প্যান-ডিটারমিনিজম নিয়ে আলোচনা
প্যান-সেক্সচুয়ালিজমের জন্য প্রায়ই মনোবিশ্লেষণকে দোষ দেয়া হয়। তবে এই দোষারোপ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এতে এমন কিছু আছে, যা আমার কাছে ভুল এবং বিপদজনক অনুমান বলে মনে হয়েছে। যেটাকে আমি ‘প্যান-ডিটারমিনিজম’ বলি। এটি দিয়ে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, মানুষের এমন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, যার ফলে, তার সামর্থ যা-ই হোক না কেন, সে প্রয়োজনে যেকোনো অবস্থাতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। মানুষ শুধু তার ভাগ্য নির্ধারিত পথেই চলে না। সে নিজের পথ নিজে গড়ে নিতে জানে। কিংবা বলা চলে, মানুষ নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের মতো নিছক একটি জীবন নয়। মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কীভাবে তার জীবনকে খরচ করবে, তার পরবর্তী মুহূর্ত কেমন হবে?
একই ভাবে বলা যায়, প্রতিটি মানুষের নিজের জীবনকে, চলার পথকে যেকোনো মুহূর্তে পরিবর্তন করার স্বাধীনতা আছে। একটি কোকিলকে সারাজীবন কোকিলের জীবনই যাপন করতে হয়, একটি বাঘকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঘ থাকতে হয়। অর্থাৎ তাদের জন্মগত জীবনই যাপন করতে হয়। কিন্তু একজন মানুষ প্রথম জীবনে সুরের সাধনা করে পরবর্তী সময়ে সে দস্যুর জীবন গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ সবসময় সে তার জীবনের গতিপথকে বদলে দেবার স্বাধীনতা রাখে। তাই, আমরা একজন ব্যক্তির কাজকর্মের ধরণ দেখে শুধু তার ভবিষ্যৎ জীবনের পূর্বাভাসই দিতে পারি। কিন্তু অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি মানুষই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। তার সম্বন্ধে আগে থেকেই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। সাধারণত জৈবিক, মনস্তাত্তিক, সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কিছুর পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সে যেকোনো মুহূর্তে নিজের যেকোনো পরিস্থিতিকে অতিক্রম করার সামর্থ্য রাখে।
এই মুহূর্তে আমার ডা. জে.-এর কথা মনে পড়ছে। আমার সারা জীবনে দেখা একমাত্র ব্যক্তি, যাকে মফিস্টোফিলিয়ান বলার সাহস রাখি। পুরোপুরি শয়তানের প্রতিচ্ছবি। শয়তানের সাথে তার কোনো উনিশ-বিশ নেই। সেই সময় তাকে ‘স্টেইনহফের কুখ্যাত খুনি’ নামে ডাকা হতো (ভিয়েনার সবচেয়ে বড় মানসিক হাসপাতাল ছিল সেটি)। নাজিরা যখন এথেনসিয়া প্রোগ্রাম (সহজে মানুষমারার কর্মসূচি) হাতে নিল, তখন এই কসাই এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে সব দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিল। তিনি ছিলেন ধর্মান্ধ। তার উপর দায়িত্বকে সে যথাযথ ভাবেই পালন করেছিল। একটি মানুষ মানসিক রোগীও তার হাত থেকে নিস্তার পায়নি। সবাইকে গ্যাসচেম্বারে ধুকে ধুকে মরতে হয়েছে। যুদ্ধ শেষে আমি ভিয়েনা ফিরে আসি। তখন ডা. জে. সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
‘রাশিয়ানরা তাকে স্টেইনহফের একটি নির্জন কারাকক্ষে আটক করে রেখেছিল।’ তারা আমাকে বলল। ‘পরের দিন যখন সেই কক্ষের দরজা খোলা হলো, তখন আর তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি।
পরে আমি ধারণা করলাম সে হয়তো অন্যান্য বন্দিদের সহায়তা নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা পালিয়ে গেছে। সম্প্রতি আমার সাথে একজন সাবেক অস্ট্রিয়ান কূটনৈতিকের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি অনেক বছর কারাবন্দি ছিলেন। প্রথমে বন্দি ছিলেন সাইবেরিয়ার কারাগারে। পরে মস্কোর বিখ্যাত কারাগার লুবিয়াঙ্কাতেও ছিলেন। আমি যখন তাকে স্নায়বিকভাবে পরীক্ষা করছিলাম, তখন তিনি আচমকা আমাকে একটি প্রশ্ন করেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ডা. জে.-কে আমি চিনি কি না?
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম, হ্যাঁ, চিনি।
তিনি তখন বলতে লাগলেন, ‘লুবিয়াঙ্কায় তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তার ইউনারি ব্লাডে ক্যানসার হয়েছিল। জেলেই তিনি এই ক্যানসারের কারণে মারা যান। তখন তার চল্লিশ বছর বয়স ছিল। মারা যাবার আগে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি সহবন্দি হিসেবে যে কত ভালো ছিলেন, তা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। তিনি সবাইকে সান্ত্বনা দিতেন। বোঝাতেন। আদর্শ জীবন বলতে যা বোঝায়, তার জীবন ছিল তা-ই। আমার দীর্ঘ কারাজীবনে তার মতো ভালো বন্ধু একজনও পায়নি। দেখিওনি।’
এই হলো ডা. জে.-র গল্প। অথচ তাকেই এক সময় ‘স্টেইনহফের কুখ্যাত খুনি’ বলা হতো। এখন আপনারাই বলুন, একজন মানুষের আচরণ দিয়ে কি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা যেতে পারে? আমরা বড়জোর মেশিন সম্পর্কে, রোবট সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। আলোচনা করতে পারি মানুষের মনের গঠন বা গতিশীলতা নিয়ে। কিন্তু মানুষ নিয়ে অগ্রিম কিছু বলা? নৈব নৈব চ। অসম্ভব। মানুষ সব কিছু থেকে অনেক বড়। অনেক উপরে।
স্বাধীনতাই শেষ কথা নয়। স্বাধীনতা গল্পের একটি অংশ। এটি একটি অর্ধসত্য শব্দ। স্বাধীনতার নেতিবাচক দিক আছে। কিন্তু স্বাধীনতার সাথে যখন দায়িত্বশীলতা যুক্ত হয়, তখন সেটি ইতিবাচক দিক বলেই সবার কাছে পরিচিতি পায়। কিন্তু মানুষ যখন তার দায়িত্বপালন না করে, যা খুশি তা করে বেড়ায় তখন স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারীতায় রূপান্তরিত হয়। এজন্য আমি বলি, পূর্ব উপকূলে স্ট্যাচু অব লিবার্টি নির্মাণ করলে তার পরিপূরক হিসেবে পশ্চিম উপকূলে অবশ্যই স্ট্যাচু অব রেসপন্সিবিলিটি নির্মাণ করতে হবে।