ঋতু বলল আপনি না তুই?
তখন বিশ্বরূপায় বৈশাখী ঝড়’ নাটকটি নিয়মিত চলছে। অভিনয়ে আমি, শুভেন্দু, শাশ্বত , আরো অনেকে। একদিন রিহার্সালে সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, আমাদের মন্টু এলো। সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলে। ছেলেটি আমাকে একটা সিরিয়ালের অফার দিতে এসেছে। নাম ‘রাঙা পিসিমা’। এবিসিএল এর প্রজেক্ট (অমিতাভ বচ্চন প্রযোজিত। পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)। ছেলেটির কোঁকড়া চুল, চোখেমুখে শার্পনেস, দেখতে সুন্দর। কিন্তু ধরন-ধারণ বড্ড মেয়েলি। মেয়েলি ছেলেরাও আজকাল ছবি বানাচ্ছে বুঝি? আমি শুরুতে একেবারেই গুরুত্ব দিইনি। গুরুত্ব না দিলে কি হবে ধীরে ধীরে সকলের নজর কেড়ে নিল। বাংলা ছবির এক নম্বর পরিচালকের জায়গাটি পাকা করে ফেলল। বুঝলাম ইন্ডাস্ট্রিকে ওর অনেক কিছু দেওয়ার আছে। ছেলেটির নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ।
‘রাঙা পিসিমা’র কাজটা আর হলোনা। টাকা পয়সার বিস্তর ঝামেলায় এবিসিএল এর সমস্ত প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন বাদেই আরেকটা অফার নিয়ে এলো ঋতু। ফুড প্রোডাক্ট এর কাজ। আমি, কুণাল মিত্র আর জুন মালিয়া। সেটা ছিল জুনের ডেবিউ। জুন তখন সদ্য যুবতী। আমার চরিত্রটা কছিল বিদেশ থেকে আসা জুনকে বাঙালি খাবারে অভ্যস্ত করে তোলা। মূলত মুড়ির নানা রকম প্রিপারেশন শেখানো। মুড়িমাখা, তেলেভাজা ইত্যাদি। শেষে মেয়েটি যখন ফিরে যাবে শপিং এর যাবতীয় জিনিস ফেলে রেখে প্যাকেট প্যাকেট মুড়ি সুটকেস বোঝাই করে ফেরে। ওই ছোট্ট কাজে পরিচালকের অধ্যবসায় ছিল চমকে দেওয়ায় মতো। সেদিনই বুঝেছিলাম ঋতুপর্ণ ঘোষ লম্বা রেসের ঘোড়া।
‘এবং ঋতুপর্ণ’ বলে ই টিভি বাংলায় একটা অনুষ্ঠান হতো। ঋতু হোস্ট। নতুন ধরনের কনসেপ্ট। সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে নিখাদ আড্ডা। আমাকে প্রায়শই ডাকত। তখন খুব কাজের চাপ। একের পর এক সিরিয়াল। যাব যাব করেও আর যাওয়া হচ্ছিলনা। অবশেষে দিন ঠিক হলো। সেটা ছিল কোন একুশে জুলাই। চারিদিক থেকে মিছিল বেরিয়েছে। শহরে ভয়ানক যানজট। আমার পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আদর দিয়ে সেটে বসালো ঋতু। প্রথমেই ওর প্রশ্ন ”জানিস তো আমি সবাইকে ‘তুই’ বলে বেড়াই বলে লোকে আমাকে খুব গালমন্দ করে। বলে আমি নাকি বড়দের সম্মান দিতে জানি না। আচ্ছা বলতো তোকে রেকর্ডিং এর সময় কি বলবো ‘তুই’ ‘তুমি’ না ‘আপনি’ ?” আমার সহজ উত্তর ”তুই যেটায় স্বচ্ছন্দ” শেষমেষ অনুষ্ঠান চলাকালীন ‘তুমি’ সম্বোধনটাই বেছে নিল। মনে আছে ‘রাঙা পিসিমা’র শুটিংয়ের প্রথম দিন ‘আপনি’ ডাকত দ্বিতীয় দিন সেটা ‘তুমি’তে গড়ালো তৃতীয় দিনে ”আর পাচ্ছিনা রে ‘তুই’ বলি”? একচোট হেসে মজা করে বললাম ”বলনা— তুই তো পারলে তোর মাকেও তুই বলিস” যদিও তার কয়েকদিনের মাথায় ‘রাঙা পিসিমা’র কাজটা বন্ধ হয়ে যায়।
মনে আছে ‘এবং ঋতুপর্ণ’র শুরুতে একটা লম্বা গৌরচন্দ্রিকা করলো। ”আমি ‘রাঙা পিসিমা’ নামে একটা সিরিয়াল করব বলে ঠিক করেছিলাম। কাজটা হয়নি ওই গল্পটা নিয়ে একটা ছবি বানাবো ঠিক করেছি। রাঙা পিসিমা চরিত্র করবে লিলিদি। আপনাদের সামনে আজ সেই লিলি চক্রবর্তী।” আমি তো আশ্চর্য। ছেলেটা বলে কি! এতগুলো দর্শকের সামনে এভাবে কমিট করে দিল? বললাম ”দেখ তুই কিন্তু হাজার হাজার দর্শকের সামনে কথাটা বললি। পারবি তো আমাকে নিতে?”
-”তোকে ছাড়া আমি কাজটাই করবো না” আমাদের আড্ডা সেদিন জমে উঠেছিল। সাধারণত একজনকে নিয়ে দুটো এপিসোড হতো। আমাদেরটা চারটে এপিসোড গড়ালো। যদিও রাঙা পিসিমার গল্প অবলম্বনে ওঁর ‘শুভ মহরৎ’ ছবিতে আমার কাজ করা হয়নি। হঠাৎ একদিন প্রডাকশন ম্যানেজার নির্মল ঘোষের ফোন। গড়গড় করে বলতে লাগল ”জানোতো লিলি প্রডিউসারের সঙ্গে ঋতুদার ফাটাফাটি ঝগড়া চলছে। ঋতুদা তোমাকে নেবেই এদিকে প্রডিউসারের পছন্দ রাখি গুলজার। ‘রাঙা পিসিমা’য় আমার আর কাজ করা হলো না। কিছুদিন বাদে রাখি এলো কলকাতায়। যদিও ছবিটি একেবারেই চলল না।
এসবের বেশ কিছুদিন বাদে একদিন সকাল সকাল ঋতুর ফোন।
-” কাল কি করছিস রে?”
-”বাড়িতেই আছি। কেন বলতো?”
-” আচ্ছা বেশ বাড়িতেই থাকিস আমি আসছি।” পরের দিন ঠিক চলে এলো। এসেই আবেগ মাখানো স্বরে ওর প্রশ্ন ”কি রে রাগ করেছিস আমার ওপর?” আর যাই হোক ঋতুর ওপর রাগ করে থাকা ছিল অসম্ভব। আমি কেন কেউই ওর উপর রাগ করে থাকতে পারত না। ”বললাম ওমা তোর উপর রাগ করতে যাব কেন?”
-” রাঙা পিসিমায় নিতে পারলাম না!”
-”ওসব কথা রাখতো! নতুন কি কাজ করছিস বল?” জানালো ‘চোখের বালি’ করবে। বোম্বে থেকে ঐশ্বর্য রাই আসছে। ঐশ্বর্য ‘বিনোদিনী’ চরিত্রে। বুম্বা ‘মহেন্দ্র’। আমাকে ‘রাজলক্ষ্মী’ চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। সেদিনই কথা পাকা। বলল ”বুঝতেই তো পারছিস বম্বে থেকে আর্টিস্ট আনছি টাকাটা একটু কম নিস” আমি মজা করলাম ”ভালই তো ফন্দি এঁটেছিস। বোম্বে থেকে একটা করে আর্টিস্ট আনবি আর কোপ পড়বে আমাদের ওপর?” যদিও পেমেন্ট হতেই বুঝলাম আমাদের ওপর এতোটুকু কোপ পড়েনি। বরং যথেষ্ট সুবিচার হয়েছে।
লুক টেস্ট হল ঋতুর বাড়িতেই। ঘরে ঢুকলে বোঝা যায় কী অসম্ভব শিল্পবোধ ছেলেটার। পরিপাটি করে সাজানো চারপাশ। লুকটেস্ট নামমাত্র। মেতে গেলাম তুমুল আড্ডায়। ঋতুর মা এসে সে কি বকুনি ”কিরে তুই! কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এত সিনিয়র একজন আর্টিস্টকে ‘তুই’ বলছিস?” আমি হেসেই কুটোপাটি। উত্তর দিলো ”তুমি তো জানো মা আমি এরকমই” মার প্রতি ঋতুর ছিল অগাধ ভালোবাসা। মাকে নিয়ে হাজারো গল্প। নানা প্ল্যানিং। মা চলে যেতেই ছেলেটা কেমন একটা হয়ে গেল।
ঋতুর সেটে এলে মনে হত ‘শাখা প্রশাখা’ কিংবা ‘জন অরণ্যে’র সেটে আছি। একেবারে সত্যজিৎ ঘরানা। প্রত্যেকটা বিষয়ে পরিচালক এর সমান নজর। কাজের ব্যাপারে ভীষণ পারফেকশনিস্ট। সহজে কোনকিছু পছন্দ হতো না। শুটিং চলাকালীন মাঝেমধ্যে চিৎকার করে উঠতে ”কিছু হচ্ছে না কিচ্ছু না”। একটা দৃশ্যের যে কতবার রিটেক হয়েছে! যদিও শেষমেষ যেটা বেরোত সেটা মাস্টারপিস।
‘চোখের বালি’র একটা দৃশ্য ছিল- আমি মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করতে করতে মহেন্দ্র তিরস্কার করছি। অংশটার শুটিং শেষ হতেই এসে জড়িয়ে ধরলো। সবাই তখন হাততালি দিচ্ছে। বুঝলাম ওদের পছন্দ হয়েছে। ‘আনন্দলোকে’ ‘চোখের বালি’র কথা লিখতে গিয়ে আমার জন্য অনেকগুলো লাইন খরচ করেছিল ঋতুপর্ণ ঘোষ। ভাবিনি ছবিটা এত সাড়া ফেলবে! ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ আর ‘চোখের বালি’ একসঙ্গে রিলিজ করে। ফেলুদা কে পেছনে ফেলে ঋতুর ছবি বাজি জিতে নিল। যদিও হাজারও সাফল্যের মাঝে আমার একটা অভিযোগ আজও থেকে গেছে। বিনোদিনীর ডাবিং নিয়ে ঋতু আরেকটু যত্নবান হলে বোধহয় ভালো হতো।