অজয় কর ও কাঁচ কাটা হীরে
অজয় করের ‘প্রভাতের রঙ’ ছবিতে সেকেন্ড লিড ছিল আমার। বিশ্বজিৎ আর শর্মিলা মূল চরিত্রে। আউটডোর হয়েছিল আর.জি.কর-এ। ইনডোর শুটিং এন.টি-২ স্টুডিয়োতে। অজয়দা ছিলেন রসিক মানুষ। বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। ইনডোর শুটিং এর ফাঁকে একদিন গল্পে গল্পে বললেন- ”তুমি কাঁচকাটা হীরা পরসো?” তখন আমি সময় পেলেই গল্পের বই পড়তাম।
বললাম- ”কেন পড়ব না! ওটা আমার খুব প্রিয় একটা লেখা”।
-”তুমি ‘উমা’র চরিত্রটা করবা”।
মুহূর্তে আমার মুখে আলো এসে পড়লো। উমা মানে তো গল্পের নায়িকা। বাড়িতে এসেই অজিতকে বললাম- অজয়দা আমাকে হিরোইনের চরিত্র অফার দিয়েছে। কোন দিকে মন না দিয়ে পুরো লেখাটা এক নিঃশ্বাসে আরও একবার পড়ে ফেললাম।
ইতিমধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আরও দু-একটা ছবির অফার পেয়েছি। অনেকগুলো কাজের শুটিং চলছে একসঙ্গে। মাঝেমধ্যেই নানাজনের মুখে শুনছি অজয় করের নতুন ছবির কথা। কেউ বলছে বম্বে থেকে নতুন হিরোইন আসবে। কেউ বলছে ওটা নাকি মাধবী করবে। আমি শুধু শুনছি। একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে! বোধহয় এই রোলটাও ফস্কে গেল। ইতিমধ্যে আমি আর অজিত একটা ছবির কাজে বম্বে যাচ্ছিলাম। ফ্লাইটে তখনকার নামকরা প্রোডিউসার আর.ডি.বনশল এর সঙ্গে দেখা। ফ্লাইটেই অজিতের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল ওঁর। ফিরে এসে বললো- ”তুমি অজয় করের ছবির আশাটা ছেড়ে দাও। উনি আর্টিস্ট খুঁজতে বম্বে যাচ্ছেন। হয়ত ওয়াহিদা রহমান অভিনয় করবেন”।
বম্বে পৌঁছে একটা ভোজপুরি ছবি করলাম। ‘হামার সংসার’। শুটিং সেরে অল্পদিনের মধ্যে ফিরেও এলাম। বড্ড দ্রুত গতিতে দিন কাটছিল। এটা না হয় নাই বা হল। অজয়দা তো আরও ছবি করবেন। হয়তো আবার সুযোগ আসবে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একদিন সকালবেলা ফোন-
লিলি আইজকা কি করতাসো?
সেদিন কোন কাজ ছিল না। বললাম- শুটিং নেই, বাড়িতেই আছি।
-বাহ! খুব ভালা, আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসতাসি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন। সঙ্গে প্রোডাকশান ম্যানেজার বিমলবাবু।
এসেই গড়গড় করে স্ক্রিপ্ট পড়তে লাগলেন। বললেন-
কেমন হইসে কও দেহি?
কি আর বলবো! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ”শুনো, অনেকে অনেক কথা কইসে। আমি একজায়গায় খাড়াইয়া ছিলাম। লিলি করবো তো লিলিই করবো। হেই চরিত্রে লিলি ছাড়া আর আমার মনের ভিতরে কেউ নাই। বিমলবাবু আপনি হর লগে কথা ফাইনাল করেন”।
বললাম- ”আপনি যে আমাকে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি বিনে পয়সাতেও ছবিটা করতে রাজি”।
‘কাঁচকাটা হীরে’র আউটডোর শুটিং হয়েছিল ডুয়ার্সে। ডুয়ার্সের সেই নিবিড় বনচ্ছায়া, প্রকৃতির আশ্চর্য সব শব্দ, গন্ধ এখনও মনে আছে। তখন নীল আকাশের সঙ্গে কার্যত পাল্লা দিয়ে সবুজ মাথা তুলে দাঁড়াতো ডুয়ার্সের জঙ্গলে। প্রকৃতির মধ্যে যে এক আশ্চর্য শক্তি আছে, সবুজ রঙের মধ্যে যে নানা বৈচিত্র্য আছে, গাছেদেরও যে নিজস্ব ভাষা আছে- ‘কাঁচকাটা হীরে’র আউটডোর আমাদের সেইসব জানাচ্ছিল। ডুয়ার্সের সেই ছবি অনেকগুলো অনেকগুলো ভার্জিন ফ্রেম তৈরি করে রেখেছে আমার বুকের মধ্যে। সৌমিত্রদা, শুভেন্দুদা, বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস এমন সব একগুচ্ছ স্টারদের নিয়ে কাজ। ছবিটা সাড়া ফেলেছিল। এখনও মাঝেমধ্যে অনেকের থেকে ফিডব্যাক পাই। পুরনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে মন্দ লাগেনা।