প্ৰথম পৰ্ব
দ্বিতীয় পৰ্ব

অস্তিত্বের মূল কথা

অস্তিত্বের মূল কথা

দায়বদ্ধতার এই বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হয় লোগোথেরাপির উপর। বিষয়টা এমন যে, “তুমি দ্বিতীয় জীবন কাটাচ্ছো। প্রথম জীবনে যেসব ভুল করেছো, দ্বিতীয় জীবনে সেই একই ভুলের অভিনয় করতে হবে। এটা তোমার দায়িত্ব।’ আমার মনে হয়, দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অন্য কোনো নীতিকথা বা ম্যাক্সিম এর চেয়ে সুন্দর করে কিছু বলেনি। এর ফলে মানুষকে একটি কল্পনা করার সুযোগ করে দেয়। মানুষ ভাববে, তার বর্তমান জীবনটাই যেন তার অতীত জীবন। এখন সে দ্বিতীয় জীবন পার করছে। তবে তার অতীত এখনো পরিবর্তিত হতে পারে। সংশোধিত হতে পারে। এই নীতি জীবনের সূক্ষ্মতার মুখোমুখি করিয়ে দেয়। পাশাপাশি তার নিজের এবং নিজের জীবনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

লোগোথেরাপি একজন রোগীকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন করে তোলে। ফলে সে বুঝতে পারে কেন, কিসের জন্য, কার জন্য তাকে দায়িত্ববান হতে হবে। এইজন্য একজন লোগোথেরাপিস্ট সাইকোথেরাপিস্টের চেয়ে রোগীকে মূল্যবোধ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার বেশি সুযোগ দেয়। বলা চলে, লোগোথেরাপিস্টরা রোগীর উপর ভাবনাগুলো চাপিয়ে দেয়। লোগোথেরাপিস্ট কখনো রোগীর বিচারের ভার ডাক্তারের উপর চাপিয়ে দেবার অনুমতি দেয় না।

এরফলে একজন রোগী সমাজের প্রতি বা নিজের বিবেকের প্রতি কতটুকু দায়দায়িত্ব পালন করবে তা সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যাপার। কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু নিজের দায়িত্বপালন করেই ক্ষান্ত হোন না, বরং তাদেরকে যারা দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছেন, তাদের প্রতিও দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকেন।

লোগোথেরাপি কখনোই শিক্ষা দেয় না বা ধর্ম প্রচার করে না। নৈতিক উপদেশ বা যুক্তির কচকচানি থেকে লোগোথেরাপির অবস্থান বেশ দূরে। বোঝানোর সুবিধার্থে বলা যেতে পারে, একজন চিত্রশিল্পীর চেয়ে চক্ষু- -বিশেষজ্ঞের সাথেই লোগোথেরাপিস্টের বেশি মিল রয়েছে। একজন চিত্রশিল্পী যেভাবে পৃথিবীকে দেখেন, ছবির মাধ্যমে আমাদের তা-ই দেখাতে চান। অর্থাৎ ছবিতে আমাদের পরিচিত পৃথিবীকেই তখন চিত্রশিল্পীর চোখ দিয়ে দেখি। অপরদিকে একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ চেষ্টা করেন, চোখ দিয়ে যেন আমরা পৃথিবী যেমন, তেমনটাই দেখতে পারি। লোগোথেরাপিস্ট চেষ্টা করেন, রোগীর দেখার পৃথিবীকে আরও বড়, আরও প্রশস্ত করতে। যেন পৃথিবীর বা জীবনের পুরোটাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই প্রতিটি মানুষই দায়বদ্ধ। তার এই দায়িত্বকে যথাযথভাবে পালন করার নামই জীবন। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, নিজেকে আবিষ্কার করার চেয়ে পৃথিবীকে আবিষ্কার করাই প্রকৃত জীবনের অর্থ। অর্থাৎ নিজের জন্য না বেঁচে পৃথিবীর জন্য, দশের জন্য বাঁচতে হবে। যদিও এটি একটি বদ্ধ প্রক্রিয়া। আমার মতে এই গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যই হলো, মানব অস্তিত্বের উৎকর্ষ, যা সে নিজেই অর্জন করে। মানুষের কিছু লক্ষ্য আছে। সে সবসময় সেদিকেই এগিয়ে যায়। এটা করতে গিয়ে কখনো সে অন্যের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করে। যা কখনো ঠিক নয়। মানুষ যত বেশি নিজের স্বার্থকে ভুলে থাকবে, নিজেকে যত বেশি অন্যের জন্য উজাড় করে দিবে, মানুষকে যত বেশি ভালোবাসবে, ততই সে মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠবে। বুঝতে পারবে, মনুষ্যত্ব কাকে বলে। উপলব্ধি করতে পারবে নিজেকে। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেকে উপলব্ধি করা বলতে কী বোঝায়? কীভাবে আত্ম-উপলব্ধি করা যায়? এখন প্ৰথম কথা হলো, আত্ম-উপলব্ধি অর্জন করা যায় না। কারণটা খুবই সহজ। সে যত বেশি আত্ম-উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে, ততই সে এটার অভাব অনুভব করবে। অন্য ভাবে বলা যায়, আত্মোৎকর্ষের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেই আত্ম-উপলব্ধি করা সম্ভব।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দেখিয়েছি, জীবনের মানে সব সময়ই পরিবর্তন হয়। হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই পরিবর্তন হওয়া, বদলে যাওয়া কখনো থামবে না।

লোগোথেরাপি অনুযায়ী, জীবনের অর্থকে আমরা তিনটি দৃষ্টিকোণ আবিষ্কার করতে পারি।

এক. কাজ করার মাধ্যমে বা কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে। দুই. কোনো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা কারো সংস্পর্শে এসে।

তিন. অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা যে মনোভাব অর্জন করে থাকি, তার মাধ্যমে।

প্রথম অর্জন বা সিদ্ধি লাভের পথটি বেশ স্পষ্ট। তবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উপায়টি নিয়ে আরও কথা বলা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন, ধার্মিকতা, সত্য এবং সুন্দরের সান্নিধ্যে এসে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করা যেতে পারে। এই অভিজ্ঞতা অর্জন করা যেতে পারে প্রকৃতি বা সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে। অন্য মানুষের কাছ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিটি বেশ অভিনব। অন্য মানুষের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায় হলো তাকে ভালোবাসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *