জড়িয়ে ধরেছিলেন মহানায়ক

জড়িয়ে ধরেছিলেন মহানায়ক

নয় নয় করে প্রায় ৫৮ বছরের অভিনয় জীবন পাড়ি দিলাম। নায়ক তো কম দেখিনি। ছোট, বড়, মেজো কত নায়কই তো দেখলাম। কিন্তু উত্তমকুমার একজনই। ঐ চাহনি, ঐ টোল ফেলা হাসি আর ভক্তদের ‘গুরু গুরু’ চিৎকার- আজও বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। উত্তমদার সঙ্গে প্রথম ছবি দেয়া-নেয়া। কেন জানিনা খুব স্নেহ করতেন আমাকে। দেখা হলেই ‘কেমন আছি’, ‘কি কাজকর্ম চলছে’, ‘বাড়ির সবার খবর কি’- এসব ছিল তাঁর বাঁধা প্রশ্ন। এখন দেখছি তাঁর ঘনিষ্ঠ কোন কোন নায়িকা নিজের জীবনের কথা লিখতে গিয়ে অকারণ উত্তম কুমারের স্বভাব সম্পর্কে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। এও বলছেন- ভালোবাসার মর্যাদা নাকি দিতে জানতেন না উত্তম কুমার। জানি না সত্যি মিথ্যে। আমি তো সে অর্থে অত ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। তবু বলব অকারণ অযাচিত স্নেহে তাঁর পরম মানবিক মুখ প্রত্যক্ষ করেছি একাধিকবার। তিনি যখন আজ আর নেই তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে কী লাভ! আমি সব সময়েই এমন নিন্দাবাদ থেকে দূরে থাকতে চাই। কত যে অপমান কত যে হিংসার শিকার হয়েছি তার শেষ নেই। এখন জনে জনে সেসব কথা বলতে গেলে নিজেকে কেমন ছোট লাগে। তবু সমসাময়িক ইতিহাস ও সত্যের প্রেক্ষিতে দু-একটা কথা জানাতেই হবে। অনুরোধ করব একে নিন্দাবাদ বলে ভাববেন না।

মনে পড়ছে একদিনের কথা। সেটা ৬-এর দশকের মাঝামাঝি। সেদিন এন.টি.টু তে তার কোন শুটিং ছিল না। আসলে স্টুডিওই তো ছিল তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার জায়গা। হঠাৎ কি কাজে এসেছিলেন। কেদার রাজার শুটিং-এ আমিও তখন স্টুডিওতে। মুখোমুখি হতেই যেন আলো জ্বলে উঠলো চারপাশে। ঈষৎ ঝুঁকে তাঁর চিরাচরিত চাহনি হেনে একেবারে সামনে এসে পড়লেন- ”কোন দোকানের চাল খাওয়া হয় বৌঠান? এখনও এত স্লিম?” উত্তমকুমারের মুখে রূপের প্রশংসা শোনার জন্য ইন্ডাস্ট্রির নায়িকারা তখন মুখিয়ে থাকতেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা কানকে। কানের ভেতর গমগম করছে সেই স্বর। যা যে কোন মেয়েকে যে কোন মুহূর্তে পরিযায়ী করে দিতে পারে। আমার রূপের প্রশংসা করছেন মহানায়ক! বিস্ময়, আনন্দ, চমকের ঘোর কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত আমার স্বর আসতে চলে গেল অনেকটা সময়। অথচ সামনে তখনও দাঁড়িয়ে উত্তমদা, এমন একটা কমপ্লিমেন্টের উত্তরে আমি কী বলব! ভেবে পাইনি। বললাম- ”এই একই কথা তো আপনাকেও বলতে পারি”। বললেন- ”বুড়োদের কথা ছাড়ো তো বৌঠান”

-”আপনি বুড়ো?” ঠোঁটে চলে এলো কথাটা।

আমাদের সকলের স্বপ্নের নায়ক কী কখনো বুড়ো হতে পারে? আমি তাকিয়ে আছি উত্তমদার দিকে। হাওয়ায় এলোমেলো উড়ছে তাঁর কপালের সামনের চুলগুলো। আরও স্বপ্নিল দেখাচ্ছে তাঁকে। সেদিনের ঐ মুহূর্তগুলো আজও আমার বুকের ভেতর জাগিয়ে রাখে মানুষ উত্তমকুমারকে। যিনি মেয়েদের তো বটেই, সম্মান করতে জানেন ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত কর্মীদের। কো-অ্যাক্টর থেকে সামান্য স্পটবয় পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাঁর নজরে সহকর্মী।

ঠিক করেছিলেন ‘গৃহদাহ’ ছবিতে আমাকে নেবেন। পারলেন না। উত্তম কুমারে এক ঘনিষ্ঠ নায়িকা এসে হাজির হলেন। তখন তাঁর অনেক নাম ডাক। অভিনয়েও তিনি চমকে দেন বাঙালিকে। সেই বড় মাপের অভিনেত্রী আমার মত কম বয়সের এক তরুণীর সামনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিলেন। তিনি উত্তম কুমারের ঘনিষ্ঠ। তার কথা উত্তমদা ফেলবেন কী করে! গৃহদাহ-র কাস্টিং শুনে বললেন- ”লিলি কেন? আমি ওর থেকে কম টাকায় কাজ করব। তুমি আমাকে নাও”। তখন ইন্ডাস্ট্রির এমন অনেকেই শুধু উত্তমের নায়িকা নন। আরও বেশি কিছু। তাঁদের কথা উত্তমদাকে রাখতেই হত। তাই আমারো আর মৃণাল চরিত্রে কাজ করা হয়নি। খুব কষ্ট হত। কেন বারবার আমার সঙ্গেই হয় এরকম! কই আমি তো কখনও কারও রোল কেড়ে নিই নি। যাদের সঙ্গে সবসময় ওঠা বসা, যাদের বন্ধু বলে ভাবি, তারা কিভাবে পারে এরকমটা করতে! অজিত বলত- ”তোমাদের লাইনটাই এমন। এসব তো হবেই। শুধু মুখ বুজে কাজ করে যাও”। মুখ তো বুজেই রইলাম। তাই সেই নায়িকার নামটা আর জানালাম না। যদিও আজ আর কোন অভিমান অবশিষ্ট নেই। জীবন আমাকে ভরে দিয়েছে। আজও রোজ গাদাগুচ্ছের অফার আসে। সময়ের অভাবে বাচ্চা বাচ্চা পরিচালকদের ডেট দিতে পারিনা। ওদের বলি ”আমার বদলে তোমরা বরং সাবুদিকে নাও, কিম্বা বেণুদিকে নাও। বেশ মানাবে”। পাইয়ে দেওয়ার যে কী আনন্দ সে কেবল আমিই জানি।

গৃহদাহ-তে কাজ করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ‘ভোলা ময়রা’-য় কাজ দিয়ে উত্তমদা পুষিয়ে দিলেন। আমি তখন বম্বেতে। উত্তমদা ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট দের বললেন- ”যে করে হোক লিলিকে রাজি করাও। ভোলা ময়রা-য় ওকে আমার চাই-ই চাই। সেবারও আমাকে আটকাবার কম চেষ্টা হয়নি। শক্তি সামন্তর একটা ছবির অফার ছিল। তরুণ মজুমদার বললেন- ”হিন্দি ছেড়ে আপনি যাচ্ছেন একটা বাংলা ছবি করতে? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” সেদিন আর কোন প্ররোচনায় পা দিইনি। উত্তমদার সঙ্গে কাজ করতে ছুটে এসেছিলাম। আমি ছিলাম ওঁর স্ত্রীর চরিত্রে। পর্দায় অমন চরিত্র খুব কমই পেয়েছি। ছবির একটা ঘটনা এখনও স্মৃতিতে বড়ই উজ্জ্বল। একটা দৃশ্য ছিল উত্তমদা গান গাইতে গাইতে আমাকে মুক্তোর মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। গানটা শেষ হতেই সেটের মধ্যে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আমি তো লজ্জায় লাল। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায়না— ভেতরে ভেতরে তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। যে নায়ককে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য হাজার হাজার মেয়েরা হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, তাঁর এমন মায়াবন্ধন কিনা আমার শরীরে! উত্তমকুমারের আদর খাচ্ছি আমি! ভাবলেই আজও সব কেমন গুলিয়ে যায়। সেদিন পাশেই ছিলেন বেণুদি। বললাম- ”দেখো না বেণুদি, উত্তমদা কী করছে”। বেণুদির মুখে হাসি, কিন্তু ভেতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে ঈর্ষায়। আগুনে ঘি ঢাললেন উত্তমকুমার- ”ও কি বলবে লিলি? এখন তো তুমি আমার বৌ”। গোটা শুটিং জুড়ে এমন সোহাগে ভরিয়ে রাখলেন আমাকে। আজও চোখ বুজলেই ওর শরীরের গন্ধ আমার নাকে আসে। ওর স্পর্শে যেন ফুলে ওঠে শিরা উপশিরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *