ইস্কুল বাড়ি
সোহাগ, আহ্লাদ, আদরের পর সব শিশুরই যেমন হয়, তেমনই শুরু হল স্কুল জীবন। ছোট্ট লিলি স্কুলে যাবে, বাড়িতে তাই বড়দের মধ্যে নানা ব্যস্ততা। খাইয়ে দাইয়ে তৈরি করে দেওয়া হল আমাকে। প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আর পাঁচ জনের থেকে মোটেই আলাদা ছিল না। বাড়ি ছেড়ে, মা, বোনকে ছেড়ে একা আমাকে অনেকক্ষণ কোথাও থাকতে হবে ভেবেই কান্না পেল। যেতে তো হবেই, স্কুলের পথে পা বাড়ালাম। ছোটবেলার সেই স্কুলটার আবছা একটা ছবি আমার মনে আছে। কিছুটা স্বপ্নের মত। স্পষ্ট করে বলতে গেলে হারিয়ে যায়। অথচ চোখ বুঝলেই ভেসে ওঠে। সেই আমার প্রথম পাঠশালা। যেমন সেই ছোট্টবেলাকার আমার একটা মুখের ছবি এখনও গেঁথে আছে মনে। আসলে তো এসব দানা বেঁধে আছে অনুভূতিলোকে। তাই স্পষ্ট করা খুব মুশকিল।
স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতে পড়াবার জন্য একজন মাস্টারমশাই আসতেন। আমি আর ভাই পড়তে বসলেই ছোটবোন মুড়ির বাটি নিয়ে আমাদের পাশেপাশে ঘুরঘুর করত। খেত কম, ছড়াতো বেশি। বেশ নাদুস-নুদুস দেখতে ছিল। ওকে আমরা ভুড়ু ভুড়ু বলে ক্ষ্যাপাতাম। সেই বোন এখন আমার ফ্ল্যাটের নীচতলায় থাকে। বয়সে ছোট হলেও এখন বোন আর ভগ্নীপতিই আমার অভিভাবক। ওর ভালো নাম দীপ্তি। আমার ২৪ ঘন্টা সুস্থ থাকার সমস্ত দায়িত্ব এখন ওদের কাঁধে। ওঁদের মেয়ে সংহিতা। ইতিহাস গবেষক। সংহিতা আমার মেয়েও বটে।
ওর দিকে তাকালে আমার কৈশোরে ফিরে যাই। মনে হয়, ওকে নিয়ে দিনরাত কথা বলে চলি। শুনতে ইচ্ছে করে, ওরা এখন জীবন নিয়ে কী ভাবে! মনে পরে যায় ছোটবেলার হাজারও গল্প।
আমার বাবার নাম কেশবনাথ চক্রবর্তী। মা দীপালি চক্রবর্তী। বাবা প্রথমে আমার মেজমাসিকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের তিন সন্তান। দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেজমাসি হঠাৎ মারা যায়। ছেলেমেয়েদের দেখার কোন লোক ছিল না। মামাবাড়ির সবাই মিলে ঠিক করে আমার মা’র সঙ্গে বাবার বিয়ে দেবে। আমরা ভাইবোনেরা অনেক বড় হয়েও এসব কিছুই জানতাম না। আমরা সবাই ছিলাম এক মায়ের পেটের। এখনও তাই।
এক অর্থে সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিলাম। ঢাকায় বাবার বিরাট বড় ব্যবসা। সেই সূত্রে ঢাকাতেই থাকতাম। বাবা বলতেন আমার জন্মের পরই নাকি তাঁর ব্যবসার উন্নতি। তখন শুনতে বেশ লাগতো। এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মানুষ আসলে যে যার ভাগ্যে করে খায়। উন্নতি, অবনতি সব তার কপালেই লেখা থাকে। তবু বাবার বিশ্বাসকে ছোট করতেও ইচ্ছে করেনা।
এসবের মাঝেই একটা গভীর আতঙ্ক ছাপ ফেলে গেল আমার শিশুমনে। একটা ট্রমা! মনে আছে একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে সব ভাইবোনদের ডেকে তুললেন মা। আমার সেদিনের সেই ছোট্টবেলার ভয় পাওয়া মুখটা এখনও স্পষ্ট ভাসে। সেই প্রথম এতটা ভয় পেয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম- আমরা কোথায় যাচ্ছি? মা কোন উত্তর দিলেন না। চিৎকার, কান্না, হট্টগোলের মাঝে বেরিয়ে পড়ে দেখলাম, আমাদেরই মত আরও অনেক অসহায় মুখ। তারাও যেন পালাচ্ছে এক বিরাট আতঙ্ক দৈত্যের তাড়া খেয়ে। যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে নাড়ির টান। অনেক পরে জেনেছি সেই দৈত্যের নাম দেশভাগ। ভাবলে আজও লোম খাড়া হয়ে যায়। সব ফেলে আমরা পৌঁছলাম কলকাতায়। বাবা তখন কলকাতাতেই ছিলেন। জিনিসপত্র প্রায় কিছুই আনতে পারলো না মা। ভাইবোনদের গায়ের গয়নাগাঁটি, অল্প কিছু টাকা আর দু’একটা জামাকাপড়। বাদবাকি সব পড়ে রইলো ঢাকায়। কলকাতায় এসে আমার মন পড়ে থাকতো সেই বাড়ির পাশের পুকুরটায়। সেটা যে আর কোনদিন দেখতে পাবো না তখনও বুঝিনি। এখন এই বুড়ো বয়েসে আমার নিবেদিতা অ্যাপার্টমেন্টের উল্টোদিকের ঝিলটায় বাংলাদেশের ছায়া খুঁজি। মাঝেমধ্যে দু’দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। ছোটবেলার কথা ধীরে ধীরে মনে পড়ে যায়। ভালোলাগায় ভরে ওঠে মন।
কলকাতায় এসে আমরা উঠলাম বালিগঞ্জে। বাবার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে। যতটুকু সম্বল ছিল তা দিয়ে বাবা নতুন করে ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করছিল। মা ঢাকায় বাবার এক বন্ধুর কাছে প্রায় ২০০ ভরি গয়না রেখে এসেছিল। তিনি পরে অনায়াসে সবটা অস্বীকার করলেন! কথাগুলো কানে ভাসে- ”বৌদি, আপনার মাথার ঠিক ছিল না, কাকে ভুলে কী দিয়ে এসেছেন। এখন আপশোশ করে লাভ আছে!” সত্যিই তো আপশোশ করে কী লাভ! শুনেছি সেই ভদ্রলোকের শেষটা ছিল ভয়ানক কষ্টের! চোখে দেখা যেত না। তিনি চলে গেছেন, এখন আর নিন্দেমন্দ করে কাজ নেই! তবে অসৎ, মিথ্যেবাদী কাউকে দেখলে আজও আমার মনে পড়ে যায় সেই ভদ্রলোক ও তাঁর শেষজীবনের কথা।
যাই হোক, বাবার ব্যবসাটা আর করা হল না! যা মূলধন দরকার, মা গয়নাগাটি বেচেও যোগাড় করতে পারলেন না। তাছাড়া ছোটখাটো ব্যবসায় বাবার একেবারেই মন ছিল না। আমাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকলো। কাকার বাড়িতে আর কতদিন থাকা যায়! যদিও ওঁরা সবাই আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বিশেষ করে বাবার মামিমা, মানে আমাদের ঠাকুমা। আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ওই ছোটবেলাতেই এটুকু বুঝতে পারতাম, এখানে আর বেশীদিন থিতু হওয়া যাবেনা। জীবনের আর একটা অধ্যায় যেন শুরু হতে চলেছে। আমরা বড় হচ্ছি, কিন্তু আমাদের পড়াশুনো ঠিক মত হচ্ছে না। তখন বড় মামা থাকতেন মধ্যপ্রদেশের ছিনুওয়াড়া ডিসট্রিক্টের ডুঙ্গুরিয়া বলে একটি জায়গায়। ১৮ কিলোমিটার জুড়ে কোলিয়ারি বেল্ট। চারিদিকে ধুলো, বালি আর কয়লার গুঁড়ো উড়ছে সর্বক্ষণ। তারই মাঝে বড় মামার ছোট সুন্দর একটা কোয়ার্টার। বড় মামা সেখানকার চিফ সার্ভেয়ার। আবার একটা নতুন শুরু। সেই অল্প বয়সেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেললাম। ঢাকা থেকে কলকাতা। সেখান থেকে আরও পশ্চিমে, মধ্যপ্রদেশ। আমার পড়াশুনো শুরু হল। কাছাকাছি কোন স্কুল ছিল না। প্রায় ৪ মাইল দূরে একটা স্কুল। কমিউনিকেশান খুব খারাপ। পাহাড়ি রাস্তা। রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটতে হত। সারাদিনে একটা মাত্র বাস। সাইকেল ছাড়া যাতায়াতের কোন পথ নেই। একরকম বাধ্য হয়েই বাড়িতে পড়াশুনো শুরু করলাম। পড়াশুনো শুরু হল বটে, তবে সবই হিন্দিতে। প্রথম প্রথম খুব রাগ হত। কি খটমট ভাষা রে বাপু। কিছুই বুঝি না ছাই! যদিও আস্তে আস্তে সব রপ্ত হয়ে গেল।
বড়মামা বললেন- ”বাঙালি ঘরের মেয়ে শুধু হিন্দি শিখবে, বাংলা শিখবে না! এ কী করে সম্ভব!” বাংলা শেখানোর জন্য আলাদা একজন মাস্টারমশাই রেখে দিলেন। বাড়িতে বই পড়ার চল থাকলেও এই মাস্টারমশাই আমাকে উপন্যাস পাঠের নেশা ধরিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই চিনলাম বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে।
জায়গাটা খুব রুক্ষ হলেও গাছপালা ছিল প্রচুর। বাড়ির সামনেই দু’টো মহুয়া গাছ। সারাক্ষণ মহুয়ার গন্ধে ম-ম করত। তারই একটা ডালে দোলনা লাগিয়েছিলাম। একটু ছাড়া পেলেই- দে ছুট। আমার দোল খাওয়া শুরু। বাড়ির সামনে ছিল ফুলের বাগান। পেছনে অনেকটা জায়গা। মা সেখানে সব্জি বাগান করেছিল। ভেন্ডি, উচ্ছে, কুমড়ো, লাউ, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা কী লাগায়নি! আমাদের মত এত বড় বাগান আর কোন কোয়াটার্সে ছিল না। আরও খানিকটা পিছিয়ে বিশাল বড় একটা জঙ্গল। তার পেছনে নালা। বর্ষাকালে নালাটা ভরে যেত। জলের গর্জন শুনে রীতিমত ভয় করত। সেটাই আবার গ্রীষ্মে শুকিয়ে কাঠ। হেঁটেহেঁটে নালা পেরিয়ে আমরা ওপারে যেতাম। ছোটবেলা থেকেই জল আর জঙ্গল আমার ভীষণ প্রীতি। এখানে এসে তা আরও বেড়ে গেল।
চলছিল ভালোই। তখন প্রায় ৯ বছর বয়স। ছোটমামা থাকতেন বেলুড়ে। দিদিমা আর মেজদিও সেখানে থাকতেন। হঠাৎ কী খেয়াল হল, ছোটমামা বললেন- ”লিলি আমার কাছে থাকবে। এখানে থেকেই পড়াশুনো করবে”। ছোটমামা বেলুড়ে নিয়ে এলেন। আসলে ছোটমামার খুব প্রিয় ছিলাম তো! একরকম ধরে বেঁধেই আমাকে আনা হল। কাছেই বালী বিদ্যাপীঠ স্কুল। ভর্তি হলাম। অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে গেলাম। স্কুলে ছোটখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে অংশ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। নাটক, কবিতাপাঠ কিছু একটা হলেই হল। আমি সবার আগে হাজির। কোন কিছুতেই আগ্রহের খামতি নেই। তখন আমি যেন ডানা মেলে উড়ছি। বাতাসে প্রাণের আনন্দ। বড় হচ্ছি একটু একটু করে। বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে একটা মেয়ের জেগে ওঠা। কিন্তু হঠাৎই আমার সেই উড়তে থাকা ডানা ধাক্কা খেল চরম। কয়েকদিনের ঘুসঘুসে জ্বর। তারপরই ধরা পড়ল টাইফয়েড। ছোটমামা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি সেরেও গিয়েছিল। কিন্তু রিল্যাপস করল। এসব কিছুই মাকে জানানো হয়নি। দ্বিতীয়বার আর না-জানিয়ে উপায় ছিল না। তখন খুব ঘ্যানঘ্যানে হয়ে গিয়েছিলাম। দেওয়াল ধরে ধরে হাঁটতাম। খবর পেয়ে ছুটে এল মা। আমার রোগ জর্জর শরীর দেখে মা’র মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। তবু আমাকে বুঝতে দিলেন না তাঁর ভেতরের ভয়টা। সেকালে টাইফয়েড অনেক কিছু কেড়ে নিত। কারও চোখ, কারও কান। মা দাঁতে দাঁত চেপে যেন আমাকে সুস্থ করার লড়াইয়ে নামলেন। নিজের দিকে তাকিয়ে তখন আমার কান্না পেত। বড় বিশ্রী লাগত নিজেকে। সেকালের মানুষেরা জানেন টাইফয়েড তখন কী মারাত্মক ছাপ ফেলত শরীরে। আমার রূপ গেল ঝরে। যে মেয়ের চুল ছিল হাঁটু পর্যন্ত, তাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হল। তবু মা’র মুখের দিকে তাকালে শরীরে যেন একটু বল পেতাম। ভাবিনি, সেরে উঠবো। মা বললেন- ”তুই না আমার মেয়ে! আমরা হাল ছাড়তে শিখিনি।” মা’র স্পর্শে একটু একটু করে সেরে উঠছিলাম। দাঁড়ানোর বল পেলাম পায়ে। অবশ হাতগুলো সচেতন হয়ে উঠলো। আর বুকের মধ্যে জোর তৈরি করছিল মা’র ভোকাল টনিক। ধীরে ধীরে সুস্থ স্বাভাবিক হচ্ছি। এমন সময় বাড়িতে সুখবরের হাওয়া।
মা বললেন- ”এসেছি যখন এবার ভাইয়ের বিয়ে দিয়েই যাবো”।
মেজদি, দিদিমা দু’জনেই মায়ের কথায় সায় দিলেন। মনে আছে, দিদিমা নির্মলা রায় চৌধুরী তখনও খুব অ্যাক্টিভ। সারাক্ষণ তাঁর ছোটাছুটি লেগেই আছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের সমস্ত কাজ তদারক করতেন। এমনকী আমি দিদিমার শাশুড়িকে পর্যন্ত দেখেছি। তাকে নিয়ে একটা মজার ঘটনাও আছে। আমরা ওকে মধ্যপ্রদেশে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বুড়ি দিব্যি সেখানে গিয়ে কয়লা খাদানের ভেতরে ঢুকে পড়লো। বলেছিল- ”আমি দেখতে চাই মাটির নীচে কী আছে”। পিছু পিছু দ্বিগুণ উৎসাহে আমিও গেলাম। ও বাবা! ভেতরে সে কী অন্ধকার! ”মা গো”- বলে এক চিৎকার। ছুটে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তিনি হেঁটে হেঁটে সব দেখলেন। বেরিয়ে এসে বললেন- ”গেলি না তো! গেলে দেখতে পেতি ভেতরে কী মজার মজার সব যন্তর”।
বড় হয়েও কোনদিন আর কয়লা খাদানের ভেতরে ঢোকার সাহস করিনি। সে বুড়ির সাহস আর উৎসাহ দেখে এখনও তাকে মনে মনে প্রণাম করি।
আমি সেরে উঠলে ছোটমামার বিয়ে দেওয়া হল। আর এই ছোটমামার বিয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমার অভিনেত্রী হয়ে ওঠার এক পরোক্ষ আভাস। দিনক্ষণ মনে নেই, কিন্তু এই ছোটমামার বিয়ের পরই আমি প্রথম থিয়েটার দেখেছিলাম। সেই মঞ্চে দর্শক আসন থেকেই বুকের ভেতরে কেমন বেজে উঠেছিল সাঁঝঘরের অন্দরমহল। ঠিক হল, নতুন বৌকে নিয়ে সবাই মিলে নাটক দেখতে যাওয়া হবে। স্টার থিয়েটারে তখন ‘পরিণীতা’ চলছে। আমি তো লাফাচ্ছি। সবার সঙ্গে আমিও যাবো। সকলেই বারণ করলো- ”এই বয়সে এসব থিয়েটার দেখবে! একদম না। লিলি বাড়িতে থাকবে”। কান্নাকাটি জুড়ে দিলাম। বেগতিক বুঝে ছোটমামা সবাইকে বলে কয়ে একরকম রাজি করালো। ওই যে বললাম, ছোটমামার প্রিয় ভাগ্নীটি বলে কথা। আমাকে না নিয়ে তিনি কী যেতে পারেন! তখন কিন্তু কিছুই বুঝি না। কিন্তু ঐ যে স্টেজের মধ্যে লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে; নানারকম আলো, শব্দ সেসব দেখে অবাক লাগতো। কেমন বিভোর হয়ে যেতাম। মনে হত, আমি যেন দর্শক আসনে নেই, মঞ্চে উঠে গেছি। ওদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে আমিও অভিনয় করছি। তাই নাটক দেখতে গেলে আমার আর খুশির অন্ত থাকত না।
সদ্য টাইফয়েড থেকে উঠেছি। তাই মা আর কাছছাড়া করতে চাইলো না। সঙ্গে করে নিয়ে এলো। আবার চলে এলাম মধ্যপ্রদেশ। মাথায় একটাও চুল নেই। রুমাল বেঁধে ঘুরতাম। ব্যস, ওমনি বন্ধুরা ক্ষেপাতে শুরু করল। আমার নাম হয়ে গেল নেড়ি। কী যে কষ্ট হত তা আর বলার নয়! মাঝেমধ্যে ভয় হত, আর যদি চুল না গজায়! আমি কি নেড়িই থেকে যাবো? যদিও সে ভয় বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। অচিরেই আমি আবার কেশবতী হয়ে উঠলাম। তখন ঘনঘন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। মনে মনে বলতাম- ”খুব নেড়ি বলা না! এবার দেখ কেমন লাগে”।
বড়মামা ইতিমধ্যে ডুঙ্গুরিয়া থেকে দূরে পরাশিয়া বলে একটি জায়গায় বদলি হয়ে এসেছে। পরাশিয়ার কোয়াটার্সটা ছিল আরও সুন্দর। একটা ছোটখাটো বাংলোবাড়ির মত। বাড়ির পেছনে একটা বিশাল মাঠ। মাঠের ধার ঘেঁষে সরু নদী। তারপর রেললাইন। রেললাইন পেরিয়ে ড্যাম। ড্যামের ওপারে একটা ছোট্ট পাহাড়। বাড়ির পেছনের জানলা খুললেই প্রকৃতি যেন আমার হাতের মুঠোয়। ট্রেনের হুইসেল কানে এলে, ছুটে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়িতে থাকলে একদিনও বাদ যেত না। কিভাবে পাহাড়টাকে পেছনে রেখে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে সন্ধের শেষ ট্রেন। আমার কেমন একা লাগতো! ঠিক ওই ট্রেনটার মত।
রেলগাড়ির কথা যখন উঠলই, তখন বলেই ফেলি সেই মজার অভিজ্ঞতাটা। তখন আমি কিশোরী। বাবা-মা কলকাতায়। আমি ও ছোটভাই বাচ্চু (কমল চক্রবর্তী) পরাশিয়ায়। কিশোরীবেলায় একা একা ট্রেনে চড়া আমার জীবনের এক দুর্লভ আনন্দ অনুভূতি।
আমি আর ভাই তখন মাঝেমধ্যেই কলকাতায় ঘুরতে আসি। ফেরার সময় আমাদের ট্রেনে তুলে দেওয়া হত। আমরা একা একাই ফিরে যেতাম। প্রথমে কলকাতা থেকে নাগপুর যাওয়ার ট্রেন। নাগপুর থেকে ছিনুওয়াড়া, সেখান থেকে আবার পরাশিয়ার ট্রেন ধরতে হত।
মনে আছে, নাগপুরে নেমেই আমরা রেলের পরিচিত দুই গার্ড মাস্টারের খোঁজ করতাম। তাদের একজনকে ডাকতাম মুখার্জি মামু বলে। ট্রেনটা কিন্তু নাগপুর থেকে ছিনুওয়াড়া হয়ে সোজা পরাশিয়া যেত না। দু’টো স্টেশন ঘুরে তারপর পরাশিয়া পৌঁছত। তাতে আধঘন্টা সময় বেশি লাগতো। শুধু তাই নয়, আমাদের বাড়ির পেছন দিয়ে ট্রেনটা ঘুরে অন্য স্টেশনে চলে যেত। যা আমার আর ভাই এর মোটেই পছন্দ ছিল না। মুখার্জি মামুকে আগেভাগেই বলা থাকত। মুখার্জি মামু ড্রাইভারকে বলে আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনদিকটায় ট্রেনটা দাঁড় করাতো। আমাদের হাত ধরে নামিয়ে দেওয়া হত। বাগান পেরিয়ে এক লাফে বাড়ি পৌঁছে যেতাম। হাত নাড়িয়ে টাটা করতেই, ট্রেনটা একটা লম্বা হুইসেল ছেড়ে দূরে পালিয়ে যেত। ভাই আর আমার যে কী আনন্দ হত, বলে বোঝানো প্রায় অসম্ভব।
পরাশিয়ায় এসে আবার নতুন স্কুল। অনিন্দ্যপ্রকৃতির মধ্যে এক আশ্চর্য পঠনপাঠন ছিল সেই স্কুলে। জল, জঙ্গল আর নীল প্রকৃতির মাদকতা ছড়িয়ে থাকতো এলাকায়। আমার ছোটবেলার যেন এক স্বপ্নরাজ্য সেই পরাশিয়া।
স্কুলটা ছিল কোয়েড। পেইঞ্চভ্যালি নদীর ধারে পেইঞ্চভ্যালি হাইস্কুল। আমি আর বাচ্চু ওখানে ভর্তি হয়েছিলাম। বাংলার কোন বালাই নেই, সমস্তটা হিন্দিতে। হিন্দি বলতে শিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু গ্রামারটা তখনও রপ্ত হয়নি। স্কুলে হিন্দির টিচার ছিলেন খান স্যার। খান স্যার আমার নড়বড়ে হিন্দি নিয়ে খুব মজা করতেন। একদিন বললেন- ”বোলো লিলি, আজ টিফিন পর কেয়া খায়েগা?” আমি মাথা নীচু করে খুব আস্তে আস্তে বললাম- ”খায়েগা নেহি স্যার, খায়েগি”। শুনে গোটা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠলো। খান স্যার বললেন- ”কামাল হে! বাচ্চি তো শিখ রেহি হে”।
হিন্দি হাতের লেখা যা ছিল সে তো কহতব্য নয়। স্যার রোজ একপাতা করে লিখতে দিতেন। খান স্যার ছিলেন অন্য শিক্ষকদের থেকে একটু আলাদা। মাঝেমধ্যেই ক্লাসরুম থেকে বাইরে মাঠে নিয়ে বসাতেন। বলতেন- চারদেওয়ালের মধ্যে আবার পড়াশুনো হয় নাকি! রবীন্দ্রনাথের বড় ভক্ত ছিলেন। হিন্দির টিচার হলে কী হবে! কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওড়াতেন। বলতেন- ”টেগর কি কবিতা পড়ো। জিন্দেগি বদল জায়েগি”।
খান স্যারকে বোঝা বড় মুশকিল ছিল। কখন যে কী করে বসবেন, আগে থেকে কেউ আন্দাজ করতে পারত না। একদিন আচমকা আমাদের ক্লাসে চলে এলেন। আমাকে বললেন ”লেখা দেখাও”। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কাঁচুমাচু স্বরে বললাম- ”খাতা তো আনিনি স্যার”। আনবো কিভাবে সেদিন তো ওর ক্লাসই ছিল না! শাস্তি দিলেন ”কান ধরে দাঁড়াও”। পরবর্তী হুকুম ” সবাই হিন্দি বই বের করো”। কেউ আর বই বের করেনা। করবে কী করে, কেউই তো বই আনেনি! অবশেষে ভয়ে ভয়ে ক্লাস মনিটর বলল- ”আপনি বোধহয় ভুল করে চলে এসেছেন স্যার, আজ আপনার ক্লাস নেই”। এবার স্যার একটু অপ্রস্তুত। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ”বুঝেছি এইজন্য লিলি খাতা আনেনি। আচ্ছা বেশ আগামীকাল নিয়ে এসো”। সেদিনটা ছিল শনিবার। আমি আস্তে করে বললাম- ”কাল আপনি একা আসবেন স্যার, আমরা কেউ আসব না। কাল রবিবার। ছুটি”। বলেই সবাই মিলে খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলাম। এমনই হুল্লোড়, মজায় আমাদের ক্লাস চলত। খান স্যারের মধ্যে মেঘ রৌদ্রের মত এমন বৈপরীত্য ধরা পড়ত বারবার। এখন বুঝতে পারি, আসলে শিক্ষকের জীবন এমনই হওয়া উচিৎ। শাসনে ও স্নেহে যিনি সবসময় কাছে টেনে নেবেন। তাঁর কথা মনে পড়লে বুকের ভেতর ভারী হয়ে আসে আজও। তিনি হয়ত আজ আর নেই। তবু কখনও কখনও চোখের সামনে দেখতে পাই এই মাস্টারমশাইকে। সব সংকীর্ণতার দেওয়াল ভেঙে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক আশ্চর্য মন নিয়ে।
স্কুলে কোন অনুষ্ঠান হলেই আমার ঘাড়ে দায়িত্ব এসে পড়তো। আমি সেটা উপভোগ করতাম। ফ্রক পড়ে স্কুলে এলে হেডমাস্টার বকতেন। তাই শাড়ি বা সালোয়ার পড়তাম। বয়সের তুলনায় বোধহয় একটু বড়সড় দেখাতো। স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে বিনা বাক্যে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও আমার নেতৃত্ব মেনে নিত।
স্কুলের একটা ছেলের কথা মনে পড়ে। খুব দুষ্টু ছিল। নামটা ভারী মিষ্টি। শিউ পাল। ক্লাস শুরুর আগে প্রতিদিন প্রেয়ার হত। প্রেয়ার লিড করত শিউ পাল। আমরা সবাই ওকে ফলো করতাম। বিহারে ট্রাইবালদের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেত। শিউপাল ছিল বিবাহিত। তবু ও সারাক্ষণ আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। ওর বোন শিউকুমারি আমার বন্ধু ছিল। শিউকুমারিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ”তোর ভাই আমার দিকে অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে কেন রে?” ও কোন উত্তর দেয়নি। আসলে অতগুলি অবাঙালি মেয়ের মধ্যে একটা সুন্দরী বাঙালি মেয়ে। এক মাথা চুল, টানা টানা চোখ দেখে ওঁর বোধহয় আমাকে মনে ধরে গিয়েছিল। ব্যস আর কোথায় যাবে! ছোটমাসিরা ওকে নিয়ে ক্ষ্যাপাতে শুরু করল। ছেলেটা রোজ বাংলোর পেছন দিকে এসে বাঁশি বাজাত। একটা অদ্ভুত মনকেমন করা সুর। একদিন বড়মামা ওকে খুব দাবড়ে দিলেন। তারপর আর কোনদিন আসেনি। পরে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে শিউপাল কী অন্যায় কিছু করেছিল? বাঁশিটা তো খারাপ বাজাতো না! তবে? কত বয়স হল ওর? ও কি এখনও বাঁশি বাজায়? বেঁচে আছে শিউপাল?