লিলি নাম বদলাও

লিলি নাম বদলাও

‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ নামে একটা ছবির অফার পেলাম। আমার চরিত্রটা ছিল বাসন্তীদেবীর আদলে। পরিচালক আমাকে বাসন্তীদেবীর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেলেন। উনি তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বাড়িতেই থাকেন। খুবই অসুস্থ। বেড রিডেন। তা সত্বেও ছবির কথা শুনে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন। সিদ্ধার্থবাবুর মা অপর্ণাদেবী আমাকে নিয়ে গেলেন ওঁর ঘরে। হাড়জিরজিরে শরীর, কোঁচকানো চামড়া, দীর্ঘ অসুস্থতার ভারে ন্যুব্জ দেহ। আমাকে দেখে অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালেন। আমি সেদিন খুব ছিমছাম ভাবেই বেরিয়েছিলাম। সাজগোজ তেমন কিছুই করিনি। কপালে একটা ছোট টিপ, হালকা তাঁতের শাড়ি আর গায়ে একটু পাউডার। শুধু নাকে একটা ফলস নাকছাবি ছিল। বাসন্তীদেবী আমাকে দেখেই বললেন- তুমি এত সেজেছো কেন? আমি এত গয়না পড়তাম না। আমার সিন্দুক ভর্তি গয়না ছিল। লোকে সেসব দেখতে আসত। বললাম- সেই গল্প জানতেই তো আপনার কাছে আসা। নাকছাবিটা তবে খুলে ফেলি?

-না না থাক। ভালোই লাগছে।

তারপর বললেন- তোমার নাম লিলি কেন? কোন বাংলা নাম নেই তোমার?

-ছিল একটা নাম। কিন্তু সে নামে তো কেউ চেনে না। ইন্ডাস্ট্রির সবাই লিলি বলেই ডাকে।

-কি সেই নাম?

-জ্যোৎস্না।

-এমন সুন্দর নাম থাকতে ইংরেজদের নাম নিয়েছো কেন? তোমাকে আমি জ্যোৎস্না নামেই ডাকবো।

বাসন্তীদেবী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। চোখের সামনে দেখেছেন ইংরেজ শাসকের বীভৎসতা। ইংরেজের ছোঁয়াটুকুও কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। সেকারণেই বোধহয় আমার লিলি নামটাও তাঁর অপছন্দের ছিল।

এভাবে একের পর এক গল্প গড়ালো। বলতে শুরু করলেন সুভাষ বসুর কথা- রাতদুপুরে সুভাষ এসে যে কী হুল্লোড় করত, তা আর বলার নয়। তাঁর সমস্ত আবদার আমার কাছে। তাঁর জন্য আমাকে হাজার রকমের পদ রেঁধে রাখতে হত। তাঁর এটা চাই, সেটা চাই, আরও কত কী! জ্বালিয়ে মারতো আমাকে ছেলেটা।

উনি যে এত কিছু শেয়ার করবেন, আমি ভাবতেই পারিনি। বেরিয়ে প্রায় গেটের কাছে চলে এসেছিলাম। অপর্ণাদেবী বললেন- ”মা এখন আর কারও সঙ্গে এত কথা বলেন না। তোমাকেই বললেন। নিশ্চই ওঁর তোমাকে খুব ভালো লেগেছে”।

বলেই প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা তোমাকে আমি কি নামে ডাকি বল তো? তুমি তো আমার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছো। আজ থেকে তুমি আমার লিলি মা। বলে এক গাল মিষ্টি হাসি দিলেন। অমন হাসি অপর্ণাদেবীর মুখেই মানায়। আর একবার একটা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনিতে রবীন্দ্রসদনে গিয়েছিলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। আমাকে দেখেই বললেন- ”আরে! এই তো আমার দিদিমা। বাসন্তীদেবী যে!”

সিনেমার জগতে এসেছিলাম বলেই তো এমন সব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এই আনন্দ মুহূর্তগুলিই আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে। বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। সে সময় তো আর এখনকার মত হাতে হাতে মুঠোফোন থাকতো না! এখন তো কিছু হলেই হল, ওমনি একটা সেলফি তোলা চাই। তখন সেসব কোথায়! মুহূর্তগুলো লেন্সবন্দী করতে পারলাম না, এই যা দুঃখ! তবে স্মৃতি থেকে সরাবে কে? এমন উজ্জ্বল মুহূর্ত স্মৃতিতে প্রতিদিন নতুন ভাবে ধরা দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *