চুমু খেয়ে অমিতাভ বলেছিল ভালোবাসি

চুমু খেয়ে অমিতাভ বলেছিল ভালোবাসি

‘চুপকে চুপকে’-র ইউনিটটা ছিল মজাদার। তার মধ্যে আবার সব বাঙালিরা একসঙ্গে। আমি, শর্মিলা, জয়া নিজেদের মধ্যে বাংলাতেই কথা বলতাম। আর আমাদের পরিচালক ঋষিদা তো হাফ বাঙালি, হাফ হিন্দুস্থানী। উনি হিন্দি বলতেন বাঙলার মত করে। হয়তো ধর্মেন্দ্রকে ডাকবেন, বলে উঠতেন- এই ধরম ইধার এসো। হৃষিকেশ মুখার্জী ছিলেন খুব হাসিখুশি মানুষ। ‘চুপকে চুপকে’-র সেটেই প্রথম অমিতাভের সঙ্গে দেখা।

তখনও অমিতাভ স্টার হয়ে ওঠেনি। বম্বেতে স্ট্রাগল করে যাচ্ছে। ছবিতে অমিতাভ আর জয়া ছিল প্রেমিক প্রেমিকা। আমি জয়ার দিদি। একটা দৃশ্য ছিল অমিতাভ আর জয়া আড়ালে প্রেম করছে। দূর থেকে আমি ওঁদের দেখে ফেলি। অমিতাভও খেয়াল করে আমাকে।

এরপর একটা মজার সংলাপ ছিল। অমিতাভ দুটো ফুল নিয়ে বলতে শুরু করে- ইয়ে বড়ি ফুল হ্যায়, ওউর ইয়ে ছোটি ফুল হ্যায়। বড়ি ফুল ছোটি ফুল কি দিদি হ্যায়। দিদি পিছে খাড়ি হ্যায়। ব্যস, ওমনি জয়াও বুঝে যায় দিদি পুরোটা দেখে ফেলেছে।

আসলে অমিতাভ ছবিতে ছদ্মবেশে আমাদের বাড়িতে এসেছিল আমি জানতাম ও বিবাহিত। তাই ওঁদের সম্পর্কটা একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। যদিও ছবির শেষে সবার ভুল ভেঙে যায়। ‘ছদ্মবেশী’-র গল্পটাই হিন্দিতে ‘চুপকে চুপকে’ নামে রিক্রিয়েট করেন ঋষিদা।

অমিতাভের সঙ্গে আমার প্রায় ৮-১০ দিনের শুটিং ছিল। দেখতাম একটি সুপুরুষ ছেলের কাজের প্রতি কী অসম্ভব ডেডিকেশন! ওঁর প্রথম কর্মক্ষেত্র কলকাতাকে নিয়ে ভয়ানক আগ্রহ ছিল। কাজের ফাঁকে অনেক গল্প হত। কলকাতা শহর নিয়ে, টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে। কিন্তু তখন তো আর বুঝিনি সেই অমিতাভ এত বিখ্যাত হবে। তাহলে কী ওকে আর এত সহজে ছেড়ে দিতাম!

এরপর যখন ‘আলাপ’ শুরু হল, তখন আরও লম্বা শিডিউল। ছবিতে অমিতাভ আমার দেওর। দেওর-বৌদির বন্ধুত্বের সম্পর্ক। প্রায় সমস্ত দৃশ্যই ছিল অমিতাভের সঙ্গে। শুটিং শুরুর দিন আমি মেকআপ করে ঋষিদাকে দেখাতে গেছি, দেখি ঋষিদা ফ্লোরের বাইরে চৌকি পেতে দাবা খেলছে। ওঁর খুব দাবার খেলার শখ ছিল। সুযোগ পেলেই পার্টনার জুটিয়ে বসে যেতেন। আমার মেকআপ দেখে হেয়ার ড্রেসারকে দু-একটা পরামর্শ দিলেন। চুলের খোঁপাটা একটু বড় করে তাতে সোনা-রূপোর কাঁটা গুঁজে দিতে হবে। উনি সমস্ত কিছুতেই বাঙালিয়ানাকে প্রেফার করতেন। চরিত্রদের সাজগোজেও থাকতো বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। ঋষিদার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখ গেল দূরে আমাদের দিকে পেছন ফিরে অমিতাভ যেন কার সঙ্গে গল্প করছে। একটা ছবিই তো মাত্র করেছি! ভাবলাম চিনতে পারবে না। ফিরে যাচ্ছিলাম। ওমা দেখি পেছন থেকে ডাক এল- কেয়া লিলিজি একসাথ কাম কিয়া, একবার হ্যায় ভি নেহি বোলা, হ্যালো ভি নেহি বোলা, বাপস চলি যা রেহি হে! শুনে আমি তো হকচকিয়ে গেছি। বড্ড এমব্যারাসড লাগছিল। কী যে বলি ওকে! বললাম- না না, আপনি তো একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি। বললো- ছোড়িয়ে, মেরেকো মালুম হ্যায়, আপ ভুল গেয়ে। বললাম- তাই কখনও হয়! একবার অমিতাভকে দেখলে কখনও ভোলা যায়! ছবিতে অমিতাভ ছাড়াও রেখা, ফরিদা জালাল, আসরানি এমন আরও অনেকে ছিল। ফরিদার সঙ্গে অল্প সময়েই আমার খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। ও ছিল ভারি সরল-সোজা মেয়ে। সবাইকে বলতো- দেখো দেখো লিলি কা হাসি কিতনা সুইট হ্যায়!

আমি বলতাম- তোমারই বা কম কী ফরিদা?

-ম্যায় তো মোটি হুঁ। মেরে কো সব আমূল বাটার ক্যায়তি হ্যায়।

ছবির ফাঁকে ফাঁকে এমন অনেক মজা করতাম আমরা। মনে পড়ে ‘আলাপ’-এ অমিতাভের সঙ্গে প্রথম দৃশ্যটা— গাড়ি থেকে নেমেই অমিতাভ আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। তারপর জড়িয়ে ধরছে। জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খাচ্ছে। এরপর ছিল অমিতাভের একটা লম্বা ডায়লগ— এগুলো কেন করলাম বল তো? প্রণাম করলাম কারণ তুমি আমার থেকে বয়সে বড়, সম্পর্কে বৌদি তাই। জড়িয়ে ধরলাম তুমি আমার বন্ধুর মত বলে। আর চুমু খেলাম কারণ আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।

কিন্তু সেই শেষ! তারপর অনেক সময় গড়িয়েছে। চুলে পাক ধরেছে লিলি চক্রবর্তীর। তাদের আবার দেখা হোল দীর্ঘ ৩৫ বছর পর। মাঝেমধ্যেই খবর পাই শুটিং এর কাজে কলকাতা এসেছে অমিতাভ। ইচ্ছে থাকলেও দেখা করা হয়ে ওঠে না। এবারও এসেছিল ‘তিন’ ছবির শুটিং-এ। হঠাৎই ফোন আসে আমার কাছে। অমিতাভ বচ্চন ফ্যান ক্লাব, প্রতিদিন ওদের আয়োজনে অমিতাভের সঙ্গে টালিগঞ্জের আর্টিস্টদের একটা গেট-টু-গেদার হবে। আসতে হবে আমাকেও। শুনে বেশ ভালোই লেগেছিল। কতদিন পর দেখা হবে! মন্দ কী! তবে জানতাম নির্ঘাত ভুলে গেছে। কত বড় স্টার! ওঁর কী সেসব ছোটখাটো কথা মনে থাকে!

সেদিন অমিতাভের সঙ্গে মঞ্চ আলো করে ঘিরে শর্মিলা, অপর্ণা, সন্দীপ রায়, আর ‘তিন’ ছবির প্রোডিউসার সুজয় ঘোষ। সঞ্চালনায় ছিল মীর। কথায় কথায় ‘আলাপ’-এর প্রসঙ্গ এল। সঙ্গে সঙ্গে মীর বলে উঠলো- দেখুন তো, দর্শকাসনের প্রথম সারির ওই ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারেন কিনা?

আমি হাত তুললাম। অমিতাভ কয়েক সেকেন্ড একেবারে চুপ। তারপর বলে উঠলো- আরে! লিলিজি! ক্যায়সে হে আপ! নীচে নেমে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। অমিতাভের হাতের স্পর্শে বহু পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *