প্ৰথম পৰ্ব
দ্বিতীয় পৰ্ব

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা – ৩

একদিনের ঘটনা বলি- আমাদের অশউইজ থেকে দাচাও যাবার কথা ধরা যাক।

আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদেরকে ট্রেনে করে মাওথাওসেনে নিয়ে যাওয়া হবে। দুই পুরনো অভিজ্ঞ যাত্রীর কথা শুনে জানতে পারলাম যে, ওই ক্যাম্পে পৌঁছাতে একটা নির্ধারিত ব্রিজ পার হতে হয়। ওই ব্রিজের যত কাছে পৌঁছাচ্ছিলাম, ততই চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম আমরা। কিন্তু দেখা গেল, ট্রেনটা ব্রিজের দিকে না গিয়ে ‘দাচাও’তেই থামলো। তখন আমাদের কী যে আনন্দ হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আগেই কোনো কিছু চিন্তা করে ঘুম হারাম করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সারাক্ষণ দুঃখ, কষ্ট, অপ্রাপ্তির কথা ভাবার চেয়ে ছোট ছোট প্রাপ্তির কথা, সুখের কথা ভাবলে অনেক শান্তিতে থাকা যায়।

যাইহোক, দুই দিন তিন রাত ভ্রমণ করে ‘দাচাও’ পৌঁছানোর পর কি হয়েছিল, বলি।

আমরা যে-ট্রেনের যে-কামরায় ছিলাম, সেখানে সবার বসার জায়গা ছিল না। বেশির ভাগ যাত্রীকেই পুরো রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছিল। এরমধ্যে প্রস্রাবে ভেজা এক দড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম পালা করে। যাইহোক, যাত্রা তো শেষ হলো। কিন্তু ঐ ক্যাম্প সম্পর্কেও আমাদের বড় একটা আতঙ্ক ছিল। তবে সেখানে পৌঁছানোর পর কি শুনলাম জানেন? খবরটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা হলো, সেখানে কোনো গ্যাস চেম্বার নেই। অপেক্ষাকৃত ছোট ছিল সেই ক্যাম্প। মাত্রা আড়াই হাজার জন মানুষ ছিলাম আমরা।

তো গ্যাস চেম্বার নেই শুনে আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, কোনো মোসলেমকে তাহলে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হবে না। বরং কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তথাকথিত অসুস্থদের বহন করার গাড়ি এলে তাদের আবার অশউইজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে খুশির খবর ছিল সেটাই, আমাদের কাউকে আপাতত চিমনির ধোঁয়া হয়ে আকাশের ভেসে যেতে হবে না।

সেখানেও আমাদের রসিকতা করার কোনো বিরাম ছিল না। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় যা ঘটেছিল সবই মুখ বুজে সহ্য করে নিয়ে ছিলাম। যখন নতুন বন্দিদের গোণা হচ্ছিল, দেখা গেল একজন বন্দি নেই। লাপাত্তা। তারজন্য আমাদের বৃষ্টি এবং ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ যতক্ষণ হিসাব না মিলবে, ততক্ষণ আমাদের গ্রহণ করা হবে না। তার জন্য খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। কোথায় গেল সেই বন্দি? পাপিষ্ঠ কোথায়?

অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল এক ঘরে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।

সারারাত তার জন্য আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সারা সকালও গেছে এইভাবে। ঠান্ডায় জমে গিয়েছিলাম সবাই। ভিজে চুপচুপা হয়ে

গিয়েছিলাম। এত দীর্ঘ যাত্রার পর এই আজাব ভোগ করেও আমরা খুশি ছিলাম। কারণ সেখানে কোনো চিমনি নেই। অশউইজ ক্যাম্পও বহু দূরে।

.

আরেকবারের ঘটনা।

একদল বন্দি হেঁটে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে। তাদের দেখে কী হিংসাটাই না হয়ে ছিল আমাদের। আমরা মনের দুঃখে ভাবছিলাম যে- তাদের হয়তো গোসল করার সুযোগ আছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা করে টুথব্রাশ, কাপড় ঝাড়ার ব্রাশ, বিছানা আছে এবং প্রত্যেক মাসে তারা খবর পেত তাদের পরিবার পরিজনের- অন্তত বেঁচে আছে কিনা, সেটা জানতে পারত। আমাদের সেই সুযোগ নেই। তাই মনে হয়েছিল, তারা আমাদের থেকে কতই না সুখী। সুখ-দুঃখের এইসব আপেক্ষিকতা তখনো জানতাম না।

শুধু তাদেরই নয়, যারা কারখানায় এবং ছাদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল, তাদের দেখেও আমাদের হিংসা হতো! আমাদের মনে হতো এমন জীবন পাওয়া শত জন্মের ভাগ্যের ব্যাপার। আবার ক্যাম্পের বাইরের এমন অনেকগুলো দল ছিল যাদের অবস্থা অন্যদের থেকে আরো খারাপ বলে মনে করা করা হতো। তাদেরকেও হয়তো যারা বারো ঘণ্টা রেল স্টেশনে মাটি কাটার কাজকরতো, তারা হিংসা করতো। হতেই পারে। হওয়টাই স্বাভাবিক। কারণ বেশিরভাগ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এখানেই ঘটতো। নিয়মিতই ঘটতো।

অন্য অনেক দলের ফোরম্যানরাই দাজ্জালের মতো আচরণ করতো। অধস্তদের নির্যাতন করার ঐতিহ্যকে তারা ফরজ মনে করে পালন করতো। সেইসব নির্যাতিত বন্দিরা আবার আমাদের বলতো, তোমরা কত সুখেই না আছো ভাই!

দুর্ভাগ্যক্রমে একবার আমাকে এরকম এক দলে নেয়া হয়েছিল। যদি না সেদিন সাইরেন বেজে উঠত (বন্দিদের জড় করে আবার নতুন কাজে দেয়ার জন্য), তাহলে হয়তো বা আমি সেদিন মৃতলাশ বহনকারী গাড়ি বা অবসাদে মৃত ব্যক্তিদের বহনকারী স্লেজে ফেরত আসতাম।

পুরোটা সময় ধরে ফোরম্যান আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এক পা-ও নড়ছিল না। কেউ হয়ত বিশ্বাস করবে না এমন অবস্থায় সাইরেনের শব্দকেও বাঁশির চেয়ে সুমধুর মনে হয়েছিল। কী যে শান্তি নিয়ে এসেছিল মনে! আমরা ছোটখাটো অনেক কিছুর জন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম।

যেমন, ঘুমোতে যাওয়ার আগে উকুন পরিষ্কার করার জন্য সুযোগ দেয়া হতো। সেই সুযোগ পেলে অনেক খুশি হতাম। যদিও এর মানে ছিল হাড়কাঁপানো শীতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এমন এক ঘরে যেখানে কিনা হিটার বলতে কিছুই ছিল না। তবুও এ কাজের মধ্যে কোনো সাইরেন না বাজলে বা বাতি বন্ধ না করলে, আমরা খুশি হতাম। কারণ এটা না করতে পারলে আমাদের অর্ধেক রাত জেগে থাকতে হতো।

ক্যাম্পের ছোট ছোট আনন্দগুলো এক ধরনের স্বস্তি দিত, তৃপ্তি দিত- যাকে শোপেনহাওয়ার ‘কষ্ট থেকে মুক্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আসলে এটাও ছিল আপেক্ষিক ব্যাপার। আমাদের চিত্তাকর্ষক আনন্দ বলতে গেলে হাতে গোনা অল্পকিছু ছিল।

আমার মনে আছে, একদিন আমি এই ‘আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলো’ এক টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আবিষ্কার করলাম সত্যিকার অর্থে দুটো আনন্দময় মুহূর্ত কাটিয়েছিলাম আমি।

