প্ৰথম পৰ্ব
দ্বিতীয় পৰ্ব

সংযোজন : একটি দুঃখজনক আশাবাদের গল্প

সংযোজন : একটি দুঃখজনক আশাবাদের গল্প

[বইয়ের এই অংশটি এডিথ ওয়েস্কোফ-জোয়েলসনকে উৎসর্গ করা হলো।

১৯৫৫ সালে আমেরিকায় লোগোথেরাপি চিকিৎসার প্রচলনের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর অবদান ভোলার নয়।]

প্রথমেই প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘দুঃখজনক আশাবাদ’ বলতে কী বোঝায়? সংক্ষেপে বলা যায়, মানুষের জীবনে তিনটি ট্র্যাজেডি আছে।

এক. দুঃখ;

দুই. পাপ;

তিন. মৃত্যু।

এই তিনটি ট্র্যাজেডি থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আশা করেন। আশায় থাকেন। লোগোথেরাপির ভাষায় এটাকেই দুঃখজনক আশাবাদ বলে।

মূলত এ অধ্যায়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, জীবনের সব অবস্থায় কীভাবে ‘হ্যাঁ’ বলা সম্ভব। প্রশ্নটি অন্যভাবে করা যেতে পারে, এই ত্রয়ী ট্র্যাজেডি থাকা সত্ত্বেও কীভাবে জীবনকে সম্ভাবনায়ময় বলা যেতে পারে? সর্বোপরি, জার্মান ভাষায় লেখা আমার একটি বইয়ের শিরোনাম, ‘সবসময়ই জীবনের জন্য ‘হ্যাঁ’ বলুন।’ যেখানে বলা হয়েছে, জীবন অপার সম্ভাবনাময়। এমনকি যারা দুর্দশাগ্রস্ত, তাদের জন্যেও এ কথাটি প্রযোজ্য। যেকোনো অবস্থা থেকে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। অন্যভাবে বলা যায়, যেকোনো অবস্থাকেই মানুষ নিজের করে নিতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের সেরাটা আদায় করে নিতে পারে। ‘সবচেয়ে সেরা শব্দটিকে ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়েছে, ‘সর্বোত্তম’।

এজন্যই আমি দুঃখজনক আশাবাদ বলেছি। ট্রাজেডির মুখোমুখি হয়েও মানুষ জীবনের সম্ভাবনা খোঁজে, চেষ্টা করে নিজের জন্য সবচেয়ে সেরাটা আদায় করে নেবার। যেমন:

এক. দুঃখকেও মানুষ তার প্রাপ্তিতে পরিণত করতে পারে;

দুই. অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের জন্য ভালো কিছু করতে পারে। এবং

তিন. ক্ষণস্থায়ী জীবনেও নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, জোর করে বা চেয়েচিত্তে আশাবাদ অর্জন করা যায় না। একজনের পক্ষে হাজার চেষ্টা করেও সব সময় আশাবাদী হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আশার ক্ষেত্রে যেটি সত্য, তিনটি উপাদানের অন্য দুটো অর্থাৎ বিশ্বাস এবং ভালোবাসার ক্ষেত্রেও সেটি সত্য।

ইউরোপিয়ানরা আমেরিকান সংস্কৃতি থেকে যে বৈশিষ্ট্য পেয়েছে, তা হলো, নিজেকে বারবার আদেশ দেয়া, হুকুম করা ‘সুখী হও, সুখী হও।’ কিন্তু এভাবে সুখ পাওয়া যায় না। ‘সুখী হওয়ার’ কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। যখন কারো জীবনে সুখী হবার কোনো কারণ ঘটে, তখন সে নিজে নিজেই সুখী হয়। আমরা কী দেখি, একজন মানুষ কিন্তু সুখ খোঁজে না, সে সুখী হবার কারণ খোঁজে।

মানুষ যখন সুখী হয়, তখন আরেকটি পরিচিত লক্ষণ দেয়া যায় মানুষের মাঝে। হাসি। যদি আপনি কাউকে হাসাতে চান, তাহলে কোনো না কোনো হাসির কারণ ঘটাতে হবে। যেমন আপনি তাকে একটি হাসির কৌতুক বলতে পারেন। তাকে বলে কয়ে, হুকুম দিয়ে সত্যিকারের হাসি হাসানো কখনোই সম্ভব নয়। এমনকি সে নিজেও যদি চেষ্টা করে তবু নয়। বড়জোর সে কৃত্রিম হাসি হাসতে পারবে। অথবা, ছবি তোলার সময় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ‘চেস’ বললে যেমন মুখে মেকি একটি হাসি ফুটে ওঠে, এ হাসি তেমনই হবে। কিন্তু কোনো কারণ না ঘটলে মন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি হাসা কখনোই সম্ভব নয়।

