চলেছেন একের পর এক ছবি । খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দূর-দুরান্তে। এসব ভাবতেই ভাবতেই ফের সেই ব্যারিটোন ভয়েসে — ”অনেকদিন তোমাকে দেখিনি। একবার এসো। দেখি তোমাকে। আমি একটা ছবি করছি। ‘শাখা-প্রশাখা’। তোমাকে লাগবে”।
দেখা হল দিনসাতেক বাদেই। সেদিন আমার পদ্মপুকুর ল্যান্সডাউনে নাটকের রিহার্সাল ছিল। পদ্মপুকুরের কাছেই বিশপ লেফ্রয় রোড। বাড়িটা আগে থেকেই চেনা।পা টিপেটিপে সিঁড়ি ভাঙছি। কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। কত বছর বাদে আবার দেখা। ভাবতেই সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ডোরবেল বাজাতে আচমকা দরজা খুলে হাজির হলেন সেই ছয় ফুট সাড়ে চার ইঞ্চির বিশালদেহী মানুষটি। ওঁর ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতি আমাকে নীরব করে দিল। কী বলবো! মুখে কোন কথা নেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। নীরবতা ভাঙল জলদগম্ভীর কণ্ঠে- ”আরে এসো এসো। কতদিন বাদে তোমার সঙ্গে দেখা। ঘরে এসো।” মুহূর্তে ডুবে গেলেন ‘জন-অরণ্যে’র গল্পে। শুটিং এর এক একটা দিনের ছোটোখাটো ঘটনাও মনে রেখেছেন তিনি। বিস্ময়ের বোধহয় আরও কিছু বাকি ছিল। আমার জন্য চা এর কথা বলতে লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। উনি করছেন কী! আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। চমক লাগছিলো বারংবার। খ্যাতি যেন তাকে আরও সহজ আরও স্বাভাবিক করে তুলেছে। চা এলো খানিক বাদেই। সত্যজিৎ বাবুর বাড়ির চায়ের কদর কো-আর্টিস্টদের মুখে বহু শুনেছি। চেখে দেখবার সৌভাগ্য হল। চুমুক দিতেই বুঝলাম, মকাইবাড়ি গ্রিন টি। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। ইতিমধ্যে বৌদি এলেন। তখন ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’-র শুটিং চলছে। ছেলের কাজ দেখতে রোজ হাজির হতেন মা। বাবুর তখন সদ্য শুরু। সত্যজিৎ রায়ের মতই মা’ই ছিল তাঁর প্রধান ক্রিটিক। বৌদি এসে যোগ দিতেই আড্ডা জমে উঠলো দ্বিগুণ। হাসি-ঠাট্টা আর খুনসুটিতে পরিশেষ যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। বৌদি বললেন ”কই, সবাই বলছিল, তুমি নাকি মোটা হয়ে গেছ! আমার তো কিছু চোখে পরছে না!” কথা কেড়ে নিলেন সত্যজিৎ রায় ”ও তো বাড়ির বড় বৌয়ের চরিত্র করবে। একটু স্বাস্থ্য ভাল না হলে হয় নাকি! ঠিক মানিয়ে যাবে।” বলতে বলতে একপ্লেট মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে এলেন। আমি একটাও মুখে তুলছিনা দেখে মুচকি হেসে বললেন বৌদি বললেন ”তুমি কী আমাদের কথা শুনে ডায়েট শুরু করলে ? পেটপুরে মিষ্টি খাও তো, ওসব ডায়েট পরে হবে।” গল্পে গল্পে সন্ধে গড়িয়ে রাত। ফেরার কথা সেদিন যেন ভুলেই গেছি। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক ও তাঁর পরিবার এমন এক আন্তরিক সন্ধে উপহার দেবেন আমাকে এ ছিল ভাবনার অতীত!
স্ক্রিপ্ট পাঠের ডেট পড়ল। ‘জন অরণ্য’-র সময় সত্যজিৎ রায় আমাকে আলাদা করে স্ক্রিপ্ট পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমি তখন বম্বেতে। একসঙ্গে সবাই মিলে স্ক্রিপ্ট পাঠের অভিজ্ঞতা হয়নি। আগেও বলেছি, ওঁর পাঠ নিয়ে কী বলবো! যাই বলি কম হয়ে যায়। শুধুমাত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে সমস্ত চরিত্র যে এত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব তা সত্যজিৎবাবু না থাকলে জানাই হত না। আমার খালি মনে হয় উনি যদি অভিনয়ে আসতেন তবে অনেকের ছুটি হয়ে যেত।
ট্রেনে করে শুটিং স্পটে যাওয়ার দিন তো আর এক কাণ্ড। ‘জন অরণ্য’-র ফোর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট জানিয়েছিল শিয়ালদার ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে। আমি পৌঁছতেই মমদি (মমতাশংকর) আর বিট্টু (সোহম) এল ওঁর বাবা-মা’র সঙ্গে। খানিক বাদে রঞ্জিত। ট্রেন ছাড়ার সময় এগিয়ে আসছে ক্রমশ। নিজেরা গল্প করছি বটে, কিন্তু বারবার চোখ যাচ্ছে ঘড়িতে। তবু আর কারও পাত্তা নেই! টেনশন বাড়ছে আমাদের। সি অফ করতে সেদিন ভাই এসেছিল সঙ্গে। হঠাৎ দেখি প্ল্যাটফর্ম থেকে ও ছুটতে ছুটতে আসছে— ”তাড়াতাড়ি চলো, ট্রেন ছাড়তে আর দু’মিনিট বাকি। সবাই উঠে পড়েছে।” ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা এলোমেলো ছুটতে লাগলাম। মূহুর্তে আশঙ্কার কালো মেঘ ছেয়ে ফেললো মন। আদৌ কী পৌঁছতে পারব! যদি বেরিয়ে যায় ট্রেন! ভুল তো আমাদের নয় তবু কী করে মুখ দেখাব সত্যজিৎ রায়কে! ভাবতে ভাবতেই লম্বা হুইসেল। কীভাবে যেন এক লাফে উঠে পড়লাম আমরা। প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে ট্রেন। ভাই হাত নাড়ছে। আমরা হাঁপাচ্ছি। বিশ্বাস হচ্ছে না তখনও। ট্রেনে উঠতে পেরেছি তো ? আশ্বস্ত হলাম সত্যজিৎ রায়ের গলা শুনে ”ওরা এসে গেছে? যাক বাঁচলাম। নইলে কাল আমি কাদের নিয়ে শুটিং করতাম!” ভুল খবর দেওয়ার জন্য সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরটির যে কী অবস্থা হয়েছিল তা আজ আর বলে কাজ নেই।
ট্রেন জার্নি মানেই মজার। তবু ‘শাখা প্রশাখা’র জার্নি যেন সবার থেকে আলাদা। একে তো সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতি সঙ্গে পুরো একটা বগি জুড়ে আমরা। ট্রেন এগোচ্ছে। ক্রমশ সবুজ বাড়ছে চারপাশে। সরে সরে যাচ্ছে গাছপালা,দূরের একটা দুটো ঘরবাড়ি। ঝালমুড়ি আর বাদামভাজা সহযোগে জমে উঠছে আড্ডা। কিসের ঘুম! খোশ গল্পে কেটে গেল সারারাত। পরদিন ভোরবেলা এনজেপি। আমাদের সঙ্গে রেলের একজন অফিসারকে রাখা হয়েছিল। আসলে সত্যজিৎ রায়ের তখন শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ওঁর পক্ষে প্ল্যাটফর্মে নেমে ওভারব্রিজ ক্রস করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এনজেপিতে ঢোকার মুখে লেভেল ক্রসিং-এ ট্রেনটা দাঁড় করানো হল। সত্যজিৎবাবু আর বৌদি ওখানেই নামলেন। তারপর আমাদের নিয়ে ট্রেন পৌঁছলো এনজেপি-তে। তথ্যসংস্কৃতি দপ্তর থেকে এই ব্যবস্থাটি নেওয়া হয়েছিল। ফেরার সময় ছিল একই বন্দোবস্ত।
শিলিগুড়িতে আমাদের জন্য দুটো হোটেল বুক করা হয়। নামগুলো এখন আর মনে নেই। আমি, টিটো (দীপঙ্কর দে), মমদি, সত্যজিৎ রায়, বৌদি, বাবু আর বুনি (সন্দীপ রায়ের স্ত্রী) ছিলাম একটা হোটেলে। পাশেই আর একটা হোটেলে হারাধনদা, রঞ্জিত, বিট্টু ও ইউনিটের আরও অনেকে। শুকনা ফরেস্টে তিনদিনের আউটডোর শুটিং। আগেভাগেই জানতাম মেকআপের কোন বালাই নেই। ‘জন অরণ্যে’র সময় উইগ পড়েছিলাম বলে অনন্তদা তবু একটু আধটু সাজিয়ে দিতেন। ‘শাখা প্রশাখা’য় মেকআপ বলতে- আমি মম-এর চুল বেঁধে দিচ্ছি, মম আমার গালে একটু পাউডার লাগিয়ে দিচ্ছে। কারণ ততদিনে আমরা খুব ভালো করেই জানি ন্যাচারাল লুকটাই সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে পছন্দ। অভিনেতা অভিনেত্রীদের লুক, মেকআপ থেকে পোষাক পরিচ্ছদ সমস্ত ব্যাপারেও উনি ভীষণ খুঁতখুঁতে। ‘জন অরণ্য’-র সময় আমার আর অপর্ণার সবকটা শাড়ি ওর নিজে হাতে পছন্দ করে কেনা। অসুস্থতার জন্য ‘শাখা প্রশাখা’-র সময় পারেননি। দায়িত্ব পড়েছিল বৌদি আর বুনির কাঁধে।
‘শাখা প্রশাখা’ ছিল ফরাসি কোলাবরেশানের ছবি। শুটিং -এ আয়োজনের কোন খামতি ছিল না। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মেডিকেল টিম ব্যবস্থা থাকত সবের। আশ্চর্যের বিষয় ছবিতে আউটডোর শুটিং এর অরিজিনাল সাউন্ডই ব্যবহৃত হয়। ডাবিং কোন এর প্রয়োজন হয়নি। সংলাপ ছাড়াও ঝর্নার জল, পাখির ডাক, এমন বেশ কিছু ন্যাচারাল সাউন্ড নেওয়া হয়েছিল। এডিটিং এর সময় জুড়ে দেওয়া হয়। ভাবতেই অবাক লাগে, সেই সময় দাঁড়িয়ে ‘শাখা প্রশাখা’য় একটিও কৃত্রিম শব্দের ব্যবহার নেই। সমস্তটা সম্ভব হয়েছিল ফরাসি প্রযুক্তির সহায়তায়।
শুটিং-এ সবচেয়ে মজা হত রঞ্জিতকে নিয়ে। রঞ্জিতের ছিল মুখ চেপে কথা বলার অভ্যেস। সত্যজিৎ রায় ওকে পইপই করে বলে রেখেছিল- পরিষ্কার করে ডায়লগ বলবে, সবকটা শব্দ যেন স্পষ্ট শোনা যায়। ব্যাস বেচারা গেল টেনসড হয়ে ! সংলাপ বলা নিয়ে সে কী টেনশন! ছবির একটা অংশে রঞ্জিতের বেশ বড় একখানা ডায়লগ ছিল। আমরা রোজ দেখতাম ও কিচ্ছুটি মুখে না দিয়ে শুটিং স্পটে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন কি দুপুরেও খাওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যেত। কিন্তু টিটো কী আর ছাড়বার পাত্র! চেপে ধরল- ”রঞ্জিত হঠাৎ উপোস শুরু করলি যে!”