একদিন কাজ থেকে ফেরার পর রান্না ঘরে ঢুকতে পারলাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর। বন্দিরাধুনী ফ. এর লাইনে দাঁড়ালাম আমি। সে রাঁধুনী বিশাল বড় পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে চামচ দিয়ে একের পর এক বন্দির বাটিতে দ্রুত স্যুপ ঢেলে দিচ্ছিলেন। তিনিই একমাত্র রাঁধুনি ছিলেন, যে কিনা শুধু স্যুপ দেয়ার সময় কারো চেহারার দিকে তাকাতেন না। সবাইকে সমানভাবে খাবার বিলিয়ে দিতেন। সেটা যে-ই হোক। নিজের বন্ধু বা দেশের পরিচিতজনদের বাটিতে বিশেষ ভাবে আলু তুলে দিতেন না। স্বজনপ্রীতির রেশ মাত্র ছিল না তার কাছে। তাই অন্য বারের মত উপরের পাতলা পানির বদলে আসল স্যুপ পেয়েছিলাম আমি। তবে তাকে মাপকাঠি ধরে যারা সেখানে স্বজনপ্রীতি করতো, পরিচিত মানুষকে সুযোগ সুবিধা দিত, তাদের ঠিক দোষী বলা যাবে না। মৃত্যু হবে নিশ্চিত জেনেও কেউ যদি তার বন্ধু-বান্ধবকে সুবিধা দেয়, তাহলে কি তাকে দোষারোপ করা যায়? তাছাড়া অন্যের বিচার করার আগে ওই জায়গা নিজেকে ভাবতে হয়। কেউ যদি জোর গলায় বলতে না পারে যে, তার জায়গায় নিজে থাকলে অন্য রকম ভাবে কাজটি করতে পারবে, তাহলে তার এই বিচার করা উচিতও না।

অনেক পরে যখন আমি পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম অর্থাৎ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেলাম, তখন কেউ একজন আমাকে ইলাস্ট্রেড উইকলিতে প্রকাশিত একটি ছবি দেখায়। ছবিটি ছিল বন্দিদের। অনেকগুলো বন্দি অল্প একটু জায়গায় গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আগত দর্শনার্থীদের দিকে।

আমাকে ছবিটি দেখিয়ে বলল, “কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য, না? অনাহারে সবার কী করুণ অবস্থা!’

‘এখানে ভয়ঙ্করের কী আছে?’ আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।

সেই সময় মনে হলো আমি ক্যাম্পের দিনগুলোতে আবার ফিরে গেছি।

ভোর পাঁচটা বাজে।

বাইরে তখনো ছোপ ছোপ অন্ধকার।

আমি ছোট একটি ঘরে কাঠের তক্তার উপর শুয়ে আছি। এই ছোট ঘরটি আমাদের সত্তর জনের ঠিকানা। আমরা অসুস্থ ছিলাম। তাই আমাদের সেদিন কাজে যেতে হয়নি। এমন কি প্যারেডেও যাইনি আমরা। সেই ছোট্ট রুমের এক কোণায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটাতাম। ঝিমোতাম। অপেক্ষা করতাম রুটির, স্যুপের। অসুস্থ হবার কারণে রুটি এবং স্যুপ – দুটোর পরিমাণই কমে গিয়েছিল। তাছাড়া যে স্যুপ দেয়া হতো, তাকে স্যুপ বললে পানির প্রতি অবিচার করা হবে। তারপরও এই সামান্য বিষয় নিয়েই আমরা কতই না খুশি ছিলাম। সুখী ছিলাম। আমরা একজন আরেকজনের গা ঘেষে শুয়ে থাকতাম যেন ঠান্ডা না লাগে। আর এতটাই অলস হয়ে পড়েছিলাম যে, একটা আঙুলও নড়াতে চাইতাম না। ওখানে শুয়ে শুয়ে শুনতে পেতাম, রাতের বেলা কাজ করা শ্রমিকেরা ফিরে এসেছে। তাদের চিৎকার, চেঁচামিচি শুনতাম। মাঝে মাঝে বাঁশির শব্দ ভেসে আসতো। শুয়ে শুয়েই শুনতাম, বাইরে এসেম্বলিতে বন্দিদের রোলকল করা হচ্ছে।

তেমন একদিনের ঘটনা। হুট করেই আমাদের রুমের দরজা খুলে গেল। হু হু করে আসতে লাগলো ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের সাথে আমাদের রুমে এসে ঢুকলো একজন শ্রমিক। দেখে বোঝা যাচ্ছিল ভীষণ ক্লান্ত। সারা শরীর বরফে ঢাকা। এসেছিল একটু বিশ্রামের জন্য। কয়েক মিনিট জিরিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু একজন সিনিয়র বন্দি এসে তাকে সাথে সাথেই সেখান থেকে বের করে নিয়ে যায়। অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা করানোর রুমে কোনো লোক আসা কড়াকড়ি ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল। আবার এ ভেবে আনন্দিত ছিলাম যে, তার জায়গায় আমি নেই। অর্থাৎ এখানে আরও দুয়েকদিন বিশ্রাম নিতে পারবো, এটাই ছিল আমার খুশির কারণ।

ম্যাগাজিনের ছবি দেখে আমার এইসব কথাই মনে পড়ছিল। তখন তাকে বুঝিয়ে বললাম, ‘ঘরের মানুষগুলো দেখে হয়তো তোমার কষ্ট লাগছে, তবে এমনও হতে পারে তারা তখন আনন্দেই ছিল। তাই এই ছবি দেখে আমার ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না, তাদের জন্য করুণা হচ্ছে না।’

আমার অসুস্থতার চতুর্থ দিন। কিছুটা ভালো হওয়ায় আমাকে রাতের শিফটের কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন হঠাৎ দায়িত্বে থাকা ডাক্তার এসে আমাকে অন্য এক শিবিরে টাইফাস রোগীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। আমার বন্ধুদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও (কারণ কেউ এই স্বেচ্ছাসেবীর কাজ বলতে গেলে করে না) আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে রাজি হয়ে যাই। আমি জানতাম, কাজের দলে চলে গেলে আমি মোটেও টিকবো না বেশি দিন। কিন্তু যদি মরতেই হয়, তাহলে ভালো কোনো কাজ করেই মরতে চাইছিলাম। নিঃসন্দেহে আমার সহবন্দিদের ডাক্তার হিসেবে সেবা করা এভাবে কাজকর্মহীন বন্দি থাকার চেয়ে অনেক ভালো।

তাছাড়া আমার জন্য ছিল এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো ত্যাগ নয়। কারণ আমি ব্যক্তি জীবনে ডাক্তার ছিলাম। কিন্তু স্যানিটাইশন স্কোয়াডের ওয়ারেন্ট অফিসারদের নির্দেশ ছিল, যে দুইজন ডাক্তার টাইফাস ক্যাম্পের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আছে, তাদের যাওয়ার আগপর্যন্ত যেন ভালো ভাবে খেয়াল নেয়া হয়। আমাদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, তিনি ভয় পেয়েছিলেন, ডাক্তার দুজন হয়তো শেষপর্যন্ত এখান থেকে লাশ হয়ে ফিরে যাবে।

প্রথমে যে বলেছিলাম, নিজেকে বাঁচানোর জন্য বা বন্ধুদের বাঁচানোর জন্য সব কিছু করা যায়, এই বিশ্বাসের উপর আমি আর স্থির ছিলাম না তখন। এ কথার কোনো মূল্য ছিল না আমার কাছে। এতকিছুর পর সব মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের সব বিশ্বাস নানা দ্বিধা- দ্বন্দ্বে পড়ে শঙ্কায় রূপান্তরিত হয়েছিল। আমরা তখন এমন এক পৃথিবীতে বাস করছিলাম যেখানে- মানুষের জীবন, তার মূল্যবোধ, তার সম্মানের কোনো দাম ছিল না। যেখানে মানুষের সব ইচ্ছাশক্তি হরণ করে তাকে বলি দেবার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল। যেখানে নিষ্ঠুর বাস্তবতার ঘোরপ্যাচে মানুষের ব্যক্তিত্ব এক অকল্পনীয় মূল্যবোধের সংকটে ভুগছিল। আর এই ব্যক্তিত্ব রক্ষা করার জন্য যদি কেউ সংগ্রাম না করত, তাহলে তারা তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা চিরতরে হারাত। এর ফলে তারা নিজেকে হাজার মানুষের মধ্যে একজন বলে মনে করতো। কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা থাকতো না। পশুদের মতো জীবন যাপন করতো।

বন্দিদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এমন ভাবে নিয়ে যাওয়া হতো, ফিরিয়ে আনা হতো যেন আমরা মানুষ নই। গরু-ছাগল। কোনো অনুভূতি নেই আমাদের। একদল নেকড়ের মত লোক আমাদের উপর সব সময় নজর রাখতো। নির্যাতন এবং পীড়ন করার ব্যাপারেও তারা ছিল ওস্তাদ। যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছে এখান থেকে ওখানে নিয়ে যেত, ওখান থেকে সেখানে নিয়ে যেত। মন চাইলেই লাথি মারতো। গুঁতা লাগাতো। আমাদের তখন দুটো চিন্তা ছিল, কীভাবে এইসব নেকড়েদের হাত থেকে বাঁচব, কীভাবে একটু খাবার পাব।

ভেড়ার পাল যেভাবে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে, আমরাও তেমনি দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম। এটার আর একটা সুবিধা ছিল যে, আশেপাশের, সামনে পিছনে যে গার্ড থাকতো তাদের মারের হাত থেকে বাঁচা যেত ওখানে থাকলে। পাশাপাশি সবার মাঝে থাকলে, তীব্র ঠান্ডাটাও কম লাগতো শরীরে। তাই নিজেদের ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্যই দল করে দাঁড়াতো সবাই। না বুঝেই তারা এটা করে থাকতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমরা ইচ্ছা করে এ কাজটা করতাম। তবে এসএস সদস্যদের বিষয়টি যেন দৃষ্টি-আকর্ষণ না করে, তা নিয়ে আমরা অনেক সচেতন ছিলাম।

অনেক সময় ভীড় থেকে দূরে থাকতে হতো। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল, যেখানে আমাদের জোর করে রাখা হচ্ছিল, সব সময় নজরদারি করা হতো। কারণ, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করতো অনেকেরই। অল্প সময়ের জন্য হলেও এ চিন্তা মাথাচাড়া দিতো। কখনো কখনো বন্দি একা থাকতে চাইতো। নিজের জীবনের কথা ভাবার জন্য, চিন্তার জন্য নিৰ্জনতা, একাকীত্ব তার কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠতো। তথাকথিত রেস্ট ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হবার পর আমি বহু মূল্যবান অবসরের দেখা পেয়েছিলাম। খুব বেশি না, এই অবসরের মেয়াদ হতো বড় জোর পাঁচ মিনিট। আমি যেখানে কাজ করতাম সেখানে পঞ্চাশ জন অসুস্থ বন্দি ছিল। সে ক্যাম্পের এক কোণে কাঁটাতারের দুটো বেড়ায় ঘেরা একটি জায়গা ছিল। বেশ নিরিবিলি। তারপাশেই কিছু খুটি আর গাছের ডাল ব্যবহার করে তাবুর মত জায়গা করা হয়েছিল, সেখানে প্রতিদিনের মৃতদেহ রাখা হত (প্রতিদিন প্রায় আধ ডজন মানুষ মারা যেত)। এছাড়াও পানির পাইপ বহনকারী একটা খাদও ছিল। কাঠের ঢাকনা দিয়ে খাদের মুখ ঢাকা থাকত। কাজ না থাকলে আমি সেই ঢাকনার উপর গিয়ে বসে থাকতাম। অপলক দৃষ্টিতে নীল বাভারিয়ান আকাশ আর ফুলে ঢেকে থাকা সবুজ পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেমন বিভ্রম লাগতো। ক্যাম্পের সীমানার কাঁটাতারের জন্য মনে হতো বাইরের পুরো দৃশ্যটা যেন কাঁটাতারের জালে ঘেরা। আকাশের উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওই দিকে আমার বাড়ি। কিন্তু শুধু মেঘই যেন চোখে পড়তো আমার। তাকিয়ে তাকিয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতো। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পাতা মুছে নিতাম আলগোছে।

সামনে পোকায় ঢাকা, পচতে থাকা লাশগুলো আমার চিন্তায় কোনো প্রভাব ফেলতো না। বেমালুম ভুলে থাকতাম এগুলোর কথা। তবে কোনো গার্ডের পায়ের আওয়াজ পেলে আমার ঘোর কেটে যেত সাথে সাথেই। অথবা অসুস্থদের চেক-আপ করার জন্য ডাক পরলে বা কয়েক সপ্তাহের জন্য পাঁচটি বা দশটি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট অর্থাৎ আমাদের ঔষধ সরবরাহ সংগ্রহ করার জন্য ডাক আসলে আমি উঠে পড়তাম। ওষুধ সংগ্রহ করা, রোগী দেখা, তাদের ওষুধ দেয়া ছিল আমার কাজ।

মোটামুটি যেসব রোগীদের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলাম বাঁচবে না, তাদের ওষুধ দিতাম না। কারণ তাতে কোনো কাজ হতো না বরং কিছুটা আশা ছিল যাদের, তাদের জন্য ওষুধ কম পড়ে যেত।

ঠিক একই ভাবে, যাদের সামান্য অসুখ-বিসুখ ছিল, তাদের ওষুধ দেয়া হতো না। উৎসাহব্যঞ্জক কথাই ছিল তাদের দাওয়াই। এভাবে রোগীদের ওষুধ দিয়ে বেড়াতাম। যদিও নিজেই টাইফাস জ্বরের কারণে বেশ দুর্বল ছিলাম।

কাজ শেষ হলেই পানির খাদের উপর রাখা ঢাকনায় গিয়ে বসতাম। একা নিরিবিলি সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগতো।

মজার বিষয়, এই খাদই একবার আমার তিনজন সহবন্দির জীবন বাঁচিয়েছিল।

স্বাধীনতার ঠিক আগে আগেই একটি গাড়ি আনা হয়েছিল বন্দিদেরকে ‘দাচাও’য়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন এ তিন বন্দি বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পালানোর ফন্দি করে। তারা ওই খাদে লুকিয়ে পড়ে। আমি তখন ওপরে ঢাকনা দিয়ে বসে পড়ি। সেখানে বসে নিরীহভাবে বাচ্চাদের মত তারের দিকে নুড়ি পাথর ছুড়ে মারছিলাম যেন কেউ কোনো সন্দেহ না করতে পারে। আমাকে এক গার্ড ডাকতে গিয়েও ইতস্তত করে চলে গিয়েছিল। তারপর আমি ওই তিনজনকে জানিয়েছিলাম, তাদের বিপদ কেটে গিয়েছে।

একজন বাইরের মানুষের পক্ষে ক্যাম্পের জীবন যে কত কষ্টের, তা কল্পনা করা কখনো সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে জীবনের কোনো মূল্য নেই। এক মূল্যহীন জীবনযাপন আমরা করতাম সেখানে। তবে আমরা যারা বন্দি ছিলাম, তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মানসিকভাবেও অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও একদল অসুস্থ মানুষকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন গাড়ীর বন্দোবস্ত করা হতো, তখন পুরোনো কষ্টটা যেন আবার জেগে উঠতো। নতুন করে বুঝতে পারতাম আমাদের জীবন কত নগণ্য, তুচ্ছ। অসুস্থদের হাড়গোড় সর্বস্ব দেহগুলো ছুঁড়ে ফেলা হতো বহনকারী দু’চাকার গাড়ির উপর। এমনও হয়েছে ভীষণ তুষারপাতের মধ্যেও মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তালিকার কোনো একজন যদি আগে মারা যেত, তার পরেও তার দেহটাকে ছুড়ে ফেলা হতো বাহনে কারণ তালিকাটা ঠিক থাকতে হবে। তালিকা ছিল তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বন্দিদের জীবন তাদের কাছে ছিল মূল্যহীন। মৃতদের নাম্বার ছিল বলেই তাদের গোণা হতো, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা দরকারি বলে গণ্য করা হতো না। শুধু সংখ্যার হিসেবটাই তারা দেখতো। এই সংখ্যার অধিকারী মানুষ, না গরু; জীবিত, না মৃত, তা নিয়ে কোনো মাথা তাদের কখনোই ছিল না। এই সংখ্যার পিছনের মানুষ, তার জীবন কাহিনি সবই তুচ্ছ, মূল্যহীন। তার ভাগ্য, তার ইতিহাস, তার নাম- এইসব বিষয় যেন তাদের ভাবনার যোগ্য হয়ে উঠেনি।

যেহেতু আমি অসুস্থদের ডাক্তার ছিলাম, তাই আমাকেও তাদের এই গাড়ীতে করে যেতে হতো। একবার ব্যাভারিয়ান এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যাওয়ার পথে দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের নাম তালিকায় ছিল, আরেক জনের নাম ছিল না। যে ভাইয়ের নাম তালিকায় ছিল না, সেই ভাই দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছে অনে অনুনয়বিনয় করলো যেন তার ভাইয়ের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ করার পর সেই দায়িত্বরত কর্মকর্তা মীমাংসা দিল যে তার ভাইয়ের জায়গায় সে অন্য একজন বন্দিকে নিয়ে যাবে। কারণ তালিকা ঠিক রাখতে হবে। হিসেবের গড়মিল করা যাবে না। তাই অন্য বন্দির সাথে সংখ্যা বদলে নিয়েছিল মাত্র।

আগেই বলেছিলাম, আমাদের সাথে কোনো কাগজপত্র ছিল না। নিজেদের কোনো মতে টিকে থাকা শরীরটাই ছিল আমাদের সব। অসুস্থদের জন্য এই বিশেষ গাড়ীতে কারা যাচ্ছে, এ বিষয়ে এক শ্রেণির বন্দিদের মধ্যেই আগ্রহ কাজ করতো। যাদের জামাকাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে ত্যানায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল, তারাই খেয়াল করতো কাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা দেখতো যেসব ‘মোসলেম’দের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাদের জুতো, পোশাক-আশাক বা কোনো কিছু তাদেরগুলোর তুলনায় ভালো কিনা। যাই হোক না কেন, তাদের ভাগ্য লেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যারা ক্যাম্পে থেকে গিয়েছিল, কাজ করতে সক্ষম ছিল, তারা নিজেদের অবস্থা বদলানোর জন্য যে কোনো কিছু করার জন্য রাজি ছিল। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের আবেগ কাজ করতো না। বন্দিদের সব কিছু গার্ডদের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করতো। তারা নিজেদের গার্ডদের খেলনা হিসেবেই ভাবতো। তাদের ভাগ্য ছিল গার্ডদের হাতে। এইসব ভাবনা, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তাদের মানবিক মূল্যবোধ নিঃশেষ করে দিয়েছিল।

অশউইজ ক্যাম্পে থাকার সময় আমি নিজেই নিজের জন্য কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করে নিয়েছিলাম। যা আখেরে বেশ উপকার দিয়েছে আমাকে। পরবর্তী সময়ে আমার অনেক সহবন্দিই নিয়মগুলো অনুসরণ করতো। আমি সাধারণত সব প্রশ্নের সত্য উত্তর দিতাম। তবে যেসব প্রশ্নের উত্তর ঠিক মতো চাওয়া হতো না, সেগুলোর উত্তর আমি দিতাম না।

যেমন, যখন আমার বয়স জানতে চাওয়া হতো, বলতাম।

যদি জিজ্ঞেস করতো, আমি কী করি?

বলতাম, ডাক্তার।

তবে কিসের ডাক্তার, কী আশয়-বিষয়, তা বিস্তারিত বলিনি।

অশউইজ ক্যাম্পের প্রথম দিনের সকালবেলার কথা। এসএস অফিসার প্যারেড ময়দানে এলো। আমরা বন্দিরা নানান দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যাদের বয়স চল্লিশের নিচে, তারা এক গ্রুপে। চল্লিশের উপরে যাদের বয়স তারা আরেক গ্রুপে। এছাড়াও যারা লোহা-লক্কড় নিয়ে কাজ করেছে, তাদের এক দল, মেশিন নিয়ে যারা কাজ করেছে তাদের অন্য দল— এভাবে নানান উপদলে বিভক্ত হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর আমরা আবার দক্ষতা নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এখান থেকেও আবার নতুন এক দল তৈরি করা হয়।

আমি যে দলে ছিলাম, সে দলের সবাইকে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও আবার নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আরও কয়েকটি দল তৈরি করা হয়। এই ভাবে কয়েকটি দলে ভাগ করার পর, আমাকে আমার বয়স এবং পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলো। উত্তর দেবার পর তারা আমাকে আরও একটি ছোট দলে পাঠিয়ে দিল। তখন আমাদের আরেকটি ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেখানেও আরেকটি দল তৈরি করা হলো। অনেকক্ষণ ধরে এই প্রক্রিয়া চলছিল। কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম আমি। যদিও আমার বিরক্তিতে কারো কিছু যায় আসে না। আমার চারপাশের মানুষজন নানান ভাষায় কথা বলছিল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। তাই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। তারপর শেষ বারের মতো বাছাই করা হলো। তখন দেখা গেল, আমি প্রথমে যে দলের সাথে ছিলাম, সেই দলেই আবার এসে পড়েছি।

কে জানে তারা খেয়াল করেছিল কি না, যে আমাকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে পাঠানো হয়েছিল। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম, ভাগ্য আমাকে নিয়ে খেলছে।

এরপর যখন অসুস্থ বন্দিদের তালিকা তৈরি করা হলো রেস্ট ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য, সেখানে আমার নাম (মূলত সংখ্যা) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কারণ তাদের কিছু ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। তবে কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে, তাদের আসলেই রেস্ট ক্যাম্পে পাঠানো হবে। কয়েক সপ্তাহ আগেও এমন ভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই সবাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিল, তাদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হবে।

এরপর ঘোষণা দেয়া হলো, যারা রাতের শিফটে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য নাম লেখাবে, তাদের নাম ওই ট্রান্সপোর্টের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। তখন বিরাশিজন সাথে সাথেই রাতের শিফটে কাজ করার জন্য রাজি হয়ে যায়।

পনেরো মিনিট পর গাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাদ দেয়া হয়। কিন্তু এই বিরাশিজন ঠিকই রাতের শিফটে কাজ করার জন্য বহাল থাকে।

তাদের আর নাম কাটানোর কোনো উপায় ছিল না। এই যে ট্রান্সপোর্ট তালিকা থেকে নিজের নাম কাটানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠা, এর কারণ অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস ছিল, যাদের নিয়ে যাওয়া হবে, পরবর্তী পনেরো দিনের মধ্যে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত।

এরপর আবার দ্বিতীয়বারের মতো গাড়ীর ব্যবস্থা করা হলো রেস্ট ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্য। এবারও কেউ নিশ্চিত ছিল না যে, সত্যিই রেস্ট ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, নাকি ভুজুং ভাজুং দিয়ে আবার রাতের শিফটের স্বেচ্ছাসেবক পাওয়ার ধান্ধা করা হচ্ছে! সবাই একটা দোটানার মধ্যে ছিল।

ক্যাম্পের প্রধান ডাক্তার আমাকে বেশ পছন্দ করতেন।

তিনি একদিন সন্ধ্যায় আমাকে একা পেয়ে বললেন, ‘তুমি চাইলে এখনো ওই তালিকা থেকে নিজের নাম কাটিয়ে নিতে পারো। আজ রাত দশটা পর্যন্ত এই সুযোগ তোমার হাতে আছে।’

আমি তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘এ কাজটা আমার সাথে যায় না। কারণ ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে।’

‘বন্ধুদের সাথে যাওয়াটাই মনে হয় ভালো দেখায়।’ আমি বললাম।

সে মায়াভারা চোখে আমার দিকে তাকালো। তার চোখের চাহনির মানে, তুমি তো জানো না, কি হতে যাচ্ছে…।

তিনি কিছু না বলে আমার হাতে হাত রাখলেন। এই হাত রাখা সাময়িক বিদায় দেবার জন্য নয়, সারাজীবনের জন্য বিদায় দেয়া।

আমি আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে এলাম। সেখানে এক বন্ধু আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে প্রকৃত অর্থেই ছিল আমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

সে খুব কষ্টের সাথে বলল, ‘তুমি কি আসলেই তাদের সাথে যেতে চাও?’ বলে আমার মুখের দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে রইল।

‘হ্যাঁ, সত্যিই আমি যেতে চাই।’

তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

সে নিজেকে কোনো ভাবেই আর সামলে রাখতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।

তারপর আমার শেষ ইচ্ছাগুলো বললাম।

‘অট্টো, বন্ধু আমার, যদি আমি আর কখনো ফিরে না আসি, যদি আমার স্ত্রীর সাথে তোমার কখনো দেখা হয়, তাহলে প্রথমেই তাকে বলবে, তাকে আমি সব সময় মনে করতাম। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় তার সাথে মনে মনে কথা বলতাম। তাকে অনুভব করতাম। মনে হতো সে আমার পাশেই আছে, স্পর্শের সীমার মধ্যেই আছে। বন্ধু, তুমি দয়া করে তাকে দ্বিতীয় যে কথাটি বলবে, আমি তাকে পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। তৃতীয় কথা হলো, তাকে জানাবে, বিয়ের পর হয়তো খুব অল্প সময়ই তার সাথে কাটিয়েছি, তারপরেও পৃথিবীর যত সুখ, আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছি।’

অট্টো, বন্ধু আমার, জানি না এখন তুমি কোথায় আছো? কেমন আছো? এও জানি না বেঁচে আছো কি না? তোমার কি মনে আছে আমাদের শেষ বিদায়ের সেই মুহূর্তটুকুর কথা? শেষ ঘণ্টার কথা? তুমি কি তোমার পরিবার, স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছিলে? তোমার কি মনে আছে, আমি যখন আমার শেষ ইচ্ছার কথা তোমাকে শোনাচ্ছিলাম, তখন আমার একেকটি কথা শুনে তুমি কীভাবে বাচ্চার মতো কেঁদেছিলে?

পরের দিন সকালে, আমি গাড়িতে করে ওখান থেকে চলে আসি। এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই ছিল, কোনো ধোঁকা ছিল না। তবে আমাদের কোনো গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যায় হয়নি। রেস্ট ক্যাম্পেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যারা ভালোবেসে আমার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিল বরং তারাই এমন ক্যাম্পে রয়ে গেল যেখানে নতুন ক্যাম্পের চেয়ে ক্ষুধার কষ্ট বেশি। তারা নিজেদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের ভাগ্য আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। মুক্তির কয়েক মাস পর এক বন্ধুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তখন সে আমাকে একটা ঘটনা শুনিয়েছিল। ক্যাম্পের পুলিশ হওয়ার সুবাদে, লাশের গা থেকে খসে পড়া এক টুকরো মাংস খুঁজছিল সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রান্না হতে থাকা এক পাত্রের মধ্যে সেটা খুঁজে পায়। খাবারের অভাবে অনেকে নরকখাদকে পরিণত হয়েছিল। আমি সময় মত সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম।

আমার ওই ঘটনাটা কি ‘ডেথ অফ তেহরান’ গল্পটার কথা মনে করিয়ে দেয় না?

‘একদিন এক ধনী, সাহসী ইরানী তার চাকরকে নিয়ে বাগানে হাঁটছিলেন। এমন সময় চাকরটি হঠাৎ কেঁদে ওঠে। কারণ আজরাইল তাকে হুমকি দিয়েছে।

সে তার মনিবকে অনুরোধ করলো, তাকে যেন মনিবের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়াটা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঘোড়ায় করে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তেহরান পালিয়ে যেতে পারে।

মনিব শুনে অবাক হলো।

তবে চাকরকে তার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়াটি নিয়ে যাবার অনুমতি দিল। চাকর তখনই ঘোড়ায় করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

বাড়িতে ফিরে আসার পর মালিকের সাথেও আজরাইলের দেখা হয়। তখন সে আজরাইলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কেন আমার বিশ্বস্ত চাকরকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলেন?’

আজরাইল মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ‘আমি তাকে হুমকি দেইনি বরং তাকে এখানে দেখে অবাক হয়েছিলাম। কারণ আজ রাতে তার সাথে আমার তেহরানে দেখা হওয়ার কথা।’

ক্যাম্পে বন্দিরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে, কিছু করতে ভীষণ ভয় পেত। এর কারণ তারা ভাবত, তাদের ভাগ্য ক্যাম্পের গার্ডদের হাতে। গার্ডদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর তাদের বাঁচা মরা নির্ভর করছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা একদম উচিত হবে না।

নিজেরাই তাদেরকে নিজেদের ভাগ্যবিধাতা বানিয়ে রেখেছিল। এছাড়া একধরনের উদাসীনতা, অনীহা কাজ করত তাদের ভেতর, যা কিনা পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছিল। কিছু কিছু সময় জীবন-মরণের প্রশ্নে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হতো। বন্দিরা ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে ওটা। তবে কিছু সিদ্ধান্ত ছিল তাদের নিজের হাতে। যেমন: ক্যাম্প থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া। ক্যাম্প থেকে পালাবে কি না, এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ভাবনার সময়টুকু ছিল জাহান্নামের আগুনে পোড়ার মতো কষ্টের। তার কি পালিয়ে যাওয়া উচিত? এ ঝুঁকি নেয়া কি তার উচিত হবে? এ দোলাচল তাকে ভীষণ অস্থির করে তুলতো।

আমি নিজেও একবার এ দ্বিধার মধ্যে পড়ে ছিলাম। সৈন্যদল যখন আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন সুযোগ ছিল পালিয়ে যাবার।

আমার এক সহকর্মীকে ওষুধ আনার জন্য মাঝেমধ্যে ক্যাম্পের বাইরে যেতে হতো। সে এই সুযোগে আমাকে সাথে নিয়ে পালাতে চাইছিল। কোনো এক রোগীর ওষুধ আনার জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত লাগবে, এই কথা বলে সে আমাকেও ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে আসে। সে আগেই একটি বিদেশি দলের সাথে কথা বলে রেখেছিল। তারা আমাদের জন্য পোশাকসহ প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমেই হোক আর যেজন্যই হোক, কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে সেদিন আমাদের পালানো হয়নি। ক্যাম্পে ফিরে আসতে হয়েছিল। ক্যাম্পে ফিরে আসার সময় আমরা কিছু পচা আলু আর একটি ঝুড়ি নিয়ে এসেছিলাম।

মেয়েদের ক্যাম্পের একটা খালি ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তাদের হয়তো সেখান থেকে অন্য কোনো ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঘরের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বুঝতে পারছিলাম, অনেকে খাবার- দরকারি জিনিস নিয়ে পালিয়ে গেছে। ছেঁড়া কাপড়, পচতে থাকা খাবার আর ভাঙ্গা বাসন-কোসন পড়ে ছিল এখানে ওখানে। কিছু বাসন তখনও ভালো অবস্থায় ছিল। হয়তো আমাদের কাজে আসতে পারতো। তারপরও সেগুলো আনিনি, কারণ আমি জানতাম, এগুলো শুধু খাবারের কাজেই নয়, গোসল করার জন্য, এমনকি মলত্যাগের জন্যেও ব্যবহার করা হতো (কেননা নিয়ম ছিল কোনো ধরনের বাসনপত্র ঘরে রাখা যাবে না। কিন্তু শেষের দিকে টাইফাস রোগীরা এতটাই দুর্বল হয়ে যেত যে, তাদেরকে ধরে বাইরে নেয়া সম্ভব হতো না)। আমি দরজায় পাহারাদার হিসেবে দাঁড়াই। আমার সহকর্মী ভেতরে গিয়ে হাতে করে একটা ঝুড়ি নিয়ে বাইরে আসে এবং আমাকে জানাল যে, ঠিক সেরকম একটা ঝুঁড়ি সে ভিতরে দেখেছে। তাই এবার তাকে পাহারায় রেখে আমি ভিতরে যাই। মহিলাদের ফেলে রাখা জিনিসগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি একটা ঝুঁড়ি আর টুথব্রাশ আবিষ্কার করি। হঠাৎ করেই চোখে পরে বাকিদের ফেলে রেখে যাওয়া আরেকটি জিনিস। একজন নারীর লাশ।

সেখান থেকে ফিরেই আমি দৌড়ে আমার ঘরে চলে আসি আমার জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য। আমার খাবারের বাটি, এক মৃত টাইফাস রোগীর কাছ থেকে পাওয়া একজোড়া ছেঁড়া হাতমোজা আর কিছু ছেঁড়া কাগজে লেখা আমার নোট (অশউইজে হারানো বইয়ের খসড়া পুনরায় লিখেছিলাম)। তারপর কী মনে হতেই ঘরের দু’পাশে পচা কাঠের মেঝেতে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা রোগীদের শেষবারের মতো দেখতে গিয়েছিলাম।

আমার স্বজাতি এক রোগীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সে মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল। তারপরও আমার ইচ্ছে ছিল, তাকে সারিয়ে তুলবো।

আমি আমার পালানোর কথাটা লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সে বুঝে ফেলে কিছু একটা হয়েছে। হয়তো আমি খুব অস্থির ছিলাম তখন।

সে জড়ানো গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনিও কি পালিয়ে যাচ্ছেন?’

আমি অস্বীকার করলাম।

তবে বুঝতে পারছিলাম, আমি ঠিক মতো মিথ্যে বলতে পারছি না। তার মুখের দুঃখী ভাবটা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বাকি সবাইকে দেখে আমি আবার তার কাছে ফিরে আসি। সেই একই দৃষ্টিতে সে আমাকে দেখছিল। মনে হলো, কারো কাছে সে নালিশ করছে। বন্ধুর সাথে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে অস্বস্তি কাজ করছিল, তা যেন আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে। হঠাৎ করে আমার ভেতরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

আমি দৌড়ে বন্ধুর কাছে চলে গেলাম।

জোর গলায় বললাম, তার সাথে পালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

যখন আমি বন্ধুকে বললাম, ‘আমি আমার রোগীদের ছেড়ে কোথাও যাব না’, তখন আমার মনে থেকে সব অস্বস্তি চলে গেল। যেন এক পাথর নেমে গেল আমার বুক থেকে। পরের দিনগুলোতে কী হবে তা আমি জানতাম না। কিন্তু নিজের মধ্যে এক ধরনের শান্তি লাগছিল। যা আমি আগে খুঁজে পাইনি। ঘরে ফিরে এসে সে স্বজাতি ভাইয়ের পায়ের কাছে রাখা কাঠের বোর্ডে গিয়ে বসলাম। তারপর তার সাথে গল্প করতে লাগলাম। তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করলাম। একপর্যায়ে সে আমার কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হলো।

ক্যাম্পে আমাদের শেষ দিন এগিয়ে আসতে লাগল। বিপক্ষের সৈন্যবাহিনী যত সামনে এগিয়ে আসছিল, ততই আমাদের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে বদলি করতে লাগলো। ক্যাম্পের অনেক কর্মকর্তা, কাপোরা এবং রাঁধুনিরা পালিয়ে গিয়েছিল ততদিনে।

একদিন ঘোষণা দেয়া হলো, সূর্যাস্তের আগেই ক্যাম্প খালি করা হবে। সবাইকেই যেতে হবে- অসুস্থ বন্দি, ডাক্তার, নার্স, সবাইকেই যেতে হবে। কারণ রাতেই ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে।

এটা জানানো হলো, অথচ অসুস্থদের জন্য যে গাড়ী আসার কথা ছিল, তা দুপুরের মধ্যেও আসেনি সেদিন। বরং ক্যাম্পের প্রধান গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, তার আশেপাশে পাহারার ব্যবস্থা করেছিল যেন কেউ পালাতে না পারে। মনে হচ্ছিল সবার সাথে পুড়ে মরাই আছে কপালে। আমরা দ্বিতীয়বারের মত পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই সেদিন।

সেইদিন দুপুরে সীমানা ঘেরা দেয়ালের বাইরে তিনটা লাশকে কবর দেওয়ার হুকুম করা হয়। ক্যাম্পে লাশ কবর দেয়ার মত শক্তি শুধু আমাদের দুইজনের ছিল। বাকি সবাই যার যার ঘরে জ্বরের ঘোরে কাতরাচ্ছিল। আমরা পরিকল্পনা করছিলাম, কিভাবে প্রথম লাশটার সাথে আমার বন্ধুর ঝুলি পাচার করা যায়?

সিদ্ধান্ত নিলাম কফিন হিসেবে যে পুরনো কাপড় ধোয়ার টাব ব্যবহার করার কথা তার মধ্যে করে নিয়ে যাওয়া হবে। দ্বিতীয় লাশটার সাথে আমার ঝুলি বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তৃতীয়বারে আমরা নিজেরাই পালিয়ে যাবো বলে ঠিক করেছিলাম। প্রথম দু’বার আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছিল সব। পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বনের মধ্য দিয়ে যাত্রা করার কথা ছিল। আমার বন্ধু রুটি আনতে গেল। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বসে আছি, তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই। সে আর ফেরত আসে না। সময় যত গড়াচ্ছিল, ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলাম। তিন বছর বন্দিজীবন কাটানোর পর মুক্তির কথা ভাবতেই মনে হচ্ছিল, কত সুখ। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। আনন্দের সাথে সাথে ভাবছিলাম, যুদ্ধক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যেতে কি রকম লাগবে? কিন্তু অতদূর যাওয়া হয়নি আমাদের। আমার বন্ধু যখন ফেরত আসলো, ততক্ষণে ক্যাম্পের মেইন গেইট খুলে দেয়া দেওয়া হয়েছে।

একটা চকচকে হালকা-রূপালি অ্যালুমিনিয়াম রঙের গাড়ি ভিতরে এসে ঢুকলো। তার গায়ে লাল রংয়ের ক্রস আঁকা ছিল। আন্তর্জাতিক রেডক্রস, জেনেভার প্রতিনিধি এসেছেন গাড়িতে করে। ক্যাম্পের সব বন্দি তার অধীনে নিরাপদ। ক্যাম্পের পাশে এক খামার বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেন কোনো ধরনের বিপদে সে ছুটে আসতে পারে।

এমতাবস্থায় কারই বা পালানোর কথা মাথায় থাকে? গাড়ি থেকে নামানো হয়েছিল বাক্স ভর্তি ওষুধ, সিগারেট বিতরণ করা হয়েছিল। এমনকি আমাদের ছবিও তোলা হয়েছিল। আমাদের আনন্দ ছিল দেখার মতো। কারণ তখন আমাদের যুদ্ধের মধ্যে আটকে পরার কোনো আশঙ্কা ছিল না।

তীব্র উত্তেজনার মধ্যে তৃতীয় লাশটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি বাইরে নিয়ে গিয়ে তিনটি লাশের জন্য খোড়া সরু কবরে ফেলে দিয়েছিলাম। আমাদের সাথে যে গার্ড ছিল, সে এমনিতেও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। সেদিন সে আরো বিনয়ী আচরণ করছিল আমাদের সাথে। সে হয়ত বুঝতে পারছিল যে, পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে এবং আমাদের সুনজরে পরার চেষ্টা করতে চাইছিল। মৃতদেহগুলোর ওপর মাটি দিয়ে ভরাট করার আগে আমরা প্রার্থনা করা শুরু করলে সেও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের শেষ দিকে, শান্তির জন্য মন থেকেই প্রার্থনা করছিলাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধার্মিকরা যেভাবে প্রার্থনা করে, সেভাবে।

ক্যাম্পের শেষ কিছুদিন আমরা কাটিয়েছিলাম মুক্তির প্রতীক্ষায়। কিন্তু আমরা একটু বেশি আগেই মুক্তির আনন্দ উদযাপন করে ফেলেছিলাম। রেডক্রসের প্রতিনিধি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, একটা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এখন আর ক্যাম্পের বন্দিদের সরিয়ে নেয়া হবে না। কিন্তু সেই রাতেই এসএস সদস্যদের ট্রাক এসে পৌঁছালো। কারণ ক্যাম্প ছাড়তে হবে। তারা আমাদের নিয়ে যাবার আদেশ নিয়ে এসেছে। যেসব বন্দি আছে তাদের মূল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সুইজারল্যান্ডে নেয়া হবে। কিছু যুদ্ধবন্দির সাথে বিনিময় করা হবে তাদের। আমরা এসএস সদস্যদেরকে চিনতে পারছিলাম না। বদলে গিয়েছিল তাদের আচরণ। বন্ধুর মতো ব্যবহার করছিল তারা। ভয় না দেখিয়ে ট্রাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে চাইছিল। বারবার বলছিল, আমাদের ভাগ্য আসলেই ভাল।

যারা একটু হলেও শক্ত-সামর্থ্য ছিলো, তারা নিজেরাই ট্রাকে চড়ে বসলো। যারা মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল বা বেশি অসুস্থ ছিল, তাদেরকে ট্রাকে তুলে দিয়েছিলাম অনেক কষ্টে। আমি এবং আমার বন্ধু আমাদের ঝুলিটা আর লুকানোর চেষ্টা না করে শেষ লাইনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। যেখান থেকে মাত্র তেরো জনকে তোলা হবে। প্রধান ডাক্তার তেরোজনকে বেছে নিলেও কি মনে করে আমাদের দুজনকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। বাছাই করা তেরোজন ট্রাকে উঠলেও আমাদেরকে থেকে যেতে হয়েছিল।

হতাশা, বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে আমরা প্রধান ডাক্তারকে গালাগালি করছিলাম, তাকে দোষ দিচ্ছিলাম। কিন্তু সে অজুহাত দিতে লাগলো যে, সে খুব ক্লান্ত। তাই তার মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না।

তিনি জানালেন, আমরা তখনো পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম বলেই জানতেন তিনি। আমাদের ধৈর্য বাঁধ মানছিল না। অধৈর্যভাবে পায়চারি করার পর ঝুলিটা কাঁধে নিয়ে বাকি বন্দিদের সাথে শেষ ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। মনে হচ্ছিল এই অপেক্ষার প্রহর কখনো শেষ হবে না। শেষমেশ আশা-হতাশার দোলাচলে ক্লান্ত হয়ে গার্ডদের খালি রুমের পাতা বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। জামা-জুতো পড়েই শুয়েছিলাম। কারণ গাড়ী এলে যেন সাথে সাথে উঠে পড়তে পারি। সেই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বলতেও পারবো না।

রাইফেল আর কামানের শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। গভীর রাত তখন। বন্দুকের গুলি এসে ঢুকছিল আমাদের ঘরে। প্রধান ডাক্তার প্রায় দৌড়ে এসে আমাদের ঘরে ঢুকলেন।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মেঝেতে শুয়ে থাকার জন্য। জুতো পরা অবস্থায় এক বন্দি ওপরের বিছানা থেকে আমার পেটের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙার পর অনেকক্ষণ বুঝতে পারিনি, কী হচ্ছে। আস্তে আস্তে ঘুমের রেশ কেটে গেল। বুঝতে পারলাম, মৈত্রীবাহিনী আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। সারারাত এভাবে গোলাগুলি চললো। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে পড়ে রইলাম আমরা। গোলাগুলি কমে গেল ভোর হওয়ার সাথে সাথে।

ক্যাম্পের বাইরে তখন একটি সাদা পতাকা সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে পতপত করে উড়ছে।

অনেক সপ্তাহ পর জানতে পেরেছিলাম যে, শেষ মুহূর্তেও ভাগ্য বন্দিদের সাথে খেলছিল। সে মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, জীবন- মরণের প্রশ্নে মানুষের কোনো সিদ্ধান্তই কাজে আসে না। বড় অনিশ্চিত এই জীবন!

আমাদের ক্যাম্পের কাছেরই আরেকটা ছোট ক্যাম্পের কিছু ছবি হাতে পেয়েছিলাম আমি। আমাদের যে বন্ধুরা সেদিন রাতের ট্রাকে নিশ্চিন্ত মনে চলে গিয়েছিল, ভেবেছিল, তারা মুক্তি পাবে। যাদের ভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করেছিলাম, সেই রাতে ওরা যে ছোট ঘরে ছিল, সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। অনেকেই পুড়ে মারা গেছে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া কিছু লাশের ছবি দেখে আমি কয়েকজনকে চিনতে পেরেছিলাম। আমার আবার ‘ডেথ অব তেহরান’ গল্পটার কথা মনে পড়েছিল তখন।

সারাক্ষণ জীবন বাঁচানোর চিন্তা ছাড়াও নানান কারণে কয়েদিদের সব কিছুর প্রতি এক ধরনের অনীহা চলে আসতো। ক্ষুধা এবং ঘুমের ঘাটতি ছিল এর অন্যতম কারণ। সবারই মেজাজ কেমন খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। ইঁদুর এবং পোকা-মাকড়ের উৎপাতের কারণে ঘুমের আরও সমস্যা হতো। ঘরদোর ভীষণ অপরিষ্কার থাকতো। স্বাস্থ্যবিধির বালাইও ছিল না বলতে গেলে। ফলে ইঁদুর, পোকামাকড় ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া নিকোটিন কিংবা ক্যাফেইন না পাওয়ার কারণে এই খিটখিটে ভাব কাটতোই না। এইসব শারীরিক উপসর্গ ছাড়াও নানা ধরনের মানসিক উপসর্গ ছিল। বেশিরভাগ কয়েদিই এক ধরনের কমপ্লেক্সে ভুগতো। একটা সময় নিজেদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব ছিল অর্থাৎ ‘আমিত্ব’ বিষয়টি ছিল। কিন্তু বন্দি হবার পর মনে হতো আমার কোনো সত্তা নেই। আমি কেউ নই। যা ছিল মানসিক পীড়ার একটি প্রধান কারণ ফলে সবাই এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগতো। (আসলে মানুষের মূল্যবোধ সব অবস্থায় থাকে। সেটাকে কখনো বাদ দেয়া যায় না। কিন্তু বন্দি হবার পর এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, সেই মূল্যবোধ, আমিত্বটুকুও বিসর্জন দিতে হয়েছিল।)

একটা ক্যাম্পের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিচার করলেই বৈষম্যের কারণ পাওয়া যাবে। ‘বিশেষ বন্দিরা’ যেমন- কাপোরা, রাঁধুনীরা, দোকানদার কিংবা ক্যাম্পের গার্ডরা মোটেও নিজেদের নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগত না। বরং নিজেদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করত! কেউ কেউ আবার আভিজাত্যের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করত। তাদের এই ক্ষমতা, প্ৰতিপত্তি দেখে অনেকেই ঈর্ষা করতো। অনেকে বলতে বেশির ভাগ বন্দিই ঈর্ষা করতো। এই মনোভাব তাদের কথাবার্তা, আচরণে, রসিকতায় টের পাওয়া যেত। যেমন একদিনের ঘটনা বলি। একবার এক বন্দিকে এক কাপো ব্যাপারে ঠাট্টা করে কথা বলতে শুনেছিলাম।

সে বলছিল, “চিন্তা করা যায়, আমি জানতাম, এই লোকটা এক বড় ব্যাংকের সভাপতি ছিলেন মাত্র। আর এখন, তার কত উন্নতি হয়েছে দেখো। ভাগ্যে না থাকলে কি এত সহজে এত উন্নতি করা যায়?’

প্রায় সব সময়ই এই নির্যাতিত সংখ্যাগুরু আর সুবিধা পাওয়া সংখ্যালঘুর মধ্যে বিভিন্ন খিটিমিটি লেগেই থাকতো। তবে সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের তেমন কিছু করার ছিল না। কারণ সংখ্যালঘুর হাতেই ছিল বিভিন্ন ক্ষমতা। খাবার দেয়া থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুতেই। তাই প্রায়ই দুপক্ষের মধ্যে লেগে যেত। সাধারণ বিষয় নিয়েও এই অবদমিত ক্ষোভ, উৎকণ্ঠার কারণে বড় ধরনের ঝগড়া লাগতো। যেহেতু বন্দিরা সব সময় মারামারি, সহিংসতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই তাদের মধ্যে সহিংস মনোভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

অন্যের কথা বলে লাভ নেই। আমি নিজেও ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় উনিশ থেকে বিশ হলে খেয়াল করতাম রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্লান্তির কারণ ছিল। টাইফাস রোগীদের ঘরে সারারাত চুলা জ্বালিয়ে রাখতে হত আর তাদের দেখভাল করতে হত। তবে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটতো মাঝরাতে, যখন রোগীরা প্রলাপ বকত বা ঘুমিয়ে থাকত। শীতের রাতে চুলার পাশে শুয়ে আগুন পোহাতে পারতাম। চুরি করা কয়লায় কুড়িয়ে পাওয়া আলু পুড়িয়ে খেতাম। তবে রাত্রি জাগরণের কারণে পরের দিনই আমার আরো বেশি ক্লান্ত লাগতো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকত।

যখন আমি টাইফাস রোগীদের দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলাম, তখন যেসব সিনিয়র অসুস্থ ছিল, তাদের ওয়ার্ডেও আমাকে ডিউটি দিয়ে রাখা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ আমাকে ঘরদোর পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়েছিল। যদি তেমন পরিবেশকে ‘পরিষ্কার’ বলে ধরা যায়। পরিদর্শন করার নামে মানসিক যন্ত্রণা দেয়া ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা চাইলে খাবারের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়ে, কিছু ঔষধপত্র সাহায্য করতে পারতো। কিন্তু না, তারা সেটা করতো না। পরিদর্শকের লক্ষ্যই ছিল সরু বারান্দায় একটুকরো খড় পড়ে আছে কিনা, রোগীদের পায়ের নিচে ময়লা, ছেঁড়া, পোকায় কাটা চাদর ঠিকমতো গোটানো ছিল না কি, সেটা দেখা। অসুস্থ, ভুগতে থাকা বন্দিদের কি হবে সেই বিষয়ের কোনো গুরুত্বই ছিল না তার কাছে।

আমি সুন্দর ভাবে ছাটা চুলের উপর থেকে টুপিটা খুলে, পা ঠুকে রিপোর্ট করতাম। বলতাম, ‘ঘর নাম্বার ৬/৯। ৫২জন রোগী, দু’জন নার্স, একজন ডাক্তার।’

এতেই তারা খুশি হতেন এবং তা শুনে চলে যেতেন। কিন্তু যতক্ষণ না তারা আসতেন সবকিছু গুছগাছ করতে অস্থির হতে হতো।

মাঝে মাঝে যখন আসার কথা, তার অনেক পর আসতো। আবার এমনও হয়েছে, আসার কথা বলেও আসেনি। তারপরও তারা আসার খবর পেলেই রোগীদের বিছানার চাদর সোজা করা, পড়ে থাকা খড় সরিয়ে ফেলা এবং যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা রোগীদের চুপ থাকার জন্য চিৎকার করতে হতো।

সব সময় একটা ভয় থাকতো মনে, তাদের কারণে না আবার কোনো সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু রোগীদের তাতে কিচ্ছু আসতো যেতো না। এক ধরনের উদাসীনতা তাদের গ্রাস করে রাখতো। তাই আমি যতই চিৎকার, চেঁচামিচি করি না কেন, তারা এতে ভ্রুক্ষেপও করতো না।

অনেক সময় যেন চিৎকার করলেও শুনতো পেতো না। রাগে আমার শরীর রি রি করতো। ইচ্ছে হতো তাদের শরীরে কয়েক ঘা বসিয়ে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখতাম। তাদের এ অবস্থা বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আমার ভয় এবং বিরক্তি দুটোই বেড়ে যেত মাঝে মাঝে।

সাধারণ ক্যাম্পের একজন বন্দির মানসিক অবস্থার সম্পর্কে বলতে গেলে, বলতে হবে, মানুষ তার পরিবেশ দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত হয়। (এক্ষেত্রে ক্যাম্পের বিশেষ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হতো প্রতিটি বন্দি)। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? প্রতিকূল পরিবেশ কি তার আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার পক্ষেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়? তাহলে সেই তত্ত্ব কি সত্য বলে বিবেচনা করা যাবে, যা কিনা বলে যে, মানুষ কিছু শর্ত আর পরিবেশের উপাদান উপাদান ছাড়া কিছুই না? তারা সামাজিক, জীবতাত্ত্বিক বা যে প্রকৃতির হোক না কেন? আসলেই কি মানুষে এই দুর্ঘটনার ফলাফল?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কোনো বন্দি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প শব্দটি শুনে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা কি প্রমাণ করে দেয় না যে, মানুষ তার পরিবেশের প্রভাব কাটাতে পারে না? এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কি মানুষের কিছুই করার থাকে না?

অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নীতি অনুসারে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া যেতে পারে। ক্যাম্পের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, মানুষের ইচ্ছাশক্তিরও মূল্য আছে। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, যা সাহসিকতার পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয়, ইচ্ছাশক্তির জোরে, অনীহাকে কাটিয়ে তোলা সম্ভব, সম্ভব বিরক্তিকে দমন করা। মানুষ চাইলে মানসিক ও শারীরিক পীড়ন সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, পারে মানসিক স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে। আমরা যারা ক্যাম্পে ছিলাম, সবারই মনে আছে সেই লোকগুলোর কথা, যারা এক ছাউনি থেকে অন্য ছাউনিতে গিয়ে বন্দিদের আশ্বস্ত করতো, সাহস জোগাতো। এমনকি নিজেদের ভাগের রুটির শেষ টুকরোটুকুও তুলে দিতো অন্যের হাতে। তাদের সংখ্যা হয়েতো বেশি ছিল না কিন্তু তারা এতটুকু প্রমাণ করেছিল যে, মানুষের কাছ থেকে সব কেড়ে নেয়া গেলেও একটা জিনিস কেড়ে নেয়া যায় না। তা হলো মানুষের ইচ্ছেশক্তির স্বাধীনতা। যেকোনো পরিস্থিতে, যেকোনো অবস্থায় মানুষ নিজের আচরণ, নিজের পথ বেছে নিতে পারে, এই স্বাধীনতা মানুষের আছে।

প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো কিছু বেছে নিতে হত বন্দি জীবনে। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মুহূর্তে বেছে নিতে হতো একটা পথ। সিদ্ধান্ত নিতে হতো, সে তার নিজস্ব স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেবে, নাকি তার স্বত্তাকে ধরে রাখবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, একজন বন্দির মানসিক প্রতিক্রিয়া শুধু সামাজিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। অনেকে ধারণা করতে পারেন যে, ঘুমের অভাব, খাবারের অভাব এবং নানা ধরনের মানসিক পীড়ন— এ সবকিছুর প্রভাবে বন্দিরা একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে বলা যায় একজন বন্দির মাঝে কি ধরনের পরিবর্তন আসবে তা তার নিজের উপর নির্ভর করে। ক্যাম্পের পরিবেশে ওপর তা নির্ভরশীল নয়। তাই, একজন মানুষ যেকোনো পরিস্থিতির মুখে তার মানসিক বা আধ্যাত্মিক ভাবে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা তিনিই নির্ধারণ করতে পারেন। সে চাইলে তার সম্মান, তার আত্মমর্যাদা ক্যাম্পেও রক্ষা করতে পারবে।

দস্তয়োভস্কি একবার বলেছিলেন যে, ‘আমি একটা জিনিসই ভয় পাই, যন্ত্রণা হয়তো আমি সহ্য করতে পারব না।’

এ কথাটাই আমার বারবার মনে পড়ছিল, যখন আমি সেই বন্দিদেরকে দেখেছিলাম। যারা প্রমাণ করে দিয়েছিল, মৃত্যুর ভয়ও মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারে না। তারা এত নির্যাতন সহ্য করেও যে অবিচল ছিল, তা তাদের মানসিক শক্তির কারণেই। এটাই আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা- যা কখনো কেড়ে নেয়া যায় না, জীবনকে যা অর্থবহ করে তোলে, উদ্দেশ্যমূলক করে তোলে।

একটি সত্যিকারের জীবন মানুষকে উৎসাহ দেয় নানান সৃজনশীল কাজে, যেখানে এক নিষ্ক্রিয় জীবন তার পরিবর্তে সৌন্দর্য, শিল্প আর প্রকৃতিতে নিজের পূর্ণতা খুঁজে নেয়। আবার এমন অনেক আছে যাদের জীবনে সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা বা প্রকৃতির কোনো জায়গা নেই। কেবল একটা জিনিস তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তীব্র নৈতিকতাবোধ।

একটা সৃজনশীল এবং আনন্দময় জীবন তার জন্য নিষিদ্ধ। এটাও সত্যি যে, শুধু সৃজনশীলতা এবং আনন্দ অর্থপূর্ণ নয়। যদি জীবনের সত্যিই কোনো অর্থ থাকে, তাহলে যন্ত্রণার মাঝেও অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। যন্ত্রণা ভোগ করা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ- ভাগ্য এবং মৃত্যুর মতই। যন্ত্ৰণা এবং মৃত্যু ছাড়া মানব জীবন সম্পূর্ণ হতে পারে না।

একজন মানুষ যেভাবে তার ভাগ্যকে মেনে নেয়, এজন্য যে যন্ত্রণা তাকে পোহাতে হয়, সেটা তাঁর মূল্যবোধকে তুলে ধরে, তার জীবনে গভীর তাৎপর্য যোগ করতে সাহায্য করে। সেটা যতই জটিল অবস্থা হোক না কেন। অথবা নিজেকে রক্ষার কঠিন লড়াইয়ে সে তার আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে একটি পশুর মত হয়ে যেতে পারে। জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে একজন যে নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে, তা সে গ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে – সেটা তার একান্ত সিদ্ধান্ত।

তার মানে এই নয় যে, এ চিন্তাগুলো অপার্থিব, যা বাস্তব জীবনের ঊর্ধ্বে। এটা স্বীকার করতে হবে খুব কম মানুষই এমন উচ্চ নৈতিকতাবোধ অর্জন করতে পারে। বন্দিদের মাঝে অল্পকয়েকজনই তাদের আত্মিক ও মানসিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল। যন্ত্রণার মধ্য দিয়েও নিজের উন্নতিসাধন তারা করেছিল। এতেই প্রমাণিত হয়, মানসিক শক্তি দিয়ে একজন তার ভাগ্যকে পাল্টে দিতে পারে। শুধু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নয়, এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে যে-কেউ, যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়। ভাগ্য মানুষের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় সব জায়গায়, নিজেদের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভের সুযোগ তৈরী করে দেয়।

রোগীদের ভাগ্যের কথাই ধরা যাক- যাদের আরোগ্য লাভ করা সম্ভব ছিল না।

একবার আমি এক পঙ্গু যুবকের চিঠিতে পড়েছিলাম।

সে তার বন্ধুকে লিখেছিল, সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। অপারেশন করেও কোনো লাভ নেই।

সে আরো লিখেছিল, অনেক আগে সে একটি চলচ্চিত্র দেখেছিল, যেখানে একজন মানুষ মৃত্যু জন্য নিজের সম্মান বজায় রেখে, সাহসের সাথে অপেক্ষা করছিল। এই সিনেমা দেখার পর তার মনে হয়েছিল, সেও এভাবে মাথা উঁচু করে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে। বীরযোদ্ধার মত মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া অনেক বড় একটি অর্জন।

পরবর্তী সময়ে সে আবার লিখেছে, ভাগ্য তাকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *