ধুর শুভেন্দু!

ধুর শুভেন্দু!

অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিভার তুলনা ছিল না। কি মঞ্চ কি চলচ্চিত্র সবেতেই অনবদ্য। ওঁর সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেছি প্রচুর। মনে পড়ে বৈশাখী ঝড়’ নাটকের কথা। নীলিমা দাস এর পরিবর্ত চরিত্র হিসেবে আমাকে কাস্ট করল শুভেন্দু। ওই ছিল নাটকটির পরিচালক। ওর ইচ্ছে নীলিমার মতো স্বরক্ষেপণে অভিনয়টা করি। আমি কোনদিন কারও মত হয়ে উঠতে পারিনি। চিরকাল নিজের মত। এই সময়টা শুভেন্দু যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় পছন্দ না হলে উইংস এর পেছন থেকে ‘ধুর ধুর’ করত! জানতাম আমার অভিনয়ের সময়ও একই শব্দ আসবে! আর হলও সেটা! নীলিমা দাসের মতো সুর করেই ডাকতে হবে নাটকের বিভাস নামক চরিত্রটিকে। আমার মোটেও অমন ন্যাকা ন্যাকা ডাক পছন্দ ছিল না! উইংস এর পিছন থেকে ধুর শব্দটি কানে এসে লাগত! শুধু কি আমার ক্ষেত্রে? শুভেন্দুর এই বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হতো প্রায় সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের লক্ষ্য করে! তাই ঘনিষ্ঠ বৃত্তে শুভেন্দু নামটাই হয়ে দাঁড়ালো ‘ধুর শুভেন্দু!’ ভাববেন না অপমান করার জন্য এসব বলছি। ওঁর মত প্রতিভাধর অভিনেতা এদেশে খুব কমই আছে। তবু পরিচালক শুভেন্দুর ওই আচরণটা আমাদের শিল্পী মনে কেমন কাটার মত খচখচ করত! তখন হাজারো সমস্যার মধ্যেও ছিল শুভেন্দু! ঘরে বাইরে নানা ঝামেলা সামলাতে সামলাতে ভেতরে ভেতরে ভেঙেচুরে যাচ্ছিলো ছেলেটা! ফাসস্ট্রেশন থেকে বাঁচতে তখন নিয়মিত মদ্যপান স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন হয়েছে প্রচুর ড্রিঙ্ক করে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় মঞ্চে উঠেছে। ও জাত অভিনেতা তাই অভিনয় করে গেছে বটে কিন্তু কাছাকাছি ছিলাম তো তাই জানতাম শুভেন্দু ভালো নেই!

আমাদের সময় ওর মতো স্মার্ট নায়ক আর কজন! উত্তম, সৌমিত্রকেও কখনও কখনও পাল্লা দিতে দেখেছি! এখনও চোখের সামনে ভাসে ‘চৌরঙ্গী’তে উত্তমের পাশাপাশি অভিনয়। প্রায় তিন চার দশক পর যখন সব ছাপিয়ে যখন এসব ভাবি শুভেন্দুর ন্যাচারাল অভিনয়, বলিষ্ঠ চেহারা আর সুভদ্র মানুষটাই চোখে ভাসে। হয়ত তখন আমার অভিনেত্রী সুলভ ইগোর কারণেই পরিচালক শুভেন্দুর ওই রিয়্যাকশন মেনে নিতে পারিনি! অন্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি তাদেরও একই অভিজ্ঞতা। কে জানে হয়ত আমারই দোষ! অভিমানে , অপমানে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অভিনয় চলত, ওঁর পরিচালনায় অভিনয় করতাম। কিতু দীর্ঘদিন আমাদের মধ্যে কোন কথা ছিল না! তারপর একদিন সমস্ত দ্বিধা ভেঙে স্টুডিয়োয় ডাবিং করতে করতে হঠাৎ মোলায়েম স্বরে বলে উঠল ”খেয়েছো তো? নাকি শুধু কাজই করে যাচ্ছ!” সেদিনের ওর গলার স্বরটা আজও আমার কানে বাজে! ওঁর এই মহানুভবতা আমার চিরকালের সঞ্চয়! আজকাল মনে হয় যদি একবার ওর কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে বলতে পারতাম ” আমি তো তোমার বন্ধু ছিলাম। তোমার কষ্টটা ভাগ করে নেওয়ার দায়িত্ব তো আমার ছিল। তবে কেন অমন ব্যাঙ্গ করলাম!” এ আপশোশ আমার যাওয়ার নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *