প্রভাতি বেলা
তখন আমরা ডুঙ্গুরিয়ায়। বড়মামার কাছে। কত আর বয়স হবে? বছর দশেক। ছোটবেলা থেকেই মা যেমন নানা অনুষ্ঠানে আমাকে সাজাতেন- কখনও রাধা, কখনও অন্য কিছু, ডুঙ্গুরিয়ায় এসেও তার ব্যতিক্রম হল না। মা আমাকে নিয়ে ডুবে গেলেন অভিনয়ে। মা’র কাছেই আমার অভিনয়ের হাতেখড়ি। তিনিই আমার প্রথম ডিরেক্টর। সে আমার অভিনয় জীবনের প্রভাতি বেলা। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। মা কালীপুজোর সময় ডুঙ্গুরিয়ার সমস্ত বাঙালি পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে একটা নাটক করালেন। আমার বয়সী, আমার থেকে ছোট, বড় সমস্ত বাচ্চারা একসঙ্গে মিলে রিহার্সাল করতাম। নাটক তো নয়, সেটা ছিল আমার কাছে একটা দারুণ মজার খেলা। তখন মানুষে মানুষে এমন স্বার্থপরতা ছিল না। একলা আনন্দ অনুভবের চেয়ে সকলের মাঝে আনন্দ ভাগ করে নিতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। আর প্রবাসী বাঙালিরা পরস্পরের কাছে ছিল পরম স্বজন। কী নাম ছিল নাটকের, কোন চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম, সেসব কিছুই আজ আর মনে নেই। শুধু স্মৃতির বাস্তুভূমিতে আবছা হয়ে আছে মঞ্চ আর অভিনয়। বহুদিন পর বাংলা নাটক দেখতে পেয়ে সবাই খুব খুশি হয়েছিল। সেই থেকে সবাই বলতে শুরু করল- আমাদের লিলি তো খুব সুন্দর অভিনয় করতে পারে। আমারও অভিনয় করার শখ চেপে বসলো। হয়ত ডুঙ্গুরিয়ার কোথাও একটা নাটক হচ্ছে, একটি বাচ্চা মেয়ে দরকার, সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাক পড়ত। আমিও নাচতে নাচতে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিতাম। দুর্গাপুজোর সময় আমাদের সমস্ত বাঙালি পরিবারের বড়রা মিলে একটা নাটক করেছিল। সেখানে একরকম জোর করেই আমি একটা ছোট চরিত্রে ঢুকে পড়েছিলাম।
বড়মামা খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। বড়মামা আর আমি মাঝেমধ্যে সাপুড়ে নাচ নাচতাম। বড়মামা বেদে, আমি বেদেনি। নাচের একটা দৃশ্যে ছিল- সাপুড়েকে ছোবল মারবে সাপ, আর বেদেনি তার দিকে আঙুল তুলে বলবে ”বেশ হয়েছে”। আমি তর্জনি উঁচিয়ে অভিনয়টা করতাম। তার কিছুদিন পর ঐ আঙুলে একটা ফোঁড়া হল। সবাই আমাকে ক্ষ্যাপাতো, তুমি মামাকে আঙুল দেখিয়েছো, তাই তোমার এমন হয়েছে। আমিও সেটা সত্যি ভেবেছিলাম। খুব কষ্ট হয়েছিল। লুকিয়ে কাঁদতাম। একদিন বড়মামা ডাকলেন- ”ধুর পাগলি! ওটা তো অভিনয়। অভিনয় কখনও সত্যি হয়!” মুহূর্তে আমার পাপবোধ ধুয়ে মুছে সাফ। সেই প্রথম অনুভব করলাম অভিনয় আমাকে যেমন আনন্দ দেয়, হাসায়, তেমনই মাঝেমধ্যে কষ্টও দেয়। জীবনের মত সেও পরীক্ষা নেয়। আজ এই পরিণত বয়সে এসে মনে হয় বড়মামা সেদিন সহজ করে ওই কথাটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন বলেই আজও অভিনয় করে যেতে পারছি।
মধ্যপ্রদেশের কোলিয়ারি বেল্টে মাঝেমধ্যেই দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াতো। সিনেমার গাড়ি। বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি দুটো হাজির হত বিভিন্ন জায়গায় জায়গায়। গাড়ি এলেই চারপাশে ভিড় জমে যেত। তখন কুলি-কামিন থেকে শুরু করে বাবুরা- সব একজোট হয়ে সিনেমা দেখতে বসতেন। আমাকেও খুঁজে পাওয়া যেতনা। যেখানে ছবির গাড়ি আসত, সেখানেই ছুটতাম। ছোটবেলা থেকেই দেব আনন্দের বিরাট ফ্যান। দেব আনন্দের ছবি হলে তো কথাই নেই। হয়ত একটাই ছবি বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হচ্ছে। সেটাই ছুটে গিয়ে বারবার দেখতাম। নাটক করতাম বলে কোলিয়ারির ম্যানেজারের স্ত্রী খুব ভালোবাসতেন। মাঝেমধ্যেই আমাকে গাড়ি করে নিয়ে যেতেন- ”তোর হিরোর ছবি এসেছে লিলি দেখবি চল”। সিনেমা দেখতে দেখতে ভাবতাম সবাই কেমন পর্দার ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, গান গাইছে! বড় হয়ে আমিও যদি অমন হতে পারি! কী ভালোই না হত। পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাতাম আমি পড়ে আছি কোন সুদূর কয়লার দেশে; এখানে বসে সিনেমা করার স্বপ্ন দেখা নেহাৎ বোকামো! সব স্বপ্ন কি আর সত্যি হয়! মনকে এইসব সাতপাঁচ বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। এখন ফিরে তাকালে অবাক লাগে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। আজকাল মনে হয় স্মৃতিই বোধহয় আমার সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন।
মামার বদলি সূত্রে ডুঙ্গুরিয়ার পর এসে পৌঁছলাম ছিনুওয়াড়া। অভিনয়ের পিপাসা তখন আরও বেড়েছে। আর সেই সঙ্গে সিনেমা দেখার লোভ। পর্দার এক একটি চরিত্রকে তখন নিজের সঙ্গে মেলাতে শুরু করেছি। কোন নারী চরিত্রের সঙ্গে আমার কতটুকু মিল কিংবা কোন চরিত্র আমার থেকে কতটা আলাদা এসব নিয়ে দিনভর ভাবতে থাকতাম।
কালীপূজা, দোল উৎসব কিংবা দুর্গাপূজা, যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে ছিনুওয়াড়ার সমস্ত বাঙালিরা একসঙ্গে মেতে উঠতাম। সবচেয়ে মজা হত দোলের সময়। তখন আর কাউকে চেনা যেত না। আমারও এক অবস্থা। রঙ শেষ হয়ে গেলে কাদার তাল বানিয়ে ছুঁড়ে মারতাম। এত সবের মধ্যেও পড়াশুনোয় কোন অবহেলা করিনি। চিরকাল ১ থেকে ৫ এর মধ্যে আমার র্যাঙ্ক থাকতো।
একবার মামিমার খুব অসুখ করলো। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। সঙ্গে একজনকে থাকতে হবে। কে থাকবে? প্রত্যেকেই নিজের কাজে ব্যস্ত। আমাকেই পাঠানো হল। আমার পরীক্ষা একেবারে দোরগোড়ায়। বোধহয় ক্লাস সেভেন। মামিমার পাশে আমাকে একটা বেড দেওয়া হয়েছিল। ওখানেই খাতা কলম নিয়ে একটু আধটু পড়তাম। মামিমা আমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন- ”মেয়েটা কিভাবে এই অবস্থায় পরীক্ষা দেবে? আদৌ পরীক্ষা দিতে পারবে তো?” অসুস্থতার মধ্যেও এসব সাতপাঁচ চিন্তা করতেন। একরকম কোন প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা দিলাম। মামিমাকে বাড়ি নিয়ে আসা হল। দেখাশোনার জন্য একজন আয়া রাখা হয়েছিল। আয়া দিয়ে কী আর সব কাজ হয়? তখন বাড়ির অনেক কিছুই একা হাতে সামলাতে হয়েছে। কিছুদিন বাদে রেজাল্ট বেরোল। ভেবেছিলাম পাশই করবো না। কী আশ্চর্য! বেশ ভালোই রেজাল্ট হল। ১২ র্যাঙ্ক করলাম। রেজাল্ট দেখে মামিমার সে কী উল্লাস! সেই হাসি মুখটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে।
সবে থিতু হচ্ছিলাম। ঈশ্বর বোধহয় মুচকি হাসলেন। বাবা-মা’র এক সিদ্ধান্তে আবার সব এলোমেলো হয়ে গেল। মধ্যপ্রদেশ ছেড়ে আমরা চললাম কলকাতা। আবার একটা নতুন শহর। পুরনো সঞ্চয় পেছনে ফেলে নতুন করে গড়ে তোলার পালা। অল্প সময়ের মধ্যেই আমার পড়াশুনোর পাঠ চুকে গেল। স্কুলের গণ্ডি টপকে আমি কলকাতায় চলে এলাম। সেটা ১৯৫৮ সাল। বয়স ১৭ বছর। চূড়ান্ত অভাব অনটনের মধ্যে এসে পড়লাম। আমার আর কলেজ যাওয়া হল না। কিন্তু কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেদিন? তা আজও আমার কাছে অজানা!