নু-ডাইনামিকস
তবে এটা ঠিক মানসিক উত্তেজনার চেয়ে মানসিক ভারসাম্য আগে বজায় রাখা দরকার। তবে মানসিক উত্তেজনাও মানসিক স্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে জ্ঞানের চেয়ে কার্যকরী কিছু পৃথিবীতে নেই। জীবন রাতের স্বপ্ন নয়, এর অর্থ আছে, উদ্দেশ্য আছে— এই জ্ঞানই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। নিৎসের অসাধারণ একটি কথা আছে। ‘যদি কেউ জানে কেন বাঁচবো, তাহলে সে যেকোনো উপায়েই কীভাবে বাঁচবো— এই পথ খুঁজে বের করে।’
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোনো সাইকোথেরাপির চেয়ে এই আপ্তবাক্য অধিক কার্যকরী। নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এই ঘটনা চাক্ষুস করেছি। যার মনে হয়েছে, কেউ তার প্রতীক্ষায় আছে, তখন সে কোনো না কোনো ভাবে নিজেকে রক্ষা করেছে। তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নিয়ে নিয়ে অন্যান্য লেখকের বইয়ের উপসংহারেও একই ঘটনা পাওয়া গেছে। কিংবা জাপানে, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ ভিয়েনার যুদ্ধবন্দিদের ক্ষেত্রেও যে মানসিক তদন্ত হয়েছিল, সেখানেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।
অন্যের কথা বাদ দেই। নিজের কথাই বলি। আমাকে যখন অশউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আসা হয়। তখন আমার কাছে একটি পাণ্ডুলিপি ছিল। পাণ্ডুলিপিটি আমি সম্পূর্ণ করেছিলাম। তবে প্রকাশ করতে পারিনি। ক্যাম্পে আমার কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি জব্দ করা হয়। হঠাৎ আমার মনে ইচ্ছে জাগে সেই বইটি নতুন করে লেখার। আমার মনে হলো, যেকরেই হোক, বইটি আমাকে আবার নতুন করে লিখতেই হবে। নতুন করে পাণ্ডুলিপি তৈরি করার দৃঢ় ইচ্ছাই আমাকে ক্যাম্পে টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল। আমি যখন বেভারিয়া ক্যাম্পে, তখন টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হই। জ্বরের মধ্যেও উপুর হয়ে শুয়ে ছোট ছোট কাগজে আমি লিখতে শুরু করি। পাণ্ডুলিপি যখন নতুন করে লিখতে শুরু করি, তখন আমার মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবো। আমি নিশ্চিত, পাণ্ডুলিপি নতুন করে লেখার উদ্যম আমাকে বেভারিয়ার অন্ধকার ক্যাম্পে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে।
তাই বলা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য একটি নির্দিষ্ট টেনশন, চাপে থেকে গড়ে ওঠে। টেনশন মানুষ কী অর্জন করেছে, কী অর্জন করবে— এই দুয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করে। টেনশন করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানসিক সুস্থতার জন্য কিছুটা টেনশন থাকা দরকার। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য, জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার জন্য সম্ভাব্য কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিধা থাকা উচিত নয়। এভাবেই জীবনের অর্থকে খুঁজে নিতে হয়। তবে বেশি উত্তেজনা, মানসিক চাপ ভয়ঙ্কর। কারণ জীবনের জন্য সুস্থিরতা প্রয়োজন। তবে আবারও বলছি, ভাবনাহীন জীবন কোনো জীবনই নয়। পরিপূর্ণ জীবনের জন্য দরকার সংগ্রাম, চেষ্টা মানসিক দৃঢ়তা। আমাদের এমন চাপ নেয়ার প্রয়োজন নেই, যা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের অর্থ একদিনেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। জীবনের অর্থ খোঁজার এই প্রচেষ্টাকে আমি হোমিওস্ট্যাটিস না বলে নু-ডাইনামিকস বলি। অর্থাৎ অস্তিত্বের গতিশীলতার মধ্যে এটি একটি মেরুক্ষেত্র। যার একটি মেরু জীবনের অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে, অন্য মেরু মানুষ কীভাবে পরিপূর্ণ হতে চায়, তার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এমনটা চিন্তা করা উচিত নয়, এই ধারণা শুধু স্বাভাবিক অবস্থাতেই কাজ করে। বরং কেউ যদি স্নায়বিক সমস্যায় ভোগে, তার ক্ষেত্রেও এটি কাজ করবে। স্থপতিরা কোনো ভগ্নগ্রস্ত খিলানকে মেরামত করার জন্য তার উপর আর নতুন কিছু চাপিয়ে দেয়। ফলে সবকিছু মিলে খিলানটি আরও মজবুত হয়ে ওঠে। ঠিক একই ভাবে থেরাপিস্টরা তাদের রোগীদের মানসিক ভাবে সুস্থ করে তোলার জন্য তাদের মাথায় কিছু চিন্তা ঢুকিয়ে দেন। এতে ভয়ের কিছু নেই। ফলে তারাও নিজের জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
জীবনের অর্থ খোঁজার বিয়ষ নিয়ে যারা অভিযোগ করেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আসলে তারা জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কেন বেঁচে আছি, বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে কি না, এই বিষয়েই তারা সচেতন নয়। তাদের মধ্যে যে শূন্যতা, হতাশা- সেই হতাশা, শূন্যতাকেই তারা সব কিছু মনে করে। তারা নিজেরাই নিজেদের হতাশায় বন্দি হয়ে গেছে। আমি এই অবস্থাকে বলি অস্তিত্ব-শূন্যতা বা এক্সিসটেনশিয়াল ভ্যাকুম।