প্রথম আউটডোর

প্রথম আউটডোর

জীবনের প্রথম আউটডোর শুটিং বীরভূমে। তারাশঙ্করবাবুর বাড়ির খুব কাছে। মাঝেমধ্যেই উনি আসতেন- শুটিং কেমন হচ্ছে, আমরা ঠিকঠাক আছি কিনা এইসব খোঁজখবর নিতে। দেখে অবাক হতাম, অত বড় একজন সাহিত্যিক অথচ কী সাধারণ তাঁর জীবনযাপন। কী আন্তরিক ব্যবহার। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটা পুরনো দালান বাড়িতে। দোতলার ঘরে থাকতাম মেয়েরা। আর নীচে একটা বড় ঘরে ডরমেটরির মত করে ছেলেদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। মেয়েদের মধ্যে ছিলাম আমি, অনুভাদি (অনুভা গুপ্ত) আর রঞ্জনা (রঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়)। রঞ্জনা ছিল হিরোইন। ছবিতে ওঁর চরিত্রের নাম পাখি। অন্যদিকে ছেলেদের মধ্যে দিলীপ রায়, রবি ঘোষ, কালী ব্যানার্জী আরও অনেকে। বাড়ির সামনে ছিল বিরাট একটা উঠোন। আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা কুয়ো। ছেলেরা ওখানেই স্নান করত। মেয়েদের জন্য ওপরে একটা বাথরুম ছিল। আমরা আসবো বলে বাড়ির চারপাশে জঙ্গল কেটে, ব্লিচিং ছড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়েছিল। মনে আছে তবু পরপর দুদিন সাপ বেরলো। আমরা একটু ভয়ে ভয়েই থাকতাম। দুপুরে শুটিং স্পটেই খাওয়া দাওয়া সেরে নেওয়া হত। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। সারা গায়ে কাদা মেখে শুটিং। স্নান না করে উপায় আছে! এরপর তপনদা আমাদের সবাইকে নিয়ে বসতেন। পরের দিনের শুটিং নিয়ে খানিকটা আলোচনা হত। ঠিক দশটার মধ্যে রাতের খাবার চলে আসতো। টেবিল চেয়ার নয়, লম্বা বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে পাত পেড়ে খাওয়া। তপনদা থেকে ইউনিটের একজন সামান্য কর্মী পর্যন্ত একসঙ্গে গল্প গুজব করতে করতে রাতের খাওয়া সারতাম। খাওয়া হলেই ঘুম। তপনদার কড়া নির্দেশ। যদিও ছেলেরা মোটেই বাধ্য ছিল না। তপনদা আর ক্যামেরাম্যান বিমল মুখার্জী ঘুমিয়ে পড়লেই অল্প আলো জ্বেলে একে একে বেম্বদত্যিরা সব জেগে উঠতো। গল্পগুজব, লেগপুলিং থেকে মদের আসর- চলত সবই কিন্তু খুব সন্তর্পণে। আমরা বলতাম- ‘নাও শুরু হয়ে গেল ভূতের কেত্তন’। কিন্তু তাই বলে পরদিন শুটিং শুরু হতে এতটুকু দেরি হত না। যে যাই করুক, শুটিং স্পটে প্রত্যেকে ঠিক সময়ে পৌঁছতো। তখন সবাই ছিল ভীষণ ডিসিপ্লিনড।

দ্বিতীয় বারের আউটডোর শুটিং-এ লোক আরও বাড়লো। মজাও দ্বিগুণ। এবার তারাশঙ্করবাবুর বাড়ির ঠিক পাশের ঘরেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। উনি সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গেই সময় কাটাতেন। কী সুন্দর কথা বলতেন। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তারাশঙ্করবাবুর উপস্থিতি আমাদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করত।

দ্বিতীয়বারের আউটডোর শুটিং-এ আরেক আবিষ্কার অনুভাদির হাতের রান্না। শুটিং এর মাঝে ফাঁক পেলেই আমরা বায়না করতাম। রান্নার ব্যাপারে অনুভাদিরও কোন ক্লান্তি নেই। একবার বললেই হল। হাতা-কড়াই নিয়ে বসে পড়তেন। কত রকমের পদ যে রাঁধতে জানতেন অনুভাদি তা আর বলার নয়। সেবার অনুভাদির কাছ থেকে আমিও দু-একটা শিখে নিয়েছিলাম। আসলে তখন আউটডোরের পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। এখন তো সবার আলাদা আলাদা রুম। অর্ডার করলে খাবার চলে আসে। তখন ছিল ঠিক উল্টোটা। আমরা সবাই পরিবারের মত থাকতাম। মনে আছে শুটিং এর শেষ দিন ট্রেনে করে বাড়ির দিকে রওনা হব, সবার চোখে জল! অল্প সময়ে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বগুলো ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সেই বন্ধুত্বগুলো কীভাবে যেন হারিয়ে গেল!

তপনদার সঙ্গে প্রথমবার শুটিং এর অভিজ্ঞতাটাও ছিল অসাধারণ। আমি এই শুটিং এর আগে ওঁর কোন সিনেমাই দেখিনি। কাজ করতে করতে একজন অসম্ভব মেধাবী মানুষকে আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম উনি শুধু সিনেমা তৈরি করেন না, সিনেমাতেই বাঁচেন। উনি আমাদের এত সুন্দর ভাবে দৃশ্যগুলি বুঝিয়ে দিতেন, কোন হোমওয়ার্কের প্রয়োজন হত না। কাহারদের ভাষা, হাড়িয়া খেয়ে নাচ, এসব আমার বড্ড খটমট লাগতো। তপনদার কাছে তো ওসব জলভাত। ভুল হলে বারবার দেখিয়ে দিতেন। এতটুকু বিরক্ত হতেন না। তপনদার জন্যই নসুবালা হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। অনেকেই বলে এটা নাকি আমার অন্যতম সেরা কাজ। কে জানে! আমি কখনই এসব নিয়ে কিছু বলার সাহস করিনি। শুধু মনে মনে তপনদাকে প্রণাম জানিয়েছি।

আমি অসিত সেনের ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’- ছবিতে ছোট্ট একটা চরিত্র করেছিলাম। অসিত সেন আর সত্যজিৎ রায় ছিলেন বন্ধু মানুষ। সত্যজিৎ রায় তখন নতুন একটা ছবি করবেন। অল্প বয়সের মেয়ে খুঁজছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোডাকশান ম্যানেজার ভানুবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়ি। বাবাও সঙ্গে গিয়েছিলেন। উনি তখন লেক টেম্পল রোডে থাকেন। পৌঁছতেই ওঁর স্ত্রী বিজয়া রায় আমাকে নতুন একটা শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিলেন। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা হল। কোনটা খোঁপা করে, কোনটা খোঁপা ছাড়া। ছবি তোলা শেষে বললেন- ”আমি একজনের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। স্কুল থেকে ছুটি পাচ্ছে না। সমস্যা মিটে গেলে কিন্তু ওকেই নেবো। ওই মেয়েটি প্রথম পছন্দ। তুমি দ্বিতীয়। তখন যেন মন খারাপ কোরো না”।

মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম ”আচ্ছা”। মেয়েটির সমস্যা মিটে যায়। আমার আর কাজ করা হয়নি। রিলিজের পর অভূতপূর্ব সাড়া পেল ছবিটি। নাম ‘অপুর সংসার’। মেয়েটি আমার ইন্ডাস্ট্রির বন্ধু রিংকু। ভালো নাম শর্মিলা ঠাকুর। তখন আমার বয়স অল্প। সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি! ওঁর সঙ্গে ওই ছোট্ট বয়সে দেখা হওয়াটাও যে বিরাট ব্যাপার তা পরে বুঝেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *