তিন নবীন পরিচালক
সায়েন্স সিটিতে একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বহুদিন পর কৌশিক গাঙ্গুলির সঙ্গে দেখা। অনেক আগে ওঁর সঙ্গে টেলিফিল্মে কাজ করেছিলাম। দেখা হতেই আচমকা প্রশ্ন-”দিদি বাঙ্গাল ভাষা বলতে পারো?”
-বাঙ্গাল এর মাইয়া আর বাঙ্গাল কইতে পারুম না! হেইটা একটা কথা হইলো!
– আরে বাহ! তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছো গো। তোমাকে লাগবে। আমি কিছুদিনের মধ্যেই যোগাযোগ করছি।
দিন কয়েক বাদেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির। কৌশিক সিনেমার গল্প শোনাচ্ছিল আর আমি বেশ অনুভব করছিলাম বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন ঘরানা চলে এসেছে। আধুনিক, স্মার্ট অথচ কী মায়াময়। কৌশিকই এই ঘরানার পথপ্রদর্শক। ছবির আউটডোর নর্থ সিকিমে। আবার দীর্ঘদিন পর উত্তরবঙ্গের উপর দিয়ে যাত্রা। আবার পাহাড়। মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘প্রথম প্রেম’-এর শুটিং। আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। এখন যাত্রা কত সহজ হয়েছে। আকাশ পথে মাত্র ঘণ্টা দু’য়েকের রাস্তা। আর তখন লঞ্চে করে গঙ্গা পেরনো। একের পর এক ট্রেন বদল সে কী হ্যাপা! আমি, তনুশ্রী, মিমি, গার্গী, রুদ্র, কমলেশ্বর, কৌশিক সবাই মিলে একটা বিশাল টিম। বহুদিন পর আবার একসঙ্গে কাজের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। এতদিন কোঅ্যাক্টাররা প্রায় সকলেই ছিল সমবয়েসী কিংবা সিনিয়র। সময়ের সঙ্গে সব কেমন বদলে যায়। এই টিমে আমিই সবচেয়ে প্রবীণ। তবে বৃদ্ধ হওয়ার একটা মজা আছে। বাচ্চাদের মত বুড়োদেরও সবাই খুব যত্নে রাখে।
উত্তরে পা রাখতেই বুঝলাম সবুজ এখনো আগের মতই অটুট। পাহাড়িয়া হাওয়ায় ভরপুর অক্সিজেন কাজে দ্বিগুণ উৎসাহ যোগাচ্ছিল। দীর্ঘদিন ভালো কাজ না পাওয়ায় খিদে মিটিয়ে দিল কৌশিক। অঞ্জন চৌধুরি, স্বপন সাহা, হরনাথ, বাবলু সমাদ্দার- নামগুলো ক্রমশ অসহ্য লাগছিল। এই গোত্রের পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি শুটিং এর কনটিনিউটির জ্ঞানটুকু পর্যন্ত নেই এদের। সেদিনই জানতাম দর্শক ফাঁকি ধরে ফেলবে। আর ঘটলও তাই। এক ঝাঁক তরুণ ‘নিউ ওয়েভ’ নিয়ে এলো। ভেসে গেল আগাছা।
প্রিমিয়ারে কৌশিক আমাদের জন্য সাসপেন্স রেখেছিল। ‘খাদ’-এর শেষ দৃশ্যে সবার মৃত্যুর কথা আমারা ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। শুটিং এর সময় বলা হয়েছিল ওটা স্বপ্ন দৃশ্য। ছবি দেখতে গিয়ে চমক লাগল। কৌশিক বলল- কেমন দিলাম!
‘খাদ’-এর প্রিমিয়ারেই সামনাসামনি প্রথম সৃজিতের সঙ্গে পরিচয়। সৃজিত ‘রাজকাহিনি’র জন্য কাস্ট করলো। বড্ড বেশি পড়াশুনো করা ছেলে। কাজের ব্যাপারে ভীষণ ক্যালকুলেটিভ। অসম্ভব পরিশ্রমী। সৃজিতের শুটিং ছিল দেখার মত। কীভাবে কাজ আদায় করে নিতে হয় সেটা ওঁর জানা। দেরি করে ফ্লোরে আসা ঋতুপর্ণার আজন্মের অভ্যেস। তার উপর মাঝেমধ্যেই ডায়লগ ভুলে যেত। একদিন সৃজিত তো রেগেমেগে একসা- ”এভাবে সৃজিত মুখার্জির ছবিতে অ্যাক্টিং চলে না। এটা তোমার ‘সুজন সখী’ নয়।” তারপর থেকে ঋতুও শুধরে গেল। সৃজিত বলল- ”এবার বুঝলে তো কেন অমন বকুনি দিয়েছিলাম।”
‘রাজকাহিনি’র বেশ কিছুদিন বাদে আবার একটা আকাঙ্ক্ষিত ফোন। ওপারে শিবপ্রসাদ- ”দিদি আমাদের ছবিতে কাজ করবে না?”
-এটা একটা কথা হল! তোমাদের মত তরুণদের সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি।
‘পোস্ত’-এর কনট্রাক্ট সাইন করতে এসে শিবুর সঙ্গে অনেকখণ আড্ডা দিলাম। বলল- ”আমরা যেদিন কাস্টিং নিয়ে বসেছি গৌরি লাহেরীর চরিত্রটার কথা উঠতেই নন্দিতাদি টেবিল ঠুকে বলল ‘লিলিদি লিলিদি লিলিদি’। এই চরিত্রটা একমাত্র তোমার পক্ষেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।” ছোটরা এমন উৎসাহিত করলে কাজের তাগিদ বেড়ে যায়। চরিত্রে নিমগ্ন হলাম। এগিয়ে এলো শুটিং এর দিন। প্রথমে স্ক্রিপ্টপাঠ। একাধিক রিহার্সাল। অবশেষে শুটিং। এটাই শিবু-নন্দিতার নিজস্ব স্টাইল। তাড়াহুড়োয় ওঁরা একেবারে বিশ্বাসী নয়। মনে আছে দুবার রিহার্সাল হল। একদিন সবাই মিলে। আরেকদিন মিমি আর আমি নিজেদের অংশটুকু সড়গড় হয়ে নিলাম। আমার উইগের জন্য মাপজোক আগেই করা ছিল। হঠাৎ নন্দিতার ফোন- ”দিদি আমরা যদি তোমার এই উইগটা ইউজ না করি?
-তবে কী অন্য কোন উইগ বানাবে?
– না। আমরা তোমার অরিজিনাল লুকটাই রাখতে চাইছি। দেখো বেশ লাগবে।
এই একটা কথাতেই ওঁদের কাজের ধরন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি এক বাক্যে রাজি হলাম। আউটডোর শান্তিনিকেতনে। যে ঘরটায় শুটিং হয়েছিল তার হাজারটা দরজা। যেন একখানি ভুলভুলাইয়া। স্পটে পৌঁছে আরও কয়েক ক্ষেপ রিহার্সাল। সঙ্গে আমাদের ক্ষুদে আর্টিস্ট অর্ঘ্যবাবু। সে যে কী দুরন্ত তা আর বলার নয়! বাচ্চাটির সঙ্গে আমার অল্প কয়েক দিনেই বন্ধুত্ব জমে উঠলো। শান্তিনিকেতনে টানা দশ দিনের শুটিং। চুটিয়ে কাজ করলাম। শেষ দিন মেক আপ ভ্যানে উঠে এলো শিবু-নন্দিতা। জড়িয়ে ধরল হাতদুটো। বলল — ”আমাদের পছন্দের শিল্পীর তালিকায় আর একজনের নাম যুক্ত হল। তিনি লিলি চক্রবর্তী।”
ছোটদের থেকে এমন প্রশংসা কী কম বড় প্রাপ্তি!