লোগোথেরাপিতে এই ধরনের আচরণকে ‘হাইপার টেনশন’ বলে। যৌনবিকৃতির ক্ষেত্রেও এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বিকৃতি হতে পারে কোনো ভয় কিংবা পুরষত্বহীনতা। অধিকাংশ রোগীই যৌনক্রিয়ার সময় নিজেকে ভুলে যাওয়ার বদলে নিজে বেশি আনন্দ নিতে গিয়ে বরং আনন্দ থেকে বঞ্চিত হোন। ব্যর্থ হোন তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছুতে। তারা যেটাকে আনন্দের উৎস বলে ভাবেন, মূলত সেটা পুরো আনন্দকে মাটি করে দেয়।

যখন কোনো ব্যক্তি জীবনের মানে খুঁজে পান, তখন তিনি শুধু সুখীই হোন না বরং তার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাও বেড়ে যায়।

তবে তিনি যদি জীবনের মানে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হোন, তখন তার ফলাফল কী দাঁড়ায়? সেটা খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে যুদ্ধবন্দি বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করা যেতে পারে, এ অবস্থায় তারা কী করতো? প্রথমে আমি আমেরিকান সৈন্যদের কথা বলবো। তাদের আচরণ ছিল স্বচ্ছ। অথবা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সেইসব বন্দিদের কথা মনে করা যেতে পারে, যারা হঠাৎ একদিন ভোর পাঁচটায় বিছানা ছাড়তে অস্বীকার করতো। কোনো হুমকি ধামকিতেও তাদের নড়ানো যেত না। তাবুতে নিজেদের প্রস্রাব পায়খানার উপরই নিশ্চল শুয়ে থাকতো। কোনো কিছুই তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারতো না। তারপর তারা যা করতেন, গোপন কোনো পকেট থেকে লুকিয়ে রাখা সিগারেট বের করে আনতেন। তারপর ধূমপান করতেন। সেই মুহূর্তে আমরা জানতাম, পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টায় বা তার আগেই আমরা তাদের মৃত অবস্থায় দেখতে পাবো। তাদের কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। কোনো আশাই ছিল না তাদের মনে। ফলে তাৎক্ষণিক সুখকেই তারা বেছে নিয়েছিল।

প্রতিদিন আমরা যে ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি, এটি কি তারই সমান্তরাল ঘটনা নয়? আমি যেসব যুবকদের কথা বলছি, বিশ্বের সাথে নিজের তুলনা করে তাদের মনে হয়েছে, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তারা একটি ভবিষ্যতহীন প্রজন্ম। নিশ্চিত করে বলা যায়, তারা শুধু সিগারেটই পান করে না, অন্যান্য নেশাদ্রব্যের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ে।

আসলে মানুষ যখন অস্তিত্বশূন্যতায় ভোগে, তার কাছে যখন জীবনকে অর্থহীন মনে হয়, তখন সে নেশার আশ্রয় নেয়। হতাশার কারণে নেশার আশ্রয় নেয়া আমাদের সমাজের পরিচিত একটি দৃশ্য। আজকের দিনে শুধু লোগোথেরাপিস্টগণই মনে করেন না যে, জীবনের মানে খুঁজে না পাওয়া মানসিক রোগের একটি প্রধান কারণ। আরও অনেকেই এমনটি মনে করেন। আরভিনে অবস্থিত স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক্সিসটেনশিয়াল সাইকোথেরাপির অধ্যাপক ডি. ইয়ালোমের মতে, ‘ক্লিনিকের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা চল্লিশজন রোগীর মধ্যে বারোজনই (শতকরা ত্রিশ জন) জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া নিয়ে চরম সমস্যা ভোগেন। ‘

পালো এলোটা থেকে হাজার মাইল পূর্বেও কিন্তু এই গড় খুব একটা উনিশ-বিশ হয়নি। ওখানে শতকরা ঊনত্রিশ জন এই সমস্যা ভোগেন। সম্প্রতি ভিয়েনায় এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ঊনত্রিশ লোক মনে করেন, তাদের জীবন থেকে বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে গেছে।

জীবনের মানে হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কেউ মনে করেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই হয়তো আছে, কিন্তু কেন বেঁচে থাকতে হবে, এর কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ বেঁচে থাকার ব্যবস্থা আছে কিন্তু এইভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। কোনো অর্থ নেই এই জীবনের।

যদিও বক্তব্যটি অতি সরলীকরণ হয়ে গেলো। কিন্তু এটাই সত্য। বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, অনেক ব্যক্তিই বর্তমানে বেকার। পঞ্চাশ বছর আগে আমি একটি গবেষণায় দেখিয়েছিলাম, অসুস্থ তরুণরা এক ধরনের বিশেষ হতাশায় ভোগে। যাকে আমি ‘বেকারত্বজনিত মানসিক সমস্যা’ বলে অভিহিত করেছিলাম। সেখানে আমি আরও দেখিয়েছিলাম, এই মানসিক সমস্যা হয় দুটো ভুল কারণে— এক. বেকার হওয়ার পরে নিজেকে অকেজো মনে হয়। দ্বিতীয় কারণ হলো এই অকেজো হওয়ার পর মনে হয় জীবনের কোনো মানে নেই। অর্থহীন এই জীবন। এই মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমি তাদের অবসর সময়ে বিভিন্ন কাজ যেমন যুব সংগঠন করা, বয়স্ক শিক্ষা পরিচালনা করা, পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ করা বা এমন কোনো কাজ করতে বলি। আমার কথা মতো এসব অবৈতনিক কিন্তু অর্থপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হবার পর তাদের হতাশা কেটে গিয়েছিল। যদিও এতে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পেটের ক্ষুধাটা আগের মতোই ছিল। কারণ অপ্রিয় হলেও সত্য, মুখের কথায় চিড়ে ভিজে না অর্থাৎ শুধু জনকল্যাণমূলক কাজ করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

বেকারত্বজনিত কারণে মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়া ছাড়াও আর্থসামাজিক কারণেও হতাশার সৃষ্টি হয়। সাইকোডাইনামিক বা জৈব রাসায়নিক পদার্থের কারণে এই হতাশার জন্ম। এই অনুসারেই সাইকোথেরাপি বা ফার্মাথেরাপি দেয়া হয়। যাইহোক, জীবনের মানে না খুঁজে পাওয়া— এই বিষয়টিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না বা ভুলে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, এটি প্যাথলোজির বিষয় নয়, বরং মানসিক সমস্যার লক্ষণ। এটাকে আমি মানবতার প্রমাণ বলতে চাই। যদিও এটি কোনো প্যাথলজিক্যাল কারণে হয় না, তবে এর প্যাথলজিক্যাল প্রতিক্রিয়া অবশ্য আছে। অন্যভাবে বলা যায়, এটি সম্ভবত কোনো রোগ- জীবাণু। তরুণ প্রজন্মের এই স্নায়বিক লক্ষণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনটি কারণে তাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়া। যথা- বিষণ্ণতা, আগ্রাসন এবং আসক্তি। এই তিনটি কারণেই লোগোথেরাপির মতে মানুষের মধ্যে ‘অস্তিত্বশূন্যতা’ অর্থাৎ জীবনের কোনো অর্থ নেই— এই অনুভূতি তৈরি হয়।

তবে আমি কিন্তু বলছি না, জীবনের মানে খুঁজে না পাবার কারণেই সব ধরনের হতাশার জন্ম হয়। কিংবা হতাশার কারণে মানুষ অনেক সময় আত্মহত্যা করে, এর জন্য দায়ী অস্তিত্বশূন্যতা। তাছাড়া জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেললেই মানুষ আত্মহত্যা করে না। আরও নানান কারণে আত্মহত্যা করতে পারে।

আত্মহত্যা করার পেছনে অনেক শক্তিশালী কারণ থাকে। তারপরেও রোগীদের আত্মহত্যা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে কেমন হয়? অস্ট্রিয়ায় এক সরকারি হাসপাতালে আমি তরুণ ডাক্তার হিসেবে চার বছর কাজ করেছি। আমি যে বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম, সেখানের সব রোগীই ছিল হতাশাগ্রস্ত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বেশিরভাগ রোগীই সেখানে ভর্তি হয়েছিল আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর। একবার আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, ওই চার বছরে আমি কমবেশি বারো হাজার রোগী দেখেছি। তখন আমার এ বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা হয়। এখনো কখনো কোনো আত্মহত্যাপ্রবণ রোগী পেলে সেই অভিজ্ঞতা চমৎকার কাজে দেয়। আমি তাদের আমার পুরোনো রোগীদের কথা বলি। বলি যে, তারা কত খুশি হয়েছে, আত্মহত্যার চেষ্টা সফল না হবার কারণে। সপ্তাহ, মাস, বছর কেটে যাবার পরে তারা আমাকে বলে, যেই কারণে তারা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, সেই সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে। ‘যদি হাজার জনের সমস্যার মধ্যে একজনের সমস্যারও সমাধান হয়’, আমি তাদের বোঝাতে থাকি, ‘তাহলে আপনার সমস্যার সমাধান যে হবে না, এ গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? হাজারে একজন যে আপনিই হবেন না, কে জানে? তাই প্রথমেই আপনাকে যে কাজটি করতে হবে, আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। কী হবে দেখার জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে নতুন দিনের সকাল পর্যন্ত। তাই কোনো মতেই দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়া যাবে না।’

মানসিক সমস্যার দ্বিতীয় লক্ষণ হলো— আগ্রাসন। ক্যারোলিন উড শেরিফের গবেষণা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সে পরীক্ষা করার জন্য দুটো বয়স্কাউট গ্রুপের মধ্যে মানসিক আগ্রাসন তৈরি করেন। এতে তিনি ভালোভাবেই সফল হোন। তারপর তিনি খেয়াল করলেন, যখন সব তরুণ মিলে কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করলেন, তখনই তাদের মন থেকে আগ্রাসন ভাব চলে যায়। ছেলেরা যে কাজটি করেছিল, তা হলো, তাদের খাবারের গাড়ি কাদামাটির উপর দিয়ে সবাই মিলে টেনে ক্যাম্পের সামনে নিয়ে এসেছিল। তখন ওই কাজটি তাদের কাছে শুধু চ্যালেঞ্জই ছিল না, নিজেদের জীবনের মানে খোঁজার একটি পথ ছিল, যা তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ করেছে।

এবার আসি তৃতীয় লক্ষণ ‘আসক্তি’র ব্যাপারে। এবার আমি এ্যানিমেরি ভন ফোরস্টমেয়ারের গবেষণার কথা বলবো। তাঁর গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান অনুসারে নব্বই ভাগ মদ্যপায়ী মদ পান করে কারণ তাদের কাছে জীবনকে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হয়। অন্যদিকে স্ট্যানলি ক্রিপনার মাদকাসক্তদের নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েন, তাদের মধ্যে শতভাগ লোকই বিশ্বাস করেন, জীবন অর্থহীন।

চলুন, এবার দেখা যাক, ‘জীবনের মানে’ শব্দ দিয়ে কী বুঝায়? এ বিষয়ে প্রথমেই আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, একজন মানুষ সারাজীবনে যে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন, লোগোথেরাপিস্টরা সেইসব ঘটনার মাঝ থেকে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করেন। তাই আমি একজনের জীবনের অর্থ দিয়ে সবার জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করবো না। যদিও বৃহত্তর জীবনের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করি না। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে করুন। হাজার হাজার দৃশ্য দিয়ে একটি চলচ্চিত্র পূর্ণতা পায়। প্রতিটি দৃশ্যই অর্থপূর্ণ। তারপরও পুরো সিনেমার মানে কিন্তু শেষ দৃশ্যের আগে প্রকাশ করা হয় না। আবার পুরো সিনেমাটি ঠিক মতো বোঝা যাবে না, শুরু থেকে যদি কোনো দৃশ্য বাদ পরে যায়। জীবনটিও কি এমন নয়? জীবনের পূর্ণ অর্থও ঠিক এমনই। জীবনের শেষদিনের আগে কখনো বোঝা যায় না। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তা পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ পায়। আবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের যে পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ পেল, তা কি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের উপর নির্ভর করে না? তার জ্ঞান, তার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না?

সত্য কথা বলতে গেলে, লোগোথেরাপিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের মানে বা উপলব্ধি বাস্তবতাবর্জিত কিছু নয়। তাদের মতে, এটি বাতাসে ভাসমান কিছু নয় কিংবা আইভরি টাওয়ারের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখা নয়।

বিষয়টি সহজ ভাবে বোঝানোর জন্য কার্ল বিহলার বর্ণিত ‘আহা’ অভিজ্ঞতার কথা বলবো। পাশাপাশি ম্যাক্স ওয়েরথেইমারের উপলব্ধির কথাও সংক্ষেপে তুলে ধরব। কার্ল বিহলারের মতে, জীবনের অর্থের উপলব্ধি চিরায়ত উপলব্ধি থেকে আলাদা। এটি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। আমি যা দেখি, তার বাইরেও অনেক কিছু আছে। সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হবে কোনো পরিস্থিতিতে কী করতে হবে?

একজন মানুষ কীভাবে জীবনের মানে খোঁজে? শার্লট বুহলারের মতে, ‘যারা জীবনের মানে কী— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি, তাদের বাদ দিয়ে যারা উত্তর খুঁজে পেয়েছে, আমরা তাদের নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পারি।’ এক্ষেত্রে জীবনীভিত্তিক পদ্ধতি ছাড়া জৈবিক পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। লোগোথেরাপি বিবেকের মতো বা প্রম্পটরের মতো মনে করিয়ে দেয় জীবনের বর্তমান অবস্থায় কোন পথ দিয়ে এগুতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ পরিস্থিতিতে বিবেককে খাটাতে হবে। উচ্চতর মূল্যবোধের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সচেতন স্তরে এই মূল্যবোধগুলো স্পষ্টভাবে, নিজের মতো করে গ্রহণ করা যায় না। কারণ আমরা যা, এগুলো তা-ই। আমাদের বিবর্তনের সাথে সাথে, এগুলো তৈরি হয়েছে। আমার অতীত যে জীবসত্তা সেখানেও এগুলো পাওয়া যাবে। এর উৎস প্রোথিত আমাদের জীবসত্তার গভীরে। কনরাড লরেঞ্জ জৈবিক অগ্রাধিকার তত্ত্ব প্রচার করতে গিয়ে এমন কিছু কথাই বলেছিলেন। সম্প্রতি এক আলোচনায় তাকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললে, তিনি উৎসাহের সাথে এতে সম্মতি দেন। তাছাড়া আমরা আমাদের মাঝে পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার বহন করছি।

লোগোথেরাপি আমাদের বলে, জীবনের মানে খুঁজতে হলে তিনটি কাজ করতেই হবে। এক. সৃষ্টি করা বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করা। দুই. কোনো অভিজ্ঞতা বা কারো মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে। তাছাড়া যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, শুধু কাজ করলেই হবে না, সেই কাজকে ভালোও বাসতে হবে। এডিথ ওয়েস্কোফ- জোয়েলসন লক্ষ্য করেছেন, লোগোথেরাপির ধারণালব্ধ যে অভিজ্ঞতা, তা মূল্যবান। কারণ এতে শুধু আমাদের মতো অর্ধসত্য প্রকাশ পায় না।

তৃতীয় কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এটি এমন একটি পরিস্থিতি, যখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। কোনো আশাই তার থাকে না। তবে মানুষ তখন একক চেষ্টায় এইসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠে। নিজের কর্মদক্ষতায় সে তার ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে। তিনি তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিকে জয়ে রূপান্তর করতে পারেন। আবারও এডিথ ওয়েস্কোফ- জোয়েলসনের একটি মন্তব্য উদ্ধৃতি করছি। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে আমেরিকান সংস্কৃতিতে এক অসুস্থ প্রবণতা শুরু হয়েছে। লোগোথেরাপি এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে পারে। সেখানে যন্ত্রণার জন্য গর্বিত হবার সুযোগ খুবই কম। অর্থাৎ কেউ একজন নিজের কষ্ট থেকে এমন কিছু করবে, যা তার জন্য আনন্দের, গর্বের কারণ হতে পারে, এমন সুযোগ সেখানে কম। এ ব্যাপারটিকে সেখানে মহান করার চেয়ে অবজ্ঞা করা হয়।’ ফলে, ‘সে শুধু অসুখী তা-ই নয়, অসুখী হবার জন্যে সে লজ্জিত বটে।’

প্রায় পঁচিশ বছর আমি একটি হাসপাতালের মানসিক বিভাগ পরিচালনা করেছি। আমার রোগীরা সাক্ষী, কীভাবে আমি তাদের বিপদজনক অবস্থাকে মানবিক সাফল্যে পরিণত করেছি। শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই নয়, এটি গবেষণার মাধ্যমেও প্রমাণিত, কষ্ট, যন্ত্রণার মধ্যেও জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যায়। পাওয়া সম্ভব। ইয়েল ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকদের মতে,

‘ভিয়েতাম যুদ্ধে আটক অনেক বন্দিই বলেছেন, যুদ্ধে তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে— ‘নির্যাতন, রোগে ভোগা, অপুষ্টিহীনতায় ভোগা, নির্জন কারাগারে থাকা, এরকম বহু অবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। তারপরেও তাদের মতে, বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা তাদের পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে এসেছে। বন্দিজীবনের বিভিন্ন ঘটনা তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে।

তবে সবচেয়ে দুঃখজনক আশাবাদকে ল্যাটিন ভাষায় বলে আর্গুমেন্টা এড হোমেনিম। জেরি লং এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। লোগোথেরাপির ভাষায় একে বলে, “মানব আত্মার সীমাহীন শক্তি। টেক্সারকানা গেজেট থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘জেরি লং তিনি বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হোন। এর ফলে তার ঘাড়ের নিচ থেকে পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। তিনি যখন দুর্ঘটনার কবলে পড়েন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। এখন লং এক ধরনের মাউথ স্টিক দিয়ে টাইপ করতে পারে। বিশেষ এক ধরনের টেলিফোনের সাহায্যে তিনি কমিউনিটি কলেজের দুটো কোর্সে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। ইন্টারকমের মাধ্যমে দূরে থেকেও ক্লাসের সব কথা শুনতে পারেন। ক্লাসের বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। তার সময় কাটে পড়াশোনা করে, টিভি দেখে, লেখালেখি করে।’

আমি তার কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘আমি আমার জীবনকে সমৃদ্ধ এবং অর্থময় মনে করি। আমার জীবনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যাবার কারণেই আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। যেটি এখন আমার ব্যক্তিগত মতবাদ। আমার ঘাড় ভেঙে গেছে কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি। এখন আমি একটি কলেজে সাইকোলজি কোর্সে প্রথমবারের মতো ভর্তি হয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার এই প্রতিবন্ধকতাই অন্যান্যদের সাহায্য করার জন্য আমার ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। আমি জানি, আজকে যেখানে আছি, যা কিছু অর্জন করেছি, যন্ত্রণাভোগ না করলে সেটা কখনোই সম্ভব হতো না।’

তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, জীবনের মানে খুঁজে পেতে হলে, দুর্ভাগ্যকে বরণ করে নিতেই হবে? একেবারেই না। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, দুর্ভাগ্য থেকে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু জীবনের মানে বোঝার জন্য যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। যদিও এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে আমি বলেছি, দুঃখ অনিবার্য। তবে এই দুঃখ যদি এড়ানো যায়, তবে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ বেহুদা যন্ত্রণা ভোগের মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। গৌরব তো নয়-ই। অন্যদিকে কেউ যদি তার দুঃখজনক অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারে, তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। লং শখ করে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার ঘাড় ভাঙেননি। তবে এই ঘটনা ঘটে যাবার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার সাথে যা-ই হোক, তিনি ভেঙে পড়বেন না।

তবে আমরা দেখেছি, সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষ তার দুঃখজনক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। তাছাড়া কীভাবে দুঃখের সাথে টেক্কা দিতে হয়, এটি জানতে হবে। এমনকি যারা রাস্তায় থাকে, তাদের জন্যেও একই কথা। সম্প্রতি অস্ট্রিয়ান জনমতামতের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ শিল্পী বা মহান বিজ্ঞানী কিংবা বিখ্যাত ক্রীড়াবিদের চেয়ে যারা পরিশ্রম করে, লড়াই করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, তারাই বেশি সম্মানিত।

তিনটি ট্র্যাজেডির দ্বিতীয় নম্বরে ছিল, অপরাধবোধ। পাপ। আমি এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে একটু দূরে থাকবো। কারণ এ বিষয়টা আমার কাছে কিছুটা চটুল মনে হয়েছে। কারণ অনেক সময় মানুষ এমন কিছু করতে পারে, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তাছাড়া কারো অপরাধ চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে সেখানে তাকে সমর্থন করার মতো কোনো না কোনো কিছু পাওয়া যাবেই। মনে রাখতে হবে, মানুষ দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তাকে মনে করতে হবে একটি মেশিন বা যন্ত্র। যা মেরামত করার সুযোগ আছে। তবে বিষয়টি মন থেকে গ্রহণ করা কিছুটা কঠিন তো অবশ্যই। এমনকি অপরাধীরাও চিকিৎসার চেয়ে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আশা করে।

ইলিয়নসের সংশোধনাগার থেকে এক অপরাধী আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে ছিল। চিঠিতে সে লিখেছে, ‘একজন অপরাধীকে কখনো তার কাজের ব্যাখ্যার দেয়ার সুযোগ হয় না। বিভিন্ন অজুহাত দেখানো হয়। সমাজকে দোষ দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্থকে দোষ দেয়া হয়।’

একবার আমি সান কোয়েনটিনে বন্দিদের উদ্দেশ্যে দুচার কথা বলেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, ‘আপনারা আমার মতোই মানুষ। তাই আপনাদের পক্ষে অন্যায় করা, পাপ করা স্বাভাবিক। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আপনারা অন্যায় করেছেন। এখন সময় সেই পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার। নিজেকে বদলে ফেলার। ভালো মানুষ হবার।’ তারা আমার কথা বুঝতে পেরেছিল।

জেল থেকে মুক্ত হওয়া ফ্রাঙ্ক ই. ডব্লিউ.- এর কাছ থেকে একটি চিরকুট পাই। তিনি লিখেছেন, সাবেক সহবন্দিদের নিয়ে তিনি একটি লোগোথেরাপির দল খুলেছেন। জেল থেকে বাইরে এসে তারা সাতাশ জন্য একটি শক্তিশালী দল গড়েছেন। এটি মূল দল থেকে আলাদা। এখান থেকে একজন মাত্র ফিরে গেছেন। তিনি এখন মুক্ত।’

সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগত ভাবে যা মনে করি, একজনের অপরাধের শাস্তি অন্যকে দেয়া ঠিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ে আমি অক্লান্তভাবে কথা বলে গেছি। অনেক সময় তাদের এইসব কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য নীতিবাক্য বলতে হয়েছে। কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে।

একবার একজন আমেরিকান মহিলা এসে আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিল। ভর্ৎসনা করে বলল, ‘আপনি কীভাবে এখনো জার্মান ভাষায় বই লিখেন? এটা তো এডলফ হিটলারের ভাষা! এডলফ হিটলারের ভাষায় আপনি কোন আক্কেলে বই লিখেন?’

তার কথার উত্তরে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার রান্নাঘরে কি কোনো চাকু আছে?’

মহিলা আমার পাল্টা প্রশ্নে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। পরে বলল, হ্যাঁ, আছে।’

আমি তার উত্তর শুনে অবাক হওয়ার ভান করলাম। অবিশ্বাস মাখানো কণ্ঠে বললাম, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? অনেক খুনিই চাকু দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। অথচ সেই চাকু আপনি রান্নাঘরে ব্যবহার করার জন্য রেখে দিয়েছেন?

তখন তিনি আমার জার্মান ভাষায় বই লেখা নিয়ে অভিযোগ করা বন্ধ করলেন।

ট্র্যাজেডির তৃতীয় বিষয়টি মৃত্যু বা মৃত্যু সম্পর্কিত। মৃত্যু জীবনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। যেকোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে। একবার মারা যাবার পর কখনোই আর জীবন ফিরে পাওয়া যায় নাা। তবে জীবনের এই অনিত্যতাই কি আমাদের জীবনকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে শেখায় না? তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি আমাদের দ্বিতীয় জীবন। প্রথম জীবনে যা ঘটেছে, এই জীবনে তাতে অভিনয় করে যেতে হবে।

আসলে ঠিক মতো কাজ করার সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য প্রতিটি সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। একবার যখন আমরা একটি সুযোগকে কাজে লাগাবো, বাস্তবায়ন করবো, মনে রাখতে হবে, সেটি সারাজীবনের জন্যই বাস্তবায়িত হলো। আমরা যা যা করছি, সব কিছুই অতীতে জমা হচ্ছে। অতীত কখনো জীবন থেকে হারিয়ে যায় না। অতীতের কিছুই হারিয়ে যায় না। সব ঠিকঠাক মতো জমা আছে। যা খুবই মূল্যবান।

নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, মানুষের দৃষ্টি শুধু বর্তমানের দিকে। বর্তমানে শস্যশূন্য মাঠকেই শুধু সে চোখে দেখে। অতীতের শস্যভাণ্ডারের দিকে একটুও নজর দেয় না। ভুলে যায়, অতীতে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার সাথে কত ভালোবাসা, ত্যাগ, যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে।

এ অবস্থায় বৃদ্ধদের দয়া দেখানোর কোনো কারণ নেই। বরং তরুণদের উচিত তাদের ঈর্ষা করা। এটা সত্য বৃদ্ধদের ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। তবে তাদের এরচেয়ে বেশি কিছু আছে। আমরা যেটাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বলে মনে করছি, সেটা তাদের কাছে অতীত। সম্ভাবনাগুলো তারা বাস্তবায়ন করেছেন। জীবনের মানে তারা খুঁজে পেয়েছেন। মূল্যবোধগুলো তারা উপলব্ধি করেছে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদের কাছ থেকে অর্জন কেড়ে নিতে পারবে না। মুছে ফেলতে পারবে না তাদের সমৃদ্ধ অতীত।

দুর্ভোগের মধ্যে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যায়। তারপরেও বলতে হয়, জীবন কোনো শর্ত মেনে চলে না। জীবন অপার সম্ভাবনাময়। প্রতিটি মুহূর্তেই জীবন সম্ভাবনাময়। অর্থময়। যাদের খুব দুর্দশা চলছে, তাদের ক্ষেত্রেও এই কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।

সমাজের উপকারের জন্য মানুষ সব কিছু করে থাকে। তবে আজকের দিনে সমাজে সফল, সুখী মানুষের বিশেষত যুবকদের আদর এবং কদর বেশি। ফলে অন্যদের অবহেলা করা হচ্ছে। এই যে পার্থক্য করা হচ্ছে, এ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নইলে কোনো ব্যক্তির বর্তমান অবস্থার উপর যদি তার উপযোগিতা নির্ণয় করা হয়, তাহলে বিষয়টি সমাজের অবক্ষয় ডেকে আনবে। এর ক্ষতিকর দিক হিটলারের মানুষ হত্যার সমতুল্যই হবে।

মানুষের বর্তমান কার্যকারিতা তার মূল্য নির্ধারণ করবে, এটি ভুল ধারণা। এর ফলেই তরুণদের মাঝে নিহিলিজমের মতাদর্শ অনুপ্রবেশ করছে। তারা বিশ্বাস করছে, তাদের কোনো মূল্য নেই। গবেষণা করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। নিহিলিজম বলে না যে, কিছু নেই। তারা বলে সবকিছুই অর্থহীন। এক্ষেত্রে বলা যায়, জর্জ এ. সার্জেন্ট যে মতবাদটি প্রচার করেছিল ‘শেখার কোনো অর্থ নেই’, তা ঠিকই ছিল। তিনি নিজেই একজন থেরাপিস্টের মতো নিজেকে বলতেন, ‘জর্জ, মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা একটি কৌতুক মাত্র। এখানে কোনো বিচার নেই। যে যার মতো চলছে। এটা তুমি তখনই অনুধাবন করতে পারবে, যখন বুঝবে সবকিছু সিরিয়াসলি নেয়া কত বোকামি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। এটা যা আছে, তা-ই। তুমি কী করবে, কীভাবে করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে, তার কোনো মানে নেই। এতে কারো কিছু যায় আসে না।’

বিষয়টিকে অন্য আট-দশটি বিষয়ের কাতারে ফেলে বিবেচনা করা উচিত নয়। এখানে নীতিগত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। থেরাপিস্টদের কাজ হবে রোগীদের চিকিৎসা করার চেয়ে কথা বলে তাদের মাথা থেকে নিহিলিজমের ভূত নামানো।

লোগোথেরাপি অন্যান্য সাইকোথেরাপির মতো কিছু শর্ত মেনে চলে। অন্যভাবে বলা যায়, যদি কারো প্রয়োজন হয়, তাহলে সে নেকড়ের সাথে কাঁদতে পারে। তবে বাস্তবিকই যদি এমন করতে হয়, তাহলে আমি তাকে বলবো, ভেড়ার গায়ে যেন নেকড়ের পোশাক পরিয়ে নেয়। মানুষের মৌলিক ধারণার প্রতি বিশ্বাস হারানোর প্রয়োজন নেই। জীবনের যে প্রধান দর্শন, তা লোগোথেরাপিতে আছে। সত্যের খাতিরে বলতে হয়, এ ধরনের আনুগত্য মেনে চলা কঠিন কোনো কিছু নয়। এলিজাবেথ এস. লুকাস একবার পর্যালোচনা করে দেখিয়েছিল, ‘সাইকোথেরাপির ইতিহাসে লোগোথেরাপির মধ্যে অযৌক্তিক কোনো কিছুই ছিল না।’ লোগোথেরাপির প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে (সান ডিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়া, নভেম্বর ৬ থেকে ৮, ১৯৮০) আমি বলেছিলাম, সাইকোথেরাপি শুধু পুনর্বিবেচনার জন্যই নয়, লোগোথেরাপির অবনতি নিয়েও কথা বলেছিলাম। মিথ্যে তোতাপাখির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই, সে শুধু তার মনিবের সুরেই কথা কয়। আমি স্বাধীন, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল মনের আলো চাই।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড একবার বলেছিল, ‘অনেকগুলো ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে কেউ খাবার তুলে ধরুক। ক্ষুধার প্রাবল্যে তাদের মাঝে এক খাবার থেকে অন্য খাবারের কোনো পার্থক্য থাকবে না। একটি দিকেই শুধু তাদের নজর থাকবে।’

আল্লাহকে ধন্যবাদ, সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে কোনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটাতে হয়নি। তাঁর ধ্যানধারণা ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির উপর গড়ে উঠেছে, অশউইজ ক্যাম্পের নোংরার মধ্যে বাড়েনি। ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির সাথে অশউইজ ক্যাম্পের মোটা দাগে পার্থক্য আছে। স্বাভাবিক জীবনের

মানুষ আর এখানকার মানুষ এক নয়। এখানে আসার পর সবার মুখোশ খুলে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে তাদের সত্যিকারের চেহারা। কারো চেহারা শূকরের, কারো সাধু-সন্তের। আজকে ‘সাধু’ শব্দটি ব্যবহার করতে কোনো দ্বিধা করতে হয় না। ফাদার ম্যাক্সিমিলিয়ানের কথাই ধরুন। তাকে অনাহারে রাখা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত অশউইজ ক্যাম্পে ইনজেকশনের মাধ্যমে তার শরীরে কার্বোলিক এসিড ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ ১৯৮৩ সালে এসেও তার নামের গুণগান করা হয়।

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ায় আপনারা হয়তো আমাকে ইতোমধ্যে দোষারোপ করা শুরু করেছেন। এথিকস অফ স্পিনোজার শেষ বাক্যটি বলতে চাই। ‘সবকিছুই মহৎ। শুধু সময় মতো বুঝতে পারাটাই কঠিন।’ আপনারা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, এখানে ‘সাধু’ শব্দটি উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল কি না? শুধু ভদ্রলোকদের কথা বললেই কি হতো না? এটি ঠিক তারা সংখ্যালঘু। সবচেয়ে বড় কথা এই ধরনের ব্যক্তিগণ সবসময় সংখ্যালঘুই থাকবে। এবং এই সংখ্যালঘুদের সাথে যোগ দেয়া অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। তবে আমরা যদি এখনো নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ ভালো করার চেষ্টা না করি, তাহলে পৃথিবীর অসুখ বেড়ে গিয়ে গভীর থেকে গভীরতর হবে।

তাই, আমাদের দুটো বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে : কারণ অশউইজ থেকে জানি, মানুষ কী করতে সক্ষম। এবং হিরোশিমা থেকে আমরা জানি, কী ঝুঁকি আছে।

[এ অধ্যায়টি ১৯৮৩ সালে পশ্চিম জার্মানির রেগেনবার্গ বিশ্বাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত লোগোথেরাপির তৃতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে দেয়া ভাষণের আলোকে লেখা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে তা বইয়ে সংযুক্ত হয়।]  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *