অজিত আমার অজিত

অজিত আমার অজিত

সেটা ২০০৩-০৪ সাল। অজিত তখন বার্ধক্যে। আমার একনাগাড়ে সিরিয়াল। চলছে ‘চোখের বালি’র শুটিং। ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছিল অজিত। সর্বক্ষণের কাজের লোক রেখে দিলাম। তবু কেমন জানি সিঁটিয়ে যাচ্ছিল। একদিন ‘চোখের বালি’র সেট থেকে কল করলাম। ফোনটা ধরলো। কিন্তু কোন কথা নেই। মনে হল রিসিভারটা হাত থকে পড়ে যাচ্ছে। মনটা কু ডেকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার ননদ অঞ্জলিকে ফোন করলাম। বললাম- ”ওকে একটু দেখে আসবে? হঠাৎ অসুস্থ হয়নি তো!” ওরা ছুটে গেলো। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পরও কোন সাড়াশব্দ নেই। প্রায় আধঘণ্টা বাদে লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে দরজা খুলেই নেতিয়ে পড়েছিল। অঞ্জলির মুখে বর্ণনা শুনে সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম কাজ ছেড়ে দেবো। সিরিয়াল বন্ধ করে দিলাম। ‘চোখের বালি’র শুটিং তো আর ফেলে আসা যায় না। ঠিক হলো যে কদিন শুটিং চলবে অঞ্জলি দেখাশুনা করবে। ঋতু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিত। ‘চোখের বালি’ শেষ হতেই পুরোপুরি ছুটি। এদিকে একের পর এক অফার। আর আমার পরের পর ‘না’। অজিতের চোখের সমস্যাটা বেড়েই চলছিল। বাঁ চোখে গ্লুকোমা। ডান চোখে ছানি। তবু অসম্ভব জেদি মানুষটা কিছুতেই ডাক্তার দেখাবে না। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে দৃষ্টিশক্তি। ভেতরে ভেতরে মানসিক যন্ত্রণা কুরে খাচ্ছে অজিতকে। ছানি পেকে গেলো। ধরে বেঁধে নিয়ে গেলাম নার্সিংহোম। আমার ইচ্ছে ছিল শুশ্রুতে চিকিৎসা করাব। ও বাড়ির কাছে পিয়ারলেস ছাড়া কোথাও যাবে না। ছোটখাটো নার্সিংহোমে চিকিৎসার একেবারে পক্ষপাতি ছিলাম না। আমার আশঙ্কাই সত্যি হলো! অপারেশন করাতে গিয়ে ছিড়ে গেল রেটিনা। কি বলব আপনাদের! তাকাতে পারছিলাম না অজিতের দিকে। কাছের মানুষের এত যন্ত্রণা কী সহ্য করা যায়? একদিন ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে দাঁতে দাঁত লেগে গেল। মুখ দিয়ে লালা বেরিয়ে আসছিল অনবরত। সঙ্গে সঙ্গে আবার নার্সিংহোম। পরপর দুবার এরকম হলো। বাড়িতে আয়া রাখলাম। তবুও কাজের কাজ কিছু হচ্ছিল না। জীবনে বহু প্রতিকুলতা এসেছে। দাঁতেদাঁত চেপে লড়াই করে গিয়েছি। কখনো হার মানিনি। কিন্তু এবার যেন ভেঙে পড়ছিলাম। সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে।

ইতিমধ্যে বায়না জুড়ে বসলো। ভাগ্নের বাড়িতে যাবে। আমাদের বাগবাজারের ঘরটা ছিল গলির ভেতরে। আলো পৌঁছত না তেমন। বড্ড স্যাঁতস্যাঁতে। গোটা শীতকাল একটু আলো বাতাসের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতো। তবু ওর এই প্রস্তাবে মোটেই সম্মত ছিলাম না। জানতাম অজিতের ভগ্নিপতি সুবিধের লোক নয়। আমার বম্বের ফ্ল্যাটটায় ওকে থাকতে দিয়ে বড় বিপদে পড়েছিলাম। পাকাপাকিভাবে চলে আসার পর প্রথমে বম্বের ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিলেন বিশ্বনাথ ঘোষ। উনি ব্যায়াম শেখাতেন। বোম্বেতে একখানি সেন্টার খোলার ইচ্ছে। তাই বাড়িটা ভাড়া নিলেন। কিছুদিন যেতেই বুঝলাম ও সব ছুতো। একটা ছেলেকে রেখে বিশ্বনাথ ঘোষ হওয়া। সময় মত ভাড়া দেওয়ার নামগন্ধ নেই। সেই ছেলেটিকে কোন টাকাপয়সা পাঠাতোনা! খাবার না পেয়ে সে একের পর এক ফার্নিচার বিক্রি করতে শুরু করলো। বুঝলাম বিশ্বনাথ ঘোষকে আর রাখা যাবে না। অজিত বলল ভগ্নিপতি ভাড়া চাইছে। কথা এগোতেই স্পষ্ট হল অভিপ্রায়। উনি বাড়িটি কিনে নিতে চান। তখন বোম্বের জুহুতলা রোড এর মতো জায়গায় ফ্ল্যাট -এর দাম কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা। ঠিক হলো অজিতের ভগ্নিপতির নামে বম্বের ফ্ল্যাটটা লেখা হবে। বদলে শোভাবাজারে আমাদের একখানি ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হবে। রেজিস্ট্রির দিন চমকে গেলাম। শোভাবাজারের ফ্ল্যাটটি আমরা কিনলাম ভগ্নিপতির ছেলের নামে। আজিত আত্মীয়দের প্রতি স্নেহপ্রবণ। টু শব্দটি করলো না! তাই বলে এত বড় আপমান!। এরপরও অজিত আবার যেতে চাইছে সেই লোকটার বাড়িতে! ওর অসুস্থ শরীর আর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ‘না’ বলতে পারলাম না। অজিতের ভাগ্নে একখানি ঘর রং করে সাজিয়ে রেখেছিল। আমরা শ্যামবাজারের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। অজিত হাঁটাচলার ক্ষমতাটুকুও হারিয়েছে। নিথর দৃষ্টি নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে থাকতো। ভালো লাগতো না আমার। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন ঈশ্বর? প্রার্থনা একটাই- অজিতকে ভালো করে দাও।

এদিকে তখনও মাঝেমধ্যেই কাজের জন্য ফোন এসে চলেছে। ‘সিঁদুর খেলা’ বলে একটি সিরিয়ালের অফার এলো। ভেঙ্কটেশ ফিল্মস থেকে খুব জোরাজুরি করছিল। অজিত বলল- অনেকদিন তো ছুটি নিলে। এত করে বলছে যখন ‘হ্যাঁ’ বলে দাও। আমার ইচ্ছে ছিল না। অজিত জোর করে রাজি করালো। দীর্ঘ বিরতির পর অভিনয় করতে খারাপ লাগছিল না। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার বিপত্তি। অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। আর বাড়িতে ফেলে রাখা চলে না। তড়িঘড়ি নার্সিংহোম। এবার টানা ১২ দিন। বাড়িতে ফেরার জন্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। শিশুর মত পাগলামি করতো। একটাই কথা ”আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।” ডাক্তারকে বলেকয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। হাড়জিরজিরে শরীর। কোটরাগত চক্ষু। তাকানো যাচ্ছিলনা মুখের দিকে। বাড়িতে ফিরে আমাকে আশ্বস্ত করল ”তুমি কাজে যাও আমি ভালো আছি।” পরেরদিন শুটিংয়ে পৌছতেই কিছুক্ষণ বাদে ফোন। প্রডাকশনের লোকেদের মধ্যে ব্যস্ততা। আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা চলছে। এদিকে কাজের মেয়েটা ফোন করেই চলেছে- ”দিদা তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো দাদুর শরীর খুব খারাপ।” ট্যাক্সিতে যেতে যেতেই আমার ভেতর একটা তীব্র অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘেমে উঠছিলাম বারবার। মনটা উদাস ছিল। বাড়িতে পৌছতেই দেখলাম অনেক লোকের ভিড়। পা চলছেনা। কোনমতেই সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় শুয়ে অজিত। যেন ঘুমিয়ে আছে। আমি কপালে হাত বুলিয়ে দিলাম। কানের সামনে মুখ নিয়ে বললাম ”উঠে পড়ো আমি চলে এসেছি।” কোন সাড়া দিল না অজিত। বুক ফেটে কান্না এলো আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *