আরম্ভের আরম্ভ

আরম্ভের আরম্ভ

কোথা থেকে যে শুরু করবো! কত স্মৃতিই তো ভেসে ওঠে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম একেবারে ছোটোবেলা থেকেই বলি। আমার জন্ম ঢাকায়। বিক্রমপুরে। ছোটোবেলার কথা তেমন মনে পড়েনা। আবছা আবছা। বাড়িটা মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে। ছবির মত চারপাশ। মনে হয়, আবার যদি ফিরে পেতাম ছোটবেলা? তা কী হয়!

ছোটমামা আমার নাম রেখেছিলেন লিলি। বড় হয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম- কেন ছোটমামা? বললেন — লিলিফুলের মত দেখতে ছিলি তো তাই। বাড়ির দেওয়া আরেকটা নামও ছিল — জ্যোৎস্না। কিন্তু ওই নামটাই সবার পছন্দের। সেই থেকে আমি লিলি। শুনেছি সুন্দরীই ছিলাম। মা রোজ বিকেলবেলা সাজিয়েগুজিয়ে বারান্দায় বসিয়ে রাখত। আমাকে দেখার জন্য একজন আয়া ছিল। সেও আমার সঙ্গে ভারী ভারী মুখ করে বসে থাকত। আমি বসে বসে দেখতাম- সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, পরপর রিক্সা, কত লোক হেঁটে বেড়াচ্ছে, বেশ লাগতো। বিক্রমপুরের সেই বাড়ির সামনেই ছিল বিশাল বড় একটা পুকুর। তখন আমার কত হবে, এক দেড় বছর বয়স। সেই বাচ্চা বেলার একটি ঘটনা আমাকে পাড়ার সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। একদিন আমার আয়া মাসি আমাকে বারান্দায় বসিয়ে রেখে, কোন কাজে অল্পক্ষণের জন্য ঘরের ভেতরে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখতে পেল আমি নেই। মুহূর্তে গোটা বাড়ি তোলপাড়। বাড়ির আশেপাশে, রাস্তার চারিদিকে খোঁজা শেষ, পুকুরে জাল ফেলবার ব্যবস্থা চলছে। এমন সময় আমি কাকার এক বন্ধুর কোলে চেপে দিব্যি এসে হাজির। ততক্ষণে গোটা পাড়ার লোক বাড়িতে চলে এসেছে। সবাই ভেবেছিল আমি পুকুরে পড়ে গেছি। এক পাড়া লোক আমাকে দেখতে এসেছে- কী যে আনন্দ হয়েছিল! কিন্তু বেচারা কাকার বন্ধুর কপালে জুটলো বেজায় ধমক।

মা ছিল ভীষণ হুজুগে। যখন যা খেয়াল চাপত করে বসত। ঝুলন উৎসবে প্রত্যেক বছর বাড়ির সামনের বড় বারান্দাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হত। মা’র একবার ইচ্ছে হল, ঝুলনে আমাকে রাধা সাজিয়ে দোলনায় দোল খাওয়াবে। রাধা না হয় হল, কিন্তু কৃষ্ণ মিলবে কই? মা কী ছাড়বার পাত্র? অতএব শুরু হল কৃষ্ণ খোঁজা। আমাদের বাড়ির কাছেই দাদার এক বন্ধু থাকত। অনিল গাঙ্গুলি। ডাকনাম বুদ্ধু। অনিল পরে বম্বের নামকরা পরিচালক হয়। অনিলের বোনকে ধরেবেঁধে কৃষ্ণ সাজানো হল। মা রাধাকৃষ্ণকে সাজিয়ে দোলনায় বসিয়ে দিলেন। পাড়াসুদ্ধু লোক একে একে আসতে লাগল জীবন্ত রাধাকৃষ্ণ দেখতে। সকলের মুখে এক কথা — দুটিতে কি মানিয়েছে গো! সাক্ষাৎ রাধাকৃষ্ণ। কেউ ধরতেই পারলো না কৃষ্ণ সাজানো হয়েছে একটি মেয়েকে! যদিও আমার ওসব মোটেই ভালো লাগছিল না। সেই কোন বিকেল থেকে ঠায় রাত ন’টা পর্যন্ত একভাবে বসে থাকা। এ কী জ্বালাতন! ঘুমে ঢুলে পড়ছিলাম। তবু মা এটা-সেটা দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অনেকক্ষণ জাগিয়ে রেখেছিল। রাত ন’টার পর আর সম্ভব হয়নি। পরে শুনেছি, ন’টার পর যারা এসেছিল, তারা নাকি খুব আপশোশ করেছে। জ্যান্ত রাধাকৃষ্ণ বলে কথা! এমন সুযোগ কী হাতছাড়া করা যায়!

মনে পড়ে, ছোটবেলার আরেকটি মজার ঘটনা। মা মাঝেমধ্যেই বলত। আমি নাকি ফল খেতে খুব ভালোবাসতাম। মা কৃষ্ণনগর থেকে মাটির আম, কলা, আপেল এনে কাঠের শোকেসে সাজিয়ে রাখত। আমি হাপুস নয়নে সেসব দেখতাম আর খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। বড় হয়েও এসব নিয়ে যে কত মজা মস্করা হয়েছে! সুযোগ পেলেই পেছনে লাগতো আত্মীয়পরিজনেরা। এমনকি মা’ও মাঝেমধ্যে তাদের দলে ভিড়ে যেত।

আমার জন্মের কিছু পরে পরেই এক ভাই, দু’বোন হল। বাড়ি ভর্তি লোকজন। আমাদের বাড়িতে থেকেই ছোটমামা, কাকা, বাবার এক মাসতুতো ভাই পড়াশুনো করত। বাবার খুব বড় ব্যবসা ছিল। ঢাকাই সাবানের ফ্যাক্টরি। বাড়ি ছিল পাইকার চরে, বিক্রমপুর ডিস্ট্রিক্ট। বেশ ভালই দিন কাটছিল আমাদের। এখন বললে লোকে বলবে পূর্ববাংলার সবাই জমিদার। কিন্তু আমরা আক্ষরিক অর্থে জমিদারই ছিলাম। মা আমাদের সব ভাইবোনকে গয়না পরিয়ে রাখত। ওটা ছিল মা’র আরেকটা শখ। একবার সেই বাড়ির সামনের পুকুরটায় বিরাট বড় একটা সাপ বেরিয়েছিল। মুহূর্তে ভিড় জমে গেল। আমিও চলে গিয়েছিলাম সেই ভিড়ের মধ্যে। সাপ দেখতে। ফিরে আসার পর মা দেখলো, আমার গায়ে কিচ্ছুটি নেই। না কানের দুল, না গলার হার। আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। মা একটুও বকল না। আলমারি থেকে নতুন গয়না বের করে আমাকে পরিয়ে দিল। এখন এসব ভাবলে চোখে ধাঁধা লাগে।

মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি কি এখনও একইরকম আছি? গয়না হারালে কি আজও কষ্ট হয়? হয়ত হয়! হয়ত এমন হলে এখনও আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতাম। আজ মনে হয়, যে গয়নাগুলি সেদিন হারিয়েছিলাম বা আজও হারানোর আতঙ্কে থাকি, সেগুলি আসলে অলঙ্কার নয়। গয়না গেঁথে আছে আমার মনে। নিজেকে সাজিয়ে উপস্থাপনের যে প্রয়াস আজও আমার মনের ঘরে ডাক তোলে, হয়ত সেদিন, শৈশবের সেই অবোধ মনেও ঈশ্বর তেমনই কোনও প্রেরণা গুঁজে দিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *