বাংলার বাইরে বাঙালি

বাংলার বাইরে বাঙালি

মুকুলবাবু বারবার করে ওঁর বাড়ি যেতে বলেছিলেন। এক ছুটির রবিবারে গিয়ে হাজির হলাম। ওমা! যেতেই বলেন কিনা- গুলজারজিকে আপনার কথা বললাম। গুলজারজি গত রাতেই আপনার ‘দেওয়া-নেওয়া’ দেখেছেন। আজই আপনার সাথে দেখা করতে চান। মুকুলবাবুই গাড়ি ঠিক করে দিলেন। আমি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে। তার কিছুদিন আগেই আমি ওর ‘কৌশিশ’ দেখেছি। মুগ্ধতা গ্রাস করেছিল। আমি কী সত্যিই সেই পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি! বিশ্বাস হচ্ছিল না! বাড়িতে পৌঁছতেই পরিচারক গোছের একজন আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে বসালেন। ডাইনিং রুমের ছড়ানো মেঝেতে বড় একখানা গদি পাতা। পাশে দু’টো চেয়ার। তার একটাতে গিয়ে বসলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গুলজারজি এসে হাজির। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে নিপাট ভদ্রলোক। দেখলেই বাঙালি বলে ভাবতে ইচ্ছে হয়। এসেই গদিতে হাঁটু মুড়িয়ে বসলেন। ওঁর দেখাদেখি আমিও চেয়ার ছেড়ে মাটিতে বসতে যাচ্ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললেন- ”আরে না না, আপনি ওপরেই বসুন। আমার এরকমই অভ্যেস”।

গুলজার যে এত ভালো বাংলা বলেন আমার জানা ছিল না। ক্রমশ বুঝলাম, গুলজার শুধু ভালো বাংলাই বলেন না, উনি মনেপ্রাণে একজন বাঙালি। বললেন- আমি একটা নতুন ছবির কথা ভাবছি। আপনাকে চাই। ভাবলে আজও লোম খাড়া হয়ে যায়। প্রথম সাক্ষাতেই গুলজারের কাছ থেকে ছবির অফার পাওয়া আমার জীবনের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। জানতে চাইলেন ওঁকে দেখাবার জন্য আমার কাছে কোন ছবি কিংবা ভিডিও আছে কিনা? আমার কাছে ওসব কিছুই ছিল না। ওসব যে আনতে হয় তাও জানতাম না! বললেন

-সাধারণ ঘরোয়া ছবি হলেও চলবে।

খুঁজলে সে রকম ছবি হয়ত একটা দু’টো পাওয়া যাবে। বললাম- বাড়ি গিয়ে পাঠিয়ে দেবো। উনি তাতেই রাজি।

বললেন- বাংলায় তো অনেক কথা হল! কিন্তু আপনি হিন্দি কেমন বলেন তা তো জানা হল না!

উত্তর করলাম- আপ হিন্দি মে পুছিয়ে কুছ? তো ম্যায় বাতা দুঙ্গি ক্যায়সা হিন্দি বোল সকতি হু?

-আরে বাহ! আপ কো তো লাগতাহি নেহি আপ বাঙ্গালি হে! ইতনা আচ্ছা অ্যাকসেন্ট! একদম জয়া জেয়সি। শর্মিলা অউর রাখিকে অ্যাকসেন্ট সে পাতা চলতা হে ও বাঙ্গালি হে। মগর আপকো পকড়না বহত মুশকিল হে।

-ম্যাঁয় অউড় জয়া দোনোহি একই জাগা সে হুঁ। দোনোহি মধ্যপ্রদেশ মে থা।

-ইসলিয়ে আপকা হিন্দি ইতনা আচ্ছা হ্যায়।

বুঝলাম গুলজার বেশ ইমপ্রেসড। পরীক্ষায় পাশ করেছি। খুঁজে-টুজে একটা ছবিও পেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলাম ওঁর কাছে। ‘সম্পূর্ণ বিষ্ণুপুরান’ এর জন্য ঘনঘন বম্বে যাতায়াত করতে হচ্ছিল। বম্বের আনন্দনগরে, জুহুতলা রোডের ধারে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। কিশোর কুমারের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হত। সামনের রাস্তাটা ছিল খুব সরু কিন্তু কমপ্লেক্সটা বিরাট জায়গা জুড়ে। দিন পনেরো বাদে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলেন গুলজার। আমাকে একটা নাম্বার দিয়ে বললেন- একটা কল করতে পারবেন?

জিজ্ঞাসা করলাম- কার নাম্বার?

বললেন- আমার প্রোডিউসারের।

সেই মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়েছিলাম আমি। নামটা গুলজার হলেও নিজের মূল্যবোধ থেকে সরে আসিনি। বললাম- আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমাকে মাপ করবেন। জীবনে কোনদিন নিজে থেকে প্রোডিউসারকে ফোন করিনি। এ আমি পারবো না।

ওপার থেকে বেশ অপ্রস্তুত শোনালো গুলজারকে। বললেন- না না, থাক থাক। আমি কথা বলে নিচ্ছি। রাখি আপনার খুব প্রশংসা করেছে। ঋষিদাও বললেন- ‘আমাদের বাঙালি লিলি খুব ভালো অভিনয় করে’। আপনাকে আমার ছবিতে নেবোই।

কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম গুলজারের ছবিতে আমার আর কাজ করা হল না। ওখানকার প্রোডিউসারদের মতিগতি কিছুই জানতাম না। একটা ফোন করতে রাজি হইনি, কাজের আশা করি কী করে! একদিন বিকেলে চা খেয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ৬টা বাজে। সূর্যের আলো এসে লাগছে চোখে মুখে। বম্বেতে ৭টা-৭.৩০টার আগে কখনও সূর্য অস্ত যায় না। দেখলাম একটা ছোট গাড়ি কমপ্লেক্সের সামনে এসে থামলো। দু-তিনজন লোক নামলো। তাদের একজনের হাতে হ্যাঙারে ঝোলানো গুটিকতক শাড়ি। ভাবলাম কার বাড়িতে আবার এসব এলো! দেখি ঘরের ডোরবেল বাজছে। দরজা খুলতেই একটি ছেলে বলল- আমি গুলজারজির অ্যাসিস্ট্যান্ট। আগামীকাল থেকে আপনার ‘আচানক’ ছবির শুটিং। টেইলার আমাদের সঙ্গেই আছে। মাপ-জোক গুলো বলে দিন। আর কয়েকটা শাড়ি দেখিয়ে বললো- ”এর মধ্যে থেকে নিজের মত পছন্দ করে নিন”। বললাম- ”এসব আমি কি বলবো? এগুলো তো ডিরেক্টর ঠিক করবে”। তখনও পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না! শুটিং শুরুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কিনা জানতে পারলাম আমি ‘আচানক’ ছবির হিরোইন! এও কি সম্ভব? কপালে থাকলে বুঝি এমনও হয়। আমার জীবনে বারবার এমন সব ঘটনা ঘটেছে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করে পারি না।

পরদিন সকাল সকাল গাড়ি চলে এলো। ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে টানা দশদিন আচানক এর শুটিং চলল। গল্পটা আর পাঁচটা হিন্দি ছবির থেকে একেবারে আলাদা। মেজর রঞ্জিত খান্না ও তাঁর স্ত্রী পুষ্পার সুখের সংসার। দুজনেই পরস্পরের প্রেমে হাবুডুবু। কিন্তু আকস্মিক অভিঘাতে সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। পুষ্পা ও তার প্রেমিককে এক গোপন মুহূর্তে গাছের আড়াল থেকে দেখে ফেলে রঞ্জিত। সহ্য করতে না পেরে রাগের মাথায় দু’জনকেই খুন করে বসে। পুলিশের হাতে ধরা দিয়েও স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে নাটকীয় ভাবে পালিয়ে যায় রঞ্জিত। পরবর্তীতে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন এক সেবিকার সঙ্গে আবেগঘন সম্পর্ক তৈরি হয়। চলচ্চিত্রের একেবারে শেষে রঞ্জিত খান্নার ফাঁসির আদেশ হয়। কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। আমি আর বিনোদ খান্না ছিলাম প্রধান চরিত্রে। রঞ্জিত করেছিল বিনোদ, আমি পুষ্পা। সেবিকার চরিত্রে ছিল ফরিদা জালাল। ফরিদা, বিনোদ, ওম শিবপুরি, আসরানি- প্রত্যেকের অভিনয়ই দেখার মত। ছবিতে আমার একটা চুম্বন দৃশ্য ছিল।আগে কখনও এত ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করিনি। একটু টেনসড ছিলাম। যদি গোলমাল করে ফেলি! গুলজারজির গাইডেন্সে আর বিনোদের সহযোগিতায় ভালোভাবেই উতরে গেল। এক টেকেই ওকে। ‘আচানক’ ছিল গুলজারের ফিল্ম কেরিয়ারের অন্যতম বড় হিট। বিনোদেরও তাই। ছবিটা আমাকে বম্বেতে পরিচিতি এনে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *