অব্যক্ত যন্ত্রণা, অভিনয়ে মুক্তি

অব্যক্ত যন্ত্রণা, অভিনয়ে মুক্তি

বাবা কলকাতায় এসে বরানগরে বাড়ি ভাড়া নিল। সেখান থেকে পরে মানিকতলা। আমাদের তখন ভয়ানক দৈন্যদশা। বর্ষায় ঘরের চাল বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। মা দেখলো, বাবার একার পক্ষে আর সংসার চালানো সম্ভব নয়। মা’র ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের শখ। একটা নাটকের দলে যোগ দিলেন। তখন বয়স কিন্তু কম নয়। ছোটখাটো যা রোল পেতেন তাই করতেন। তাতে যদি দু’টো পয়সা আসে, তখন সেটাই অনেক। যদিও পরবর্তী সময়ে মা ‘নান্দীকার’-এর বিখ্যাত অভিনেত্রী হয়েছিলেন। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, ‘শের আফগান’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরী’ এমন সব নাটকে দীপালি চক্রবর্তী তখন নামকরা অভিনেত্রী। মেজদিও মা’র দেখাদেখি অফিস ক্লাবে অভিনয় শুরু করল। উদ্দেশ্য একটাই- সংসারে দু’টো পয়সা যোগানো। এসব আজ এত সহজে বলে ফেলতে পারলাম বটে, কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষিতে মা’র পক্ষে কাজটা তেমন সহজ ছিল না। তবু সর্বংসহা ধরিত্রীর মত সব সমালোচনা দূরে ঠেলে রেখে সংসার বাঁচাতে তিনি অভিনয়ে নেমেছিলেন। আমি সদ্য মধ্যপ্রদেশ থেকে কলকাতায় এসেছি। বাড়িতে বসে বসেই সময় কাটে। একদিন মেজদি বললো- ”যাবি আমাদের রিহার্সাল দেখতে?” আমি তো এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলাম। সম্মতি জানাতে এক মুহুর্ত লাগলো না। ক্লাবটার নাম ছিল ‘নবনাট্যম’। তখন ‘মেঘনাদবধ কাব্যের’ রিহার্সাল চলছে। ডিরেক্টর দেবব্রত সুর চৌধুরী। মেজদির সঙ্গে চলে এলাম। একমনে রিহার্সাল দেখতাম। হঠাৎ ডিরেক্টর বলে বসলেন- ”খুকি একটা রোল করে দেবে?” আমি কিছু না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে ”হ্যাঁ” বলে দিলাম। মেজদি সেদিন খুব বকেছিল- ”বাড়িতে না জানিয়ে তোমার ‘হ্যাঁ’ বলা মোটেও উচিৎ হয়নি”। বললাম- ”ভেবো না ঠিক মানিয়ে নেবো”। শেষ পর্যন্ত অভিনয় করলাম ‘মেঘনাদ বধ-এর একটা ছোট্ট চরিত্রে। নিউ এম্পায়ারে মর্নিং শো ছিল। কে জানে কেমন হল! সেসব মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে নাটক শেষ হতেই দু’জন লোক এসে খুব প্রশংসা করলেন। বললেন- ”আমাদের অফিস ক্লাবে অভিনয় করবে?”

আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি তো যেচে কারও কাছে যাচ্ছিনা। আমার নাটক দেখে লোকে আসছে। তার মানে অভিনয় মন্দ হয়নি। সংসারের অবস্থা তো ভালো নয়! আমিও না হয় মা আর মেজদির মত খানিকটা চেষ্টা করেই দেখি! যদি দু’টো পয়সা আসে খারাপ কী! রাজি হয়ে গেলাম। শুরু হল রিহার্সাল। নাটকটার নামটা মনে নেই। ডিরেক্টর ছিলেন কুণাল মুখার্জি। অল্প সময়েই কুণালদার প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলাম। খুব মজা করে রিহার্সাল করতাম। রিহার্সালের ফাঁকে একদিন চমকে দিলেন কুণালদা— ”ছবিতে অভিনয় করবি লিলি?”

আমি একেবারে অপ্রস্তুত। তখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না। মুচকি হেসে বললাম- ”যা! মশকরা কোরো না!”

-”নারে সত্যি! আমার দাদা কনক মুখার্জির ছবিতে তোকে একটা ছোট রোল করে দিতে হবে।”

মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল পরাশিয়ার একটা ছোট্ট ঘটনার কথা। আমাদের পাশের বাংলোতেই শচীন মামা বলে একজন থাকতেন। শচীন মামা আমার হাত দেখে বলেছিলেন- ”হ্যাঁ রে লিলি তুই তো অভিনেত্রী হবি”। আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম- ”বাজে কথা বোলো না তো শচীন মামা!”

তবে কী শচীন মামাই সত্যি?

বাবার সঙ্গে এসে পৌঁছলাম টালিগঞ্জের ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিও’য়। তখন আমরা উল্টোডাঙায় থাকি। ডিরেক্টর কনক মুখার্জি জানালেন আজই শুটিং। ছবির নাম ‘ভানু পেল লটারি’। বাবা তো ঘাবড়ে গেলেন। বাড়িতে কিছুই বলে আসা হয়নি। কতক্ষণ সময় লাগবে কে জানে! বাবা বললেন- ”তুমি চুপটি করে বসো। আমি চট করে বাড়িতে খবর দিয়ে আসি”। তখন কলকাতা শহরে এখনকার মত এত যানজট ছিল না। ১৫ মিনিটেই টালিগঞ্জ থেকে উল্টোডাঙা পৌঁছে যাওয়া যেত। সেই প্রথম স্টুডিওর মেকআপ রুমে ঢুকলাম। সেখান থেকে শুটিং ফ্লোর। প্রথম দৃশ্যটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে- আমি টাইপ মেশিনে মুখ গুঁজে আছি, পেছন থেকে একজন হঠাৎ ডাকলেন। চমকে উঠলাম আমি। তারপর কিছু ডায়লগ। আমার নাম ছিল মিস ঢ্যাঙ। বেশ মজার ছবি। কো–অ্যাক্টর ছিলেন জহর রায় ও কমল মিত্র। সদ্য মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছি। উত্তম-সুচিত্রার দু-একটা ছবি দেখেছি। ছবি বিশ্বাসের নামটা জানি। আর তো কাউকেই চিনি না। অজান্তেই দু’জন বড় মাপের অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করে ফেললাম। তখন অভিনয়ের কী বা বুঝি! কনক মুখার্জি যা যা বলেছিলেন ঠিক তাই করলাম। শুটিং শেষে সে কী আনন্দ। ভাবতেই পারছি না সিনেমায় অভিনয় করে ফেললাম। বাড়ি ফিরে উল্টোডাঙার ঘুপচি ঘরটাকেও সেদিন স্বর্গ মনে হয়েছিল।

পরদিন রিহার্সালে যেতে কুণালদা বললেন- তোর জন্য দাদার কাছে খুব জোর বকুনি খেয়েছি। শুনে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। নির্ঘাত খুব বাজে অভিনয় করেছি! পরিচালক বোধহয় খুব গালমন্দ করেছেন! ওমা! কুণালদা বলে কিনা- ”দাদা বলছিল মেয়েটাকে আগে পেলি না? কী সাবলীল অভিনয়। কোন ভয়ডর নেই। আমি তো ভেবেছিলাম কমল মিত্রের সামনে ডায়লগ বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে যাবে! ওকে আগে পেলে হিরোইন করতাম”। আমি আর ভালোলাগা চেপে রাখতে পারলাম না! হাসতে গিয়ে হঠাৎ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ছোটবেলায় মা শিখিয়েছিল শুধু দুঃখে নয় আনন্দেও চোখে জল আসে। সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম কাকে বলে আনন্দাশ্রু!

ভেবেছিলাম, কপাল জোরে একটা ছবিতে চান্স পেয়ে গেছি। এই শুরু এই শেষ। মিরাক্যাল বারবার হয়না। কিন্তু ঘটলো উল্টোটাই। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটা ছবির ডাক এলো। ‘ভানু পেল লটারি’র ক্যামেরাম্যান আরেক জায়গায় গিয়ে বললেন আমার কথা- ”একটা নতুন মেয়ে এসেছে, বেশ অভিনয় করছে”। এভাবেই মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল। পরপর পাঁচটা ছবিতে কাজ জুটে গেল। তার মধ্যে একটায় আবার ছবি বিশ্বাসের মেয়ের চরিত্রে। ‘মধ্যরাতের তারা’। ডিরেক্টর পিনাকী মুখার্জি। ছবি বিশ্বাসের নাম শুনে সবাই খুব ভয় দেখিয়েছিল। উনি নাকি খুব নাক উঁচু গোছের। কো-আর্টিস্টদের পাত্তাই দেন না। আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, যতটা পারি নিজের মত প্রাণপণে চেষ্টা করবো। তার পরও যদি পাত্তা না দেন, না দেবেন! গেলাম শুটিং ফ্লোরে। ফার্স্ট টেক হল। সবাই খুব খুশি। পরিচালক বললেন ঠিকঠাক। আমি তাকিয়ে আছি ছবি বিশ্বাসের দিকে, উনি কিছু বললেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন- ”আর একটা টেক নেবো”। বুঝলাম পছন্দ হয়নি। কিন্তু না, একটা অচেনা, অজানা, আনকোরা কো-আর্টিস্টকে মেয়ের মত বোঝাতে লাগলেন- ”বেশ ভালোই হয়েছে। খালি লাইটটা নিয়ে যা একটু সমস্যা। আসলে আমি এতটা লম্বা, তোমার মুখে আলো পৌঁছোয়নি। একটু অন্ধকার দেখাচ্ছে। আরেকবার চেষ্টা করো। আরও ভালো হবে”।

দ্বিগুণ উৎসাহে সেকেন্ড টেক দিলাম। এবার উনি নিজেই এগিয়ে এলেন। বললেন- ‘পারফেক্ট’। আমার মুখে কথা নেই। কী আর বলবো! সেদিন থেকে ছবি বিশ্বাস আমার ছবিদা হলেন। পরপর কয়েকটা ছবিতে অভিনয়ের পর একদিন ‘স্টার থিয়েটার’ থেকে ডাক এলো। ইতিমধ্যে আরও একবার আমাদের বাড়ি বদল হয়েছে। উল্টোডাঙা থেকে ঠিকানা বদলে বাগবাজার। বাগবাজার থেকে ‘স্টার থিয়েটার’ খুব একটা দূর নয়। খবর পেয়েই পৌঁছে গেলাম। এসে শুনি ছবিদাই নাকি বলেছেন আমার কথা। তখন ‘স্টারে’ নতুন একটা নাটক শুরু হবে। নাম ‘শ্রেয়সী’। এক সে এক স্টার কাস্ট। অনুপকুমার, কমল মিত্র, বসন্ত চ্যাটার্জী, তুলসী চক্রবত্রী, সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস কে নেই! তাঁদের মাঝে এসে পড়লাম কিনা আমি! একদম নতুন। বয়সেও সবার থেকে ছোট। তাই বোধহয় খুব সহজেই সবার ভালোবাসা আদায় করে নিতে পেরেছিলাম।

টানা একমাস রিহার্সাল চললো। সেটা ছিল আমার থিয়েটারের ক্লাসরুম। প্রতিমুহূর্তে কিছু না কিছু শিখছি। সে অভিজ্ঞতা আজও আমাকে পথ দেখায়।

বৃহস্পতি, শনি, রবি এই তিনদিন আমাদের শো থাকতো। ডিরেক্টর দেব নারায়ণ গুপ্ত। তখন শো শেষে স্টারের সামনে একটা ডাবল ডেকার বাস এসে দাঁড়াতো। যাতে নাটক দেখে যাত্রীদের ফেরার কোন সমস্যা না হয়। কিছুদিন পর বাসের কন্ডাকটর এসে অভিযোগ জানালেন- বাস আগের মত ঠিক সময়ে এলেও শো শেষ হতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট দেরি হচ্ছে। আমরা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কী! অবশেষে দেবনারায়ণদা রহস্য উদঘাটন করলেন। একদিন হঠাৎ দেখি পরিচালক মশাই শো চলাকালীন উইংসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার গোয়েন্দাগিরিতে বেরিয়ে এলো ঘটনার মূলে আসলে অনুপদা। অনুপদা একের পর এক বাড়তি ডায়লগ দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে। অনুপদার সঙ্গে আমারও একাধিক দৃশ্য ছিল। অনুপদা বানিয়ে বানিয়ে বলে যাচ্ছে। যথারীতি আমাকেও বানিয়ে বলতে হচ্ছে। অনুপদা যখন সেদিন এগজিট করবে, দেখি দেবনারায়ণ গুপ্ত উইংসের একদিকে বেত নিয়ে হাজির। ওমনি অনুপদা বানিয়ে আরেকটা ডায়লগ বলে দিলেন- ”ওদিকটায় একটা ভূত দাঁড়িয়ে আছে। আমি বরং অন্য দিক দিয়ে যাই”। বলে উল্টো দিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এভাবেও যে ইনস্ট্যান্ট বানিয়ে বানিয়ে ডায়লগ বলে অসাধারণ অভিনয় করা যায় সেটা অনুপদাকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। আর তাতে নাটকের এতটুকু ক্ষতি হত না। অনুপদার এই তাৎক্ষণিক দক্ষতা ছিল শেখার মত। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় টালিগঞ্জে এমন প্রতিভা বিরল!

আজও ঘুম না আসা মধ্যরাতে জানলার ধারে বসে এসব ভাবি। অনুপদা, ছবিদা, তাঁদের অভিনয়, তাঁদের আন্তরিকতার কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের গায়ে চোখ চলে যায়। ফিরে না আসার জগতে চলে যাওয়া এই মানুষগুলো কোথায় আছেন এখন? বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে বারবার। আজ বুঝতে পারি কত মহৎ ছিলেন এইসব মানুষেরা। কী পরম আশ্রয়ে ঘিরে রেখেছিলেন আমার চারপাশ!

এর মধ্যে আরও একটা ছবির ডাক এলো। অরবিন্দ মুখার্জির ‘আহ্বান’। আউটডোর সেরে এসে ইনডোর চলছে এন.টি.-টু তে। একদিন লাঞ্চ টাইমে অনিল চ্যাটার্জী বললেন- ”চল তোকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো”। গেলাম অনিলদার সঙ্গে। গিয়ে দেখি তপন সিনহা বসে আছেন। বেশ অপ্রস্তুত আমি। উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ”তোমার পছন্দের তারিফ করতে হয় অনিল। এ মেয়েকে দিয়ে হবে। যদিও গায়ের রঙটা বেশ ফর্সা। প্রয়োজনে কালো রঙ মাখতে হবে। কী অসুবিধে নেই তো?”

আমি মুহূর্তে সম্মতি জানালাম। ভেতরে তখন আনন্দের ফোয়ারা। তপন সিনহার সঙ্গে কাজ করবো, এ কী কম বড় পাওয়া! সেদিনই প্রায় সমস্ত কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো অন্য জায়গায়। ছবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। আমার চরিত্র নসুবালা। দু’দফায় আউটডোর শুটিং। প্রথম দফায় ৭ দিন। দ্বিতীয় দফায় ১৫ দিন। ‘স্টার’-এ এসে সমস্তটা জানালাম। শুনেই ওঁরা বেঁকে বসলো। শো-এর দিনগুলো বাদ দিয়ে যেতে পারি, কিন্তু বৃহস্পতি, শনি, রবি আমাকে কিছুতেই ছাড়া হবে না। ওদিকে তপন সিনহাকে কথা দিয়েছি। আমি পড়লাম মহা বিপদে। অবশেষে আমার পুরনো অফিস ক্লাবের বন্ধু লতিকাকে এক রাতের মধ্যে সমস্ত ডায়লগ মুখস্থ করিয়ে ‘স্টারে’ নিয়ে এলাম। অনেক কষ্টে ওদের রাজি করানো গেল। ঠিক হল, আমার পরিবর্তে কয়েকদিন লতিকা দাস অভিনয় করবে। আউটডোরে বসেই খবর পেলাম লতিকা ভালোমত চালিয়ে দিয়েছে। শো-এতটুকু অসুবিধে হয়নি।

আউটডোর থেকে সদ্য ফিরেছি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমার নামে উকিলের চিঠি এসেছে। মোট ৪ টে শো অ্যাবসেন্ট থাকার জন্য ৪০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। স্টারে পৌঁছে দেখলাম লতিকা মেকআপ করছে। সেদিনও আমাকে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হবে না। এমনটা প্রত্যাশা করিনি! খুব অসহায় লাগছিল। কেন জানি না মনে হল, এই মুহুর্তে ছবিদাই একমাত্র আশ্রয়। ছুটে গেলাম। সবটা জানালাম। উনি তখন খুব অ্যাজমায় ভুগতেন। ইনহেলার নিচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে ছবিদা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ডেকে পাঠালেন দেবনারায়ণ গুপ্তকে। ছবিদা তখন ইন্ডাস্ট্রির শেষ কথা। উনি কিছু বললে কেউ ফেলতে পারতেন না। সেদিনের মত ছবিদাকে কখনও এতটা উত্তেজিত হতে দেখিনি- ”তোমরা অহেতুক মেয়েটাকে বিপদে ফেলছো। নতুন এসেই কত বড় বড় জায়গায় কাজ করছে। এতে আখেরে ‘স্টার’-এর লাভ। একটা সম্ভাবনাকে তোমরা নষ্ট কোরো না। নিয়ম না থাকলে নিয়ম তৈরি করে নাও। কিন্তু মেয়েটাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দাও।” এক নিশ্বাসে বলে গেলেন ছবিদা। তাঁর সেই বজ্রগম্ভীর স্বর আজও কানে বাজে। দেবনারায়ণ গুপ্ত কিংবা স্টারের কেউ সেদিন ছবিদার বিপরীতে একটি কথা বলার সাহস করেনি। ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, উকিলের চিঠি ছিঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন ছবি বিশ্বাস। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত আমার মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হল। ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। ঠিক হল এখন থেকে আমাকে ছুটি দেওয়া হবে। ড্যামি হিসেবে রাখা হবে লতিকাকে। ছবিদা না থাকলে হয়ত সেটাই ছিল আমার কেরিয়ারের শেষ দিন। বাবার মত পাশে এসে দাঁড়ালেন। বড় আপশোশ হয়। সেই লোকটাকে আর বেশীদিন কাছে পাইনি। যিনি মৃত্যুভয়ে কখনও প্লেনে চাপতেন না। বম্বে যেতে হলে ট্রেনে যাতায়াত করতেন। যে লোকটা কখনও নিজে ড্রাইভ করতেন না, সেই তিনি আউটডোর থেকে ফেরার পথে ড্রাইভারকে হটিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং ধরে বসলেন। তারপরই মুহুর্তে সব শেষ। ছবিদা চলে গেলেন। আমি পিতৃহারা হলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *