নিজের দিকে তাকিয়ে

নিজের দিকে তাকিয়ে

ও মানে অজিত একটা ছবি করবে বলে আমার কাছে এসেছিল। আমরা তখন উল্টোডাঙার বাড়িতে থাকি। বাবা আমাকে নিয়ে নাটকের রিহার্সালে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় হঠাৎ দেখা। বললো- ”একদিন বাড়িতে আসবো। কথা হবে”। কিছুদিনের মধ্যে চলেও এল। সেদিন বাবা মায়ের সঙ্গে অনেক কথা হলো ওঁর। আমি পাশে বসে শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল- লোকটাতো বেশ! এমন ভাবে কথা বলে যেন কতদিনের চেনা। আমার মা তখন খুবই অসুস্থ। বয়স তেমন বেশি ছিল না। আসলে মায়ের ওপর দিয়ে ধকল গেছে প্রচুর। অল্প বয়েসেই বার্ধক্য জাঁকিয়ে বসেছিল। অজিত বলত- ”তোমার মাকে দেখলে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে”। আসলে ওঁর ছোটবেলাটাও খুব কষ্টের। একই দিনে বাবা-মা দু’জনকে হারাতে হয়েছে। আজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে সেই শোক। ওঁর তখন সবে ১৮। দীর্ঘ রোগভোগের পর মায়ের মৃত্যু। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাবা একইদিনে সুইসাইড করেন। ওঁর মুখে সেই বর্ণনা শুনে চমকে গিয়েছিলাম—

”ঘরের দরজা বন্ধ। বাবা মাথায় রিভলভার ঠেকিয়েছে। আমি জানলার রেলিং ধরে প্রাণপণে চিৎকার করেও শেষরক্ষা করতে পারিনি”।

-”বাবা আমাদের কে দেখবে?”

-”ভাবিস না। যাদের কেউ নেই তাদের ঈশ্বর আছেন”।

প্রথমবার মিসফায়ার হল। দ্বিতীয়বার কানের পর্দা ফাটানো বিকট একটা শব্দ। বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। বহুদিন আমার মুখে কোন কথা ছিল না”।

শুনেছি তখন থেকেই ও একটু অন্যরকম। কারও মা-বাবা কষ্টে আছে শুনলে ও চুপ থাকতে পারতো না। মাঝেমধ্যেই আমার মা’র জন্য ব্যাগ বোঝাই করে নানারকম খাবার, ফলমূল নিয়ে হাজির হত। আমি মজা করে বলতাম— ”কী ব্যাপার? আজ তো আপনার আসার কথা নয়!” মিহিস্বরে উত্তর দিত— ”তুমি রিহার্সালে যাও। তোমার মা’র সঙ্গে দেখা করতে এলাম”। ওঁর একটা বড় ওষুধের দোকান ছিল, সঙ্গে ডেয়ারি ফার্ম চালাতো। ম্যাডন স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে একার সংসার বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। অন্যদিকে আমরা তখন উল্টোডাঙার বস্তিতে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ কি খেয়াল হল, বাদুড়বাগান স্ট্রীটে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিল অজিত। আমাদের সবাইকে সেখানে নিয়ে এলো। ম্যাডন স্ট্রীটের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে নিজেও চলে এলো আমাদের সঙ্গে। বাবা ওকে খুব পছন্দ করত। বলত- ”অজিতের মত ভালো ছেলে হয়না। লিলিকে ওঁর সঙ্গেই বিয়ে দেবো”। ও কিন্তু প্রথমে মোটেই রাজি ছিল না— ”আমি লিলির থেকে বয়সে ১৮ বছরের বড়। একবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ডিভোর্সের মামলা চলছে। আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন না মেসোমোশাই”। ভগবানের এমনই লীলা কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্সের মামলাটা মিটে গেল। বাবার জোরাজুরিতে অজিত রাজি হয়ে গেল। এসেছিল আমাকে নিয়ে সিনেমা করতে! ১৯৬৯ সাল। আমি তখন সবে আঠেরো পেরিয়েছি। আমাদের মালাবদল হয়ে গেল।

বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই, আজ আমি যা কিছু হতে পেরেছি সবই ওঁর অবদান। অজিত ছিল আমার অভিভাবক, আমার সেক্রেটারি, আমার মাস্টারমশাই সমস্ত কিছু। কোন রোলটা আমার করা উচিৎ, কোনটা নয় সব ওই ঠিক করে দিত। টাকা পয়সার ব্যাপারেও আমি কখনও নাক গলাতাম না। কিন্তু কোথাও মনে হত না ও কোথাও খবরদারি করছে। রোজ ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলতো। উঠে কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ। তারপর সারা গায়ে মুসুর ডালবাটা মেখে স্নান। স্নান সেরে এসেই গলা ঠিক রাখার জন্য হারমোনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজ। অজিত আমাকে রীতিমত রুটিনে বেঁধে ফেলেছিল। কড়া শিক্ষকের মত সবসময় নজরদারি চলত। আমার এতটুকু ফাঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না। হয়তো রেওয়াজ করতে করতে ঘুম পেয়ে গেছে। গান থামিয়ে যেই না একটু চোখ বন্ধ করেছি, ওমনি পাশের ঘর থেকে- ”কী হল! আওয়াজ পাচ্ছি না কেন?” এক এক সময় বড্ড রাগ হত। লোকটা কী আমাকে এক মুহূর্তও নিজের মত থাকতে দেবে না! পরক্ষণেই মনে হত, ওই তো আমাকে ধরে রেখেছে, নইলে না জানি কোথায় ভেসে যেতাম! তখন খুব রোগা ছিলাম। তাই অজিতের প্রেসক্রিপশন মত প্রতিদিন একটা করে ডিমের কুসুমের সঙ্গে এক চামচ ব্র্যান্ডি ছিল আমার বাঁধা। রোজ নিজে হাতে ফলের রস করে খাওয়াতো। কমলালেবু, বেদানা, আঙুর। যখন যেটা পাওয়া যায়। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আড়ালে বলতো লিলি হল বরের পুতুল। এভাবে নাকি বেশিদিন টেকা যায় না। আমার এখন বেশ আনন্দ হয়। আমি ওঁদের ভুল ভেঙে দিতে পেরেছি। অজিত ছিল বলেই আমি এত সুন্দরভাবে কেরিয়ার আর ফ্যামিলি ব্যালান্স করে চলতে পেরেছিলাম। ও আমাকে একটা নির্মল জীবন উপহার দিয়েছিল। অনেক ভাগ্য করে এমন স্বামী মেলে।

আজকাল মাঝেমধ্যে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমাকে এখন আর কেউ আগলে রাখে না। কেউ ফলের রস বানিয়ে মুখের সামনে গ্লাস এগিয়ে ধরেনা। কেউ শাসন করেনা। পরামর্শ করার মত কোন অভিভাবক নেই। ওঁর অনুপস্থিতি প্রতিমুহূর্তে আমাকে একা করে দেয়।

বিয়ের পরপরই ‘প্রথম প্রেম’ নামে একটা ছবি করলাম। আমি, সন্ধ্যা রায়, বিশ্বজিৎ, কণিকা মজুমদার এমন আরও অনেকে। ছবির ডিরেক্টর ছিলেন অজয় বিশ্বাস। আউটডোর শুটিং হয়েছিল দার্জিলিং-এ। তখন দার্জিলিং-এ পৌঁছনো মানে সে বিরাট ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে করে প্রথমে মুর্শিদাবাদ, সেখান থেকে স্টিমারে করে গঙ্গা পেরোনো, তারপর আবার ট্রেন জার্নি। হ্যাপা হলেও সারারাত স্টিমারে করে গঙ্গা পেরোনো ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। অজিতও গিয়েছিল সঙ্গে। পরিচালক অজয় বিশ্বাস ছিলেন অজিতের বন্ধু। উনিই বললেন- ”চল ঘুরে আসি। আউটডোর শুটিং এর ফাঁকে তোদের হানিমুনটাও হয়ে যাবে”। তখন ডিসেম্বর মাস। দার্জিলিং-এ কনকনে ঠান্ডা। তিনটে বাজলেই আমাদের কাঁপুনি ধরে যেত। একমাত্র অজিতের কোন হেলদোল নেই। যেন ওঁর ঠান্ডাই লাগেনা। একদিন সবাই ওঁকে চেপে ধরলো- ”কী ব্যাপার বলতো? আমরা সবাই ঠান্ডায় মরছি, আর তুই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিস!” দেখালো হাতে এক কোয়া রসুন। ঠান্ডা থেকে বাঁচার টোটকা। খুব হুল্লোড় করে শুটিং করেছিলাম। আমরা সবাই প্রায় সমবয়সী। আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত বন্ডিং ছিল। কত ছবিরই তো আউটডোর করেছি। ‘প্রথম প্রেম’এর আউটডোরটা আজও বিশেষভাবে মনে আছে। আরও মনে আছে অজিতের জন্যে। সমস্ত আড়ষ্টতা ভেঙে সেই প্রথম ওঁর শরীরী অনুভূতির তুমুল স্পর্শ পেলাম আমি। আমার ভেতরে তখন উড়নচণ্ডী মাতাল হাওয়া। অনেকদিন তো হয়ে গেল। বিশ্বজিৎদা, সন্ধ্যা রায় ওরাও আমার মত বয়সের ছোবলে আক্রান্ত। তবু মনে হয় ‘প্রথম প্রেমের’ আউটডোরের দিনগুলো ওদেরও নিশ্চিত মনে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *