কষ্টভোগ করা বলতে কী বোঝায়
ভুলে গেলে চলবে না, জীবনের সব আশা যখন একে একে নিভে যেতে থাকে, আমরা তখনই জীবনের মানে খুঁজি। আমরা তখনই জীবনের অর্থ জানতে চাই, যখন ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা, কোনো মতেই যখন দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়ে না। তখন আমাদের কী করতে হবে? তখন আমাদের দেখতে হবে, মানুষ একক চেষ্টায়, পরিশ্রমে কীভাবে নিজের দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যে পরিণত করে। কীভাবে একজন মানুষ সমগ্ৰ মানবজাতির গৌরব হয়ে ওঠে। তারপরও এমন কখনো কখনো আসে, যখন আমরা আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি না। যেমন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার। তবু আমাদের সব কিছু বদলে দেবার চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।
আপনাদের একটি উদাহরণ দিচ্ছি। তাহলে ব্যাপারটি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। একবার এক বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তার আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি তখন প্রচণ্ড হতাশায় মুষড়ে পড়েছেন। এই হতাশা, বিষণ্ণতা থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, জানার জন্যেই আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তার সাথে কথা বললাম। তার স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় দুই বছর আগে। তিনি এখনও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার মনে স্ত্রীর অবস্থান ছিল সবচেয়ে উপরে। স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এখন তাহলে আমি তাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? কী বলতে পারি তাকে, যা শুনলে তার কষ্ট, হতাশা কমবে? আচ্ছা, বেশ। আমি তাকে তেমন কিছুই বলিনি। শুধু দুয়েকটি প্রশ্ন করেছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার সাহেব, ধরুন, স্ত্রীর বদলে যদি আপনি প্রথমে মারা যেতেন, তাহলে আপনার স্ত্রী কি এই শোক বহন করতে পারতো?”
বৃদ্ধ ডাক্তার যেন আমার কথায় আৎকে উঠলেন। বললেন, “না, না। এটা তার জন্য খুবই ভয়ঙ্কর হতো। খোদা জানে, তিনি কীভাবে এই কষ্ট সহ্য করতেন। ‘
আমি তখন সাথে সাথেই বললাম, ‘তাহলে বুঝুন, তাকে এখন সে কষ্ট পেতে হচ্ছে না। এবং সেটা আপনারই জন্য। আপনি তাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এজন্য তো আপনাকে কিছু মূল্য দিতেই হবে। সেই মূল্যটা হলো, আপনি বেঁচে থাকবেন এবং তার জন্য শোক করবেন।
তিনি আর কিছু বলেন না। বলা ভালো বলতে পারলেন না। শুধু শক্ত করে আমার হাতটি কিছুক্ষণ ধরে রাখলেন। তারপর নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে হেঁটে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কখনো কখনো যন্ত্রণা নিজেই শান্তির কারণ হয়, যখন তার কোনো অর্থ থাকে। যেমন আত্মত্যাগ করা।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এটি যথাযথ চিকিৎসা ছিল না। কারণ, প্রথমত, তার হতাশা কোনো রোগ ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমি তার ভাগ্য বদলে দিতে পারিনি। তার স্ত্রীকে আমি তার হাতে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তবে আমি একটা কাজে সফল হয়েছিলাম। আমি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পেরেছিলাম। তার ভাগ্যের বদল না হলেও তার যন্ত্রণা ভোগের একটি অর্থ পেয়েছিলেন। যেটা ছিল তার বড় সান্ত্বনা। এটি লোগোথেরাপির একটি মৌলিক ভিত্তি। আনন্দ পাওয়া বা কষ্ট এড়ানো মানুষের লক্ষ্য নয়, মানুষের কাছে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়াটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তাই মানুষ যদি বুঝতে পারে তার কষ্টভোগেরও কোনো কারণ আছে, তখন সে যত খুশি যন্ত্রণা ভোগ করতে রাজি থাকে।
তবে আমি একটি কথা পরিষ্কার করে বলছি, জীবনের মানে বোঝার জন্য যন্ত্রণা পোহাতে হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। আমি শুধু জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি যে, কষ্ট পাওয়ারও কারণ থাকতে পারে। কখনো কখনো কষ্ট ভোগ করা অপরিহার্য হয়ে যায়। তবে সাইকোলোজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল বা পলিটিক্যাল অর্থাৎ রাজনৈতিক কারণে কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ অনেক সময় এড়ানো যায়। মনে রাখতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কষ্ট ভোগ করার মাঝে কোনো বীরত্ব নেই।
এডিথ উইসকো জোয়েলসন মৃত্যুর আগে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান
মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। তিনি লোগোথেরাপির উপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এই দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষকে সুখী হতে হবে। অসুখী থাকা অসুস্থতার লক্ষণ। অসুখী হবার অসুখ হওয়ার চেয়ে অনিবার্য অসুখ হবার ভার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ এই মূল্যবোধ।
আরেকটি প্রবন্ধে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, লোগোথেরাপি ‘বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির মধ্যে যে অসুস্থ প্রবণতা, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। সেখানে অযোগ্য কষ্টবহনকারী ব্যক্তিকে কষ্ট নিয়ে গর্ববোধ করার জন্য খুব কমই সুযোগ দেয়া হয়। তাকে অবজ্ঞা করা হয়।’ ফলে, ‘সে শুধু অসুখীই হয় না, বরং অসুখী হবার জন্য লজ্জিতও হয়।’
এমন পরিস্থিতি হয় যেখানে একজন ব্যক্তিকে তার কাজ করার সুযোগ থেকে, জীবনকে উপভোগ করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তবে অনিবার্য কষ্টকে কখনো দমিয়ে রাখা যায় না। সাহসিকতার সাথে কষ্টভোগ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে, বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে থাকে। এবং আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, জীবন কোনো শর্ত মানে না। ফলে অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রণাভোগ করাও জীবনের মানের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কথা আবার বলছি। ক্যাম্পে ২৮ জনে একজন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল। চাইলে এ পরিসংখ্যানটি যে কেউ খুব সহজেই যাচাই করে নিতে পারবে। আমাকে যখন অশউইজ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমার কোটের পকেটে আমার প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি ছিল। সে পাণ্ডুলিপি যখন কেড়ে নেয়া হয়, তখন আর কোনো সম্ভাবনাই ছিল না এটি উদ্ধারের। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সব কিছু নতুন করে শুরু করা আমার জন্য সত্যিই কষ্টের ছিল। এখন মাঝেমধ্যে ভেবে দেখি, তখন কি জীবনটাকে নিজের কাছে পুরোপুরি অর্থহীন মনে হতো না? নিজেই নিজেকে তখন এমন হাজার প্রশ্ন করতাম। জীবনকে তখন সত্যিই পুরো অর্থহীন মনে হতো।
অথচ একটি জিনিস খেয়াল করিনি, যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমি দিনরাত মাথা খুটে মরছি, সে প্রশ্নের ইতোমধ্যেই তৈরি ছিল। শুধু তাই নয়, যথাসময়েই তা পেয়েছিলাম। ঘটনাটি বলি। ক্যাম্পে আসার পরই আমার পোশাক খুলে নেয়া হয়েছিল। তখন আমাকে আমারই এক সহবন্দির পুরানো পোশাক পড়তে দেয়া হয়। রেলস্টেশন থেকে অশউইজ ক্যাম্পে আসার পর পরই আমার এ সহবন্দিকে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। যাইহোক, আমার পাণ্ডুলিপিও তখন নিয়ে নেয়া হয়েছিল। অনেকগুলো পৃষ্ঠা ছিল পাণ্ডুলিপিতে। এই পাণ্ডুলিপির বিনিময়ে তখন পরা কোটের পকেটে একটি পৃষ্ঠা পেয়েছিলাম। হিব্রু ভাষায় লেখা একটি প্রার্থনার বইয়ের ছেঁড়া পৃষ্ঠা ছিল সেটি। সেখানে শামা ইসরাইয়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা লেখা ছিল। ইহুদিরা বেশ ভক্তিসহকারে এই প্রার্থনাটি পাঠ করতো। আমি জানি না, এই কাকতালীয় ব্যাপারটি কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? কারণ, কাগজে লেখা এই প্রার্থনাটি আমার চিন্তার গতি বদলে দিয়েছিল। বাঁচার প্রেরণা যুগিয়েছিল।
পরবর্তী সময় আমার মনে হতো আমি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মারা যাবো। ওই সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থাতেও অন্যান্য বন্দিদের চেয়ে আমার চিন্তাভাবনা আলাদা ছিল।
তাদের মনে যে প্রশ্নটি জাগতো, সেটি হলো, ‘আমরা এই ক্যাম্পে শেষপর্যন্ত কি বেঁচে থাকতে পারবো? যদি নাই পারি, তাহলে এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করার কোনো মানে হয় না।’
অপরদিকে আমার মনে যে চিন্তাটি সারাক্ষণই ঘুরপাক খেতো, তা হলো, ‘এই যে এত কষ্ট, এত মৃত্যু, অর্থ কী? যদি এর কোনো অৰ্থ না-ই থাকে, তাহলে বেঁচে থাকারও কোনো মানে হয় না। জীবন, যার অর্থ নির্ভর করে কোনো ঘটনার উপর। কেউ পালিয়ে যাবে, না যাবে না, চূড়ান্ত ভাবে বেঁচে থাকার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।’