উত্তর দেবে কী! রঞ্জিত তখন লজ্জায় লাল। এভাবে রোজ ও নির্জলা উপোস করে শুটিং স্পটে আসতো, আর হোটেলে ফিরে যেত। হবে হবে করে অংশটা আর কিছুতেই হচ্ছে না। আড়ালে হাসাহাসি করতাম বটে কিন্তু রঞ্জিতের তখন ল্যাজেগোবরে অবস্থা। অবশেষে যেদিন ওর অংশটা শুটিং হল, সবাই মিলে রঞ্জিতকে থালা বাটি সাজিয়ে ভালো মন্দ খাওয়ালাম। কতদিনের উপোস ভাঙল বেচারা! এতদিন পরও শুটিং -এর এইসব ছোটখাটো নির্ভেজাল আনন্দ মুহূর্তের দিকে ফিরে তাকাতে বেশ ভালোই লাগে।
মনে আছে শুটিং দেখতে এসেছিলেন তখনকার নামকরা ফরাসি আর্টিস্ট দুপার দেও। সবার সঙ্গে প্রচুর ছবি তোলা হল সেবার। দুপার দেও-র সঙ্গেও বেশ কয়েকখানা ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু সেসবের একটাও আমি পাইনি। সত্যজিৎবাবুর স্টিল ফোটোগ্রাফার নিমাই ঘোষকে বেশ কয়েকবার বলেও কোন কাজ হয়নি। বলেছিলেন দেবেন। তারপর যে কী হল কে জানে! নাই বা পেলাম সেসব। ছবি কী এত সহজে হারায়! স্মৃতিতে তো আজও সবই উজ্জ্বল। কোন ছবিতেই টাকা পয়সা নিয়ে আগেভাগে কথা বলার আমি পক্ষপাতী ছিলাম না। আর সত্যজিৎ বাবুর ছবিতে তো প্রশ্নই ওঠে না। শুটিং এর ফাঁকে হঠাৎ অনিল চৌধুরী ডেকে একটা খাম ধরালেন। খাম খুলে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। বাংলা ছবিতে এত টাকা! মম-র মুখেও একই কথা। টাকার পরিমাণটা নাই বা বললাম, তবে এটুকু বলতে পারি, তখনকার দিনে বাংলা কেন, হিন্দি ছবি করেও কেউ এত টাকা উপার্জনের কথা ভাবতে পারতেন না। ‘শাখা প্রশাখা’-র প্রথম স্ক্রিনিং হয়েছিল গোর্কি সদনে। আমরা সবাই মিলে দেখতে গেলাম। বেশ মনে পড়ে, সেটাই সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে সামনাসামনি শেষ দেখা। অস্কার পাওয়ার পর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে পৌঁছতে দেরি করিনি। উনি তখন অসুস্থ। নার্সিংহোমে ভর্তি। বৌদি ছুটে এলেন- ”দেখবে অস্কারটা?” ছুঁয়ে দেখলাম। গর্বে বুকটা ভরে গেল। মনে হল, এই মানুষটার সঙ্গে দুটো ছবিতে কাজ করেছি। আমার আর কিচ্ছু চাই না। উনি যখন চলে গেলেন, সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে মানুষটাকে সবসময় সচল অ্যাক্টিভ দেখেছি, ওঁর অমন নিথরতা আমি সহ্য করতে পারবো না। এখনও মাঝেমধ্যে মনে হয় অনেকদিন তো হল, এবার বুঝি ফোনটা বেজে উঠবে। ওপার থেকে শুনতে পাবো সেই ব্যারিটোন ভয়েস ”অনেকদিন তোমাকে দেখিনি। চলে এসো। আমি একটা নতুন ছবি শুরু করছি। তোমাকে লাগবে”।